সুতোয় বাঁধা জীবন পর্ব-০২

0
1003

#সুতোয়_বাঁধা_জীবন
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – দুই

মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে বেশ কয়েক ফ্লেভারের আইসক্রিম কিনল রুদিতা। তারমধ্যে রুহানের পছন্দের আইসক্রিম তার হাতে দিয়ে বলল,

-‘খুব অল্পই খাবে। আর কিছু খেতে ইচ্ছে মাম্মামকে বলবে। বাইরের কারও কাছ থেকে কোনোকিছু নিবে না।’

রুহান আইসক্রিম হাতে নিয়ে, ভয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। রুদিতা দু’হাতে বাচ্চাটাকে আগলে নিয়ে বলল,

-‘তুমি কি আমার ওপর রেগে আছো?’

রুহান ভয়মিশ্রিত কণ্ঠ নিয়ে বলল,
-‘উনি আমাদের ক্লাস টিচার হোন।’

-‘উনি যে-ই হোন, তাতে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার সব মাথাব্যথা তোমাকে নিয়ে। তুমি হয়তো জানো না, আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতটুকু। তুমি আছো বলেই আমি বেঁচে আছি, রুহান। জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকা কত কঠিন, সেটা তুমি জানো না।’

রুহান কিছু বলতে চাইল। কিন্তু ভয়ের কারণে কিছুই বলতে পারল না। তবে রুদিতার হাতের বাঁধন থেকে ছুটতে চাইল। ছেলের অস্থিরতা টের পেয়ে বাঁধন আলগা করল রুদিতা। কপালে চুমু খেয়ে বলল,

-‘রুহান হয়তো জানে না, তার মাম্মাম তাকে কত ভালোবাসে। তুমি মাম্মামকে ভালোবাসো না?’

এই কথারও উত্তর দিল না রুহান। চুপ করে রইল। রুদিতা বলল,
-‘আমি জানি না কেন তুমি আমাকে এত ভয় পাও!’

-‘তুমি স্যারের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছ। আমি কষ্ট পেয়েছি।’

স্পষ্ট উত্তর রুহানের। শোনে ভীষণ চমকাল রুদিতা। তবে নিজের ভয়ের কারণ ছেলেকে বলল না। শুধু বলল,
-‘আচ্ছা, ঠিক আছে। স্যরি। কেন করেছি, তা হয়তো তুমি জানো। বুঝতেও পারছ। অতিরিক্ত ঠাণ্ডা জাতীয় খাবার তুমি হজম করতে পারো না। এটা তোমার শরীরের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর। গতমাসেই এর ফল ভোগ করেছ। আমি সবসময় তোমাকে সুস্থ দ্যাখতে চাই, রুহান। চোখের সামনে কেউ আমার বাচ্চাটাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিবে, এটা আমি সহ্য করতে পারব না। তাই হয়তো একটু মেজাজ দ্যাখিয়ে ফেলেছি। এর মানে কী এই যে, আমি তোমার খারাপ মা?’

রুহান কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বলল,
-‘বাবা ঠিক বলত, তুমি খারাপ। খুব খারাপ তুমি।’

দাঁতে দাঁত চাপল রুদিতা। মারা গিয়েও ইফতি তাকে শান্তি দেয়নি। জীবিত অবস্থায় যত জ্বালিয়েছে, মারা যাওয়ার পরও তার রেশ রেখে গেছে, একফোঁটাও কমেনি। বরং তার প্রভাবে রুহান দিনদিন মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। যেকোনোভাবে তাকে ওই ভয়ানক অধ্যায় থেকে সরিয়ে আনতে হবে। রুদিতা চেষ্টার কোনো কমতি রাখছে না। তবুও সম্ভব হচ্ছে না। কোথাও না কোথাও রুহান এখনও কিছু ভয়, কিছু দুর্ঘটনা, কিছু অস্বাভাবিক মুহূর্তকে মনে আঁকড়ে বসে আছে। এটা তার আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু তার কী করণীয়? এভাবে যে চলতে দেয়া যাবে না, তা বেশ বুঝতে পারল। সিদ্ধান্ত নিল, বাচ্চাটাকে শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। রুহানের কথাতে মনে ব্যথা পেলেও সয়ে নিয়ে বলল,

-‘তোমার বাবা ভুল বলত, রুহান।’

-‘বাবা কেন ভুল বলবে আমাকে? আমার বাবা তো অনেক ভালো। আমাকে কত আদর করত।’

মৃত বাবাকে নিয়ে সন্তানের মনে কোনোপ্রকার ভয়ভীতি ও নেগেটিভ ধারণা প্রবেশ করাতে চাইল না রুদিতা। বলতে পারল না, ‘ওসব লোকদ্যাখানো ছিল, রুহান। সবটাই তোমার বাবার অভিনয় ছিল। তোমার বাবা চাইত না, তুমি আমার কাছে থাকো। এজন্যই তোমাকে ও আমাকে আলাদা করে দিয়েছিল।’ ভেতরের কথা গিলে নিয়ে বলল,

-‘আমি সবকিছু ভেঙে বলতে পারব না, রুহান। শুধু এইটুকু জেনে রেখো, তোমার মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে।’

-‘মিথ্যে কথা। তুমি আমাকে ভালোবাসো না।’

-‘গর্ভের সন্তানকে দূরে সরিয়ে রাখার যে কী যন্ত্রণা, সেটা তোমাকে বুঝাতে পারব না, রুহান। আমার সম্পর্কে ভুল ধারণা মনে বাঁচিয়ে রেখেছ তুমি। আমি তোমাকে কী করে বুঝাই, বোলো তো?’

আর কীভাবে বুঝানো যায়, বুঝতে পারল না রুদিতা। বাচ্চাটা অবুঝ। খুব ছোটোবেলা থেকে যা যা শেখানো হয়েছে, সেসব এখনও মনের কোণে বাঁচিয়ে রেখেছে ছেলেটা। বুঝতে পারছে না, তার বাবার আসল রূপ। বুঝতে পারছে না তার মা’কে। তার কাছে মা সবসময়ই খারাপ ছিল, এখনও আছে। যে সন্তানকে বাঁচাতে তাকে কোর্ট-হাজত পর্যন্ত ছুটতে হয়েছে, সেই সন্তানকে কোনোভাবেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারবে না বলেই মেজাজ দেখিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সবটাই যে তার অনিচ্ছাকৃত, এটা বুঝবে কয়জন?

***

-‘রাজকার্য উদ্ধার করে মহারানীর এখন ফেরার সময় হয়েছে। ফেরার আগে ফোন করে জিজ্ঞেস করা যায় না, কোনোকিছু লাগবে কি-না? রান্নাবান্না ছাড়া আরও অনেক কাজ আছে আমার। জানিস্ আমি বাড়ির বাইরে বের হতে পারি না।’

বাড়ি ফিরতেই ভাবী শর্মীর মুখ থেকে এমন কথা শোনে দরজার মুখেই দাঁড়িয়ে রইল রুদিতা। তাচ্ছিল্যেভরা কণ্ঠে বলল,
-‘কেউ তোমাকে বারণ তো করছে না। বের হচ্ছ না কেন? নিজে গিয়ে বাজার করে নিয়ে আসো। আমি তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। কোনো কাজ-টাজ করি না।’

-‘কতবড়ো সাহস! তুই আমাকে বের হওয়ার কথা বলছিস্? আমি কেন বের হব? তুই বের হ। ভাইয়ের ঘাড়ের ওপর আর কতদিন থাকবি?”

শর্মীকে বলল কী, আর বুঝল কী! ইচ্ছে করেই ঝগড়া বাঁধাতে চাইছে মেয়েটা। রুদিতাও বুঝানোর চেষ্টা করল না। একইভাবে উত্তর দিল,

-‘আমার অংশটুকু আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি চলে যাব।’

-‘ওই এক জিনিসেরই বড়াই করতে পারিস্।’

-‘নিজে ইনকাম করছি, মাস শেষে টাকা দিচ্ছি, থাকছি, খাচ্ছি। তুমি যে আমাকে ফ্রিতে খাওয়াচ্ছ, এমনটা কিন্তু নয় ভাবী। তাই রোজ রোজ আমাকে এসব নিয়ে অযথা কথা শোনাবে না। চুপ করে শোনে যাওয়ার মেয়ে আমি নই, সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।’

-‘হ্যাঁ। তোর সব গলাবাজি তো আমার সাথেই। যেখানে গলাবাজি করার ছিল, সেখানে করতে পারিসনি। ভাইয়ের কাঁধের উপর ভর দিয়ে জায়গাসম্পত্তির দখল নিতে বাহানা সাজাচ্ছিস্ এখন।’

শর্মী তার ভাবী কম, প্রিয় বোন বেশি। মামাতো বোন হওয়ার সুবাদে একটা সময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একসাথে চলেছে। সামান্য কথার মায়ায় পড়ে একদিন শর্মীদের দুঃসম্পর্কের আত্মীয় ইফতির সাথে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তার। বিয়ের আগে ইফতির সম্পর্কে খুব একটা জানাশোনা হয়নি রুদিতার। শর্মী বলেছিল, ইফতি কর্মঠ ও বিশ্বস্ত একটা ছেলে। কিন্তু দেখা গেল উল্টো। ভাগ্যের লীলাখেলা বোঝা বড়ো মুশকিল। সেইতো আবার বাবার বাড়িতেই খুঁটি মজবুত করতে হলো। ঘর বেঁধেও সেই ঘরে সুখ হলো কই? প্রথম প্রথম শর্মী তাকে ভালোবাসলেও, বাবার বাড়িতে ঘাপটি মারার পর থেকে আর সহ্য করতে পারে না। দিনরাত সুযোগ পেলেই খোঁচাখুঁচি শুরু করে। তাই শত গালিবকা হজম করে ওইটুকুর জোরেই এখানে পড়ে আছে। কারণ তাকে বাঁচতে হলে চাকরি করতে হবে। খেতে হলে রুজিরোজগার করতে হবে। বাচ্চার ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হলে হাতভরা টাকার দরকার। ঘুণেধরা এই সমাজ শুধু মানুষের অসহায়ত্ব দেখবে, হাত বাড়িয়ে সাহায্য করবে না। এজন্য নিজের ও নিজের বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে ক’টা টাকা রোজগার করার জন্য পরের গোলামী করতে গিয়ে রোজ সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরোয়, ফিরে আসে রাতে।

রুহান ঘরে ঢুকে দৌড়ে নিজের নানুর কাছে চলে গেল। রুদিতা ছেলেকে ভেতরে পাঠিয়ে, সবগুলো আইসক্রিম ফ্রিজে রেখে আবারও অফিসের উদ্দেশ্যেই রওনা দিল। শর্মী পিছন থেকে বলল,

-‘আবার কই যাচ্ছিস্?’

-‘ওয়ার্কিং আওয়্যার শেষ হয়নি ভাবী। রুহামা ভার্সিটিতে ছিল, মায়ের বাতব্যথা বেড়েছে, তাই বিছানায় পড়ে আছেন। এজন্য আমি-ই রুহানকে আনতে ওর স্কুলে গিয়েছিলাম।’

নাক সিটকাল শর্মী। বলল,
-‘যাচ্ছিস্ যা। ফেরার পথে কিছু গাজর, শসা আর লেবু নিয়ে আসিস্। তোর ভাই তো আবার লেবু ছাড়া খাবার মুখেই তুলবে না।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওনা দিল রুদিতা। এই মহিলার সাথে এখন আর তর্ক করতে ভালো লাগে না। গা সয়ে গেছে এসব। এই গালি দিবে, এই আবার খরচের কথা বলবে। এটা নেই, ওটা নেই। নিজস্ব একটা বাড়ি তৈরী করতে পারলে, কোনোদিন এখানে পা ফেলত না। জমানো যা টাকা আছে, সেসব দিয়ে তো টিনশেডেরও একটা বাড়ি হবে না। কী উপায়ে এই অসহ্যকর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে?

***

বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উষাদ। প্রথমে তাকে গোসল করাল। এরপর একসাথে বসে খাবার খেল। বিকেলের একটা সময়ে মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজের কিছু প্রয়োজনীয় কাজও সেরে নিল। উমামা ঘুমাচ্ছে দেখে এই সুযোগটা কাজে লাগাল সে। শার্ট-প্যান্ট পরে দ্রুত বাজারে যাওয়ার মনস্থির করল। কিছু মাছ-মাংস এনে ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। আবার অল্পকিছু রাতের জন্য রান্না করতে হবে। বাড়িতে কাজের মেয়ে নেই। যা টাকা ইনকাম করে তাতে সবার খাওয়া-পরার খরচ চালিয়ে নিতে পারে। কিছু টাকা জমাতেও পারে। চাইলেই কাজের লোক রাখতে পারে, কিন্তু ইচ্ছে করেই রাখে না, বাড়তি টাকা খরচ হবে ভেবে। যাওয়ার আগে মা’কে বলল,

-‘উমা ঘুমিয়েছে। একটু দেখে রেখো। আমি একঘণ্টার মধ্যে চলে আসব।’

হোসনা বেগম ধীরেসুস্থে বিছানা ছাড়লেন। এই বয়সে আর পেরে উঠছেন না তিনি। কখনও প্রেশার, কখনও গ্যাস্ট্রিক, কখনও শ্বাসকষ্ট লেগে রয়েছেই। মুক্তি নেই এসব থেকে। তবুও নাতনীকে সামলানোর পাশাপাশি ঘরের অল্পস্বল্প কাজকর্ম করেন। কোনোমতে ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

-‘আমার ঔষধগুলো আনতে ভুলিস্ না।’

-‘চিন্তা করো না। নিয়ে আসব। বেশি ছোটাছুটি কোরো না। ওর পাশে বসে থেকো। ঘুম ভাঙার আগেই চলে আসব।’

-‘তোকে একটা কথা বলতাম বাপ।’

-‘বলো।’

-‘মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে বড়ো কষ্ট হয় আমার। একবার অন্তত ওর কথা ভেবে…। যখন আমি থাকব না, বাচ্চাটাকে সামলাবি কী করে?’

ইদানীং খুব বেশি দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করেছে উষাদ নিজেও। হোসনা বেগমের শারিরীক যা অবনতি তাতে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময়ই বিছানায় পড়ে থাকেন। তার বাবা আবু উমায়ের তালুকদার মারা যাওয়ার পর থেকে মায়ের অসুখটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এক অপয়া দুর্ঘটনার ধকল সামলাতে পারেননি ভদ্রলোক। বিনা নিমন্ত্রণে স্ট্রোক করে পরপারে চলে যান। সে তখন প্রবাসে ছিল। পাঁচ বছর আগের ওই দুর্ঘটনায়, মা ও মেয়ের করুণ সময় দেখে বিদেশের মাটিতে থাকার সাহস হয়নি আর। বেহুঁশের মতো ছুটে এসেছে দেশে। সেদিন থেকে তার একটা আফসোস, প্রবাস জীবন তার সব শেষ করে দিয়েছে। জীবনের সুখ, আনন্দ, শখ-আহ্লাদ সব অবিশ্বাসের অনলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। সে মায়ের মনের কথা বুঝতে পেরে বলল,

-‘অসুবিধা নেই। ওকে একা পথ চলতে শেখাব।’

-‘বাচ্চা মানুষ। সবদিক কি আর একা বুঝে উঠতে পারবে? মাতৃস্নেহে’র অভাব ও’কে দিনদিন একা করে দিচ্ছে।’

-‘আমি আছি তো। সব অভাব দূর করে দেব।’

-‘তবুও দ্বিতীয়বার নিজের কথা ভাববি না?’

-‘সম্ভব নয় মা। ঘর বাঁধার স্বপ্ন তো একবার দেখেছিলাম। বিশ্বাস, ভরসা ও দায়িত্ব দিয়ে একজনকে তো ঘরে এনেছিলাম। কী লাভ হোলো? তিন মাসের ঘর, এক বছরের দায়বদ্ধতা, এরপর অবিশ্বাসের চাবুক! আমি আর কিছু ভাবতে পারব না, মা। পারব না। প্লিজ, আমাকে এই নিয়ে জোর কোরো না।’

-‘উমার কথা ভেবে রাজি হয়ে যা, আমি একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।’

-‘জন্মদাত্রী মা যাকে এক সপ্তাহের মাথায় নর্দমার কীট ভেবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তাকে সৎ মা এসে আগলে রাখবে! তুমি এটা বিশ্বাস করো? এ-ও সম্ভব, মা? আমার মেয়েটাকে আমি আর কষ্ট দিতে পারব না। ওর জন্য আমি আছি। থাকব, ইন-শা-আল্লাহ্!’

-‘তবুও…।’

-‘জোর করো না, মা।’

কথা শেষ করে দ্রুতই বাজারের পথে রওনা দিল উষাদ। ছেলে চলে যাওয়ার পর হোসনা বেগম নাতনীর মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলেন,

-‘খোদা, এই মাছুম বাচ্চাটার ওপর রহম করো তুমি। একবার ওর পানে ফিরে চাও আল্লাহ্। আমি না থাকলে কী হবে ওর? ছেলেটা কতদিক সামলাবে আর? আমার চোখের সামনে তো সব অন্ধকার। কোনো পথই যে খোলা দেখছি না আমি। কীভাবে, কী করব?’

***

অফিস থেকে ফিরতেই ফের ভাই-ভাবীর কড়া তোপের মুখে পড়ল রুদিতা। রওনক খেতে বসেছিল মাত্র। খেতে বসেই লেবু নেই কেন, এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝামেলা শুরু করল সে। এরমধ্যেই বাজার-সদাই নিয়ে ফিরল মেয়েটা। রুদিতাকে দেখেও না দেখার ভান করে শর্মী বলল,

-‘রাহাকে সে-ই কখন বললাম, ফেরার পথে লেবু নিয়ে ফিরিস্। ওর তো এখন অবধি কোনো খবর নেই। একটু অপেক্ষা করো, দেখি ফ্রিজে পাই কি-না।’

শর্মীর কথা কানে পৌঁছাতেই ব্যাগ থেকে একগাদা লেবু বের করল রুদিতা। বলল,

-‘এগুলো নিয়ে যাও, ভাবী। রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল। তাই ফিরতে একটু দেরী হয়ে গেল।’

শর্মী হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে বাজার আনল। লেবু টুকরো টুকরো করে স্বামীর পাতে দিয়ে কনুই দিয়ে গুতো দিয়ে বলল,

-‘কীগো, বলো না। এভাবে আর কত…।’

রুদিতার কানে তুলো দেয়া। এমন না যে সে এই কথা শোনেনি। নিজের ভাই-ই যাকে বুঝে না, তাকে পরের মেয়ে কীভাবে বুঝবে? সে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পা বাড়াল। রওনক গলা খাকারি দিয়ে বলল,

-‘এইদিকে একটু আয় রাহা। তোর সাথে জরুরী কথা আছে।’

দাঁড়িয়ে পিছনে তাকাল রুদিতা। বলল,
-‘বাইরের পোশাকটা পালটে আসছি, ভাইয়া।’

-‘ঠিক আছে। একটু তাড়াতাড়ি আয়।’

রুমে এসে ফ্রেশ হলো রুদিতা। চারপাশে তাকিয়ে রুহানকে খুঁজল। না পাওয়াতে নিশ্চিত হলো, রুহান ঘুমিয়ে পড়েছে। সে হেঁটে হেঁটে রুহামার রুমে গেল। মেয়েটা পড়ছে। ফাঁকে ফাঁকে রুহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দৃশ্যটা দেখে খুব মায়া হলো। ছেলেকে এইভাবে ঘুম পাড়ানোর সুযোগ হয় না তার। কোনোদিনও হয়নি। আগে যখন ছেলেকে কাছে টানতে চাইত, তখন তার স্বামী ও শাশুড়ি বলত,

-‘তোমার কাজ টাকা রোজগার করা। তুমি টাকা রোজগার করো। রুহানকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’

আলগোছে বাচ্চাটার কপালে চুমু খেল রুদিতা। বুকটা ভার হয়ে এলো। চোখে অশ্রু জমল তৎক্ষনাৎ। জন্মের পর থেকে ছেলেটা মায়ের কাছ ছাড়া। আদর-শাসন সব থেকে বঞ্চিত। স্বামী-সংসার আগলে রাখতে গিয়ে, নিজের সন্তানের সাথে দূরত্ব তৈরী হয়েছে। এখন তো দায়ে পড়ে চাকরি করতে হচ্ছে। নয়তো কে দিবে টাকা-পয়সা? কে নিবে বাবাহীন এই বাচ্চা ছেলেটার দায়িত্ব? এমন কেউ নেই এই সমাজে, যে স্বেচ্ছায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াতে আসবে!

খাবার টেবিলের সামনে আসতেই রওনক একটা দলিল বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-‘এখানে সাইন কর, রাহা।’

রুদিতা চমকে গিয়ে বলল,
-‘এটা কীসের দলিল, ভাইয়া?’

-‘এখানে লেখা আছে তুই তোর সম্পত্তি স্বেচ্ছায় পিকলু ও মৌমিকে দান করছিস।’

-‘কী বলছ? আমি যাব কোথায়?’

-‘রাস্তায় নামাব না। বিয়ে দিয়ে আবারও শ্বশুরবাড়ি পাঠাব। এখানে তো বহুদিন হলো। আর কতদিন?’

-‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?’

-‘আশ্চর্য! এত ক্ষ্যাপছিস্ কেন? বিয়ের কথা তো ভাবতেই হবে, তাই না?’

রুদিতা আড়চোখে শর্মীর দিকে তাকাল। তার লুকোচুরি হাসি দেখেই মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। মন নিশ্চিত হয়ে গেল, এইটুকু হাতছাড়া করে ফেললে তাকে রাস্তায় নামতে হবে। সে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করে বলল,

-‘স্যরি ভাইয়া। সম্ভব নয়। আমি দাতা মোহসীন নই যে, স্বেচ্ছায় নিজের ভাগের সামান্য অংশটুকু কারও নামে দান করে দেব। তোমার যদি আমাকে তাড়ানোর হয়, তবে আমার অংশ বুঝিয়ে তাড়িয়ে দাও।’

-‘উল্টা বুঝিস্ না তো। তোকে তাড়াব না আমরা। এটা তো তোরও বাড়ি। তাড়িয়ে দিব কেন?’

-‘তাই, না? যদি এটা ভাবতে, তবে দলিল তৈরী করতে না।’

-‘আহা! সাইন কর, সাইন কর। অকারণ ঝামেলা করিস্ না। মা অসুস্থ। কানে গেলে কষ্ট পাবেন।’

-‘তারমানে সব আমাকে তাড়ানোর পায়তারা! ভালোই। অথচ আমার আজকের এই অবস্থার জন্য দায়ী ভাবী ও তুমি। তোমাদের জন্য আমার এই অবস্থা।’

-‘নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিস্ না তো।’

-‘আমি কখনও নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাই না। তোমরা জানতে ইফতি মাতাল, নেশাখোর, মদখোর, মেয়েদের নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করা ছেলেপেলেদের একজন। তবুও কীভাবে ওই ছেলের সাথে আমার বিয়ে দিলে? আমারই ভুল। তোমাদের কথার ওপর ভরসা করেছি। তোমাদেরকে বিশ্বাস করেছি।’

রওনক একগুঁয়ে মেজাজে বলল,
-‘স্বামীকে আটকে রাখতে পারিসনি, এটা তো তোর ব্যর্থতা। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজে সাধু সাজার কী দরকার? কথা বাড়াস্ না তো, দ্রুত সাইন করে দে। কাজ আছে আমার।’

-‘সম্পত্তি আমি দেব না ভাইয়া। আমার ভাগেরটুকু আমার নামেই থাকবে। তোমরা ব্যবহার করতে পারো, অন্য কোনো কাজে লাগাতে পারো, কিন্তু রেজিস্ট্রি করে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এই সামান্য জায়গার জোরেই এখানে ঠাঁই পেয়েছি। নয়তো তুমি আমাকে রাস্তায় নামিয়ে দিতে।’

-‘যার স্বামীর ঘরে জায়গা হয়নি, তার আবার ভাইয়ের ঘরে এসে এত গলাবাজি কীসের? এই সম্পত্তি আমার কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে কেনা। বাবার রেখে যাওয়া সম্পদ আর কতটুকু?’

-‘যতটুকু আছে, আমার জন্য যথেষ্ট।’

-‘খুব বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, রাহা!’

-‘বাড়াবাড়ি তো তোমরা করছ। আমি তো এমনি এমনি থাকছি না এখানে। সংসারের পিছনে খরচ করছি। মায়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছি। বোনের পড়াশোনা করাচ্ছি। তোমার পকেটের একটা টাকাও আমার কিংবা রুহানের পিছনে খরচ হচ্ছে না। আমি তো কাউকে জ্বালাচ্ছি না। তবুও কেন?’

-‘পাড়ায় আর মুখ দেখানো যাবে না। স্বামীকে আঁচলের বাঁধার মুরোদ নেই, এখানে এসে টাকার গরম দেখাচ্ছে। অসহ্য। রাস্তা নেই তোর জন্য? মরতে পারিস্ না?’

দলিলের দিকে ফিরেও তাকাল না রুদিতা। নির্বিকার ভাব নিয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসল। রওনক খাবার প্লেট সরিয়ে নিতে চাইলে রুহামা এসে ভাইয়ের হাত ধরে বলল,

-‘কী করছ ভাইয়া? সারাদিন কাজ করে খেতে বসেছে মাত্র। এক্ষুণি তোমার এত কথা বলতে হোলো? যাও, বউয়ের আঁচলের তলায় লুকোও গিয়ে।’

রওনক রেগেমেগে বলল,
-‘তুইও ওর সাপোর্টার। দাঁড়া, তোরও ব্যবস্থা করছি। দুটোকে তাড়িয়ে দিতে পারলে তবেই আমার শান্তি।’

-‘কাপুরুষ কোথাকার। মা ও বোনদের মূল্য যার কাছে নেই, তার দুয়ারে মাথা ঠুকে মর‍তে আমাদের বয়েই গেছে।’

-‘আহ্, বড়ো বড়ো কথা। তা যাবি কোথায়? যাওয়ার আর জায়গা আছে তোদের?’

-‘পৃথিবীটা এতটাও ছোটো নয়, যতটা তুমি ভাবো। জায়গা ঠিকই হয়ে যাবে।’

রুদিতা বাধাপ্রদান করে বলল,
-‘উল্টাপাল্টা বকিস্ না রুহামা। এটা আমাদের বাড়ি। এখানে থাকার অধিকার আমাদের আছে।’

রওনক চেঁচিয়ে উঠে বলল,
-‘কীসের অধিকার? বিবাহিতা মেয়ের ভাইয়ের বাড়িতে কোনো অধিকার নেই। এতদিন ভালোয় ভালোয় বলেছি, শুনিসনি। এবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।’

রাগে গজগজ করতে করতে দলিল নিয়ে রুমে চলে গেল রওনক। ভাইয়ের এই রূপ, এই কাজ দেখে হতভম্ব দুইবোন। তবে রুদিতা মনে মনে একটা হিসাব কষে নিল। এখানে গালিবকা শোনে মাথা ঠুকে মরার কোনো দরকার নেই। নিজের ভাগটুকু সে না নিলেও এইভাবে দখল দিবে না। এতসব সমস্যার একটাই সমাধান। আপাতত রুহামার বিয়ের কথা ভাবতে হবে আর একটা বাড়ি দেখতে হবে। এরপর মা’কে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

***

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে