সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-২৩

0
89

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২৩
ফারিহা জান্নাত

– আমি দুঃখিত,কিন্তু এভাবে বিয়ো করা আমার জন্য সম্ভব নয়। প্রয়োজনে আমি ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যাব কিন্তু একজন অপরিচিত মানুষকে হুট করে না জেনে বিয়ে করতে পারবো না।

পৃথিশার কথায় ঘরের সব মানুষ যেন তেঁতে উঠলো। মারুফ কিছু বলছে না, সে সোফার এক কোণে বসে আছে।

– বিয়ে করবে না মানে, এই এলাকায় এসব আমরা সহ্য করবো না। হয় বিয়ে করবে নাহলে জেলে যাবে।

জেল শব্দটা মস্তিষ্কে ধাক্কা খেলো বারকয়েক। পৃথিশার একে একে মনে পড়ে গেলো সেইসব দুর্বিষহ স্মৃতিগুলো। সেই সন্ধ্যায় মণিদীপাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা, কাঁটা-ছেড়া নগ্ন দেহটা, রাশেদুল চৌধুরীর হার্ট অ্যাটাক, জেলে যাওয়া তারপর দিনই বাবার নিথর দেহ দেখা। মস্তিষ্ক যেন এত ধাক্কা নিতে পারছে না। সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মস্তিষ্ক নিতে অপারগ। তাই হয়তো প্রথমবারের মতো প্যানিক অ্যাটাক আসলো পৃথিশার। এদিকে লোকজন ক্রমাগত চিৎকার চেঁচামেচি করা শুরু করেছে। পৃথিশার কানে যেন কোন কথা ঢুকছে না। তার হাত-পা ক্রমাগত কাঁপছে, চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সে বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। মারুফ এগিয়ে এলো পৃথিশাকে দেখে। তার অবস্হা অন্যরকন দেখে এগিয়ে এসে হাত ধরে সন্দিহান স্বরে ডাকলো,

– পৃথিশা?

পৃথিশা জবাব দিলো না। মারুফের হাত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। পৃথিশার অবস্হা বেগতিক দেখেই মারুফ বুঝতে পারলো ঘটনা কি। এবার আর মানুষের পরোয়া করলো না সে। পৃথিশাকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো। এত মানুষের মধ্যে থাকলে সমস্যা আরও বাড়বে। পৃথিশকে বিছানায় বসিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে পৃথিশা শান্ত হলো। এখনো ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে।

– আমি বিয়ে করবো।

পৃথিশার মাথা মারুফের কাঁধে। হাত মারুফের মুঠোয় ধরা। মারুফ তার কথা শুনে অবাক হলেও প্রকাশ করলো না। বরং বললো,

– তুমি চুপচাপ শুয়ে থাকো তো। কথা বলো না।

– আমি বিয়ে করবো।

– আচ্ছা করো বিয়ে, তবে এখন না। পরে করো।

– আমি এখনই বিয়ে করবো। আপনি ওদের আসতে বলুন।

– পৃথিশা,দেখো জেদ করো না। কথা শুনো।

– আমি কিছু শুনবো না, আমি বিয়ে করব মানে করবই।

পৃথিশার কন্ঠস্বর কঠোর। একসাথে এতগুলো কথা বলে আবারও হাঁপিয়ে উঠেছে। মারুফের রাগ উঠে গেলো। পৃথিশাকে নিজের থেকে সরিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো। রাগি কন্ঠে বলল,

– তুমি করো তোমার বিয়ে। আমি করছি না।

– শুনুন না, এইযে ডাক্তার।

পৃথিশার কন্ঠস্বর ক্লান্তিকর। মারুফের রাগ গলে গেলো যেন। তার কাছে আসার আগেই দরজায় অনবরত ধাক্কানোর শব্দে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলতেই একে একে মানুষ জড়ো হলো। পৃথিশা তখনও বিছানায় চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে বসে। মারুফ তাদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজেই বলল,

– বললাম আপনাদের, মেয়েটা অসুস্থ। তবুও কিছু যায় আসে না আপনাদের। নিজেদের কথা নিয়েই পড়ে আছেন।

– আপনারা ব্যবস্হা করুন,আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।

সবার কথার মাঝে পৃথিশার কথায় নজর আটকালো সবার তার দিকে। কাজি আনাই ছিলো, এখন সবাই বন্দোবস্ত করতে গেলো। রুম থেকে সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর মারুফ আসলো পৃথিশার কাছে। মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,

– বিয়ে করার এত তাড়া?

পৃথিশা জবাব দিলো না। মারুফ নিজেই আবার বলল,

– আচ্ছা, তো চলো করি বিয়ে। সুন্দরী মেয়ে নিজ থেকে বিয়ে করতে চাইলে আমি তো আর না করতে পারি না তাই না?

পৃথিশা মুখ ঘুরিয়ে হাসলো। মুখটা মারুফের কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,

– জীবনকে আরেকটা চান্স দিয়ে দেখি, যদি জিতে যাই।

– চান্স যখন দিয়েছেন আপনাকে তো জিতিয়েই ছাড়ব ম্যাডাম।

পৃথিশার মাথার ওড়নাটা ঠিক করে দিয়ে মারুফ বেড়িয়ে গেলো। মারুফের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো পৃথিশা। ট্রাস্ট ইস্যু তো তার আছেই, তবে এই মানুষটাকে কেন জানি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। বিয়ে না করে যে সে যেতে পারবে না এটা পৃথিশা আগেই বুঝেছিল। লোকটা মারুফ বলেই হয়তো নিজেই একধাপ এগুলো।

অবশেষে বিকেলের আগেই পৃথিশা-মারুফের বিয়ে হয়ে গেলো। কোন রকম আয়োজন ছাড়াই অনাড়ম্বর পরিবেশে দু’টি মন বাঁধা পড়লো আজীবনের জন্য হয়তোবা। পৃথিশার কান্না পেলো না কবুল বলার সময়, খুব সাবলীলভাবেই সে বিয়েটা করো নিলো। বিয়ে শেষে লোকজন যাওয়া শুরু করলো। শেষ পর্যন্ত রয়ে গেলো সেই মহিলা ও বাড়িওয়ালা। পৃথিশা সোফায় বসে আছে।মারুফ সেই মহিলার দিকে এগিয়ে গেলো,

– আজ স্বাভাবিক একটা ঘটনাকে আপনি যেভাবে বিকৃত করেছেন তার কোন ক্ষমা হয় না। আপনার সম্পূর্ণ মতলব বুঝতে আমার সমস্যা হয় নি খালা। তবে একটা ধন্যবাদও আপনার প্রাপ্য। আপনার জন্যই হয়তোবা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম ঘটনা আজ ঘটে গেলো।

মারুফ একটু থামলো। পরপরই আবার বাড়িওয়ালাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

– আমি আগামী মাসে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিব। বিক্রি করতে চাই, আপনি কাগজ-পত্রের ব্যবস্হা করে রাখবেন।

বাড়িওয়ালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– কেন? সমস্যা কি?

-যেখানে আমার স্ত্রী-কে অকারণে অসম্মান করা হয়েছে, সেখানে আমি থাকবো না। আপনারা এখন আসতে পারেন।

উনারা চলে যাওয়ার পর মারুফ পৃথিশার দিকে এগুলো। সে তখনো সোফায় বসে, মাথায় ওড়না দেওয়া।

– তুমি চাইলে আলাদা থাকতে পারো। আমার কোন সমস্যা নেই।

পৃথিশা মাথা তুলে মারুফের দিকে তাকালো। তার মুখভঙ্গি সহজ। কিন্তু পৃথিশার মনে হলো মারুফ হয়তোবা বিয়েটা মেনে নিতে পারে নি। পৃথিশার নিজেরও অবশ্য এখনই একসাথে থাকার ইচ্ছা ছিলো না। মাথা নাড়িয়ে, আচ্ছা বলেই সে চলে যেতে নিলেই হাতে টান পড়লো। পেছন ফিরে দেখলো মারুফ হাত ধরে রেখেছে। পৃথিশাকে নিজের কাছে টেনে বলল,

– রাগ করলে চলে যেতে বলায়?

– কি? না রাগ করি নি। কেন করবো রাগ?

রাগ না করলেও মনে মনে খানিকটা অভিমান পৃথিশার হয়েছে। সেটাই ফুটে উঠেছে তার কথায়। বিয়ের পরপরই এভাবে কেউ চলে যেতে বলে।

– আচ্ছা রাগ করো নি বলছো।

– সত্যিই করি নি।

মারুফ পৃথিশার হাত ধরে টেবিলে বসিয়ে দিলো। খাবার অর্ডার করাই ছিলো। পৃথিশার প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলল,

– আজ রাতটা থেকে যাও। তারপর যেও ইচ্ছা হলে, আমি কিছু করব না।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে