#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-২২
ফারিহা জান্নাত
পৃথিশা খাওয়া থামিয়ে হাত ধুয়ে উঠে এসেছে।দরজায় কয়েকজন প্রবীণ ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে। তাদের সাথে একজন মহিলা। পৃথিশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মারুফের দিকে তাকালে মারুফ চোখের ইশারায় তাকে ভেতরে যেতে বলে। পৃথিশাকে দেখেই মহিলাটি এগিয়ে এলেন। ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলে মারুফ থামিয়ে দিলো।পৃথিশা তখনো পরিস্হিতি বুঝে উঠতে পারছে না। মহিলাটি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
– এই মেয়েটাই তো। এরেই কোলে করে নিয়ে বাসায় ঢুকছে। আমি নিজের চোখে দেখছি।
সাথে সাথে কয়েকটি দৃষ্টি পৃথিশার দিকে পড়লো। অস্বস্তিতে জমে গেলো সে। পৃথিশার পড়নে সুতি কামিজ, ঘুমানোর ফলে জায়গায় জায়গায় কুঁচকে আছে। চুল এলোমেলো, ওড়না সামনে দিয়ে রাখা। লোকগুলোকে দেখে পৃথিশা ওড়না মাথায় দেওয়ার চেষ্টা করলো তা দেখেই একজন বলে উঠলো,
– আকাম-কুকাম কইরা মাথায় কাপড় দিয়া লাভ আছে নি? দিন-দুপুরে নষ্টামি কইরা বেড়ায়। ছি ছি।
পৃথিশা ঘটনার খানিকটা ঠাওর করতে পেরে হতভম্ব দৃষ্টিতে মারুফের দিকে তাকালো। মারুফ সাথে সাথে প্রতিবাদ করলো,
– আমি আপনাদের পুরো ঘটনা বললাম।তাও আপনারা উল্টাপাল্টা বকছেন কেন? আমি এতগুলো দিন ধরে এখানে থাকি, কোনদিন কোন খারাপ কিছু চোখে পড়েছে আপনাদের? মেয়েটা পাশের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে। একদিন হলো এসেছে।
– তোমার সাথে তার কি সম্পর্ক?
– আমি বললাম তো সে অজ্ঞান হয়ে গেছিলো..
– মাইয়ার আউলা কাপড়ই সব কইয়া দিতাছে। তুমি গল্প বানাই না বাবা। পুরুষ মাইনষের মাথা খারাপ হইতে সময় লাগে না।
মারুফকে কথা বলতে দিলো না সেই মহিলা। তিনি এই বাসায় সিঁড়ি পরিষ্কার করে। মারুফকে সরিয়ে হঠাৎ পৃথিশার হাত ধরে টান দিতেই পৃথিশা ভড়কে গেলো। মারুফ মূহুর্তের মধ্যে তাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। এ দৃশ্য দেখে মহিলাটি চিৎকার করে উঠলেন,
– বললাম না? আমি বলছিলাম না এরা কাহিনী করছে এইখানে। বিশ্বাস হইলো, নিজের চক্ষে দেখেন এখন আপনারা। আমি যখন ডাইকা আনলাম তখন তো বিশ্বাস করলেন না। এখন দেহেন।
মারুফ পৃথিশাকে নিজের পিছনে আড়ালে করে রাখলো। পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। মারুফ তাদের উদ্দেশ্যে ঠান্ডা গলায় বলল,
– আমার সাথে ওর কোন সম্পর্ক নেই এটা ক্লিয়ার করেছি আপনাদের।কিন্তু আপনারা বারবার অযথা কথা বাড়াচ্ছেন। মেয়েটা অসুস্থ ছিল তাই এনেছিলাম বাসায়।
– ওরে নিয়া বাসায় ঢুকছো সেই সকালে। অথচ এখন সকাল গড়াইয়া দুপুর হইয়া গেছে৷ এতক্ষণ লাগে সুস্থ হইতে?
মারুফকে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না কেউ। ওদের মধ্যে থাকা বাড়িওয়ালা বলে উঠলো,
– বুঝলাম ফ্ল্যাট তোমার নিজের।কিন্তু এটাকে এভাবে ব্যবহার করতে পারো না। আমার বাড়িতে এসব চলবে না। এই মূহুর্তে তোমাদের বিয়ে দিব।
মাথায় যেন বাজ পড়লো পৃথিশা-মারুফ দুজনেরই। পৃথিশা দু’পা পিছিয়ে গেলো। এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন কথা না বলে থাকতে পারছে না সে।
– আমি এখানে খারাপ কিছুই করি নি। আমি অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম হুট করে, বিশ্বাস করুন আপনারা। ভুল বুঝবেন না।
পৃথিশার কথার গুরুত্ব দিলো না কেউ। মারুফকে সরিয়ে তারা বাসার ভেতরে ঢুকে গেলো। একজন গেলো কাজি আনতে। পৃথিশাকে রুমের ভেতরে পাঠিয়ে দিলো মারুফ। সে এখনো লোকগুলোকে বুঝাতে ব্যস্ত। কিন্তু কিছুতেই কোন কাজ হলো না।
শেষ পর্যন্ত কোন কাজ না হলে মারুফ বাধ্য হয়ে পৃথিশার কাছে আসলো। পৃথিশা তখন মারুফের রুমে বসে ছিলো। তাকে আসতে দেখেই চোখ তুলে তাকালো। চোখে পানি ভর্তি। মারুফ এগিয়ে এসে হতাশ ভাবে মাথা নাড়লো। সেই পরিষ্কারের মহিলাটা এই কাজের শাস্তিস্বরূপ পৃথিশার সাথে নিজের ছেলের বিয়ের কথা তুলেছে বাহিরে। মারুফ প্রতিবাদ করায় সবাই এখন মারুফের সাথে পৃথিশার বিয়ের কথা বলছে।
– কি হলো বাহিরে?
পৃথিশার কন্ঠস্বরে ধ্যান ভাঙলো মারুফের। মেয়েটার চোখ-মুখ করুণ। মারুফের মুখস্রী দেখে পৃথিশা বুঝে নিলো সব। বিছানা বসে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সে। মারুফ জলদি পৃথিশার পাশে দুরত্ব নিয়ে বসলো। বুঝানোর স্বরে বলল,
– বাহিরের খালা তার ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা উঠিয়েছে। এটা কোথা থেকে আসো আমি বুঝলাম না। আমার বাসায় তোমাকে দেখেই তারা এমন চিন্তা-ভাবনা করছে। এখানে আমাদের কিছুই করার নেই।
মারুফ থামলো। খানিকটা দম নিয়ে আবার বলল,
– পৃথিশা, এ বিয়েটা তোমার জন্য জোর-জবরদস্তি হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এটা ছাড়া তোমার-আমার সত্যি আর কিছু করার নেই। চরিত্রের উপর একবার অপবাদ লাগলে তা মুছে ফেলা যায় না, হোক সেটা মিথ্যা।
পৃথিশা চুপচাপ মারুফের কথা শুনছে। তার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। কান্নারত স্বরে মারুফের দিকে তাকিয়ে বলল,
– কিন্তু আপনিতো বিবাহিত।
– হোয়াট? কে বলেছে এসব?
মারুফ চমকে উঠলো। সে বিবাহিত অথচ সে নিজেই জানে না?
– অনেকটা সেরকমই তো।আপনি যে সেদিন বলেন আপনার ফিয়ন্সে আছে।
মারুফ শান্ত হলো খানিকটা।পৃথিশা দিকে একটু এগিয়ে বলল,
– আমার তার সাথে বিয়ের কথা চলছিলো। কিন্তু তার অন্য পছন্দ থাকায় বিয়েটা হয় নি,কথা-বার্তাও বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই।
পৃথিশা অবাক হলো অনেকটা। তার অবাকের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়ে মারুফ এগিয়ে তা একহাত নিজের মুঠোয় নিলো। মারুফের শক্তপোক্ত বড় হাতের মাঝে পৃথিশার হাতটা যেনো হারিয়ে গেলো। শক্তপোক্ত হাতটা যেন কোমল ছোট হাতটাকে বাহিরে সকল কঠোরতা থেকে আগলে রাখতে চাইছে।
– বিয়েটা আনএক্সপেক্টেড দুজনের জন্যই। কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছে। আমার সমস্যা না হলেও তুমি অনেক সমস্যায় পড়বে। তাই আমার মনে হয় বিয়েটা করাই ভালো ডিসিশন হবে। বিয়ে তো ছেলেখেলা নয়, তুমি আমার সম্পর্কে জানো,আমি তোমার সম্পর্কে জানি। আমরা নাহয় তিনমাস দেখি, তারপর যদি মনে হয় সম্ভব না পথ নাহয় আলাদা হয়ে যাবে। আমি তোমার উপর সিদ্ধান্ত চাপাতে চাইছি না পৃথিশা। তুমি ডিসিশন নাও কি করবে। কোন কিছু নিয়ে চিন্তা করো না।
চলবে,