সূর্যকরোজ্জ্বল পর্ব-০৬

0
34

#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৬
ফারিহা জান্নাত

পৃথিবীতে এখন ক্ষমতাধরদের রাজত্ব। যেদিকে টাকা ঢালে,সেদিকেই তাদের জয় জয়কার। টাকা ছাড়া আজকাল কিছু চলে নাকি! মণিদীপাকে হাসপাতালে রাখতে পারবে না বলে কতৃপক্ষ জানিয়েছে। মূলত নির্দেশ এসেছে হাসপাতালের উপরমহল থেকে। জল অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তারা সবার সামনে মণিদীপাকে দোষী বানানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মণিদীপার অবস্হা স্থিতিশীল। তার মানে এই নয় যে তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে। শরীরের অধিকাংশ জায়গায় এখনো ক্ষত। একটু হেরফের হলে সেখানে ইনফেকশন হতে সময় নিবে না। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হলেও মাথায় চাপ লাগানো নিষেধ। কিন্তু এর মাঝেই তারা মণিদীপাকে বের করে দিতে চাইছেন। পৃথিশা হাসপাতালে এসে এমন কথা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এই অবস্হায় এত দ্রুত তারা কোথায় যাবে। আর যেহেতু এই হাসপাতালে রাখতে চাচ্ছে না তার মানে অন্য কোথাও গেলেও তাদের ভর্তি নিবে না। পৃথিশা ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ডাক্তারের চেম্বারের দিকে গেলো। পৃথিশার মা মেয়ের পেছন পেছন আসলেন। পৃথিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললে, ‘ শান্ত হ মা। রাগারাগি করিস না।’
পৃথিশা তাকে কেবিনে যেতে বলে ডাক্তারের কেবিনে ঢুকলো। ডাক্তার নেই এখন।অ্যাসিসটেন্টকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো, আজ আসবে না ডাক্তার। পৃথিশা এবার হাসপাতাল অথোরিটির রুমের দিকে এগোলো। সহজ কথায় বললে খুব লাভ হবে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সে দেখা করার সুযোগ পেলো। রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো ভদ্রলোক ফোনে কাউকে ধমকাচ্ছেন। রুমের দিকে চোখ বুলালো পৃথিশা। পরিপাটি গুছানো রুম,একপাশের দেয়ালে কিছু ক্রেস্ট ও খবরের কাগজ বাঁধাই করে লাগানো।তাতে গুছিয়ে হাসপাতলের সুনামের কথা লিখা। পৃথিশা মৃদু হেসে শব্দ করে চেয়ারে বসলো। ভদ্রলোক ফোনে কথা বলা শেষ করে তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, মুখটা এমন কোমল করে রাখলেন যেন কিছুক্ষণ আগে ধমকা-ধমকি করা ব্যক্তিটি তিনি নন। যথাসম্ভব নরম স্বরে বলল,

– আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি ম্যাম? আমাকে বলা হলো আপনি সমস্যায় পড়েছেন।

– মিস মণিদীপা চৌধুরী, কেবিন নং -৪২০ তাকে কেন বের করে দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন?

ভদ্রলোকের মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো। তিনি কপালে কিছুক্ষণ হাত ঘষলেন। অতঃপর উঠে চলে যেতে নিলেই পৃথিশা তাকে আটকালো।

– কি হলো কোথায় যাচ্ছেন? আমার প্রশ্নের জবাব দিন।

ভদ্রলোক কাউকে ফোন দিলেন।কিছুক্ষণ পরই এক যুবক এলো। “ডিল উইথ হার” – বলে লোকটা বেরিয়ে গেলো।

– বলুন কী সমস্যা?

– মণিদীপা চৌধুরী, কেবিন নং -৪২০ তাকে কেন বের করে দেয়া হচ্ছে?

– দেখুন, আমরা হেল্পলেস। যা করতে বলা হয়েছে তাই করছি।

– কী করতে বলা হয়েছে আপনাদের? টাকার বিনিময়ে যে এমন করছেন তা খুব ভালো করেই জানা আছে সবার।

– জাস্ট শাট আপ। আমরা কী পরিমাণ প্রেশারে থাকি ধারণা আছে আপনার? এসেছেন নিজের গীত শোনাতে। শুনুন,যা বলা হয়েছে তাই করতে হবে। আমরা কিছু করতে পারবো না।

– আপনি আমাকে প্রেশারে থাকার কথা বলছেন? আমি কি অবস্হায় আছি তা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না।একজন রোগীকে আপনারা গুরুতর অবস্হায় অর্ধেক চিকিৎসা করিয়ে বের করে দিচ্ছেন।তার উপর আবার আমার উপরই চেঁচাচ্ছেন? আপনাদের হাসপাতালের অনেক সুনাম তাই না? তাহলে এখন আপনি শুনুন আমার কথা। এখন পর্যন্ত যা যা বললেন, সবই রেকর্ড করা হয়েছে।ইভেন এই কথাটাও রেকর্ড হচ্ছে। খুব নামীদামী একটা চ্যানেলে যদি এটা দিয়ে দেই কেমন হবে?

– আপনার এসব ফালতু হুমকিতে কাজ হবে না বুঝলেন। এখন যান আপনি।

পৃথিশা তার ফোনটা বের করলো। রেকর্ডটা প্লে করতেই সবগুলো কথা স্পষ্ট স্বরে শোনা যাচ্ছিলো। যুবকের এবার বোধ হলো। পৃথিশা উঠে চলে যেতে চাইলে তাকে আটকালো। শান্ত স্বরে বলল,

– আমরা ব্যাপারটা বসে ডিসকাস করি। ইট উইল বি বেটার।

– আ’ম নট ইন্টারেস্টেড। সো প্লিজ!

পৃথিশা চলে যাচ্ছিলো।দরজায় হাত দিতেই পেছন থেকে বলে উঠলো,

– আপনারা থাকতে পারেন এখানে। বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিবো। বাট রেকর্ড যেন ডিলিট হয়ে যায়।

পৃথিশা মুচকি হাসলো। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,

– রেকর্ড বাহিরের কারো হাতে যাবে না বাট মণিদীপার বেস্ট চিকিৎসা করা চাই।

– উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট।

পৃথিশা বেরিয়ে মণিদীপার কেবিনের সামনে আসলো। বাহিরে তার মামা বসে। পৃথিশা তার দিকে তাকিয়ে আশ্বাস দিতেই তিনি বুঝলেন আর কোন সমস্যা হবে না। কিছু সময় পরই অন্য ডাক্তার এসে মণিদীপাকে চেক করে গেলো। পৃথিশা কেবিনে ঢুকতে নিলোই তখনকার সেই যুবক এসে বলল,

– হু আর ইউ মিস পৃথিশা? আপনি এত পরিকল্পিতভাবে কীভাবে আমাদের সত্য জানতে পারলেন?

পৃথিশা তার দিকে তাকালো। উপরমহল থেকে কে হাসপাতাল অথোরিটিকে টাকা ও চাপ দিয়েছে তা খুঁজতে আমিরুল ইসলাম তাকে সাহায্য করেছে। সেটাই সে তাদের ফেসবুক পেজের ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলো। সেটার রেশ ধরেই হয়তো প্রশ্নটা করা।

– নো ওয়ান, জাস্ট পৃথিশা চৌধুরী।

________

মণিদীপার জ্ঞান ফিরেছে।তবে সে কারো সাথেই কথা বলছে না। চোখ বন্ধ করে আছে আর সেই চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পৃথিশা কেবিনে প্রবেশ করে ইশারায় সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলল। তারা যেতেই পৃথিশা মণিদীপার পাশে এসে বসলো। যত্ন করে মাথায় হাত বুলালো। মণিদীপা চোখ খুলে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। বোনের চোখের ভাষা যেন বুঝতে পারলো পৃথিশা। বোনের হাত শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখজোড়া বন্ধ করলো। তার ভেতরে অনেক কথা রয়ে গেছে। এই কথাগুলো সে অনেকবার মনে মনে আওড়েছে।চোখে বিন্দুমাত্র পানি না আনার কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে। পৃথিশা চোখ খুলে মণিদীপার দিকে তাকালে দেখলো সে এখনো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

– বুবু তোর মনে আছে আমি কালো ছিলাম বলে ছোটবেলায় সবাই কথা শোনাতো। আমি কাঁদতাম বলে তুই আমাকে বুঝাতি বাহিরের শরীরে এই আবরণ কিছুই না। বরং এই চামড়ার আবরণে যে মন লুকিয়ে আছে তাই আসল। বুবু তোর জীবনে একটা অঘটন ঘটে গেছে। এটা শুধু তোর জীবনের না বুবু। এটা আমাদের জীবনে ঘটেছে কারন তুই’তো আমাদের জীবন। তোর শরীরটাকে ওরা ছুঁতে পেয়েছে বুবু, কিন্তু তোর মন? সেটা তো আগের মতোই আছে। বাহিরের আবরণের এই ক্ষত কখনো তোর মনকে নষ্ট করতে পারে না বুবু। তোর মন পবিত্র বুবু, তাই তুইও পবিত্র। এই শরীর পবিত্র- অপবিত্র বলে কিছু নেই। সবটাই মন আর হৃদয় বুবু। তুই সেই মণিই আছিস বুবু, আমাদের চোখের মণি।

পৃথিশা থামলো।বড় করে একটা শ্বাস নিলো। হাতের মুঠোয় থাকা মণিদীপার হাত তখন কাঁপছে। মণিদীপার চোখে পানি, হালকা স্বরে বলল,

– তুই তো বড় হয়ে গেলি আমার বাচ্চাটা।

পৃথিশার চোখ টলমল করে উঠলো। মণিদীপা তার কাছে মায়ের মতো, দ্বিতীয় মা। সবসময় ছায়ার মতো আগলে রেখেছে। পৃথিশা তার একটা দিনও কল্পনা করতে পারতো না তাকে ছাড়া। সবকিছুতেই তার বুবুকে চাই। আজ সেই মা সমতুল্য বোনকে এমন ভঙ্গুর অবস্হায় দেখতে পারছে না সে। বুক ভেঙ্গে কান্না আসছে। পৃথিশা উঠে বসলো। শব্দহীন হেসে বলল,

– আমার পেটে হাজার কথা জমে আছে। ব্লান্ডার ফাটবে ফাটবে করছে। তাড়াতাড়ি সুস্হ হয়ে যা।এজন্য খেতে হবে বুবু।

হাসপাতাল থেকে লাঞ্চ দেয়া হয়েছে। সেদ্ধ সব খাবার। মণিদীপা যে ওসব খায়না তা জানে পৃথিশা। কিন্তু বাসায় কিছুই রান্না করা নেই।এই অবস্হায় বাহিরের খাবারও খাওয়ানো যাবে না। অনেকটা জোর করেই মণিদীপাকে খওয়াতে হলো তার। খাওয়া শেষ হতেই মণিদীপাকে ঔষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। হাসপাতালের দিকটা সবকিছু ঠিকঠাক রেখে বেরিয়ে এলো সে। নতুন বাসা খুঁজতে হবে অতি দ্রুত। মণিদীপাকে তো সবসময় হাসপাতালে রাখা যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হতেই হাতে থাকা মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠলো। স্ক্রিনে তাকাতেই চমক খেলে গেলো তার চোখে-মুখে। আবার নতুন ঝামেলা শুরু হতে যাচ্ছে তাহলে। এদিককার ঘটনায় ওসব ভুলেই গিয়েছিলো প্রায়। আবারও কল আসলে স্ক্রিনে নজর দিলো। ইংরেজি অক্ষরে লিখা উঠেছে – ‘Dulabhai’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে