#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – চৌদ্দ
-‘নাড়ির টানটাকে এইভাবে অপমান করলি, রওনক? এত সহজেই মিথ্যে করে দিলি সম্পর্কটাকে?’
তখন বৃদ্ধাশ্রমের প্রবেশদ্বারে গাড়ি থামাতেই ছেলের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছিলেন আতিকা জাহান। কাঁদেননি, হাসেননি, এমনকি বকেননি পর্যন্ত। শুধু নিজের ভাগ্যের হিসেব মিলিয়ে আফসোস করছিলেন। তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, ছেলে এই কাজটা করেছে। তাঁকে ঘরছাড়া করে বৃদ্ধাশ্রম অবধি নিয়ে এসেছে। রওনক মায়ের এই মনমরা স্বর শোনে বলেছিল,
-‘কী করব বলো তো? তোমার মেয়েরা তো সম্পত্তি দিচ্ছে না। তুমিও তাদের গলায় ঝুলিয়ে রেখে শান্তি পাচ্ছ। যেহেতু তুমি কিছু করছ না, করবেও না, তা-ই ভাবলাম, ঝামেলাটা আমি-ই শেষ করি।’
-‘আমি ভেবেছিলাম তুই মানুষ হয়েছিস্। কিন্তু তুই যে আস্তো একটা প//শুতে পরিণত হয়েছিস্, তা আজ স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হলো আমার। ভাগ্যিস্, তোর বাবা আজ বেঁচে নেই। মৃত বলে আজকের এই দৃশ্য মানুষটার চোখ এড়িয়ে গেল। নয়তো তোর মতো ছেলের এই চেহারা দেখার পর, জ্যান্ত পুঁ//তে ফেলতেন। আমি তো মা। তা-ই কিছু করতে পারছি না। যে হাতে মানুষ করেছি, সে হাতে চ//ড়-থা//প্প//ড় মা//রা গেলেও সন্তানকে খু//ন করা যায় না। ভাগ্য তোর সহায় হোক। ভালো থাকিস্ তোরা।’
-‘বেশি কথা বলো না তো। ভেতরে এগোও।’
আতিকা জাহান বাঁধা প্রয়োগ করে শুনিয়েছিলেন,
-‘এতটুকু রাস্তা আমি একা যেতে পারব। তুই যা। তোকে আর প্রয়োজন হবে না আমার। সব প্রয়োজন তো আজ ফুরিয়ে গেছে।’
-‘আহা, ফুরোয়নি। আমি মাসে মাসে এসে তোমাকে দেখে যাব।’
-‘অনেক দেখেছিস্, বাপ। আর দেখার দরকার নেই। তুই না দেখলেও আমি বাকিপথ চলতে পারব।’
রওনক আর পিছু ফিরে তাকায়নি। মাকে ওখানে ফেলেই সে চলে গিয়েছিল, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে। আতিকা জাহান কয়েক মুহূর্ত সময় বৃদ্ধাশ্রমের প্রবেশ পথ দিয়ে ভেতরটা দেখছিলেন। কত নারীদের হা-হুতাশ যে তাঁর চোখে পড়ল। কত পুরুষের চোখের পানি নজরে এলো। সবকিছু দেখে তিনি আর সেখানে দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছিলেন না। কী ভেবে যেন ভেতরে না গিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করলেন। তপ্ত দুপুরে তাঁর মাথায় তখন ছাদ ছিল না, ছিল প্রখড় রোদের তাপ। যা সহ্য করা দায় হয়ে পড়েছিল। তবুও তিনি ছুট দিলেন। যেপথে দু’চোখ যায়, সে’পথে।
ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত আতিকা জাহান, ফুটপাতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে মানুষের নজর থেকে বাঁচতে চাইলেন। তবুও কেউ কেউ উৎসুক দৃষ্টিতে তাঁকে দেখল। একজন রিকশাওয়ালা জানতে চাইল,
-‘আপনি কই যাইবেন খালা? আসেন, আমি নিয়া যাই।’
মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছলেন আতিকা জাহান। অসম্মতি জানিয়ে বললেন,
-‘আমি এখানেই ঠিক আছি, বাবা।’
চারিদিকে অসংখ্য মানুষ থাকলেও, কারও দিকে কারও নজর নেই। কেউ বিপদে পড়ল কি-না, কারও সাহায্যের দরকার কি-না, এসবে এখন মানুষ আগ্রহ দেখায় না। স্বার্থে ভরা এই সমাজের প্রত্যেকটা মানুষ নিজের লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেই চলে। যেখানে সন্তানেরা হয়ে যায় পর, সেখানে রাস্তার অপরিচিত মানুষ কীভাবে হবে আপন? আতিকা জাহানের না শোনে রিকশাওয়ালাও আর আগ্রহ দেখাল না। প্রত্যেকের টান আছে, পেটের টান। এই টানের জন্যই তো কর্মের খোঁজে ছুটে চলে মানুষ। কার দায় পড়েছে, যেচে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বলবে, ‘আসুন আজ থেকে আপনার সব দায়িত্ব আপনার।’ এতটুকু বলার মতো সৎ সাহস ও মানসিকতা এই সমাজের মানুষের মধ্যে নেই। যদি থাকত, সন্তান এত পর হতো না।
মিছেমিছি আরও কতসব ভাবনাকে মনে ঠাঁই দিয়ে ফুটপাত থেকে উঠে দাঁড়ালেন আতিকা জাহান। কাছেই একটা ব্রিজ। নিচে বিশাল এক নদী। মৃ//ত্যুর জন্য একদম উপযুক্ত একটা জায়গা। এই বয়সে এসে আত্ম//হত্যার মতো এমন জঘন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কোনোকালেই ভাবেননি আতিকা জাহান। ভাগ্য তাকে আজ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। তখন তাঁর মনের মধ্যে তখন একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বার বার আওড়ে যাচ্ছিলেন,
-‘যে মা সন্তানের কাছে বোঝা হয়ে যায়, সে মায়ের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। একমাত্র মৃ//ত্যুই আমাকে সব জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে।’
মানুষ কতটা অসহায় হলে মৃত্যুকে সহজ সমাধান হিসেবে বেছে নিতে পারে, তা কিছুক্ষণ আগে অবধি বুঝতে পারেননি আতিকা জাহান। এখন টের পাচ্ছেন। এই পৃথিবী থেকে যারা আত্ম//হত্যার মাধ্যমে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা আসলে মরার জন্য মরে না। বাঁচার জন্য মরে। সমস্ত ভুলচুক ও পাপকে যখন অসহ্য ঠেকে, সংসার-সমাজ, সন্তানদের চাহিদা যখন ফুরিয়ে আসে, তখনই কেউ কেউ বাধ্য হয়ে মুখ লুকাতে আত্ম//হত্যা করে। শেষ একবার তিনি ডানে-বামে তাকালেন। হাজারও কৌতূহলী দৃষ্টি তাঁকে দেখছে ঠিকই, কিন্তু কেউ জানতে চাইছে না তাঁর মনের মধ্যে কী চলছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলে মনের সবটুকু যন্ত্রণাকে উগড়ে দিলেন আতিকা জাহান। বিড়বিড় করলেন,
-‘আমার মৃত্যুর মাধ্যমেই তোরা সুখকে খুঁজে নে। তোর মতো কুলা//ঙ্গার ছেলের জন্ম দিয়ে যে পাপ আমি করেছি, সেই পাপ থেকে আজ স্বেচ্ছায় মুক্তি নিচ্ছি। দুনিয়াতে না হোক, আখেরাতে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি তোকে করতেই হবে রওনক। নয়তো তোর মুক্তি নেই।’
***
রুহামা চোখে এখন অন্ধকার দেখছে। কাছেপিঠে যে দুটো বৃদ্ধাশ্রম ছিল, সেসব দেখা শেষ। তবুও কোথাও মায়ের কোনো চিহ্নই সে খুঁজে পায়নি। একটা সময় টিকে থাকতে না পেরে, রওনককে কল করল। বেশ কয়েকটা কল করার পরও যখন ভাই ফোন রিসিভ করল না তখন শুধু একটা ম্যাসেজ পাঠাল,
-‘মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। দুটো বৃদ্ধাশ্রম দেখা শেষ। তুমি মাকে কোথায় রেখে এসেছ, আমি জানি না। শুধু একটা কথা বলি, আজ না হোক কাল, শাস্তি তুমি পাবেই। মামার কাছে যাচ্ছি। দেখি, মামা কীভাবে আদরের মেয়ের বিচার করেন।’
পুরো ম্যাসেজের মধ্যে রওনকের টনক নড়ানোর জন্য ‘মামা’ নামক শব্দটাই যথেষ্ট। ওই এক ব্যক্তিকে জমের মতো ভয় পায় রওনক। যে সমস্যা এসে সামনে দাঁড়িয়েছে, তার সমাধান ওই ব্যক্তির কাছেই আছে। মা হারিয়ে যাক কী মারা যাক, এতে রওনক মোটেও বিচলিত হবে না। সামান্যতম বিবেকও তাকে ভুল-সঠিকের পার্থক্য বুঝাতে আসবে না। সে শুধু বুঝে, শর্মী তার সব।
ম্যাসেজ পাঠিয়ে আর কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে রাস্তায় বসে পড়ল রুহামা। দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ভেতর কাঁদছে মায়ের জন্য। মাকে একনজর দেখার জন্য ছটফট করছে তার অন্তর। মায়ের কোলে মাথা রাখার জন্য, মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে যাচ্ছে। কান্নাকাটি থামিয়ে অনেক ভেবেচিন্তে নিজের মামাকে ফোন করল রুহামা। তিনি ফোন রিসিভ করে ভালো-মন্দের খবর জানতে চাইলেই রুহামা কান্নামাখা স্বরে বলল,
-‘সব শেষ হয়ে মামা। ভাইয়া-ভাবী মিলে মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আমি মাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’
বোন বড়ো আদরের সম্পদ। এই সম্পদের উপর আঁচ পড়লে ভাইয়ের যে কী কষ্ট হয়, বোন পা//গ//ল ভাই যারা, এটা শুধু তারাই জানে। আহাদুজ্জামানকে দুর্বল করার জন্য বোনের উপর উড়ে আসা একটা বিপদ সংকেতই যথেষ্ট। শক্তপোক্ত মানুষ হয়েও মুষড়ে পড়লেন তিনি। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন,
-‘কী বলছিস্, মা! শর্মী কেন এই কাজ করবে?’
রুহামা আর চেপে রাখতে পারল না কোনো কথা। হাপুসনয়নে কাঁদতে কাঁদতে সবকিছু বলে দিল তার মামাকে। তিনি বড্ড অসহায় গলায় বললেন,
-‘এতদিন এসব বলিসনি কেন তোরা?’
-‘মা কিছু বলতে দেয়নি মামা।’
-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি দেখছি। তুই বাড়ি যা।’
-‘কোথায় যাব মামা? ওই বাড়ি যে আমার জন্য ন//র//ক হয়ে উঠেছে। মাকে ছাড়া কীভাবে যাব?’
-‘তুই এক কাজ কর। আপাতত তোর মামীর কাছে আয়। আমি থানায় যাই আগে। একটা মিসিং ডায়রী লিখাই। শামীমকে পাঠাচ্ছি। ও খুঁজুক আতিকাকে। তুই আর রাস্তায় থাকিস্ না।’
‘ঠিক আছে’ বলে ফোন রেখে দিলেও মামার বাড়িতে যাওয়ার আগ্রহ পেল না রুহামা। রাস্তায়ই রইল। হন্যে হয়ে মাকে খুঁজতে নামল। এদিক-ওদিক দৌড়াতে দৌড়াতে যখন রাস্তা পার হয়ে ওপারের ফুটপাতে যাবে, তখনই ঘটল বিপত্তি। বেখেয়ালি আচরণের ফলে সে ভুলে গেল, সামনেপিছনে গাড়ি আছে। হুঁশে ফিরল হাতের বাহুতে মারাত্মক টান খেয়ে। একদম ছিঁটকে পড়ল ফুটপাতের একপাশে। ভয়ে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল রুহামা। চোখ মেলে দেখল, সে ফাহাদের উপরে আছে। তড়িঘড়ি সরে পড়ল। ফাহাদ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল,
-‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার? এটা রাস্তা। আপনার বাড়ির উঠোন নয় যে, যেমন খুশি তেমন দৌড়াবেন। এটা মেইন রোড স্টু//পিড।’
রুহামার অভিব্যক্তি ঠিক বুঝল না ফাহাদ। শুধু মেয়েটাকে কাঁদতে দেখল। অবাক হয়ে জানতে চাইল,
-‘ব্যথা পেয়েছেন কোথাও?’
কথা বলার আগ্রহ দেখা গেল না রুহামার মাঝে। মেয়েটা শুধু একপলক তাকাল। আবার ছুটতে চাইল। ফাহাদ হতবাক চোখে চেয়ে থেকে জোরপূর্বক আটকে রেখে জিজ্ঞেস করল,
-‘কী সমস্যা? কিছু জানতে চাইছি তো আমি। বেখেয়ালিতে গাড়ির সামনে পড়ে যাচ্ছিলেন। ব্যথা পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলাম, উত্তর দিচ্ছেন না। এভাবে কাঁদছেন কেন, বলবেন?’
দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল রুহামা। বলল,
-‘মাকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না।’
-‘খুঁজে পাচ্ছেন না মানে?’
বলতে না চাইলেও পরিস্থিতির চাপে পড়ে সব কথা ফাহাদকে খুলে বলল রুহামা। তারপর জানাল,
-‘আমি অনেক খুঁজেছি। সব জায়গায়। কিন্তু কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না।’
-‘আচ্ছা, ওয়েট। আমি দেখছি। থানায় জানিয়েছেন?’
-‘না। মামা জানাবেন। এতক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন হয়তো।’
-‘আপনার মামার বাড়ি কোথায়? এখান থেকে কতদূর? আপনার মা কি ওখানে যেতে পারেন?’
-‘মা ওখানে যাবেন না। ওখানে যাওয়ার চান্স অনেক কম। আর গেলেও এতক্ষণে মামা টের পেতেন।’
-‘এভাবে রাস্তায় তো মানুষ খোঁজা যায় না।’
-‘না খুঁজে উপায় নেই।’
বাঁধা না শোনে নিজের মতো করে ছুটতে শুরু করল রুহামা। ফাহাদও পিছন পিছন এগোলো। এই মেয়েটাকে একা ছাড়া যাবে না মোটেও। যেকোনো সময় গাড়ির নিচে পড়ে যাবে। অফিস থেকে বেরিয়েছিল সামান্য চা-নাশতা খাওয়ার জন্য। কিন্তু বিপত্তি ঘটাল অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। ঠিক সময় যদি সামনে না আসত, কী হতো কে জানে! পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,
-‘আপনার ভাইয়া, এমন একটা কাজ কেন করতে গেলেন?’
-‘ভাইয়া ওইরকমই। সবাইকে উচ্ছিষ্ট ভাবে।’
-‘আপনজনদের সাথে কেউ এসব করে? ভাই-বোন বোঝা হয় মানলাম, মা কীভাবে বোঝা হতে পারে?’
-‘সেটা যদি ভাইয়া বুঝত, তাহলে আজকের দিনটা আমাদের জীবনে আসত না। বিবেক-বুদ্ধি সব হারিয়ে বসে আছে ভাইয়া। সে শুধু বুঝে, সবকিছু তার নিজের। ওসবে আর কারও অধিকার নেই।’
-‘এই ধরনের মানুষের জন্যই, বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মায়ের শেষ আশ্রয় হয়, বৃদ্ধাশ্রম নামক জায়গায়। বাবা-মা আদর-যত্ন, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে, প্রতিদানে সন্তানেরা তাদের রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে। ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক।’
রুহামা অসহায় কণ্ঠে বলল,
-‘পা//পীদের কেন শা//স্তি হয় না বলুন তো?’
ফাহাদ উত্তর দিতে পারল না। উত্তরটা জানা নেই তার। সব পা//পীদের কি শা//স্তি হচ্ছে? শহরে এত এত বৃদ্ধাশ্রম, এত এত বাবা-মায়ের চোখের পানি। বুকভরা ভালোবাসার বিনিময়ে, লাঞ্চনা ও অপমানের চা//বু//ক। সব শুধু ভালো মানুষের ভাগ্যেই কেন থাকে? এই সমাজে থাকা রওনকের মতো এমন হাজারও অমানুষ, পা//পী আছে, তাদের কেন শা//স্তি হয় না? সবাই কেন দিনশেষে বুক ফুলিয়ে বাঁচে?
***
রুহামা যখন জানাল, রওনক মাকে বৃদ্ধাশ্রমের রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বাইরে এনে গাড়িতে তুলেছে। তখন থেকে অনেকক্ষণ যাবৎ স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ হয়ে বসেছিল রুদিতা। উষাদকে বলে গাড়ি থামিয়ে একটা সেইফ বাসায় বসেছিল। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল, রওনক এতটা নীচে নেমে গেছে। একটা মানুষ কবে এত অ//মানুষ, জানো//য়ার হলো, সেই হিসেব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে লাগল রুদিতা। ঘুরতে বেরিয়েছিল। সুখী ও সুন্দর দিনটা উপলব্ধি করতে চেয়েছিল। কিন্তু দিন অর্ধেক পেরোনোর আগেই সব সুখ তার অসুখে পরিণত হলো। দমবন্ধ করা মুহূর্ত আগলে নিয়ে, পাথরের ন্যায় অনড় হয়ে বসে রইল বেচারী। উষাদ প্রথমে বুঝল না। যখন ঘটনার বিস্তৃতি শুনল, তখন তার মাথায় শুধু একটা কথাই এলো,
-‘এ কেমন সন্তান! নিজের সুখের বিনিময়ে মাকে ঘর ছাড়া করে দেয়! প্রকৃত সুখ যে বাবা-মায়ের হাসিতে মিশে থাকে, এটা কবে বুঝবে মানুষ?’
এরপর থেকে রুদিতাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে উষাদ। সব সান্ত্বনা কান্নায় পরিণত হচ্ছে। বাচ্চারাও ছটফট করছে। অনেকটা সময় পর উষাদ বলল,
-‘তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় চলে যাও। আমি দেখি, কী করা যায়। কোনো উপায় খুঁজে পেলে…।’
রুদিতা কথাটা আমলেই নিল না। মাকে ছাড়া ঘরে ফেরা যে অসম্ভব। শান্তি, সুখ সবটাই তো মায়ের মাঝে। সে নিজের মতো করে বলল,
-‘আমরা মাকে খুঁজতে পারি না?’
-‘কোথায় খুঁজবে? শহরটা কি তোমার কাছে ছোটো মনে হচ্ছে? তবে একটা ডায়রী লেখাতে পারলে ভালো হতো। আর ওই নবাবজাদা ভাইকে উচিত শিক্ষা দেয়া দরকার। এমন শিক্ষা যা তাকে প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করাবে, সে পা//পী। ভয়ংকর পা//পী।’
ফোন বের করে রুহামার কাছে কল করল রুদিতা। ওপাশ থেকে মেয়েটা শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেই। কান্নার তালে কথা বোঝা যাচ্ছে না। বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘আশ্চর্য! ফ্যাচফ্যাচ করে না কেঁদে এটা বল যে, ভাইয়াকে কল করেছিস্ কি-না?’
-‘ভাইয়া কল রিসিভ করেনি। আমি মামাকে জানিয়েছি সবটা। শামীম ভাইয়া বেরিয়েছে।’
-‘আচ্ছা। আমি ভাইয়াকে কল করে দেখছি।’
অশান্তি নিয়েই ভাইয়ের নম্বরে ফোন দিল রুদিতা। দু’তিনবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো। ত্যক্তবিরক্ত গলায় রওনক বলল,
-‘তোদের জ্বালায় ম//রেও শান্তি পাব না আমি। কেন বিরক্ত করছিস্ বার বার?’
-‘তোমার ম//রে যাওয়াই উচিত। যদি সামনে পেতাম, খু//ন করে ফেলতাম। কিন্তু আমি তো তোমার মতো অ//মানুষ নই, তাই সেটা করতেও বাঁধবে। আমার মাকে কোথায় রেখে এসেছ তুমি?’
-‘তোর মা কোথায় আছে আমি কী জানি? অনেকদিন কাঁধে বোঝা নিয়ে ঘুরেছি বুঝলি, এবার একটু শান্তি পাচ্ছি।’
-‘ছিঃ ভাইয়া। এভাবে বলতে আটকায় না মুখে?’
-‘আটকাবে কেন? ঘর খালি হয়েছে বুঝিস্ না?’
-‘মায়ের দায়িত্ব নিতে পারবে না, এটা তুমি আমাকে বলতে। আমি মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসতাম। কেন এই জঘন্য কাজ করলে তুমি?’
-‘ফালতু কথা বলার জন্য ফোন করেছিস্? জম্পেশ খানাদানা চলছে, এখন এত বকবক করতে পারব না। রাখ্ ফোন।’
-‘খাচ্ছ না? তৃপ্তিভরে খাচ্ছ? খাওয়াচ্ছি। নারী নি//র্যাত//নের মা//মলা যদি না করেছি তো আমার নাম রুদিতা নয়। মনে রেখো।’
-‘তোদের যা খুশি তোরা তাই কর।’
-‘মাকে কোথায় রেখে এসেছ?’
-‘ধ্যাত্তেরি…।’
বিরক্তিকর স্বরে বৃদ্ধাশ্রমের ঠিকানা জানিয়ে লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিল রওনক। রুদিতা উঠে বসল গাড়িতে। ড্রাইভারকে ঠিকানা বলে রুহামাকেও জানিয়ে দিল। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য। সেখানে গিয়েও মায়ের কোনো চিহ্ন পেল না। গেটের কাছে পেল শুধু ফেলে রাখা ট্রলিব্যাগ। এটা যে মায়ের ব্যাগ, চিনে ফেলল রুদিতা। এই ব্যাগটা কয়েকমাস আগে নিজে কিনে দিয়েছিল। ব্যাগ যেহেতু এখানে, মা আসেপাশেই আছেন। সময় নষ্ট না করে বৃদ্ধাশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করল রুদিতা। সেখানেও মাকে পেল না। তারা জানাল, রওনক নামে কেউ একজন খোঁজ নিয়ে গেছে, আজই ওই বৃদ্ধাশ্রমে আতিকা জাহানকে নিয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও ওই নামে কেউ এখনও সেখানে উপস্থিত হয়নি। মাকে না পেয়ে ভয় ঢুকে গেল রুদিতার মনে। ডানে-বামে কোনদিকে যাবে বুঝতে পারল না। হঠাৎ চোখ পড়ল দূরে। মানুষজনের ভীড় কম হলেও যানবাহন ছুটছে অবিরত। সেসবের ফাঁকফোকর দিয়ে এপার ও ওপারের দৃশ্য যথেষ্ট পরিষ্কার হয়ে ভেসে উঠল তার চোখে। দেখল, এক বয়স্ক মহিলা ব্রিজের ফুটপাতে বসে আছেন। পাশেই একটা রিকশা দাঁড়ানো। খানিকক্ষণ পর রিকশা চলে গেলে খেয়াল করল, বয়স্ক মহিলাটিকে দেখতে একদম আতিকা জাহানের মতো। মায়ের বোরকা, মায়ের হিজাব, সবকিছুই চিনতে পারল রুদিতা। দূর থেকে চিৎকার দিল,
-‘মা…। তুমি ওখানে থাকো। আমি আসছি।’
দূর থেকে চিৎকার দেয়ার পরও, আওয়াজটা আতিকা জাহানের কানে যায়নি। তিনি তখন ব্যস্ত নিজেকে মুক্তি দিতে, শান্তি দিতে। ভাগ্য সহায় ছিল বলে, শেষ সময়ে এসে মাকে দু’হাতে জাপটে ধরল রুদিতা। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এতক্ষণের জমে থাকা সবটুকু ধৈর্য্যশক্তিকে হারিয়ে ফেলে শব্দ করে কেঁদে ফেললেন আতিকা জাহান। বললেন,
-‘আটকাস্ না, মা। শান্তি খুঁজতে দে। এই পৃথিবীটা আমার কাছে এখন বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এখানে নিঃশ্বাস টানতেও কষ্ট হচ্ছে, রাহা।’
-‘আমরা আছি তো, মা। তুমি আমাদের জন্য বাঁচবে।’
-‘আর বাঁচা…।’
বাচ্চাদের নিয়ে ওপারে এসে দাঁড়াল উষাদ নিজেও। রুহান এসে তার নানুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-‘তুমি এখানে কেন নানু?’
আতিকা জাহান উত্তর দিলেন না। নাতিকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের কাছে। রুদিতা মাকে শান্ত করতে, পানির বোতল নিয়ে এলো। ভালোমতো মুখ মুছিয়ে অল্প একটু পানি খাওয়াল। বলল,
-‘গাড়িতে উঠে বসো, মা। তুমি আমার সাথে যাচ্ছ।’
আতিকা জাহান লজ্জিত হয়ে বললেন,
-‘পাগ//লামি করিস্ না। ওখানে কেন যাব আমি?’
-‘আমাকে কেন পাঠিয়েছ?’
-‘তোকে তো বিয়ে দিয়েছি, সংসার করতে পাঠিয়েছি।’
-‘তাহলে মেয়ের সংসারে যেতে আপত্তি করছ কেন? আমি বেঁচে থাকতে তুমি ফুটপাতে হাঁটবে, ম//রার জন্য রাস্তা খুঁজবে, সেটা তো হতে দিতে পারব না। যা কিছু হোক, তুমি আমার সাথেই যাচ্ছ।’
আতিকা জাহান মেয়ের কথা শুনতে নারাজ। মানতেও নারাজ। ভদ্রমহিলাকে রাজি করাতে উষাদ নিজে এসে বলল,
-‘রাহা যদি আপনার মেয়ে হতে পারে, আমিও আপনার ছেলে হতে পারি। ছেলের সাথে যেতে কীসের আপত্তি মা? আপনি সবকিছু পিছনে ফেলে আমাদের সাথে চলুন।’
-‘এটা হয় না বাবা। আমি অন্য কোথাও চলে যাব।’
-‘কেন মা? আমাদের সাথে যেতে কীসের আপত্তি?’
-‘তোমরা বুঝতে পারছ না। ব্যাপারটা কেমন দেখায়।’
-‘যেমনই দেখাক, আপনি আমাদের সাথে যাচ্ছেন এটাই ফাইনাল। আর একটা কথাও নয়। গাড়িতে উঠুন। যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন আপনি আমাকে নিজের সন্তানের মতো ভরসা করতে পারেন, বিশ্বাস করতে পারেন।’
-‘ওটা আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। ওখানে কীভাবে যাই বলো তো? মান-সম্মান সব চলে যাবে বাবা।’
-‘কিচ্ছু হবে না। কেউ কিচ্ছু বলবে না। মেয়েরা যদি বিয়ের পর শ্বশুর-শাশুড়ির দায়িত্ব নিতে পারে, ওই সংসার আর পরিবারের সবাইকে নিজের ভাবতে পারে, তবে ছেলেদের বেলায় এটা আলাদা হবে কেন? তাদের কি শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি কোনো দায়িত্ব-কর্তব্য নেই না-কি? আমার কাছে আমার মা যেমন, আপনিও তেমন। আর আজ থেকে আমি আপনার সন্তান। সন্তান যখন চাইছে, মাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে। তাহলে মা কেন এত আপত্তি করবে শুনি?’
-‘তবুও…।’
-‘আর কোনো কথা শুনছি না। আপনি যাচ্ছেন। রুহান, উমা নানুকে গাড়িতে ওঠাও তো। বাড়ি ফিরতে হবে। আমাদের ঘোরাঘুরি ক্যান্সেল।’
ঘোরাঘুরি ক্যান্সেল শোনে দু’জনেরই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে তারা খুশি যে, নানুকে নিজেদের সাথে নিয়ে যেতে পারছে। দু’জনে মিলে ধরাধরি করে আতিকা জাহানকে গাড়িতে উঠাল। উমামা টুপ করে ভদ্রমহিলার কোলে বসে পড়ল। রুহান জায়গা না পেয়ে শেষে সামনে তার বাবাই’র কাছে চলে গেল। রুদিতা সেই ফাঁকে বোনকে কল করে জানাল,
-‘টেনশন করিস্ না। মাকে পেয়েছি। মামাকে জানিয়ে দিস্।’
-‘আচ্ছা।’
-‘তুই এখন বাড়িতে যা। যদি কোনো ঝামেলা হয়, ফোন করিস্।’
রুহামা চিন্তিত স্বরে বলল,
-‘কিন্তু বাড়ির দরজায় তো তালা।’
-‘তাতে কী? ভে//ঙে ঢুকবি। না পারলে বল, আমি এসে ভা//ঙ//ব।’
-‘না থাক্, পারব। তুমি মায়ের খেয়াল রেখো।
***
চলবে…