সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-১৫

0
709

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – পনেরো

বাড়ির কাছাকাছি এসে সদর দরজা খোলা দেখে স্বস্তি পেলেও চিৎকার-চেঁচামেচির আওয়াজে রুহামা নিশ্চিত হয়ে গেল, ভেতরে গণ্ডগোল হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে থেকে ফাহাদকে বলল,

-‘আপনি এখন যেতে পারেন। আর কোনো প্রবলেম হবে না।’

ফাহাদ শান্ত হতে পারল না। তার ধারণা, ভেতরে বিরাট একটা ঝামেলা হচ্ছে। এই ঝামেলা রুহামার উপরও প্রভাব ফেলবে। কেউ সাহায্য চাইলে করা যায়, তবে না চাইলে যেচেপড়ে কত এগোবে? এতটুকু রাস্তা তো তার নিজের ইচ্ছেতে এসেছে। শুধু মেয়েটার ওপর কোনো বিপদ যেন না হয়, এইটুকু নিরাপত্তার কথা ভেবেই। বাড়ির সামনে রেখে গিয়েও শান্তি পাবে না। জোরপূর্বক দাঁড়িয়ে থাকাও অশোভনীয়। সবদিক বিবেচনা করে বলল,

-‘প্রয়োজন পড়লে কল করবেন।’

রুহামা শুধু ঘাড় নাড়ল। গেটের ভেতরে পা রাখতেই পিছন থেকে ফাহাদ জানাল,
-‘আমি আপনার পাশে থাকতে চাই, সবসময়। মনের মধ্যে কোনো সংকোচ রাখবেন না, প্লিজ।’

ভেতরের সোরগোল শোনে আর দাঁড়ানোর আগ্রহ পেল না রুহামা। ছুটে এলো উঠোনে। দরজার কাছে আসতেই রওনকের চিৎকার শোনা গেল। ভয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল রুহামা। একবার পিছন ফিরে তাকাল। ফাহাদ তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ওখান থেকেই ইশারা করল,

-‘আসব?’

অসম্মতি জানিয়ে বুকে ফুঁ দিল রুহামা। বাইরের মানুষের সামনে এমনিতেই সম্মান অনেক নষ্ট হয়েছে। আর না হোক। বাড়ির সম্মান, মায়ের সম্মান সবটুকু বুঝে, ফাহাদকে ওখান থেকেই চলে যেতে বাধ্য করল। ফাহাদ গেল কি-না কে জানে! সে আর পিছনে ফিরল না। দরজায় দাঁড়িয়ে রওনকের চেঁচামেচি শুনল। তার ভাষণে একটা কথাই স্পষ্ট, মামা ইচ্ছেমতো বকে দিয়েছেন। এজন্য জম্পেশ খানাদানাটাও ঠিকমতো হয়নি। তার আগেই বাড়িতে আসতে হয়েছে। মনে সাহস সঞ্চয় করে ঘরে পা ফেলতেই ছুটে এলো শর্মী। হিং//স্র বা//ঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রুহামার ওপর। আকস্মিক এই আক্রমণে প্রথমে খানিকটা ভরকে গেলেও কোথা থেকে যেন সাহস পেয়ে গেল রুহামা। যে হাতে শর্মী তার চুল টে//নে ধরেছিল, সেই দুটো হাত মুচড় দিয়ে ধরে রেখে ইচ্ছামতো ব্যথা দিল হাতে। বলল,

-‘হাতটা নিচে নামিয়ে রেখো। আর একবার যদি এই হাত আমার গায়ে এসে লাগে, টু//করো টু//করো করে ফেলব। আমাকে এত দুর্বল ভাবার কিছু নেই।’

রওনক দূরে থাকল না। এগিয়ে এসে বোনকে চ//ড় দিল। ব্যথা পেলেও কষ্টগুলো গিলে ফেলল রুহামা। পিকলু ও মৌমি ধরেবেঁধে তাদের বাবাকে দূরে সরিয়ে দিল। রওনক চেঁচিয়ে বলল,

-‘কত্তবড়ো সাহস। আমার বাড়িতে থেকে আমার বউয়ের সাথে বেয়াদবি করে। তোর হাত আমি ভে//ঙে দেব রুহামা।’

-‘বউ তোমার সব? মা কিছু না? মায়ের সাথে অন্যায় কী করে করলে তুমি?’

-‘তাতে তোর লাগছে কেন? গায়ে ফোসকা পড়ছে?’

-‘তুমি কেমন মানুষ ভাইয়া? কাকে তুমি রাস্তায় ফেলে এসেছ? গর্ভধারিণী মাকে। ওই মা তোমাকে যদি লালন-পালন না করত, তাহলে তাকে শা//স্তি দিতে। যে মায়ের কোনো অন্যায় নেই, সে-ই মাকে কী করে রাস্তায় ফেলে এলে?’

-‘তোর সমস্যা কী? বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকেও রাস্তায় রেখে আসব।’

-‘তোমার এখানে থাকার জন্য ম//রে যাচ্ছি তো আমি।’

-‘তাহলে যা, বের হ। অকারণ গলাবাজি কেন করছিস্?’

রওনক বেহুঁশের মতোই বোনকে গালাগালি করছিল। সে ভুলে গিয়েছিল, তার গায়েও কেউ হাত তুলতে পারে। রুহামাকে গালিবকা দিতে দেরী, তার পিঠে দুই তিনটে পড়তে দেরী হলো না। আচমকা এই আঘাতে হতবাক হয়ে গেল রওনক। হুঁশ ফিরতেই দেখল, শামীম তাকে মা//রছে। সে নিজেকে বাঁচানোর জন্য চিৎকার দিয়ে বলল,

-‘আরেহ্ ভাইয়া। তোমার আবার কী হলো? তুমি কোথা থেকে এলে? গায়ে হাত তুলছ কেন?’

-‘তোর হাত আমি এখন ভা//ঙব। তোর কত্তবড়ো সাহস। তুই আমার ফুপিকে বাড়ি থেকে বের করে দিস্! তাও বউয়ের কথায়। এই বউ কোথায় পেয়েছিস্ তুই? ভুলে গিয়েছিস্ সব? তোদের রিলেশন মেনে নেয়ার জন্য ফুপি বাবার কাছে রিকুয়েস্ট করেছিল? সব ভুলে গিয়েছিস্? আজ বউয়ের কথায় মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিস্! অ//মানুষের বাচ্চা।’

ভাইকে এত রেগে থাকতে দেখে ভয়ে ঢোক গিলল শর্মী। হাত বাড়িয়ে স্বামীকে বাঁচাতে গেলে সে নিজেও শামীমের হাতের দু’চারটে চ//ড় খেল। রাগে চেহারার ধরণটাই পালটে গেল তার। একাধারে কয়েকটা চ//ড়-থা//প্পড় মে//রে শামীম বলে উঠল,

-‘ঘর-সংসার বুঝেছিস্? ঘরের মানুষের মূল্য বুঝিসনি? আজ যদি তোর ভাবী আর আমি মিলে বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি, তুই সেটা হজম করতে পারবি?’

শর্মী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
-‘তুমি এতটা অ//মানবিক হতে পারো না।’

-‘কেন পারি না? তুই করলে যা ঠিক, আমি করলে তা ভুল কেন?’

-‘তুমি তো আর অ//মানুষ নও।’

-‘মানছিস্ তোরা অ//মানুষ? গ্রেট…। তোদের মাথায় এই বুদ্ধিটা কোথা থেকে আসলো?’

-‘খরচ কমছিল না তো।’

-‘তাইবলে ফুপিকে বাড়ি থেকে বের করে দিবি? তোর টাকার দরকার তুই আমাকে বলে দেখতি। যতদূর জানি, রাহা আসার পর থেকে ফুপির দেখাশোনা ও-ই করেছে। তাহলে তোদের খরচটা বাড়ল কোথা থেকে? হিসেব দেখা আমাকে।’

শর্মী আমতা-আমতা শুরু করল। বিপদ এইভাবে ঘাড়ে আসবে কে জানত। রওনক তো বলেছিল, সে আতিকা জাহানকে বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত রেখে এসেছে। এখন তো দেখা যাচ্ছে উলটো। খবরটা সবার কানে পৌঁছে গেছে। সে অসহায় কণ্ঠে কিছু বলতে চাইলে শামীম তাকে বাঁধা দিয়ে বলল,

-‘রাহার জীবনটা নষ্টের জন্য তুই দায়ী। শুধু তোর খামখেয়ালী আর জোরাজুরির জন্য ইফতির মতো একটা অ//মানুষের ঘরে যেতে হয়েছিল ওকে। আজ যখন মেয়েটা একটু সুখের মুখ দেখেছে, তখনই তোর হিংসে শুরু হয়ে গেল? যদি কোনোদিন তুই এমন পরিস্থিতিতে পরিস্, কীভাবে সামলাবি নিজেকে? যদি আমি ও তোর ভাবী তোর জন্য ওই বাড়ির দরজা বন্ধ করে দিই, তুই ওখানে পা ফেলতে পারবি? পারবি না।’

-‘কী বলছ ভাইয়া? মাথা ঠিক আছে তোমার?’

-‘আমার মাথা ঠিকই আছে। তোদের মাথা ঠিক নেই। আজ একটা কথা বলে যাই, ফুপিকে স্ব-সম্মানে বাড়িতে ফিরিয়ে না এনেছিস্ তো ওই বাড়ির দরজা তোর জন্যও বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদেরকেও মৃ//ত মেনে নিবি। কথাটা মনে রাখিস্।’

শর্মী আঁৎকে উঠল। ভাইয়ের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে লাফ দিয়ে দূরে সরে গেল শামীম। মেজাজ ধরে রেখে বলল,

-‘সর এখান থেকে, নয়তো আরও দুটো দেব। জানো//য়ার কোথাকার।’

ফের রুহামার দিকে তাকিয়ে বলল,
-‘তুই আমার সাথে চল। এখানে তোর কোনো কাজ নেই।’

-‘কিন্তু ভাইয়া, মা…।’

-‘ফুপির কথা ভাবতে হবে না। বাবা রাহার বাড়িতে আছেন। কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন। এই পা//পীদের উপযুক্ত শা//স্তি না হওয়া পর্যন্ত তুই বা ফুপি, দু’জনের কাউকে এখানে থাকতে হবে না। কী হলো, যা। তাকিয়ে আছিস্ কেন?’

না চাইতেও যেতে হলো রুহামাকে। ক’দিন এদের চোখের সামনে থেকে সরে থাকতে পারলেই তার শান্তি। দু’জনে চলে যাওয়ার পর শর্মীর নাকিকান্না শুরু হলো। যেভাবে পারছে রওনককে গা//লি দিচ্ছে। কথা শোনাচ্ছে। তার ভাষ্যমতে এসবের জন্য রওনক দায়ী। সব প্ল্যান নষ্ট হওয়ার রাগ মেটাল রওনকের ওপর। ধুমধাম শব্দে কিছু থালাবাসন ভাঙল। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-‘মাথামোটা। কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। কী করতে বলেছি তোমাকে? আর তুমি কী করে এসেছ? ঝামেলা দূরে সরাতে বলেছি অথচ তুমি আরও ঝামেলা আমার কাঁধে এনে ফেলেছ। বেকুব। তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। কোথায় ভাবলাম একটু শান্তিতে থাকব, তোমার জন্য তা-ও হলো না।’

রওনক নিজেও সমানতালে চেঁচিয়ে বলল,
-‘আমি কীভাবে জানব ওরা মাকে পেয়ে যাবে? তোমার জন্য সব সুখ এনে দিচ্ছি আমি। তা-ও তোমার হচ্ছে না? সামলাতে না পেরে এখন মেজাজ দেখাচ্ছ আমাকে?’

-‘বেশি কথা বলবে না। তোমার জন্য বাড়ির দরজায় পা ফেলতে পারব না আমি। অসহ্য…। সামান্য একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারে না। আবার গলাবাজি করতে আসে।’

-‘মুখ সামলে কথা বলো শর্মী। বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

আবার চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে গেল শর্মী। এভাবে কাজ হবে না। যা কিছু করার, তাকে একাই করতে হবে। এমনকিছু করবে, যেন সাপও ম//রে, লাঠিও না ভাঙে।

***

বাড়িতে পা রাখার পরপরই আহাদুজ্জামান জানালেন তিনি বোনকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলেই রুদিতার শ্বশুরবাড়িতে এসেছেন। মামার হুকুম শোনে তাৎক্ষণিক কিছু বলার সাহস পেল না রুদিতা। মায়ের মনোভাব বুঝার চেষ্টা করল। মেয়ের বাড়িতে পা রেখে লজ্জায়, সংকোচে মাথা নিচু করে রাখলেও হোসনা বেগমের ভালোবাসা প্রকাশের ধরন দেখে সবটুকু মনোঃকষ্ট দূর হয়ে যেতে লাগল তাঁর। যখন ভাইকে দেখলেন, প্রথমেই বসার অনুমতি দিলেন। আহাদুজ্জামান ফিসফিস করে আদেশের স্বরে বললেন,

-‘আমি বেঁচে থাকতে তুই এখানে থাকবি, সেটা হতে দেয়া যায় না। এখানে থাকা লজ্জার। বুঝিস্ না? আমার ওখানে চল। রওনকের ব্যবস্থা আমি করছি।’

মামার মুখে এরূপ কথা শোনে রুদিতা বলল,
-‘এখানে থাকা লজ্জার নয়, মামা। বরং তোমার ওখানে যাওয়াটাই লজ্জার হবে। আমার ভাই একা মাকে তাড়িয়ে দেয়নি, তোমার মেয়েও ছিল। ওই বাড়িতে আমার মায়ের যতটা অধিকার, তোমার মেয়েরও ততটাই অধিকার। তা-ই মায়ের ওখানে যাওয়ার চেয়ে এখানে থাকাই সহজ সমাধান। ওখানে গেলেও ওইটুকু অধিকারের জোরে আজ না হোক কাল তোমার মেয়ে মাকে কথা শোনাবে। আর মা, চুপ থেকে চোখের পানি ফেলবে।’

-‘তাই বলে আমার বোনকে এখানে রেখে যাব? আমি শান্তি পাব? শর্মীর এতটাও সাহস হবে না যে, আমার সামনে আমার বোনকে কিছু বলবে।’

-‘স্বামীর সামনে যে মেয়ে শাশুড়িকে কথা শোনায়, তাকে খারাপ সাজায়, তার কাছে বাবার শাসন কিছুই না। সে বাবার সামনেও ওই কাজটা করতে পারব্র।’

-‘তুই আমাকে ভরসা করছিস্ না?’

-‘কথাটা ভরসার নয় মামা, সম্মানের। আমি আমার মায়ের সম্মানে আর আঘাত লাগতে দেব না। যা হয়েছে, হয়ে গেছে। এই নিয়ে আর কাদা ছোড়াছুড়ির দরকার নেই।’

আহাদুজ্জামান বিষয়টা নিয়ে ভাবলেন। বোনকে এখানে রেখে যাওয়ার কোনো যুক্তি তিনি খুঁজে পেলেন না। যে বাড়ি থেকে ছেলে ও ছেলের বউ তাঁকে তাড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে বোন আর মরে গেলেও যাবেও না, এটা নিশ্চিত। তাই বলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে রেখে যাবেন। খারাপ লাগছে ভদ্রলোকের। মেয়েকে সঠিক শিক্ষা দিতে পারেননি, এরজন্য আফসোস হচ্ছে। তাঁর চেহারায় ঘোর অমাবস্যা নেমে এসেছে। রুদিতা মামার পাংশুমুখ দেখে বলল,

-‘তুমি চিন্তা করো না, মামা। মা এখানে ভালো থাকবে।’

-‘আমি ভেবে পাচ্ছি না, ওরা এই কাজটা কেন করল? ওদের নামে মা//মলা করা উচিত।’

দু’হাতে ভাইয়ের হাত আঁকড়ে ধরলেন আতিকা জাহান। অনুরোধের স্বরে বলল,
-‘তুমি এমন কিছু করো না, ভাইজান। বাচ্চাদের জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। আমি চাই না, বড়োদের ভুলের জন্য বাচ্চারা শাস্তি পাক। ওদের বাবা-মায়ের ভালোবাসার প্রয়োজন।’

-‘আশ্চর্য! তোকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে ওরা। আর তুই ওদের হয়ে সাফাই গাইছিস্? এখনও? ওদের শা//স্তি হওয়া উচিত।’

-‘থাক্ ভাইজান। আর কোনো শা//স্তির প্রয়োজন নেই। এতে মানুষজন খারাপ বলবে। ওরা যা করেছে, ভুল করেছে। আমি ওদের ভুল ক্ষমা করে দিয়েছি।’

রুদিতা মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল। এই হচ্ছে মা। শত অপরাধ করলেও সন্তানদের অপরাধ এই মায়েরা ক্ষমা করে দিতে জানে। সে একরকম ত্যাড়াব্যাকা স্বরে বলল,

-‘সব ভুল ক্ষমা করা যায় না, মা। আমি তো জীবনেও ওদের ক্ষমা করব না। এই অপরাধের জন্য ওদের দু’জনেরই শা//স্তি পাওয়া উচিত।’

-‘তুই এত কথা বলছিস্ কেন? যা এখান থেকে। বাচ্চাদের দেখ গিয়ে।’

মায়ের এই অতি উদারতা মোটেও সহ্য হলো না রুদিতার। সরে এসে চুলোয় চা বসাল। উষাদ তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘এই মুহূর্তে তুমি কিছু বলতে যেও না, মা’কে সিদ্ধান্ত নিতে দাও।’

-‘আমার তো ইচ্ছে করছে ভাইয়ার নামে একটা মা//মলা করে আসি।’

-‘তুমি চাইলেও সেটা করতে পারবে না। কারণ মা, সন্তানের ভুলটাকে ক্ষমার চোখে দেখছেন। তিনি ভাবছেন, সন্তান আজ ভুল করেছে, কাল ঠিকই ভুল শোধরে নেবে। ভুলটা শোধরানোর জন্য তাকে সময়-সুযোগ দুটোই দেয়া উচিত।’

-‘আপনিও এই ভুলটাকে ক্ষমার চোখে দেখছেন?’

-‘মোটেও না। আমি মায়ের দিক ভেবে কথাটা বলছি। আমি তো চাই, তোমার ভাইয়ের একটা কঠিন শা//স্তি হোক।’

রুদিতা ভেবে পেল না, মা না চাইলে ভাইকে কীভাবে সে শা//স্তি দিবে? হিসাব এই দাঁড়াল, যদি মা//মলা করেও মা ঠিকই বলবেন, তার সন্তানকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। যদি এমন হয়, তবে রওনককে কোনোভাবেই উচিত শিক্ষা দেয়া হবে না। সামনে কোনো উপায় দেখল না রুদিতা। আনমনে বাচ্চাদের দিকে তাকাল। এইযে, দু’হাতে যত্ন করে বাচ্চাদের লালন-পালন করছে, ওরা যদি কোনোদিন এরূপ আচরণ করে, সে মা হয়ে বাচ্চাদের ক্ষমা করে দিবে? দৃষ্টি সরিয়ে মা ও মামাকেও একনজর দেখল। তিনি একাধারে ভাইকে অনুরোধ করে যাচ্ছেন, যেন ভাই কোনো আইনী পদক্ষেপ না নেন। এভাবে চুপ থাকা তো কখনওই কোনো সমাধানের কথা হতে পারে না। কী করবে সে? হিসাব মিলাতে পারল না রুদিতা। জানতে চাইল,

-‘এখন আমার কী করা উচিত? যা বুঝলাম, মা//মলা করলেও মা সাক্ষী দিবেন না। তার কাছে সন্তান সবার আগে। যদি সে সন্তান দোষীও হয়, তবুও তিনি সন্তানের পক্ষেই থাকবেন।’

-‘এটাই। তোমাদের যা করতে হবে। সব কাজে ভাইয়াকে অবহেলা করবে। পাত্তা দিবে না। সে তোমাদের কেউ না। এমন যে, তাকে তোমাদের আর প্রয়োজন নেই। নিজেদের জন্য তোমরা নিজেরাই যথেষ্ট।’

-‘এভাবে কী হবে?’

-‘অবহেলা সহ্য করতে না পেরে, একসময় ঘুঘু ফাঁদে ঠিকই পা দিবে।’

-‘এই ধরনের কাজ যারা করে তারা জীবনেও অনুতপ্ত হয় না। আমি তো ভাইয়াকে কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারব না।’

-‘আচ্ছা বাদ দাও। ওনাদের চা-নাশতা দাও আগে। আমি বাচ্চাদের দেখছি।’

***

আহাদুজ্জামান বলে গেছেন, কাল সকালে এসে বোনকে নিয়ে যাবেন তিনি। আতিকা জাহানও রাজি হয়ে গেছেন। মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে এক সপ্তাহ থাকা যায়, বেশি হলে পনেরোদিন, মাসের পর মাস তো আর থাকতে পারবেন না। নিজের একটা সম্মান আছে। সেই সম্মানের কথা ভেবেই তিনি বাবার বাড়িতে যাওয়ার মনস্থির করলেন। রাতে ঘুমোনোর সময় মাকে অনেক বুঝাল রুদিতা। তবুও আতিকা জাহান মানতে নারাজ। তিনি সকালেই ভাইয়ের বাসায় চলে যাবেন। এসব শোনে রেগেমেগে রুদিতা বলল,

-‘আমি বুঝলাম না, এখানে থাকতে তোমার কী সমস্যা?’

-‘তুই ওসব বুঝবি না। ভাইজানকে কথা দিয়েছি, ফিরাতে পারব না। এখন আর এত ঘ্যানঘ্যান করিস্ না। ঘুমা গিয়ে। এখানে থেকে কী ভাবব আমি? রুহামার বিয়ে দিতে হবে না?’

-‘সেসব তো আমার চিন্তা। তুমি কেন চিন্তা করবে?’

-‘তুই তো বাচ্চা নোস্, বুঝিস্ না কেন? আজ বাদে কাল লোকে নানান কথা বলবে।’

-‘লোকের মুখে আমি তালা মে//রে দেব।’

-‘বলা সহজ, করা অনেক কঠিন রাহা।’

-‘তাই বলে তুমি চলে যাবে? এখানে থাকবে না? তুমি আমার কথাটা একবার চিন্তা করো।’

-‘করছি বলেই বলছি।’

-‘ঘোড়ার ডিম করছ। আমার চিন্তা করলে তুমি ওখানে যেতে চাইতে না।’

মুখ বাঁকিয়ে রইল রুদিতা। আতিকা জাহান বললেন,
-‘বোকা মেয়ে। খামোখা রাগ করছিস্। আমি আসব তো। মাঝেমধ্যে ঘুরতে আসব। তোকে না দেখে শান্তি পাব?’

-‘সত্যিই আসবে?’

-‘হ্যাঁ, আসব। এখন যা, ঘুমা।’

রুদিতা দূরে গেল না। মশারি টানিয়ে মায়ের পাশেই শুয়ে পড়ল। মাকে একহাতে জড়িয়ে রেখে বলল,
-‘আজ আমি তোমার পাশে ঘুমোই?’

দাঁত কটমট করে তাকালেন আতিকা জাহান। রুদিতা আহ্লাদী হয়ে মায়ের পাশ ঘেঁষে চোখ বন্ধ করে রইল। তিনি বললেন,

-‘এটা কেমন কথা? যা। বাচ্চারা নিশ্চয়ই তোকে খুঁজছে।’

-‘ওরা ঘুমোচ্ছে মা।’

-‘বাচ্চাদের বাবা নিশ্চয়ই জেগে আছে।’

-‘উফফ্, বড্ড বিরক্ত করছ। ঘুমোতে দাও।’

মেয়ের অভিমান, জেদ টের পেয়ে আর কিছু বললেন না আতিকা জাহান। মাথায় হাত বুলিয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে লাগলেন। শেষ রাতে যখন ঘুম ভাঙল, তখন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ার জন্য অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়ালেন।

আযানের পর ঘুম ভাঙল রুদিতার। দেখল, আতিকা জাহান নামাজ পড়ছেন। সে নিজেও অজু করে ফজরের নামাজ পড়ে রুমে গেল। উষাদ ঘুমোয়নি। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে সে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছিল। এখনও আলো ফুটেনি। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে শুধু। পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল রুদিতা। পিঠে মাথা ঠেকিয়ে বলল,

-‘স্যরি…।’

মুখোমুখি হলো উষাদ। অর্ধাঙ্গিনীর দিকে হাসিমুখে তাকাল। বিষাদ কেটেছে। ঝরঝরে লাগছে তাকে। দু’হাতের আঁজলায় মায়াবী মুখখানি আগলে নিয়ে আলগোছে কপালের মধ্যিখানে অধর ছুঁয়ে বলল,

-‘কষ্ট কমেছে?’

-‘একটু।’

-‘সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করো না।’

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নির্ভয়ে ভরসার আশ্রয়ে মাথা ঠেকাল রুদিতা। খানিকক্ষণ জড়িয়ে থেকে চুপ করে রইল। উষাদ বলল,

-‘এখনও খারাপ লাগছে?’

-‘উঁহু…। কথা বলছেন কেন? চুপ থাকুন না।’

উষাদ চুপ থাকতে পারল না। কণ্ঠে একরাশ ভাব-ভালোবাসা এঁটে বলল,
-‘চুপ থাকতে পারি, যদি একটুখানি সুযোগ-সুবিধা পাই…।’

-‘কীসের?’

-‘যদি বলি, আমি সম্পর্কটাকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে চাই। অনুমতি পাব? যদি এক’পা বাড়াই, তুমি কি বাঁধা দিবে?’

-‘অনুমতি না দিলে নিজেকে থামিয়ে রাখবেন?’

-‘জোর করে পুরুষত্ব দেখিয়ে নিজেকে কাপুরষ প্রমাণ করতে চাই না। আমি আমার বউয়ের কাছে আজীবন একজন সুপুরুষ থাকব, কথা দিচ্ছি।’

নিঃশব্দে হাসল রুদিতা। কথা বলল না। নীরবতা দেখে উষাদ জানতে চাইল,
-‘কথা বলছ না কেন?’

-‘কী বলব?’

-‘হ্যাঁ অথবা না, কিছু একটা বলো।’

-‘সব কথা মুখে বলতে হবে কেন?’

উত্তর খুঁজতে অর্ধাঙ্গিনীর চোখের পানে তাকিয়ে মায়াবী চোখের ভাষায় ডুবে ডুবে ভাসতে লাগল উষাদ। বামহাতে আলতো স্পর্শে ছুঁয়ে দিল গাল। এমন আদুরে স্পর্শের কাছে লজ্জাবতী লতার ন্যায় নেতিয়ে গেল রুদিতা। দুটো হাত ঠেকল প্রশস্ত বক্ষে। নিশ্চুপে পবিত্র সম্পর্কটাকে আগলে নিতে চাইল। রুদিতার নীরবতা ও লজ্জাকে একধাপ বাড়িয়ে দিয়ে শব্দ করে চুমু খেল বাম গালে। একটু একটু করে পুরো মুখজুড়ে ছড়িয়ে দিল ভালোবাসার উষ্ণতা। অজস্র ছোটো ছোটো চুমুর বন্যা বইয়ে দিল। বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল কয়েকটা পানি। উষাদ ঘাবড়ে গিয়ে চোখ মেলল। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে অর্ধাঙ্গিনীর মনোভাব বুঝার চেষ্টা করল। কিন্তু রুদিতার নীরবতাতে কিছু বুঝার উপায় রইল না। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,

-‘কষ্ট দিয়ে ফেললাম?’

রুদিতা চোখ খুলল। প্রগাঢ় চোখে চেয়ে থেকে বলল,
-‘বুঝতে পারছেন না?’

-‘চেষ্টা করছি। কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছি।’

বুকের কাছে থাকা হাত দিয়ে টি-শার্ট আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরল রুদিতা। নীরবে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তখনও এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। সেটুকু মুছে নিতে চাইল না মেয়েটা। আবেগকে আজ প্রশ্রয় দিতে ইচ্ছে করছে। সব কথা নীরব থেকে বুঝিয়ে দিতে মন চাইছে। অথচ তার এই নীরবতা ভীষণরকম অপরাধবোধের জন্ম দিচ্ছে উষাদের মনে। সে একইভাবে জানতে চাইল,

-‘বললে না তো।’

-‘কিছু বলার নেই।’

-‘আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না।’

-‘আমার কষ্ট হচ্ছে না।’

-‘তবে কাঁদছ যে!’

-‘সব কান্না দুঃখের হয় না।’

উষাদের মুখে হাসি নেমে এলো। দু’হাতের আঁজলায় রুদিতার কান্নারত মুখখানি তুলে ধরল সামনে। গভীরচিত্তে চেয়ে থেকে বলল,

-‘আমায় বিশ্বাস করো?’

-‘অনেক।’

ধৈর্যের সাথে আটকে রাখা সবটুকু ভালোবাসাকে আজ মুক্ত করে দিল উষাদ। কপালে কপাল ঠেকিয়ে গভীরভাবে শ্বাস টানল। মোহমায়া জড়ানো গলায় ডাকল,

-‘রাহা…।’

-‘হু।’

-‘স্নেহ-মায়া-মমতা এসব খুব বিচিত্র জিনিস। এগুলোকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, আবার ছাড়াও যায় না। শুধু অনুভবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। ভালোবাসার অনুভূতিটাও ঠিক তেমনই রাহা। আমি এই অনুভূতিটাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে চাই।’

-‘রাখুন না, কে নিষেধ করল?’

-‘তুমি আমার শূণ্য হৃদয়ের একটুকরো স্বচ্ছ অনুভূতির নাম। আমার তৃষ্ণার্ত অন্তরের একটুখানি প্রশান্তির নাম। চিরকাল আমার থাকবে তো?’

এত যত্ন করে কেউ ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে, সম্পর্ক ও মানুষকে সম্মান দিয়ে, মন ছুঁয়ে দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করে হৃদয় সিংহাসনের দখলদারি নিতে পারে, জানত না রুদিতা। আজ দেখল। অনুভব করল। নির্দ্বিধায় অধরোষ্ঠ ছুঁয়ে দীর্ঘ প্রলম্বিত চুমু এঁকে উত্তর জানিয়ে দিল,

-‘আমি বিশ্বাস করি, ভরসা ও বিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার প্রতিশ্রুতি নেয় যে মানুষ, সে আমৃত্যু তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, বাঁচিয়ে রাখবে অনুভূতিকেও।’

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে