#সূর্যকরোজ্জ্বল
পর্বসংখ্যা-০৫
ফারিহা জান্নাত
মণিদীপা ও পৃথিশা বরাবরই ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষ। যেকোন পরিস্থিতিতে যতটুকু শান্ত থাকা যায় ততটুকু শান্ত থাকার চেষ্টা করে। মণিদীপার জ্ঞান ফিরেছে। সে কিছুক্ষণ সময় চুপ ছিল,কোথা থেকে কোথাও এসেছে বুঝে ওঠতে পারছিলো না। ডাক্তার চেকাপ করতে আসলো,তখনও চুপ-ই ছিলো। তবে বিপত্তি বাঁধলো চেকআপের পর। কোন মতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে সে ডেস্কে টানানো রিপোর্ট দেখতে পায়। গোটা গোটা ইংরেজি অক্ষরে লিখা-
Patient name: Monideepa Chowdhury
Age: 24
Case: R*ape and s*exual Abusement
থমকে দাঁড়ালো সে। মস্তিষ্ক ভার হয়ে আছে। চাপ প্রয়োগ করতেই দুইদিন আগের সন্ধ্যার ঘটনা মনে পড়তে লাগলো। টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরছিলো সে। গলির সম্মুখে আসতেই ভেতর থেকে কয়েকজন মিলে তাকে টানা-হেঁচড়া করে গলির ভিতরের পরিত্যক্ত জায়গায় নিয়ে যায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সর্বনাশ হয়ে যায়। ছেলেগুলোর চেহারা ঠিকমতো দেখতে পায় নি সে, তবে গলার স্বর শুনে বুঝেছিল পাড়ার বখাটেগুলো। নিজেকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা সে করেছিলো। পারেনি, পারে নি নিজেকে রক্ষা করতে। সে ধ//র্ষি/* কথাটা মাথায় আসতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলো মণিদীপা। পুরো শরীরে প্রচন্ড ব্যাথা, মাথা নাড়াবার ক্ষমতা নেই। তবুও তাকে ছটফট করতে দেখে নার্স এগিয়ে এলেন। হাত ধরে শান্ত করতে চাইলেই ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলো। ব্যাথাটা যেন আরো গায়ে চেপে বসলো, তবে তাতে কিছু যায় আসে না তার। কোমড় থেকে পা পর্যন্ত যেন অসাড় হয়ে গেছে। বিছানার চাদর মুচড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সে। পৃথিশা ততক্ষণে দৌঁড়ে কেবিনে ডুকেছে। বোনের কান্নারত মুখস্রী দেখে হৃদয়ে যেন ছুরিকাঘাত লাগলো তার। বুঝ হবার পর কখনো মণিদীপাকে এত ভেঙ্গে পড়তে দেখেনি। ঢোক গিলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো সে। বোনের কাছে গিয়ে তার হাত ধরলো শক্ত করে। মণিদীপা তার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকালো। কথা বলার চেষ্টা করলো, তবে গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।কি বলবে সে? ডাক্তার এসে পড়েছে। হাতের ঘুমের ইনজেকশন। চটপট মণিদীপাকে ইনজেকশন দিয়ে দিলো। এই অবস্হায় এত উত্তেজিত হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। পৃথিশা গেলো না। মণিদীপার পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুসময় পর নার্স ডাকলে বেরিয়ে এলো। চেয়ারে মাথা চেপে বসে রইলো। বিপদ যখন আসে সবদিক থেকেই আসে একেবারে। অনলাইন নিউজ, মণিদীপার অবস্হা, মানুষের কটুক্তি সবকিছু কীভাবে সামাল দিবে সে? মায়ের কথা মনে আসতেই চটপট মামাকে ফোন লাগালো সে। জলদি আসতে বলল তাদের।
পৃথিশার কথার অতিদ্রুত আমিরুল ইসলাম পৃথিশার মা’কে নিয়ে এসে পড়েছেন। তাদের হাসপাতালে রেখে বাড়ির উদ্দেশ্য বেড়িয়ে পড়লো সে। এলাকায় পৌঁছাতেই দেখলো সবকিছু স্বাভাবিক। সে বুঝলো, খবর এখনো এতটা ছড়িয়ে যায়নি।
বাসার চাবি নিয়ে দরজা খুলতেই অদ্ভুত এক শূন্যতা ঘিরে ধরলো তাকে। বাসায় আগের মতোই সব রাখা যেভাবে রেখে গিয়েছিলো। টেবিলে বাবার আধ-খাওয়া চায়ের কাপ পড়ে আছে। পাশে খবরের কাগজ। নিজ রুমে ঢুকতেই দেখতে পেলো বিছানায় শাড়ি, চুড়ি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হলো সেদিন তার আর মণিদীপার এক জায়গায় দাওয়াত ছিলো, সেখানেই একই রকম শাড়ি পড়ে যেতে চেয়েছিলো তারা। বিছানায় বসে মাথা ঝাঁকালো পৃথিশা।এখন এসব ভাবার কোন মানে নেই। যা হয়েছে তা বদলাতে পারবে না। সর্বোচ্চ চেষ্টা করলে ভবিষ্যত-টা ভালো করতে পারবে। দ্রুত গোসল সেরে ফেললো সে। ফ্রিজ থেকে বাসি খিচুড়ি বের করে গরম করতে দিলো। ঘর-দোর চটপট গুছিয়ে খেয়ে রেডি হয়ে নিলো। পরবর্তী গন্তব্য সেই অনলাইন নিউজ অফিস।
_____
নিউজ স্টুডিও-তে পৌঁছাতেই দেখলো সবাই নিজ কাজে ব্যস্ত। সে রিসেপশনে গিয়ে যে মহিলাটি নিউজ করেছে তার সাথে দেখা করতে চাইলো। প্রথমে দেখা করতে দিতে দিলো না কিন্তু পরবর্তীতে যখন বলল সে মণিদীপার বোন তখনই তারা ব্যস্ত হয়ে উঠলো। কিছু সময় পরই সেই নিউজ প্রেজেন্টার আসলো। পরিপাটি ভদ্র মেয়ে,তাকে দেখে বুঝার সুযোগ নেই যে তিনি এমন কাজ করেছেন। পৃথিশার মন চাইলো এক্ষনি উঠে গিয়ে থাপ্পড় লাগাতে তারপর কথা বলতে। নিজেকে শান্ত করলো সে। মেয়েটি ততক্ষণে ক্যামেরা রেডি করতে বলছে,সে ইন্টারভিউ নিবে। পৃথিশা শান্ত স্বরে বলল,
– আপনি বসুন, আমরা আগে কথা বলি।
– সরাসরি ক্যামেরারা সামনেই কথা বলি। তাহলে ভালো হবে।
– আমি আপনাকে বসতে বলেছি।
পৃথিশা কড়া কন্ঠস্বর শুনে দমে গেলেন মেয়েটি। ক্যামেরা সেটাপ করতে থাকা লোককে বললেন পরে আসতে। অতঃপর পৃথিশার সামনাসামনি থাকা চেয়ারে বসলেন।
– আপনাকে মণিদীপা চৌধুরী সম্পর্কে যে নিউজ দেওয়া হয়েছে তার সোর্স কী?
– আপনাদের পাড়ার কয়েকজন ছেলেই এসে এ কথা বলল। এছাড়াও তার বন্ধুরাও বলেছে তারা মণিদীপার খোঁজ পাচ্ছে না।
– আচ্ছা, ভালো কথা। পাড়ার ছেলেদের একথা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য আপনার কাছে? মেয়েটা নিজে কোন তথ্য দিলো না,তার পরিবার থেকে কোন কথা বলা হলো না। কোথাকার কোন ছেলে এসে বলেছে আর আপনি তাদের কথা বিশ্বাস করে নিউজ করে ফেললেন।
– দেখুন আপনি..
– আমার কথার মাঝে কথা বলবেন না। কথা শেষ করতে দিন। মণিদীপা চৌধুরী কি খুব ফেমাস কেউ? কিংবা কোন ইম্পরট্যান্ট ব্যক্তিত্ব যার কারনে সে দুইদিন নিখোঁজ থাকায় আপনারা তাকে নিয়ে নিউজ করবেন? আপনি, আমি দু’জনেই বুঝতে পারছি টাকার খেলায় আপনারা এমন নিউজ করেছেন।
– আপনি আমাদের অফিসে এসে আমাদের এমনভাবে অপমান করতে পারেন না।
– অবশ্যই পারি। আমি কেন পারব না, যেখানে আপনি একজন অপরিচিত মেয়ের সম্পর্কে এরকম বাজে মন্তব্য করতে পারেন ।আপনাকে কি সে বলে গিয়েছিলো সে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? এখন কথা বলছেন না কেন? উত্তর দিন?
– দেখুন, আমরা আমাদের ট্রাস্টেড সোর্স থেকেই এ খবর পেয়েছি। সো..
– কথা ঘুরানোর চেষ্টাও করবেন না আমার সাথে। আপনাকে ২৪ ঘন্টা সময় দিচ্ছি। এই সময়ের মধ্যে আপনারা মণিদীপা চৌধুরীকে নিয়ে করা সবগুলো পোস্ট ডিলিট করবেন।
– আপনার কথা আমরা মানব কেন?
– এই যে কথাগুলো বললেন, সবগুলো রেকর্ড করা হয়েছে। নতুন চ্যানেল, সবেমাত্র পরিচিতি পাচ্ছেন।এর মধ্যেই যদি আপনাদের বিরুদ্ধে এমন স্টেপ নেই বুঝতেই পারছেন আপনার চাকরি তো যাবেই,সাথে এই চ্যানেল যা পরিচিতি পেয়েছিলো সবই খোয়াবে। আমজনতা কখনও আপানদের পরিস্হিতি বোঝার চেষ্টা করবে না। জানেনই তো, ট্রাম্পকার্ড সবসময়ই ভিক্টিমের হাতে থাকে।
পৃথিশা আর কোন কথা না বলে বেরিয়ে আসলো। রিকশা নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো সে। পরবর্তী পরিকল্পনা সে ইতিমধ্যে ভেবে ফেলেছে। বাসা পাল্টাতে হবে সবার আগে। মনিদীপাকে নিয়ে ওই জায়গায় যাওয়া যাবে না কোনভাবেই। হাসপাতালে ঢুকতেই মায়ের অন্ধকার মুখ নজরে এলো তার। বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠলো। মণিদীপার কি কিছু হয়েছে?
চলবে,