#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৪
ফারিহা জান্নাত
সূর্যের আলো মুখের উপর পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো পৃথিশার। অপরিচিত জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো তার। গায়ের উপর পাতলা কাঁথা দেওয়া। কাঁথা সরিয়ে ওড়না ঠিক করে উঠে বসলো সে। পুরো বিছানায় সে একা। সোফায় চোখ যেতেই দেখলো মারুফ সেখানে বসে ঘুমাচ্ছে দেয়ালে মাথা রেখে। কাল রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করলো পৃথিশা। খাওয়ার পর ঔষুধ খেতেই ঘুম পেয়ে যায় তার। ঘুমের তীব্রতা এতই বেশি ছিলো যে সে কিভাবে বেডরুমে এসেছে তা মনে করতে পারলো না। বিছানা থেকে নামতেই পা’টা ভারী ঠেকলো। তাকাতেই দেখতে পেলো সুন্দর ঝকমকে নূপুর। কিন্তু তার পায়ে তো নূপুর ছিলো না, তবে মারুফ দিয়েছে বোধহয়। নূপুরের শব্দ পৃথিশার খুব পছন্দ। পা নাড়িয়ে বারকয়েক শব্দ করতেই মারুফের ঘুম ভেঙে গেলো শব্দে।
এতক্ষণ সোফায় থাকায় ঘাড় ব্যাথা করছে। পৃথিশা মারুফকে দেখে উঠে দা্ড়ালো। আস্তে করে বলল,
– সরি,আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম।
– ব্যাপার না, দশটা বাজতে চলল।এমনিতেও উঠতে হতো। ডিউটি আছে আজ।
মারুফ খেয়াল করলো পৃথিশা কিছু বলতে চাচ্ছে। নিজ থেকেই জিজ্ঞেস করলো,
– কিছু বলবে পৃথিশা?
– আপনি দিয়েছেন?
পায়ের নূপুরজোড়া দেখিয়ে বলল পৃথিশা। মারুফ পৃথিশার দিকে এগোলে পৃথিশা পেছিয়ে যায়। মারুফ হেসে আরেকটু এগিয়ে পৃথিশার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে থাকে। পৃথিশা অবাক হলো মারুফের কান্ডে। আবারও জিজ্ঞেস করলো,
– কি হলো বললেন না?
পৃথিশা নিজে থেকেই মারুফের কাছ থেকে সরে গেলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে যেন। মারুফ হেসে বলল,
– মায়ের নূপুর এগুলো। তিনি পেয়েছিলেন দাদির কাছ থেকে বড় বউ হিসেবে। মা বেঁচে থাকলে হয়তোবা তিনিই দিতেন। তিনি যেহেতু নেই তাই আমি দিলাম। তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে তো তাই দেখতে পাও নি কখন দিয়েছি।
পৃথিশা কিছু বলল না আর। মারুফ ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে গেলে বিছানা গুছিয়ে রাখলো সে। এ বাসার কিছুই তেমন চিনে না সে। রুমের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পেলো একপাশে বেলকনি। জলদি পা চালিয়ে বেলকনিতে গেলো সে। অনেক গাছ সেখানে। মনটা নিমিষেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো পৃথিশার।
– গাছ খুব পছন্দ বুঝি?
চমকে উঠলো পৃথিশা। তার থেকে একহাত দুরত্বে মারুফ দাঁড়িয়ে। পৃথিশা আবারও গাছে ব্যস্ত হয়ে ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল,
– খুব পছন্দ। জানেন,আমার বুবুও গাছ খুব পছন্দ করতো।
পৃথিশা হুট করে চুপ হয়ে গেলো। মারুফ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলে উঠলো,
– আচ্ছা, আমাকে এখন বাসায় যেতে হবে।পরীক্ষা আছে কোচিংয়ে।
মারুফ ইশারায় সম্মতি দিতেই পৃথিশা বেরিয়ে গেলো জলদি। অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো সে। যদিও পড়া হয় নি কিছুই। কিন্তু যা আছে কপালে দেখা যাবে। গ্যারেজে আসতেই দেখলো মারুফ গাড়ি বের করছে।পৃথিশাকে দেখে জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলল,
– জলদি আসো, লেট হয়ে যাচ্ছে।
পৃথিশা কোন বাক্য ব্যয় না করে সামনের সিটেই বসে পড়লো। বইটা খুলে তাতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করলো। হুট করে গাড়ি থামলে পৃথিশা ভাবলো বোধহয় তারা এসে পড়েছে। কিন্তু অপরিচিত জায়গা দেখে অবাক হলো। মারুফকের সিটে তাকালে দেখলো সে সিটবেল্ট খুলে বাহিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
– তুমি বসো আমি আসছি, একটু সময় লাগবে।
পৃথিশা আবারও পড়ায় মন দিলো। খুব তাড়াতাড়িই মারুফ ফিরে এলো।হাতে প্যাকেট। পৃথিশার দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
– পরে পড়বে, আগে খেয়ে নাও।
– আমি খাবো না এখন।
– পৃথিশা,
মারুফের গম্ণীর কন্ঠস্বর। পৃথিশা চুপচাপ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করলো, ভেতরে চিকেন রোল। পৃথিশা নিজে খেতে খেতে কি মনে করে মারুফের দিকে এগিয়ে দিতেই মারুফ ড্রাইভ করার মাঝেই খেয়ে নিলো।
পৃথিশাকে কোচিংয়ে নামিয়ে দিয়ে মারুফ চলে গেলো, সাথে বলে গেলো সে এসে নিয়ে যাবে।
পরীক্ষা শেষ করে পৃথিশা বাহিরে আসতেই দেখলো রাহনুমা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই তিনি দৌড়ে আসলেন এদিকে। পৃথিশাও কালবিলম্ব না করে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রাহনুমা বেগমের দিকে তাকাতেই তিনি হেসে বলল,
– আরে পাগলি মেয়ে,কাঁদছিস কেন?
– কাঁদি না তো।
পৃথিশা চোখ মুছলো। পেছন থেকে ‘পৃথিশা’ ডাক ভেসে আসলে দুজনেই সেদিকে ফিরলো। মারুফ দাঁড়িয়ে আছে। আপ্রোণ পড়া, চোখে সানগ্লাস। গাড়ির সাথে দাঁড়িয়ে হাত উচিয়ে পৃথিশাকে ডাকছে। রেহনুমা বেগম মারুফকে চিনতে পারলেন না। অবাক হয়ে পৃথিশাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ছেলেটা তোকে ডাকছে কেন? তাকে চিনিস তুই?
পৃথিশা থমকালো খানিকটা।কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। মারুফ এখনো জানে না তার জন্যই পৃথিশা বাড়ি ছেড়ে এসেছে। এখন খালাকে কিছু বলতেও সে চাচ্ছে না। অবশেষে বাধ্য হয়ে বলল,
– খালা, আমি তোমাকে ফোনে বিস্তারিত জানাবো। এখন আমাকে যেতে হবে। তুমি কিভাবে এসেছো? গাড়ি নিয়ে?
রেহনুমা বেগমের দৃষ্টি অন্যরকম। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না পৃথিশা কি করছে এই ছেলের সাথে। তিনি পৃথিশার কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললেন,
– পৃথিশা,আমাকে সত্যি করে বল এই ছেলে কে?
ততক্ষণে মারুফ এগিয়ে এসেছে। পৃথিশাকে অন্য একজের সাথে দেখে কিছুক্ষণ ইতস্তত করলেও পরে এগিয়ে গেলো। রেহনুমা এবার মারুফের দিকে তাকালেন। তাকেই জিজ্ঞেস করলেন,
– তুমি কে?
মারুফ পৃথিশার দিকে তাকালো। পৃথিশাও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কিছুসময় দৃষ্টি বিনিময়ে কাটার পর পৃথিশা নিজ থেকেই বলল,
– খালা, আমার হাজব্যান্ড, মারুফ আহমেদ।
রেহনুমা ভয়ংকর রকমের চমকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিশার থেকে দুই পা পিছিয়ে গেল তিনি। পৃথিশা তাকে বুঝানোর স্বরে বলল,
– খালা, আমার কথাটা শুনো..
– তারমানে রায়ান ঠিক ছিলো? তাইনা?
– না খালা, আমি বলছি তোমাকে সবটা।
– থাক, তোর আর কিছু লাগবে না। আমি বুঝেছি সবটা। আসলে মানুষ ঠিকই বলে পরকে এতটা মাথায় তুলতে নেই। তোকে আমি এখানে এনেছিলাম পড়াশোনার জন্য, নিজে যাতে কিছু হতে পারিস এজন্য। কিন্তু তুই কিনা।
– খালা, আমার কথাটা শুনো প্লিজ।
পৃথিশার স্বর কান্নারত। ইতিমধ্যেই চোখ পানিতল টইটুম্বুর
– কিছু শুনবো না আমি। অসভ্য মেয়ে, তুই এরকম এটা বুঝা উচিত ছিলো আমার। নাহলে কি আর তোর বোনের সাথে এরকম কিছু হয়েছে..
– খবরদার খালা, এই ভুলটা করবে না। আমি তোমার পায়ে পরি নি আমায় এখানে আনার জন্য। তুমিই এনেছো। আমি কৃতজ্ঞ এজন্য, সবসময় থাকবো। কিন্তু ভুলেও বুবুকে নিয়ে কোন বাজে কথা উচ্চারণ করবে না তুমি।
পৃথিশার গলার স্বর উঁচু, আশেপাশের অনেকে আড়চোখে দেখছে। মারুফ এগিয়ে বলল,
– পৃথিশা, কি হয়েছে? এতো হাইপার হচ্ছো কেন? চলো আমার সাথে।
মারুফ পৃথিশাকে জোর করেই নিজের সাথে নিয়ে গাড়িতে বসালো। বাসায় না নিয়ে নিজের হাসপাতালেই নিয়ে গেলো। পুরোটা সময় পৃথিশা চুপ থাকলো। মারুফ জলদি তাকে নিজের কেবিনে নিয়ে বসালো। পানি এগিয়ে দিলে পৃথিশা নিলো না। মারুফ গ্লাস রেখে পৃথিশার পাশে বসলো। কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করলো,
– কি হয়েছে পৃথিশা? আমাকে বলো?
মূহুর্তেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলো পৃথিশা। চমকে গেলো মারুফ। মেয়েটার কান্নায় কেমন দমবন্ধ লাগছে। পৃথিশাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলে কান্না যেন আরও বাড়লো পৃথিশার। অস্পষ্ট স্বরে শুধালো,
– আমি কি করেছি? আমাকে এমন বলে কেন?
মারুফ কোন কথা বললো না। চুপচাপ পৃথিশাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখলো। তাকে সামলে উঠার সময় দিলো। মাথায় শক্ত হাতটা রেখে বুঝিয়ে দিলো, আমি আছি তোমারই পাশে।
চলবে,