#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
একটা সাইক্লোন যখন বয়ে যায় তখন প্রকৃতিকে যে রকম বিদ্ধস্ত লাগে আজ সুচরিতা আর সুসমিতাকে তেমন লাগছে। আজ দশ বছর ধরে ওরা দু,বোন মায়ের সংসারের তরীটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আজোও তীরে ভীড়াতে পারলো না। যাকে মাঝি বানানোর জন্য ওরা সহায়তা করলো, সে মাঝি হলো ঠিক। তবে অন্যের নৌকা চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নিজের অস্তিত্বের সাথে বেঈমানী করলো। গাড়িতে বসে দু,বোন এ প্রসঙ্গে কোনো কথা বললো না। ড্রাইভার আছে। ওর কানে এখবর পৌঁছালে মুহুর্তে ভাইরাল হয়ে যেতে পারে।
সুসমিতাকে জিগাতলায় নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে ডোরবেল বাজালো। হিমেল দরজা খুলে সুচরিতার চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
——-তোমাকে এরকম বিদ্ধস্ত কেন লাগছে? আম্মার শরীর ঠিক আছে তো?
——আপাতত আছে। তবে যে কোনো মুহুর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে?
——এটা কেমন কথা হলো? খুলে বলো কি হয়েছে?
——খোকন বিয়ে করে ফেলেছে।
——মানে,কি বলছো তুমি? কাকে বিয়ে করেছে? মেয়ের পরিচয় কি?
——-এতো ডিটেইল জানি না। তবে মনে হচ্ছে ও বিয়ে করে ফেলেছে। আম্মার এতো আদরের ছেলে। সারাজীবন সেই ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেছে। এই ছেলে এমন বেঈমানি করবে আম্মা কখনও কল্পনাও করেনি। বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় আম্মার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছিলো আমার।
হিমেলেরও মনটা খারাপ হয়ে গেল। সুচরিতা হিমেলের কাছে এলিনার ধর্ম পরিচয়টা গোপন করলো। এবং সুসমিতাকেও সুচরিতা বলে দিয়েছে ও যেন ওর শ্বশুর বাড়িতে এই মুহুর্তে খোকনের এই অকর্মের কথা যেন গোপন রাখে।
আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি দুপুরের রান্না শেষ করলো। কাজের লোক না থাকাতে সুচরিতার উপর চাপ পড়ছে। এমন সময় তৈয়বা এসে বললো,
——তুমি একা একা নানীবাড়ি বেড়াতে গেলে আমাকে নিলে না কেন?
——আমি আনন্দ নিয়ে তোমার নানীবাড়ি বেড়াতে যাই নাই। এটা আমার নসীবেও নাই। আমি গিয়েছি একটা দরকারী কাজে। তুমি স্কুলের হোমওয়ার্ক করেছো।
—–আমি তো করেছি। কিন্তু তাকিয়া আর তারিক সকাল থেকে খেলছে। আম্মু তোমার কি মন খারাপ?
—–তা একটু খারাপ।তোমার হোমওয়ার্ক করা শেষ হলে তুমিও ওদের সাথে খেলা করো।
সুচরিতা তৈয়বাকে এসব জানাতে দিতে চায় না। সুচরিতা ভাবছে ছোটোদের ছোটো ভাবলেও ওরা আসলো বড়দের থেকেও অনেক বেশী বুঝার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে অনেক সময় নিজেদের জীবনেও এর প্রভাব পড়ে।
দুদিন পার হয়ে গেল। সংসারের ব্যস্ততায় সুচরিতার মায়ের কাছে ফোন দেওয়া হয়নি। ইচ্ছেও করেনি।এমনিতেই ওর নিজেরই অনেক জ্বালা তারউপর যেচে এভাবে যন্ত্রণা নেওয়ার কোনো মানে হয় না।চাইলেও সুচরিতা নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারে না। মা বাবা যেমনই হোক তাদের বিপদে সন্তান ছুটে না এসে থাকতে পারে না। এছাড়া মা বাবার ঋণ কোনোদিন কোনো সন্তান শোধ করতে পারে না। সুচরিতাও এর ব্যাতিক্রম নয়। ও ভাবছে আজ স্কুল থেকে ফিরে মাকে একটা ফোন দিবে।
ছুটির দিন বাদে সুচরিতা রাতে একটু দ্রুত ডিনার করে নেয়। সকালে আবার নিজের স্কুল, বাচ্চাদের স্কুল, হিমেলের অফিস সব সামলানোর জন্য ওকে আর হিমেলকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। ওরা নামাজ পড়ে দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সুচরিতা বাচ্চাদের টিফিন সকালের নাস্তা সব রেডী করে। আর হিমেল বাচ্চাদের পোশাক পরিয়ে দেয়। ব্যাগ গুছিয়ে দেয়। সেদিন সব গুছিয়ে বের হতে যাবে সেসময় শোভনের ফোন আসে। মোবাইল স্ক্রীনে শোভনের ফোনটা দেখে সুচরিতার বুকটা ধ্বক করে উঠে। ফোনটা রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে শোভন বলে উঠে,
——আপা আম্মার মনে হয় হার্ট অ্যাটাক করেছে?
,—–তুই কিভাবে বুঝলি?
——আমি ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছিলাম।ঐসময় আম্মার প্রচন্ড ঘাম হচ্ছিলো। ঘরে প্রেসার মেপে দেখি নিচে ১১০ আর উপরে ১৮০। বুকে প্রচন্ড ব্যথা আছে। পাশের ডিসপেন্সারী থেকে ডাক্তার ডেকে আনলাম। উনিই তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন।
——তুই সুসমিতাকে ফোন দিয়েছিস?
—–হুম। ওরা সিলেটের শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে গেছে।
——খোকন কই?
—–বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি আসো। সাক্ষাতে সব কথা বলবো।
—–তুই আম্মাকে বারডেমে নিয়ে আয়। আমি আসছি।
সাথে সাথে সুচরিতা আর হিমেল বাচ্চাদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলো। তৈয়বাকে হলিক্রস স্কুলে এ নামিয়ে দিয়ে তাকিয়া আর তারিককে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সুচরিতা স্কুল থেকে ছুটি নিলো। হিমেল সুচরিতাকে বারডেম হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে নিজে অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। আজ বায়ারদের সাথে হিমেলের একটা জরুরী মিটিং আছে। সুচরিতা হাসপাতালে পৌঁছানোর কিছুক্ষনের মধ্যে শোভনও পৌঁছে গেল। ওদের মাকে একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে সুচরিতা ইমার্জেন্সির দিকে নিয়ে গেল। ভাগ্য ভালো ছিলো তাই একটা সেমি কেবিন পেয়ে গেল। সাথে সাথে ওর মায়ের চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। ডাক্তার অবশ্য ওদের আশ্বস্ত করলো অ্যাটাকটা মাইল্ড হয়েছে। সুচরিতা করিডোরে বসে শোভনকে জিজ্ঞাসা করলো
——বাসায় কি এমন ঘটলো যে আম্মার শরীরটার এই অবস্থা হলো?
——তোমরা সেদিন বাসা থেকে চলে আসার কিছুক্ষণের মধ্যে আমি বাসায় পৌঁছে গেলাম। তখন আম্মা আর খোকনের সাথে প্রচন্ড কথা কাটাকাটি চলছে। আম্মা কিছুতেই ঐ মেয়েকে মেনে নিবে না। তখন খোকন বলে ওর ফিরে আসার উপায় নেই। ওর সাথে ঐ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তখন আম্মা রেগে গিয়ে ওকে বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বললো। এবং আরো বলে দিলো ও যেন সম্পত্তির অধিকার নিয়ে কখনও এ বাড়ি মুখো না হয়।
—–ও কি সাথে সাথে বের হয়ে গেল?
—–হুম,ওকে দেখে মনে হলো, ও যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো।
—–ও চলে গিয়েছে ভালোই হয়েছে। আপদ বিদায় হয়েছে। তুই তো আর তিনবছর পর বের হয়ে আম্মার পাশে দাঁড়াবি।
—–শোভন বললো ঘটনা তো এখানেই শেষ নয়। ও আম্মার নামে গ্রামীন ব্যাংক থেকে ব্যবসার নাম করে দু,লক্ষ টাকা লোন নিয়েছে।
—–আম্মা সে টাকা ফেরত চায়নি?
—–চেয়েছে। ও বলেছে সুসমিতা আপুর কানের দুল বানিয়ে দিয়েছে আর বাড়ি মেরামত করেছে এতেই সব টাকা খরচ হয়ে গেছে।
—-আমি আর সুসমিতা যে বাড়ি মেরামতের জন্য টাকা দিলাম তার কি হলো?
——সে কথা তো অস্বীকার গেল।
—–এখন ঐ লোন শোধ করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে লোনের কিস্তি চাইতে লোক আসতেছে। না দিতে পারলে চক্রবৃদ্ধি হারে এই লোন বাড়তেই থাকবে।
মানুষ কতটা খারাপ আর নীচ হতে পারে খোকনকে না দেখলে হয়তো সুচরিতার জানাই হতো না। মায়ের সাথে এভাবে ও জোচ্চুরি করলো। ও হাশরের ময়দানে আল্লাহ পাকের কাছে কি জবাব দিবে?
পাঁচ বছর পর———
সুচরিতা আর সুসমিতার অনেক টানাপোড়েন আর চেষ্টায় ওর মায়ের লোন সব শোধ করেছে। খোকন চলে যাবার পর ওদের মা দু,তিন বছর ভালোই অসুস্থ ছিলো। ঐ ধাক্কাটা সামলে নিতে সময় লেগেছে। এখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। সুসমিতার একটা ছেলে হয়েছে। সারোয়ারের এবার প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি সেক্রেটারী পদে পদায়ন হয়েছে। সুচরিতার জীবনের স্রোত ভালোভাবেই বয়ে চলছে। তাকিয়াও হলিক্রস স্কুলে চান্স পেয়েছে। ও এখন ক্লাস ফোর এ পড়ে। তারিক এ বছর সেন্টজোসেফ স্কুলে চান্স পেয়েছে। বাড়িতে এখন পার্মানেন্ট কাজের বুয়া আছে। তারপরও সুচরিতা ওর পরিবারের জন্য রান্নাটা নিজ হাতেই করে।
সুচরিতা এতোদিনে যেন ওর কষ্টের ফল পেতে শুরু করেছে। আল্লাহপাক কাউকে নিরাশ করেন না। একদিকে যেমন বান্দাদের পরীক্ষা করেন তেমনি আর একদিকে ভরিয়ে দেন। হিমেলের ব্যবসার অনেক উন্নতি হয়েছে। পৃথিবীর বেশ কয়েকটা দেশে ওর গার্মেন্টসের মাল চলে যায়। সুচরিতার মনে হয় এই পৃথিবীতে যারা সৎ থাকে সে সমস্ত বিপদ সামলে আল্লাহর রহমতে সামনে এগিয়ে যেতে পারে।
ওদিকে সোহেলের সংসারের অবস্থা খুব একটা ভালো না। এর মাঝে সোহেলের একটা ছেলে হয়েছে। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। জেবা এবার এসএসসি পরীক্ষা দিবে। রেবা ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আর ওর ছোটো ছেলে মামুন এবার নার্সারীতে ভর্তি হয়েছে। শাশুড়ীর ওদেরকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়।
সোহেলের ডায়াবেটিসের অবস্থা ভালো না। সুগার সব সময় বেশী থাকে। রোমেল এবার অবসরে গিয়েছে। ওর ছেলে রাজন আহসানুল্লাহ থেকে কম্পিউটার ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। এখন ও বাইরে মাস্টার্স করার চেষ্টা করছে। রোমেলের অবসরের টাকার কিছু অংশ খরচ করে ও কানাডায় সামনের মাসে পাড়ি জমাবে। ওর ছোটো বোনটা ক্লাস থ্রীতে পড়ে। দুই ভাইবোনের বয়সের ব্যবধান অনেক। সংসারের খরচ সামলাতে গিয়ে রোমেলের ফ্লাট কেনা হয়নি। সোহেল রোমেল আর ওর মা ভাবছে হিমেলকে কিভাবে এবাড়িতে ফিরে আনা যায়? হিমেল যদি ফিরে আসতে রাজি হয় তাহলে এ বাড়িটা ভেঙ্গে ওরা পাঁচতলা করতে পারবে। রোমেল ওর মাকে বললো,
—–,মা এ কাজটা তোমাকেই করতে হবে।
—–হিমেল কি আমার কথা শুনবে?
——ওর সাথে যে ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে না শুনারই কথা? তবে তুমি হিমেলকে বলবে না। মা তুমি সুচরিতাকে বলবে। ও রাজি হলে হিমেল অমত করতে পারবে না।
এখবর বোনদের কানে পৌঁছালে ওরাও নিমরাজি হয়। কারন কোনো বোনই এখন বাপের বাড়ি গিয়ে বেড়াতে পারে না। সোহেলের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ও এসব দায়িত্ব পালন করতে চায় না। আর কারিমাও এগুলো দায়িত্ব পালন করতে চায় না। কিন্তু হিমেল আর সুচরিতা যতদিন ছিলো মনের আনন্দে বোনেরা বাপের বাড়িতে গিয়েছে। তাই ওরা জানে হিমেল এ বাড়িতে আসলে ওরা আগের মতো বাপের বাড়িতে নাইওর খেতে যেতে পারবে।এর মাঝে টাকা পয়সা জনিত ঝামেলায় জোহরার স্বামী মান্নানের চাকরি চলে গেছে। জোহরার মেয়ে অরিন এবার নর্থসাউথ থেকে বিবিএ পাশ করেছে। তাহেরার এর মাঝে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে ওর স্বামী মারা যায়। এরপর থেকে তাহেরা একাই ওর সংসারের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। মেয়ে সন্তান হয়েছে বলে তাহেরাকে শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ওর আর সম্পত্তির দাবি নিয়ে কোনোদিন শ্বশুরবাড়িতে যাওয়া হয়নি। ওর স্বামীর পেনশনের টাকা দিয়ে মিরপুর দশ নাম্বারে বারোশত স্কয়ার ফিটের ফ্লাট কিনে নিয়েছে। সময় তো কারো জন্য বসে থাকে না।প্রতিটি মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। ওর মেয়েটা এবার নর্থসাউথ থেকে বিবিএ পাশ করে ব্যাংকে জব করছে।
সাবেরার ও সময়টা ভালো যাচ্ছে না। যদিও তাপসী সলিমুল্লাহ মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করে বিসিএস দিয়ে স্বাস্থ্য ক্যাডারে জয়েন করেছে। বর্তমানে গাজীপুর সদর হাসপাতালে ও কর্মরত। তুশিও সলিমুল্লাহ মেডিকেলে ইর্টানী করছে। কিন্তু সাবেরার স্বামী আতিকের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। সাবেরাও অবসরে গিয়েছে। আতিক এখন ফোর্থ স্টেজে আছে। ওদের পুরোপরিবারটার উপর ভালোই ধকল যাচ্ছে। সুচরিতা আর হিমেল আাতিককে দেখতে গিয়েছিলো। সাবেরার বাড়িতে গিয়ে অনেকদিন পর সুচরিতার ওর বাবার কথা মনে পড়ে যায়। কেননা আতিকও মুখ দিয়ে খাবার খেতে পারে না। তাই নাকে নল দিয়ে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আতিককে দেখে এসে সুচরিতা ভাবছে মানুষের জীবনের সময় বড়ই ক্ষণ স্থায়ী। অথচ এই জীবন নিয়ে মানুষ কতই না অহংকার করে। আজ যে ভালো আছে বলে কালও সে ভালো থাকবে এর কোনো গ্যারান্টি নাই। আল্লাহপাক এই জন্য কোরআনে বলেছেন উনি যাকে ইচ্ছা আমির আর যাকে ইচ্ছা ফকির বানাতে পারেন। কাউকে সুস্থতা দান করতে পারেন আবার কাউকে রোগে শোকে রাখেন। আল্লাহপাক হায়াত মৌত রিজিক দৌলতের মালিক। সব কিছু তারই এখতিয়ার।
অনেকদিন পর সুচরিতার সংসারে আনন্দের হাওয়া বইছে। তৈয়বা জেএসসিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে। সেই খুশীতে ওর চাচা ফুফু আর দাদী সবাই ও বাড়িতে তৈয়বাকে অভিনন্দন জানাতে চলে এসেছে। সুসমিতা সারোয়ার আর ওদের ছেলে আবীরও চলে এসেছে। শোভন ও ওর মাকে নিয়ে সুচরিতার বাসায় এসেছে। শোভন মাস্টার্স পাশ করে একটা এনজিও গবেষণা কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত। হিমেল বাইরে খাবার অর্ডার করেছে। ছুটির দিন থাকায় সবাই দিনভর প্রাণভরে আনন্দ করেছে। তারপর এক সময় সন্ধে ঘণিয়ে আসলো। সবাই যার যার ঘরের দিকে পা বাড়ালো। শুধু সুচরিতার শাশুড়ী থেকে গেল।
রাতে ডিনার করে হিমেল তৈয়বা তাকিয়া তারিক সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। বুয়াও ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিন বাড়িতে মেহমান থাকায় সবাই ক্লান্ত ছিলো। রাত তখন বারোটা বাজে। মরিয়ম বিবি সুচরিতাকে ডেকে বললেন,
—–তোমার সাথে একটু কথা ছিলো? চলো ড্রইংরুমে বসে কথাগুলো বলি।
সুচরিতার যদিও দুচোখ ভরে ঘুম নেমে আসছে তারপরও শাশুড়ীর কথা শোনার জন্য ড্রইংরুমে গিয়ে বসলো। একটু দ্বিধাদন্দ্বে মরিয়ম বিবি বলা শুরু করলেন।
—–মা, আমি আজ তোমার কাছে একটা দাবি নিয়ে আসছি। আমি জানি তোমার মনে অনেক কষ্ট জমা আছে। তোমার সাথে অন্যায় করা হয়েছে। তুমি এগুলো আর মনে রেখোনা। আমিও হীরা ফেলে কাঁচের পিছনে ছুটেছি। তবে তুমি যেদিন আমার সংসার ফেলে চলে গেলে সেদিন থেকে আমি বুঝেছি, কি হারালাম আমি? তুমি ছিলে আমার সংসারের খুঁটি। তাই তুমি চলে যাবার পর আমার সংসারের ভীতটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। মা তুমি আমার বাড়িতে ফিরে আসো।
—–মা আমি ভাবিদের সাথে আর থাকতে চাইছি না।
——তোমার ওদের সাথে থাকতে হবে না। ঐ বাড়িটা ভেঙ্গে পাঁচতলা করা হবে। হিমেলকে বেশী দায়িত্ব পালন করতে হবে। তুমি অমত করো না। আমি সখিনা আর কারিমাকে নিয়ে থাকবো। তুমি সম্পূর্ন আলাদা থাকবে। তবে হিমেলকে এই গুরুদায়িত্বটা পালন করতে হবে। মায়ের এই কথা রাখো মা। আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখ আর শান্তি দান করবেন। যতদিন আমি বেঁচে থাকবো আল্লাহপাকের কাছে তোমার ছেলে মেয়েদের জন্য দোয়া করে যাবো। আপাতত দোতলা করা হবে। তুমি দোতলায় থাকবে। একতলায় আমি ওদের সবাইকে নিয়ে থাকবো। তুমি জীবনে এতোটা সয়েছো বলে আল্লাহপাক তোমাকে এতো সুখ আর সমৃদ্ধি দিয়েছে।
সুচরিতা আর অমত করতে পারেনি। শাশুড়ীকে ও বাড়িতে ফিরে যাবে বলে কথা দিলো। হারানো মানিক ফিরে পেলে মানুষের মুখটা যেমন জ্বলজ্বল করে তেমনি সুচরিতার শাশুড়ীর মুখটাও এই কথা শুনে ঝলমল করে উঠলো। সুচরিতাকে জড়িয়ে ধরে দুচোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ছেড়ে দিলো।
বিঃদ্রঃ(প্রিয় পাঠক বন্ধুগন,আমি একবছর ধরে অনলাইনে লিখছি। আপনাদের উৎসাহ আমার অনুপ্রেরণা। আমি ভাবতে পারিনি এতোবড় একটা উপন্যাস আমি লিখতে পারবো। আপনারা প্রতিদিন আমার পর্বগুলো পরে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। আমিও অনুপ্রাণিত হয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে গল্প লিখে গেছি। কেমন হয়েছে আপনারাই ভালো জানেন। আমাদের চারপাশে গল্পের সুচরিতার মতো অনেক সুচরিতার বসবাস। এ ধরনের সুচরিতারা পৃথিবীতে এখনও আছে বলে পৃথিবী এতো সুন্দর। তারা সহজ সরল বলে মুহুর্তে মানুষের দেওয়া কষ্ট আর অপমানগুলো ভুলে যেতে পারে। আর ওরা আল্লাহকে ভয় করে সৎ থাকে বলে হোঁচট খেতে খেতে আবার উঠে দাঁড়ায়। আল্লাহপাক সবসময় ওদের পাশে থাকে। “সৎ মানুষ বহুবার বিপদে পড়ে কিন্তু প্রতিবার তারা উঠে দাঁড়ায় কিন্তু অসৎ মানুষ একবার পড়ে গেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারে না”। আপনাদের অনুপ্রেরণা যদি থাকে তাহলে সুচরিতার দ্বিতীয় খন্ড লেখা শুরু করবো।)