সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-১৬

0
716

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ষোল

সকাল সকালই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধাল রওনক। মাকে নেয়ার বাহানায় ছুটে আসলো রুদিতার শ্বশুরবাড়ি। পা ধরে লটকে রইল। ভদ্রমহিলা পড়লেন বিপাকে। দূরে সরাতে পারছেন না, আবার কাছে টানতেও বাঁধছে। আহাদুজ্জামান এখনও আসেননি। আতিকা জাহান প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, ভাইয়ের বাসায় যাবেন। অথচ রওনক এসে অহেতুক নাটক শুরু করল। তার এই লোকদেখানো মায়াকান্না সহ্য হলো না রুদিতার। বলল,

-‘তুমি এখান থেকে চলে যাও ভাইয়া। মা ওই বাড়িতে যাবেন না আর।’

রওনক চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘তুই এত কথা বলছিস্ কেন? চুপ থাক।’

-‘কথা তো বলতেই হবে। নাটক শুরু করেছ তুমি। মামার গালিবকা সহ্য করতে পারোনি, তাই বাহানা সাজিয়ে এসেছ। দু’দিন পর আবারও মাকে কষ্ট দিবে তোমরা। তোমাদেরকে হাড়েমজ্জায় চেনা হয়ে গেছে।’

-‘খুব তো চিনেছিস্ তাহলে মাকে নিজের কাছে রাখতে পারলি না কেন? কেন মামাকে সব কথা জানালি? শুধু তোদের জন্য শামীম ভাইয়া আমার গায়ে হাত তোলার সাহস পেল।’

উপর দিয়ে যে তুফান গেছে সেটা বেশ বুঝে গেল রুদিতা। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘খবরদার মা, তুমি আর ওই বাড়িতে পা রাখবে না। এতকিছুর পর যদি তুমি ওখানে যাও, তাহলে ধরে নিবে আমরা তোমার কেউ না।’

আতিকা জাহান মনে ব্যথা পেলেন। এক সন্তান কাছে টানতে চায়, আরেক সন্তান লা//তি মে//রে তাড়িয়ে দেয়। অথচ ওদের তিনজনকেই তিনি সমান ভালোবাসেন। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন,

-‘আমি তো যেতে চাইছি না, রাহা। কিন্তু তোর ভাই-ই তো জোরাজোরি করছে।’

তাদের পারিবারিক আলোচনায় উষাদ কিংবা হোসনা বেগম কেউ-ই নাক গলাননি। সকালেই স্কুলে চলে গেছে উষাদ। আগামীকাল থেকে বাচ্চাদের পরীক্ষা শুরু। দু’জনকে আলাদা রুমে পড়তে বসিয়েছে রুদিতা। বসার ঘরের কোনো আওয়াজ ও তর্কবিতর্ক বাচ্চাদের কানে যেতে দিতে চাইছে না সে। এজন্য যথাসম্ভব ঠাণ্ডা মাথায় ভাইয়ের সাথে তর্ক করে যাচ্ছে। মায়ের আমতা-আমতা স্বরের আওয়াজ শোনে বলল,

-‘যেভাবে পা ধরেছে একটা লা//তি মে//রে দিলেই তো পারো। আমি হলে তা-ই করতাম।’

কথাটা বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন। এটা ভুক্তভোগী ছাড়া আর কেউ বুঝে না। ছোটো বাচ্চাদের গায়ে একবার হাত তুললেই মায়েদের অনুশোচনা শুরু হয়, সেখানে রওনক তো বিশালদেহী এক পুরুষ। বয়স, বুদ্ধি, সবদিক থেকেই সে এখন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। যদিও তার কাজগুলো অমানবিক, তবুও সে মায়ের আদরের সন্তানই। এতবড়ো ছেলের গালে গতকাল চ//ড় মেরেছেন। আজ আবার লা//তি মারবেন? রুদিতার কথাটা সহজে মানতে পারলেন না তিনি। জোরপূর্বক পা ছাড়িয়ে বললেন,

-‘তুই যা রওনক। আমি ওখানে যাব না আর।’

-‘কেন যাবে না? একশোবার যাবে। এক্ষুণি যাবে।’

-‘একবার না বলেছি তো আমি। জোর করবি না।’

মায়ের কথা মেনে নিতে নারাজ রওনক। এতক্ষণ জোরাজোরি করলেও ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারল না আর। চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-‘এই মেয়ে তোমার সব হয়ে গেছে না এখন? আমি কেউ না? আমার কথার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?’

-‘খামোখা কথা বাড়াচ্ছিস্ রওনক। আমি যাব না বলেছি তো।’

-‘তুমি যাবে মানে, যাবে।’

রওনক মায়ের হাত ধরে টেনে তুলে, নিজের সাথে নিয়ে যেতে চাইল। রুদিতা পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল,
-‘আর একপা যদি এগিয়েছ, তোমার পা আমি ভে//ঙে দেব ভাইয়া।’

একহাতে মাকে সামলে অন্যহাতে রুদিতাকে চ//ড় মারতে গেল রওনক। সঙ্গে সঙ্গে হোসনা বেগম রওনকের হাত ধরে আটকে দিয়ে বললেন,

-‘অনেক বলেছ বাবা। এবার যাও। আর হাতটা এবার থেকে নিচে নামিয়ে রেখো। ও শুধু তোমার বোন নয়। আমার বাড়ির বউ। আমার সামনে তুমি আমার বউমার গায়ে হাত তুলবে আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব? এতটাও বোকা আমাদের ভেবো না। এমন বাহাদুরিও আর দেখিও না, ঠিক আছে?’

দাঁত কিড়মিড় করে বাজখাঁই কণ্ঠে রওনক বলে উঠল,
-‘কয়দিনেই একেবারে আপন হয়ে গেছে না? আরও ক’দিন পর নিজেরাই ঘরের বউকে ভাইয়ের কাছে রেখে আসবেন। আপনাদের মতো শাশুড়িদের আমার চেনা আছে।’

-‘চিনেছ তো। নিজের মাকে খুব চিনেছ। তোমার মা-ও কিন্তু একজন শাশুড়ি। কই, তিনি কি পেরেছেন ছেলে বউয়ের শত অত্যা//চার নিয়ে মুখ খুলতে? পেরেছেন, বউকে তার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে? পারেননি।’

-‘আমি আমার মাকে নিতে এসেছি। আপনার লেকচার শুনতে আসিনি। এত লেকচার আমাকে দিবেন না।’

-‘কেউ যেতে না চাইলে তাকে জোর করে নেয়ার আইন কোথায় পেয়েছ তুমি? হোন উনি তোমার মা। এইমুহূর্তে আমার বাড়ির মেহমান ও সম্পর্কে আমার বেয়ান। আমার সামনে তুমি আমার বউমার গায়ে হাত তুলবে আবার আমার বেয়ানকেও টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে নিজেকে বীরপুরুষ দাবী করবে, এটা তো আমি হতে দিব না। যদি পারো মাকে সম্মানের সাথে নিয়ে যাও, এভাবে অপমান করে নয়। সত্যিই যদি নিতেই চাও, তাহলে তোমার বউকেও নিয়ে এসো। তারও উচিত, নিজের শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চাওয়া। শত হলেও, অপরাধী তোমরা দু’জন। তুমি একা কেন এত লড়াই করবে?’

-‘আপনি আমাদের মাঝখানে আসবেন না আন্টি। সরে যান এখান থেকে।’

-‘তোমার সাহসের প্রশংসা না করে পারছি না আমি। আমার বাড়িতে এসে আমার দিকেই গলার আওয়াজ বাড়িয়ে দিচ্ছ। তুমি তো সন্তান নামের কলঙ্ক…।’

-‘উফফ্ আন্টি।’

রাগের মাথায় চিৎকার দিয়ে উঠল রওনক। হোসনা বেগম ও আতিকা জাহান দু’জনেই চমকালেন। রুদিতা মাকে নিজের দিকে টেনে এনে বলল,

-‘এত ঝামেলার দরকার নেই ভাইয়া। তুমি যাও। একটু পর মামা এসে মাকে নিয়ে যাবেন।’

মায়ের হাত ছেড়ে দিল রওনক। এর বেশি বেটাগিরি সে দেখাবে না। এমনিতেও ঘাড়ের ওপর বোঝা নেয়ার ইচ্ছে নেই। নিজেকে বীরপুরুষ প্রমাণ করতেই এতক্ষণ মাকে নিয়ে যাওয়ার মিথ্যে নাটক সাজাচ্ছিল। কেউ যখন মায়ের দায়িত্ব তার কাঁধে দিতে নারাজ, তখন সে যেচেপড়ে কেন ঝামেলাকে কাঁধে তুলবে? নিজের দিক ভেবে সে বলল,

-‘ঠিক আছে। দেখব কতদিন মামা নিজের বোনের দায়িত্ব নিতে পারেন। অসুস্থ হলে যেন আমাকে কেউ খবর না দেন। আমি দেখতে যাব না।’

এত ব্যথা কোথায় লুকোবেন আতিকা জাহান? দীর্ঘ দশ মাস যে সন্তান মায়ের গর্ভে থেকে বড়ো হয়, জন্মের পর থেকে মায়ের সান্নিধ্যেই যে সন্তান ভরসা খুঁজে পায়, বড়ো হওয়ার পর সেই সন্তান কীভাবে মাকে দূরে সরিয়ে দেয়? কীভাবে গর্ভধারিণী মাকে বৃদ্ধাশ্রমের দ্বারে ফেলে আসে? দুঃখে বুকটা ভার হয়ে গেল ভদ্রমহিলার। কষ্ট বুকে আগলে নিয়ে দীর্ঘশ্বাসের সাথে বললেন,

-‘আমি মরলেও আমার মৃত্যুর খবর যেন এই অমানুষটার কানে না আসে। আজ থেকে আমার শুধু দুটো সন্তান। তুই আমার কেউ না, কিচ্ছু না।’

রাগ ও ক্ষোভ জমে থাকলেও সেসব প্রকাশের সুযোগ পেল না রওনক। মাকে রেখেই সে চলে গেল। রুদিতা ফুঁস করে দম ছেড়ে আতিকা জাহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘ভেবো না মা। আমরা তো আছি-ই। সবসময় থাকব। একদম চিন্তা করবে না।’

***

ভাইয়ের সাথে বাবার বাড়িতে এসে বুকভরে শ্বাস নিলেন আতিকা জাহান। ভাবীর সাথে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করলেন। দুপুরের খাবার একসাথে খেলেন। চাচাতো ভাই-বোন যারা কাছেপিঠে ছিল, সবাই এসে দেখা করে গেল। অনেকদিন পর তিনি বাবার বাড়িতে পা রেখেছেন। এজন্য যে-ই শুনছে, সে-ই এসে দেখা করে যাচ্ছে। এখানে এসে আতিকা জাহান উপলব্ধি করলেন, সন্তান পাশে না থাকলেও তিনি আর একা নোন।

বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে ছিল তাদের বাবা-দাদার আমলের পুরনো জমি। সেই জমিটাই মূলত পারিবারিক কবরস্থানে রূপ নিয়েছে এখন। আসরের নামাজ শেষে, হাতে তাসবীহ্ নিয়ে বাবা-মায়ের কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন আতিকা জাহান। রুহামা দূর থেকে দেখল। নিজেও ছুটে গেল সেদিকে। পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এখানে কেন এসেছ এখন?’

আতিকা জাহান দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে নিয়ে বললেন,
-‘অনেকদিন বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি না। আজ একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। আমি থাকি এখানে, তুই যা।’

রুহামা মায়ের এই হেয়ালি আচরণটা ধরতে পারল না। বলল,
-‘মৃত মানুষের সাথে কীভাবে কথা বলবে?’

-‘দোয়ার মাধ্যমে।’

নিজের বোকা বোকা ব্যবহারে মুচকি হাসল রুহামা। মৃত মানুষের কথা হয়তো বলা যায় না। তবে দোয়া চাওয়া যায়। অনেকদিন পর সে-ও মায়ের সাথে মোনাজাতে দাঁড়াল। খেয়াল করল, আতিকা জাহান কাঁদছেন। একটু একটু করে বাঁধভাঙা পানির ন্যায় চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। তিনি চোখের পানি মুছতে চেষ্টা করছেন না উল্টে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে তুলছেন। একটা সময় মোনাজাত শেষ করে বাবা-মায়ের কবরের মাঝখানে বসে পড়লেন তিনি। রুহামা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

-‘ঘরে চলো মা।’

-‘এখানে এসে শান্তি পাচ্ছি রে মা। ভেতরের সবটুকু জ্বালা-যন্ত্রণা দূর করতে পারছি।’

কথা বলতে বলতে আবারও ডুকরে কেঁদে উঠলেন আতিকা জাহান। বললেন,
-‘কত কষ্ট করে সন্তানদের লালন-পালন করলাম। বৃদ্ধ বয়সে ছেলেরা না-কি বাবা-মাকে আগলে রাখে। অথচ আমার ছেলে আমাকে তাড়িয়ে দিল। এই দিনটা দেখার জন্য ওকে বড়ো করেছিলাম আমি? হায় আফসোস। আমার মরণ কেন হয় না?’

-‘মা প্লিজ। শান্ত হও। ছেলে নেই তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি। তুমি কেন ভেঙে পড়ছ বলো তো? ঘরে চলো মা। মামী অপেক্ষা করছেন। আর কতক্ষণ বাইরে থাকবে?’

আতিকা জাহান উঠতে চাইলেন না। মাটিতেই বসে থাকলেন। রুহামা ধরেবেঁধেও মাকে নিয়ে যেতে পারল না। তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মনের ভেতরের সব যন্ত্রণাকে ঠেলে বাহির করতে চাইলেন। যেন এখানেই কেঁদেকেটে সকল দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাবেন। রুহামা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল,

-‘ওঠো না মা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। ঘরে চলো।’

-‘তুই যা তো। বকবক করে মাথা খাস না। আমাকে থাকতে দে এখানে। আমি আমার বাবা-মায়ের কাছে থাকি। এখানেই আমার শান্তি। এখানেই সুখ। অন্য কোথাও গিয়ে শান্তি পাব না আমি। তুই যা। ঘরে যা।’

-‘এই অসময়ে তোমাকে এখানে রেখে যাব আমি? পাগল পেয়েছ আমায়? ওঠো তো।’

ঘরে এনে মাকে বিছানায় বসিয়ে, নিজের মতো করে বুঝাতে লাগল রুহামা। বলল,
-‘আর কান্নাকাটি করবে না বলে দিচ্ছি। এসব ভালো লাগে না আমার। যার জন্য কাঁদো, সে কি বুঝে? কেন কাঁদবে তুমি? কী হারিয়েছে তোমার? কিচ্ছু হারায়নি। আমরা তো আছি না-কি। কেন একটা অমানুষের জন্য চোখের পানি ফেলবে? আর কেঁদো না মা। অসুস্থ হয়ে যাবে।’

মেয়ের কোনো কথাকে ঠিকমতো কানে জায়গা দিলেন না আতিকা জাহান। সবকথা হজম করে বললেন,
-‘এক গ্লাস পানি নিয়ে আয়।’

রুহামা পানি আনতে রান্নাঘরে গেল। সেখানে শামীমের বউ মাহেরা ও তার মামী বসেছিলেন। রুহামাকে দেখে ভদ্রমহিলা বললেন,
-‘আপাকে নিয়ে এসেছিস্?’

-‘জি মামী। কান্না থামাতে পারছি না। একটু দেখো না তুমি।’

-‘আচ্ছা, যাচ্ছি।’

ভদ্রমহিলা চলে যাওয়ার পর রুহামা মায়ের জন্য পানি নিল। মাহেরা তখনও রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত। আহাদুজ্জামানের স্ত্রী গুটিকয়েক পা ফেলে ননদিনীর রুমে প্রবেশ করলেন। তাকে একপাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখে বললেন,

-‘আপা, তোমাকে আমি কতবার বুঝিয়েছি, কেঁদেকেটে নিজেকে অসুস্থ করো না। তাক্বদীরে যা ছিল, তা হয়ে গেছে। এখন এত কেঁদে লাভ আছে? আমরা তো আছি। আমরা তোমাকে দেখব। তোমার কেউ নেই, এই চিন্তাভাবনা মাথা থেকে সরাও।’

আতিকা জাহান সাড়া দিলেন না। তিনি পাশে গিয়ে বসে গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিলেন,
-‘আপা, ওঠো। চা খাও। শামীমের বউ খুব ভালো চা বানায়। তুমি না ওর হাতের চা পছন্দ করো? ওঠো। একসাথে চা খাই।’

এবারও সাড়া না পেয়ে রীতিমতো ঘাবড়ে গেলেন তিনি। রুহামা পানি নিয়ে এসে দেখল, তার মামী তখনও ডেকে যাচ্ছেন। অথচ আতিকা জাহান সাড়া দিচ্ছেন না। সে পানি রেখে মায়ের পাশে বসে, দুহাতে মাকে ধরে ডাক দিল,

-‘মা, পানি খেয়ে নাও। একটু আগেই তো জেগেছিলে। এরমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লে।’

দু’হাতে ধরে বসাতে গিয়ে দেখল, নিস্তেজ শরীর। ধ্বক করে বুক কেঁপে উঠল রুহামার। হাত দিয়ে মায়ের শরীর চেক করে হতবাক চোখে মামীর দিকে তাকিয়ে বলল,

-‘মামী, মায়ের পালস্ তো নড়ছে না। ডাক্তার ডাকতে হবে?’

পুরো ব্যাপারটা তখনও আন্দাজ করতে পারল না রুহামা। পুরুষ মানুষ কেউ বাসায় নেই। সে তড়িঘড়ি শামীমকে ফোন করে ডাক্তার আনতে বলল। এদিকে রুহামার মামী ননদিনীর গরম শরীর ও নিঃশ্বাস থেমে যাওয়া দেখে অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করলেন,

-‘ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’

রুহামা তখনও বারান্দায়। সে মামীর বিড়বিড় শোনে সামনে এসে বলল,
-‘ভাইয়া ডাক্তার নিয়ে আসছে।’

-‘ডাক্তার আনতে হবে না আর। তোর মা আর নেই।’

কানে ভুল শোনার ন্যায় মামীর কথাকে অবিশ্বাস্য মনে হলো রুহামার। পাত্তা দিল না। কাছে এসে অনবরত মাকে ডাকতে শুরু করল। এত ডাক, এত কাকুতি-মিনতির পরও জন্য মায়ের নড়চড় পেল না, তখনই তার অবচেতন মন তাকে নিশ্চিত করাল, মা আর নেই। চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল রুহামা। মাহেরা ছুটে এলো। বাচ্চারাও এলো। মাকে জড়িয়ে ধরে বুকফাটা আর্তনাদ করছে রুহামা। তার এই আর্তনাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন যারা ছিলেন সবাই ছুটে আসলেন। মাহেরা মুহূর্তেই সবাইকে মৃত্যু-সংবাদ জানিয়ে দিল। কাজ ফেলে শামীম ছুটে আসলো, আসলেন আহাদুজ্জামান নিজেও। বোনের প্রাণহীন দেহ দেখে বুকটা কেমন ব্যথা করে উঠল তার। মৃতদেহ’র মুখ একটা পরিচ্ছন্ন চাদর দিয়ে ঢেকে রেখে শামীমকে বললেন,

-‘রাহাকে আসতে বল শামীম। রওনককেও জানিয়ে দে। ওর ঘাড়ের বোঝা একেবারে খালি হয়ে গেছে। আর কোনো টেনশন নেই ওর। আর কোনো বাড়তি খরচও নেই।’

***

দিন গড়ানোর আগেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর খবর শোনে স্তব্ধ হয়ে গেল রুদিতা। বাচ্চাদের রেখে যাবে, না-কি সঙ্গে নিয়ে যাবে, এই নিয়ে খানিকক্ষণ মনের সাথে যুদ্ধ করলেও দু’জনকে হোসনা বেগমের কাছে রেখে, উষাদকে সাথে নিয়ে মামাবাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। ততক্ষণে মৃতদেহ’র গোসল ও কাফন পরানোর কাজ কমপ্লিট। বাড়ির ড্রয়িংরুমে একটা খাটিয়া সাজানো। তাতে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন আতিকা জাহান। বাড়তি কোনো পুরুষ মানুষকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হলো না। এমনকি রওনকও পারল না। শুধু একাই ঘুমন্ত মায়ের শিয়রের সামনে গিয়ে ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে পড়ল রুদিতা। আলগোছে কাফনটা সরিয়ে কম্পনরত হাতে মায়ের মুখখানি ছুঁয়ে দিল। চিৎকার দিল কাঁদতে গিয়েও থেমে গেল। গলা দিয়ে আওয়াজ আসছে না তার। ভেতরটা জ্বলছে। সকালেও মা সুস্থ ছিলেন, সন্ধ্যের মধ্যেই মৃত হয়ে গেলেন? মনকে বুঝাতে পারল না। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে মাকে ডাকল রুদিতা,

-‘তুমি না বলেছিলে, আমাকে দেখতে যাবে? কই, যাওনি যে। আমি সারাদিন তোমার পথচেয়ে থেকেছি মা। তুমি এইভাবে আমাকে ফাঁকি দিলে? কেন মা? কেন এত অভিমান নিয়ে চলে গেলে তুমি?’

মাকে ডাকতে ডাকতে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল রুদিতা। মাহেরা এসে পাশে বসে বলল,
-‘কান্না থামাও রাহা। আর কেঁদে লাভ নেই।’

মাহেরাকে জাপটে ধরল রুদিতা। ভাঙাগলায় বলল,
-‘ভাবী, মামা তো বলেছিলেন আমায়, মাকে দেখে রাখবেন। কী হয়ে গেল ভাবী? আমার মা কেন এইভাবে আমাদেরকে কিছু না বলে চলে গেলেন? আমরা কাকে মা বলে ডাকব ভাবী? কার কাছে দুঃখের কথা শেয়ার করব? কার কোলে মাথা রেখে একটু শান্তি খুঁজব বলো? আমি গতকাল রাতেও মায়ের সাথে ঘুমিয়েছি জানো। মা তখনও আমাকে কিছু বুঝতে দেননি। আমি যদি জানতাম, মা এইভাবে চলে যাবেন। ভুল করেও মাকে কাছ-ছাড়া করতাম না ভাবী। ভুল করেও করতাম না, ভাবী।’

স্বান্তনা দেয়ার ভাষা জানা নেই মাহেরার। সে শুধু রুদিতাকে আগলে নিয়ে রুম ছেড়ে অন্য রুমে গিয়ে বসল। সিলিংফ্যান ছেড়ে তাকে কতক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ করে দিল। বাইরে থেকে রওনকের চিৎকার ভেসে আসছে। মাকে দেখতে না পারা, ছুঁতে না পারা, কাছে আসতে না পারা, এসব এত সহজে মেনে নিতে পারছে না রওনক। শামীম যথাসম্ভব তাকে আটকে রাখছে। কারণ একটাই, যে মায়ের সাথে সে অন্যায় করেছে, সেই মাকে দেখা অনুচিত তার, এইভেবে। রওনকের চিৎকার-চেঁচামেচিকে কানে জায়গা দিলেন না আহাদুজ্জামান। জানাযার সময় হয়ে যাওয়াতেই খাটিয়া তুলে নেয়ার আদেশ দিলেন তিনি। তখন বাঁধল আরেক গণ্ডগোল। রওনক চেঁচিয়ে উঠে বলল,

-‘আমি মাকে নিয়ে যাব। সরো সবাই। কারও কোনো কথা শুনব না। এই মৃত নারী আমার মা। তাকে কাঁধে তুলে নেয়ার অধিকার আমার আছে।’

শামীম সমানতালে বলল,
-‘কীসের অধিকার? বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার আগে মনে ছিল না, এই নারী তোর মা? এখন এত মা মা করছিস কেন হারামী?’

শর্মী নিজেও এসেছিল ফুপিকে শেষবারের মতো দেখতে। কিন্তু দেখতে পারল না। সুযোগই পেল না সে। দু’জনের দ্বন্দ্ব দেখে ভাইকে বলল,
-‘এসব ভুলে যাও না ভাইয়া। আমরা ভুল করেছি। আমাদের ক্ষমা করে দাও।’

-‘অসম্ভব। ফুপি নিজেই চায়নি, রওনক তার মুখ দেখুক আর।’

-‘ওসব তো অভিমানে বলেছেন। মন থেকে তো বলেননি।’

বোনের অনুরোধ শোনে বাঁধা দিল না শামীম। এখন ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। জানাযার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। মানুষজন গিজগিজ করছে বাড়িতে। সে যখন উষাদ ও আরও একজনকে নিয়ে খাটিয়া তুলতে যাবে, তখনই দুইবোন এলো সামনে। রেগেমেগে ধা//ক্কা মা//রল রওনককে। খাটিয়া আগলে দাঁড়িয়ে রুদিতা বলল,

-‘খবরদার, তুমি আমার মাকে ধরবে না। তোমার মতো পা//পী সন্তানের কোনো অধিকার নেই, মাকে কাঁধে তোলার। কবরস্থানে নেয়ার জন্য আরও অনেক মানুষ আছে। তারা নিবে। ভুল করেও এই খাটিয়ায় হাত দিবে না তুমি।’

বোনের এই পাগলামি সহ্য করতে পারল না রওনক। বলল,
-‘সরে দাঁড়া রাহা। আমাকে আমার কাজ করতে দে।’

রুহামা আবারও ধা//ক্কা মারল ভাইকে। ঠেলতে ঠেলতে দূরে নিয়ে গেল। বলল,
-‘দূরে থাকো তুমি। কাছে ঘেঁষলে মাথা ফা//টি//য়ে দেব।’

দুই বোনের এই আচরণে হতভম্ব মুরব্বি মানুষেরা। কানাকানি শুরু হওয়াতে আহাদুজ্জামান এই সমস্যার সমাধান নিজেই দিলেন। রওনককে দূরে রেখে তিনি নিজেই এসে খাটিয়া কাঁধে তুলে নিলেন। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সীমানা যখন ত্যাগ করছিলেন, দূরে থেকে ছটফট করছিল রওনক। মায়ের কাছে যেতে তার এত বাঁধা আসবে টের পায়নি আগে। এখন বুঝতে পেরে নিজেকে তার চরম অসহায় ও একা মনে হচ্ছে। উঠোনের একপাশেই হাঁটুভেঙে বসে পড়ল সে। সবগুলো ভুল আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, ভুল শোধরানোর সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সে ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বিলাপ করতে লাগল। দুইবোন ভাইয়ের কাছে ভীড়ল না। শর্মীকেও কেউ পাত্তা দিল না। নিজেদের মতো করে মায়ের জন্য দোয়া চাইতে বসে গেল রুদিতা ও রুহামা।

রাত দশটায় জানাযার নামাজ শুরু হলে, দূরে থেকে নামাজে শরীক হলো রওনক। নামাজ শেষে সবাই যখন চলে গেলেন, সেই ফাঁকে মায়ের কবরের পাশে গিয়ে বসল সে। কতক্ষণ ভেজা মাটিতে হাত বুলিয়ে দু’হাতে কবরটাকে আগলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

-‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, মা। আমি তোমার পা//পী সন্তান। সময় থাকতে তোমার মূল্য বুঝতে পারিনি। তোমার চলে যাওয়াই আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে দিয়েছে মা। ও মা, ফিরে এসো না। একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দাও। আমি তোমার পায়ের কাছে পরে থাকব মা। তবুও তুমি ফিরে এসো।’

থাকতে মানুষের কদর করতে হয়, এইটুকু কেন আগে বুঝল না রওনক। নিজের এই ভুল, এই পা//প, এই অন্যায়-অবিচার তাকে শেষবারের মতো মাকে ছুঁতেও দিল না। মায়ের মুখও দর্শন করা হলো না। সব ভুল ও অপরাধকে একেবারে মুক্তি দিয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছেন মা। আর তাকে দিয়ে গেছেন, অভিশাপ। শেষবেলা মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ারও সুযোগ পেল না সে। কত আহাজারি, কত অনুরোধ, কত অনুশোচনা তার কণ্ঠে। তবুও জন্মদাত্রী মা আজ সাড়া দিচ্ছেন না। অভিমানে মুখ লুকিয়েছেন মাটির আড়ালে। এই অভিমান কীভাবে ভাঙাবে রওনক? সব পথ যে বন্ধ করে দিয়ে গেলেন মা।

রওনক ওখানেই পড়ে রইল। ঘরে এলো না। বাইরে দাঁড়িয়ে রইল শর্মী নিজেও। ভেতরে যাওয়ার সাহস হলো না তার। বোনকে মামা-মামীর কাছে রেখে বিদায় নিল রুদিতা। রুহামা পূণরায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদল রুদিতাও। শেষবেলা সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

-‘কাঁদিস্ না আর। কাঁদলে মায়ের কষ্ট হবে। এত অপমান, এত কষ্ট, সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাই তো খুব অভিমানে, কাউকে কিছু না বলেই চলে গেলেন।’

মাহেরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুহামাকে সামলাতে। রুদিতা আর দেরী করল না। বিদায় নিয়ে বাড়ির বাইরে এলো। দূর থেকে একনজর কবরস্থানের দিকে তাকাল। না ফিরলেও হতো আজ। কিন্তু আগামীকাল বাচ্চাদের পরীক্ষা। হয়তো বাবা-মাকে খুঁজছে দু’জনে। এই ঘটনা বাচ্চাদের মনে প্রভাব ফেলবে দেখেই কাউকে সাথে আনেনি। কান্নারত মলিন মুখ নিয়ে উবারে উঠতে গেলে রওনক ডাক দিল রাহাকে। বলল,

-‘একটু দাঁড়া, রাহা।’

গভীর করে শ্বাস টেনে রুদিতা বলল,
-‘তোমার সাথে আর কোনো কথা নেই আমাদের। সম্পর্ক শেষ হওয়ার সাথে সাথে সব দায়িত্ব-কর্তব্যও শেষ হয়ে গেছে। এবার থেকে শান্তি তোমার। সব খরচ একেবারেই কমে গেল। যাও, বউয়ের কাছে যাও। ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে গিয়ে পেট ভরে খাও। দেখার মতো কেউ নেই আর। অভিযোগ করার জন্যও কেউ নেই। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে সব সম্পর্ক ও প্রয়োজনের সমাপ্তি ঘটিয়ে গেছেন তিনি। সুখী থাকো। আমাদের খোঁজ নিতে হবে না তোমাকে। আমাদের প্রতি কোনো দায়িত্ব-কর্তব্যও পালন করতে হবে না। যার সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটে, তার সাহায্য কিংবা স্নেহ-মায়া-মমতা কোনোকিছুরই প্রয়োজন পড়বে না আর। আমাদের ছাড়া যখন তুমি ভালো থাকতে শিখে গেছো, তখন তুমি ছাড়াও আমরা ভালো থাকতে শিখে যাব। সময় সবকিছু সহজ করে দিবে।’

আর দাঁড়াল না রুদিতা। গাড়িতে গিয়ে বসল। উষাদ উঠতে গেলে তার হাত ধরে আটকে ফেলল রওনক। বলল,
-‘ও ছোটো মানুষ। বয়স কম, অভিজ্ঞতাও কম। আমার অবস্থা কিছুতেই বুঝবে না। তুমি তো বুঝবে ভাই। পারলে ওকে একটু বুঝিয়ে বলো। বলো যে, আমাকে যেন ক্ষমা করে দেয়। মায়ের কাছে তো ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেলাম না। কোনোদিন যদি ওদের কাছেও ক্ষমা চাইবার সুযোগ না পাই! পাপের বোঝা থেকে কীভাবে মুক্তি নিব বলো তো? আমার তো মুক্তি নেয়ারও সুযোগ রইল না আর।’

-‘চেষ্টা করব।’

শুধু এইটুকু বলে বিদায় নিল উষাদ। গাড়িতে উঠে রুদিতাকে আগলে নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ ধরে আটকে রাখা কষ্টকে এবার মুক্তি দিল রুদিতা। নিঃশব্দে কাঁদল। দমবন্ধ করা যন্ত্রণাদের আগলে নিয়ে বলল,

-‘আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না মা আর নেই। মাকে ছাড়া কীভাবে থাকব আমরা? ও আল্লাহ, কী করলে এটা? কেন করলে? কেন আমাদের এতিম করে দিলে মাবুদ?’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে