#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৭
ফারিহা জান্নাত
সাজানো-গুছানো এক ক্যাফেতে বসে অপেক্ষা করছে পৃথিশা। কিয়ৎক্ষণ পরই মণিদীপার হবু বরে আদিদের দেখা মেলে তার। হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করছে সে। পৃথিশার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
– সমস্যা কি মণির? কোন খবর নেই দুইদিন ধরে। বাসায় গিয়েও তোমাদের পেলাম না, কেউ কোন খবর বলতে পারলো না। তোমার ফোনও বন্ধ। কি হয়েছে?
– আপনি বসুন ভাইয়া,তারপর কথা বলছি।
পৃথিশার কন্ঠ শীতল। আদিদ শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। চেয়ার টেনে বসলো। পৃথিশা আজ ক্যাফেতে আসতে বলায় অনেকটা অবাকই হয়েছে সে। কোন দিন পৃথিশার সাথে খুব একটা আলাপ করা হয় নি, পৃথিশা নিজেই দুরত্ব বজায় রাখতো। চিন্তা-ভাবনা একপাশে ঠেলে পৃথিশার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো সে,
– এবার কথা বলো। মণি কোথায়? ওর ফোনে কি হয়েছে?
– আপু হাসপাতালে ভর্তি..
মূহুর্তেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো আদিদ। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলেই পৃথিশা হাত উঠিয়ে থামতে বললো তাকে।
– কথা শেষ করি। বুবুর রিপোর্ট দিচ্ছি এখন,আপনি দেখে তারপর উত্তর দিবেন কি করবেন?
পৃথিশা মণিদীপার রিপোর্টগুলোর কপি আদিদের দিকে এগিয়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে সেগুলো হাতে নিলো সে। তবে রিপোর্টগুলো পড়তে পড়তে কুঁচকানো ভ্রু সহসাই সোজা হলো, বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে উঠলো। পুরোটা পড়ার দুঃসাহস করতে পারলো না। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে রইলো প্রবল বিস্ময়ে। পৃথিশার মুখ কঠিন। দৃঢ় গলায় বলল,
– আপনি যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সেটা আপনার উপর। তবে আমাকে আগে সিদ্ধান্ত জানাবেন, তারপর বুবুর সাথে দেখা করার অনুমতি পাবেন।
আদিদ তখনো ঘোর কাটাতে পারছে না। তার ফুলের মতো মণির এই অবস্হা কেন যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না। বাবা নেই তার, মা একাই। দুনিয়া উল্টে গেলেও মণিদীপাকে ছাড়তে রাজি নয় সে। কন্ঠনালি দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছে না। কাঁপা স্বরে বলল,
– কীভাবে হলো এসব? মণি কেমন আছে? জ্ঞান ফিরেছে?
– বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সময়। টিউশনি থেকে ফিরতে দেড়ি হচ্ছিলো বলে আমি ও বাবা খুঁজতে গিয়েছিলাম। পরে একটা গ..গলির মধ্যে এই অবস্হায় পাই।
– আমি দেখা করবো তার সাথে। আমাকে একবারও জানালে না এমন অবস্হার কথা।
আদিদ তড়িঘড়ি করে উঠে যেতে লাগলো। পৃথিশা রিপোর্টটা ব্যাগে ঢুকিয়ে তার পেছন পেছন হাঁটা ধরলো। গতি বাড়িয়ে আদিদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। জোর গলায় বলল,
– আপনি এখন বুবুর সাথে দেখা করবেন না। বুবু এখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আপনি গেলে নিজেকে আরও দোষারোপ করবে। বুবুকে বাসায় নেওয়ার পর তার সাথে দেখা করবেন যদি তাকে বিয়ে করেন। আন্টিকে সাথে নিয়ে আসবেন। যদি রাজি থাকেন তবেই আসবেন।
আদিদ কিছু বলল না। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে নিম্নস্বরে প্রশ্ন করল,
– মণিকে এই অবস্হার জন্য আমি ছেড়ে দিবো বলে তুমি মনে করো?
– আমার মনে হওয়াতে কিছু যায় আসে না। আপনি কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুবুকে আর কোনরূপ কষ্ট আমি পেতে দিবো না।
পৃথিশা আদিদকে রেখেই বেরিয়ে গেলো। আদিদ কি করবে না করবে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই তার। ফোন বের করে চাচাকে ফোন দিলো সে। আগামীকাল বাবার মিলাদ। কিভাবে কি করবে তা জানাতে হবে। বাবার কথা মাথায় আসতেই তার মনে পড়লো মণিদীপা এখনো কিছুই জানে না। সে জানলে কি রকম প্রতিক্রিয়া করবে তা ভাবতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো পৃথিশার।
________
গোধুলি বেলা। লাল রঙে সেজেছে আকাশ। পৃথিশা মুখ ঘেমে-নেয়ে একাকার। খোপা করা চুলগুলো ভারে কাঁধের উপর হেলে পড়েছে। চাবি নিয়ে বাসার দরজা খুলতেই বাজে গন্ধ এসে নাকে ঠেঁকল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা সোফায় রাখতেই দেখলো ফ্রিজের দরজা খোলা,পুরোপুরি লাগানো নেই। তৎক্ষনাৎ বুঝলো, খিচুড়ি নেওয়ার পর ফ্রিজটা ভালোমতো লাগানো হয় নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে লেগে পড়লো সে। বাসায় এসেছিলো মূলত আগামীকাল গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য গোছগাছ করতে। মণিদীপাকে এখানে আনা যাবে না কোনভাবেই, তাই সে ভেবেছিল জামা-কাপড় নিয়ে যাক হাসপাতালে।তারপর সেখান থেকেই গ্রামের উদ্দেশ্য রওনা দিবে তারা। সব কাজ শেষ করে ঝটপট গোসল সেরে নিলো সে। মা’কে ফোন করে একবার মণিদীপার খবর নিয়ে নিলো। সে ঘুমাচ্ছে শুনে আপাতত আর হাসপাতালে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। পা’দুটো ব্যাথায় টনটন করছে।সারাদিন আজ বাসা খুঁজতে বেশ হাঁটতে হয়েছে,তবুও মনমতো বাসা পায়নি। বাসায় সবচেয়ে আদরের ছিলো পৃথিশা। ছোট মেয়ে হওয়ায় রাশেদুল চৌধুরী তাকে মাথায় করে রাখতেন।মণিদীপা পুতুলের মতো আগলে বড় করেছে তাকে। কখনই এতো দৌড়-ঝাপ করা হয়নি একসাথে। মাথায় উপর ছায়া দেওয়া দু’জন মানুষ আজ আর নেই। একজন মাটির বিছানায় আরেকজন হাসপাতালে শুয়ে। বিছানায় শুয়ে পিঠটা লাগাতেই মনে হলো যেন কতবছর যেন ঘুমোয় না সে। শরীর কাঁপিয়ে কান্না এলো তার। জীবন বড্ড প্যাঁচ ঘুরাতে ভালোবাসে। কালকে সবাই জানবে মণিদীপার কথা। বাবা থাকলে সে এটা নিয়ে চিন্তাই করতো না। বাবা তাদের দুই বোনের জন্য বর্ম ছিলো। কোন কিছুর আঁচ লাগতে দিতো না গায়ে। বাসা পাল্টিয়ে ফেললেই কি সত্য পাল্টানো যাবে। সবকিছু কি আগের মতো আদতেও হবে।কখনোই হবে না, মণিদীপা তার পড়াশোনা শেষ করতে পারবে? পৃথিশা-কি এডমিশনের প্রস্তুতি নিতে পারবে নতুন করে ঘুরে। রিস্টার্ট কি এতই সোজা!
পৃথিশার শীত অনুভব করতে লাগলো। বুঝতে পারলো জ্বর আসছে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো তার কেউ নেই এই জ্বরে মাথায় হাত বুলানোর জন্য। হুট করে দেখতে পেলো দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে মণিদীপা ঢুকছে। সাইড টেবিলে ঔষধ রেখে ধমকের স্বরে বলল,
– জ্বর হয়েছে কিন্তু এখনো টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা কথাও শোনে না আমার। দেখি বাবু, জ্বর কতটা বেড়েছে।
ঝট করে চোখ খুললো পৃথিশা। দেখতে পেলো ঘর সম্পূর্ণ ফাঁকা। কেউ নেই। চোখের কোণে থাকা পানি মুছে ফেললো। রাত হয়ে আসছে দেখে রেডি হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো সে। যাওয়ার পথেই দেখতে পেলো সেদিনের বখাটে ছেলেগুলো। কোণা চোখে তাদের দিকে তাকাতেই তারা চোখ নামিয়ে সরে গেলো সেখান থেকে।
হাসপাতালের কেবিনে ঢুকতেই মণিদীপার মুখস্রী দৃষ্টিগোচর হলো। সে করুণ মুখে সামনে থাকা খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। পৃথিশা ঢুকতেই তার দিকে তাকালো। মণিদীপা আগের থেকে এখন অনেকটা ভালো। তাকে হেলান দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। পৃথিশা হাত ধুয়ে ব্যাগ থেকে টিফিনকারি বের করতেই মণিদীপার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। পৃথিশার দিকে তাকিয়ে উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
– তুই রান্না করেছিস পৃথি? কি করেছিস?
পৃথিশা টিফিনকারি খুলতেই মণিদীপা হেসে দিলো। তার প্রিয় খিচুড়ি, বেগুনভাজা ও ডিমভাজা। পৃথিশা বলল,
– বেশি কিছু করতে পারি নি।
– চুপ থাক। খিদে পেয়েছে।খায়িয়ে দে।
পৃথিশা মণিদীপাকে খাওয়াতে শুরু করলো।হুট করে মণিদীপা জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, বাবা কোথায়? তাকে দেখলাম না একবারও।
পৃথিশার হাত থেমে গেলো। মায়ের দিকে একপলক তাকালো, তিনিও তার দিকেও চেয়ে। সে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করলো,
– বুবু, খাওয়ার সময় কথা বলতে নিষেধ করেছি কতবার। গলায় আটকাবে।
মণিদীপা পৃথিশার মুখ ধরে নিজের দিকে ফিরালো। শক্ত কন্ঠে বলল,
– বাবা কোথায়? ঠিক করে বল। আমার সাথে চালাকি করবি না।
পৃথিশা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা চালালো। খাবার প্লেটটা রেখে হাত ধুয়ে নিলো। মণিদীপার হাত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– বাবা নেই বুবু।
মণিদীপা আঁতকে উঠল। পৃথিশার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
– নে..নেই মানে? নেই মানে কি হ্যাঁ?
– তুই যেদিন অ্যাক্সিডেন্ট করলি ধকল সামলাতে না পেরে সেদিন রাতে বাবা হার্ট অ্যাটাক করে আর..
পৃথিশা আর বলতে পারলো না। তার কন্ঠরোধ হয়ে এলো। মাথা নিচু করে আটকে থাকা অশ্রু মুছে ফেললো। মণিদীপা বুদ্ধিমতী, পৃথিশার না বলা কথাটা বুঝে নিতে বেগ পেতে হলো না।কথাটা তার কানে বাজলো একবার কিন্তু হৃদয়ে বাজলো হাজারবার। মস্তিষ্ক যেন বারবার বলছে, “তুই দোষী,তোর জন্য তোর বাবা আজ নেই,তোর জন্য আজ এত সমস্যা। তুই সব সমস্যার মূল”। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। পৃথিশা বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু মণিদীপা শান্ত হলো না। হাত-পা ছুড়তে লাগলো বিক্ষিপ্তভাবে। চিৎকার করে বলতে লাগলো, আমি ন//ষ্টা, আমার জন্য বাবা নেই। আমিই খারাপ, আমার দোষ সব। বাবা, প্লিজ একবার আসো আমার কাছে। ও বাবা,একটা বার প্লিজ। পৃথিশা মণিদীপার সাথে পেরে উঠলো না। হাত-পা ছুড়োছুড়ি করাতে কিছু ক্ষত থেকে রক্ত বের হতে শুরু করেছে। পৃথিশা মা’কে ইশারায় ডাক্তার ডাকতে বলল। মণিদীপা তখনো কেঁদেই যাচ্ছে। পৃথিশা মণিদীপার মুখ তুলল,চোখের পানি মুছিয়ে দিলেও লাভ হলো না আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
– বুবু, কথা শোন আমার বুবু। তোর এখানে কি দোষ,বল। তুই কি জানতি এমন কিছু হবে? ব্যাপারটা কি ইচ্ছাকৃত? তুই বল? এভাবে কাঁদিস না বুবু, বাবা কষ্ট পাবে।
মণিদীপা তাও থামে না। কোন কথাও বলে না। কিছুসময় পরই ডাক্তার এসে তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়। ক্লান্ত থাকায় দ্রুতই ঘুমিয়ে যায় সে। পৃথিশা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাত জ্বলুনি অনুভব করতেই তাকিয়ে দেখলো মণিদীপার হাতের আঁচড়ে জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে গেছে কিছুটা। পৃথিশা মায়ের দিকে তাকালো, তিনি নত মুখে বসে আছেন। তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। পৃথিশা তার পাশে গিয়ে বসলো। মায়ের কোমড় জড়িয়ে বুকে মুখ গুজলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়লো তার। বিড়বিড়িয়ে বলল,
– সবকিছু এভাবে উলোটপালোট হয়ে যাওয়ার খুব কি প্রয়োজন ছিল মা।
চলবে,