সুচরিতা পর্ব-২৪+২৫

0
663

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-চব্বিশ
মাহবুবা বিথী

সুচরিতা কলেজে যাওয়ার পর হিমেলের উপর ওর মা সমস্ত রাগ ঝেড়ে বললো,
——তোমার আর ব্যবসা করতে হবে না। অফিস চালাতে হবে না। বসে বসে বউয়ের বান্দিগীরি করো। আর দিনে দিনে স্ত্রৈনতে রুপান্তরিত হও। এই জন্য মনে হয় তোমারে জন্ম দিয়ে ছিলাম। এটাও আমার কপালে লেখা ছিলো। এইটুকু একটা মেয়ের সাথে তুমি পেরে উঠো না। এতো সাহস ঐ নটাঙ্গিনীর আসে কোত্থেকে? নাকি ওর বাপের বাড়ির মানুষগুলো কলকাঠি নেড়ে বেড়ায়? তোমার নাকি ব্যবসার অবস্থা ভালো না। তাহলে বউরে লেখাপড়া করানোর সময় টাকা আসে কোত্থেকে?

হিমেলের মা একটানা হিমেলকে গালমন্দ করে যাচ্ছে দেখে রোমেল এসে বললো,
——মা,এভাবে মাথা গরম করো না। সারাক্ষণ এভাবে বকাবকি করলে তুমি তো অসুস্থ হয়ে যাবে।
——আমার সুস্থ অসুস্থতায় কার কি যায় এসে যায়।কতদিন ওরে বললাম,বউয়ের লাগাম টেনে ধর। কে শোনে কার কথা। বউরে যে মাস্টার্সে ভর্তি করালো ওর বাচ্চা কে দেখবে? এই চিন্তা ও করেছে?
আমার পক্ষে বাচ্চা সামলানো সম্ভব না।

হিমেল মনে মনে সুচরিতার উপর বিরক্ত হলো। আজ ওর না গেলে কি এমন ক্ষতি হতো?
সুচরিতা রিকশা করে কলেজের পথে রওয়ানা হলো। কল্যানপুর থেকে বাংলা কলেজে বেশ কাছেই। এইটুকুন পথ ও রিকশায় আসা যাওয়া করে। সচরাচর ও গাড়ি ব্যবহার করে না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম হিমেলের গাড়িটা ও ব্যবহার করতো। কিন্তু একদিন শাশুড়ী খোঁটা দিয়ে বললো,
——বাপের সংসারে থাকতে কোনোদিন তো প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে বেরোনোর স্বপ্ন ও দেখোনি। কি ভাগ্য তোমার!বিয়ের পর তুমি গাড়ি হাঁকিয়ে ঘুরে বেরাতে পারো। আর আমার মেয়েরা এতো শিক্ষিত সুন্দরী হয়েও এখন পর্যন্ত নিজেদের ব্যক্তিগত গাড়ি কিনতে পারলো না। অথচ আমার মেয়েরা চাকরি করে।
যেহেতু সুচরিতার বাপের বাড়িতে গাড়ি ছিলো না তাই ও একা বের হলে কখনও হিমেলের গাড়ি ব্যবহার করে না। যদিও হিমেল বলে ওর যা কিছু আছে সবটাতেই সুচরিতার অধিকার আছে। তারপরও সুচরিতার কোথাও যেন বাঁধে। আর এতো খোঁটা ওর আত্মসম্মানে লাগে।
আজকে ওর না আসলে এমন কোনো সমস্যা হতো না। কিন্তু ওর নিজের অস্তিত্বকে বুঝাতে একরকম জোর করেই কলেজে এসেছে। শাশুড়ী ননদ যদি এভাবে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা না করতো তাহলে হয়তো ও আজ কলেজে আসতো না। কিন্তু ওরা যেভাবে বাঁধার সৃষ্টি করেছে বাধ্য হয়েই সুচরিতা আজ কলেজে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুচরিতা জানে এভাবে কলেজে আসাতে বাসার সবাই ওর উপর বিরক্ত হবে। এতে অবশ্য সুচরিতার কোনো কিছু আসে যায় না। এই যে সারাদিন সবার মন রক্ষার্থে সংসারের কাজগুলো আপন মনে করে যায় এতেও কি ঐ সংসারের ভালোবাসা ওর কপালে জুটেছে? বরং দিন কে দিন ওর সাথে খারাপ হয়েই চলেছে। তাই ও আর নিজেকে বঞ্চিত করতে চায় না। কথায় আছে “টাকা পয়সা ধন দৌলত সবাই কেড়ে নিতে পারে কিন্তু বিদ্যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না”। একান্ত নিজের এই অমুল্য সম্পদটাকে ও অর্জন করে নিতে চায়।
কিছুদিন পর সুচরিতার শাশুড়ী জেবাকে ভর্তির উদ্যেগ নিলো। তাও আবার একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। সেদিন ছিলো রবিবার। সকালে হিমেল অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঐ সময় পঞ্চাশহাজার টাকার একটা বিল হিমেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—–জেবাকে প্লেতে ভর্তি করাবো। অফিসে যাওয়ার আগে এই টাকাটা আমাকে দিয়ে যাবি।
হিমেল অবাক হয়ে বললো,
—–মা, এই মুহুর্তে এতো টাকা খরচ করার অ্যাবিলিটি আমার নাই। তাছাড়া প্লেতে একটা বাচ্চাকে ভর্তির জন্য এতোগুলো টাকা খরচ করার কোনো মানে হয় না। বরং এক বছর পর তুমি ওকে নার্সারীতে ভর্তি করিয়ে দাও। এছাড়া ওকে যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে, ভাবি কি পারবে ওকে পড়াতে?
——-পারবে কি পারবে না সেটা আমি দেখবো। সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। টাকা দিতে বলেছি দিয়ে দিবি।
কিচেনে সুচরিতা আর কারিমা রান্নার উদ্যেগ নিচ্ছিলো। কিচেন থেকে ওরা লিভিংরুমে মা ছেলের কথপোকথন ঠিক শুনতে পারছে। সুচরিতা বুঝতে পারছে হিংসার বশবর্তী হয়ে ওর শাশুড়ী মা আর কারিমা হিমেলের সাথে এই কাজটা করলো। আর সুচরিতা লেখাপড়াটা করছে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। কারিমা শাশুড়ী মায়ের কথা শুনতে পেরে সুচরিতার রিঅ্যাকশন দেখার জন্য গদ গদ হয়ে বললো,
——আসলে জেবা তো এ বাড়ির বড় নাতনী। তাই জেবাকে নিয়ে ওর দাদীর অনেক আশাভরসা। আমি মাকে বলেছিলাম,করোনার জন্য ছোটো ভাইয়ের ব্যবসাটা যখন ভালো যাচ্ছে না কি দরকার এখন জেবাকে ভর্তি করার। কে শোনে কার কথা। মা তো শুনতে চাইলেন না। এখন ছোটোভাই আমার সম্পর্কে কি ভাববে?অথচ এখানে আমার কোনো দোষ নাই।
——সমস্যা নাই ভাবি। আমি আপনার ভাইকে বুঝিয়ে বলবো। আর মা যখন চাইছে তখন হিমেলকে বলবো জেবাকে ভর্তি করে দিতে। তবে আমি যখন কলেজে যাবো আপনি তৈয়বার দিকে খেয়াল রাখবেন। আমি অবশ্য তৈয়বাকে দেখাশোনার জন্য একটা বাঁধা ছোটো মেয়ে খুঁজছি। ও তৈয়বাকে দেখে রাখবে। আপনি শুধু একটু খেয়াল রাখবেন।
কারিমা মনে মনে সুচরিতার উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলো। কোথায় সুচরিতাকে বোল্ড করতে চাইলো অথচ নিজেই বোল্ড হয়ে বসে আছে। তারপর মুখে মিচকে হাসির ভাব এনে বললো,
—–বাঁধা লোক রাখাটা শাশুড়ী মা কি মানতে চাইবেন?
—–আমি যেমন আপনার ভাইকে বুঝিয়ে জেবাকে ভর্তির ব্যবস্থা করবো আপনি তেমনি শাশুড়ী মাকে বুঝিয়ে বাঁধা লোক রাখাটা মানিয়ে নিবেন। নয়ত আপনার উপরেই চাপ পড়বে। আমি তো আর পড়াশোনা বন্ধ করবো না।
সুচরিতার কথা শুনে রাগে কারিমার শরীর জ্বলে গেল। ও তরকারী কুটছিলো। তরকারী কুটা বন্ধ করে নিজের রুমে গিয়ে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালো।
যথারীতি হিমেল মায়ের সাথে তর্ক বিতর্ক করে নাস্তা না খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। আজ আর সুচরিতা খাবার দিলো না। ইচ্ছে করেই দিলো না। ও দেখতে চায় শাশুড়ী মায়ের এটা নিয়ে কোনো প্রকার মাথা ব্যথা হয় কিনা? কারিমার দরজার লাগানোর শব্দে ওর শাশুড়ী মা চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন,
——আমার ঘরে কি ডাকাত পড়েছে নাকি?
কারিমা আবার সাথে সাথে মোালায়েম সুরে বললো,
—–মা, আপনার আদরের নাতনী এই কাজ করেছে।
সুচরিতা কারিমাকে দেখে অবাক হয় মানুষ কিভাবে পারে এরকম দ্বিচারী আচরণ করতে। এটাকে তো মোনাফেক বলে। যারা মুখে এক কথা আর অন্তরে আর এক রকম কথা বলে।
এদিকে শব্দের কারনে তৈয়বার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সুচরিতা তৈয়বাকে শাশুড়ী মায়ের ঘরে দিয়ে দ্রুত দুপুরের রান্নাটা সেরে নেয়। এরপর তৈয়বাকে গোসল করিয়ে খিচুরী খাইয়ে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। যোহরের আযান শোনা যায়। সুচরিতাও গোসল সেরে নামাজ পড়ে নেয়। তারপর টেবিলে খাবার বেড়ে দেয়। সবাই মিলে খেতে বসে। আজ জেবাও টেবিলে বসেছে। শাশুড়ী মা খেতে বসে সুচরিতাকে বললো,
—–হিমেলটা সকালে না খেয়ে অফিসে গেল খারাপ লাগছে।
——অফিসে লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। আপনি এটা নিয়ে চিন্তা কইরেন না।(কারিমা বললো)
—-ভাবি আপনার ভাই বাইরের খাবার খেতে পারে না।
—–দু,একদিন খেলে এমন কিছু হয় না। ইটালীতে তোমার ভাই ও তো মাঝে মাঝে বাইরের খাবার খায়।
এমন সময় জেবা বলে উঠে,
——ছোটো চাচী তুমি খুব বেশী খাও। এ বাড়ির সব কিছু তুমি খেয়ে শেষ করে দিলে।
সুচরিতা অবাক হয়ে জেবার দিকে তাকিয়ে ভাবলো,কথায় আছে যেমন গাছ তার তেমন ফল”।কথাটা আসলেই খুব সত্যি। সুচরিতার শাশুড়ী জেবার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললো,
——জেবা কি হচ্ছে এসব? ভদ্রতা শেখো।
——মা আপনি ওকে ধমকাচ্ছেন কেন? ওর বুদ্ধির প্রশংসা করুন। সুচরিতার মতো একটা বড় মানুষকে ও কিভাবে নাজেহাল করলো।
এ কথা বলে কারিমা হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আর সুচরিতা অবাক হয়ে ভাবলো মানুষের জ্ঞানবুদ্ধি কতটা কম হলে কিংবা নির্বোধ হলে চোখের সামনে নিজের সন্তানের অধঃপতন দেখে। মেয়েটা যে বেয়াদবি শিখলো সেটা কারিমার মাথায় আসলো না।
সুচরিতা জেবার দিকে তাকিয়ে একটু ধমকের সুরে বললো,
——তুমি ছোটো মানুষ। তোমার ছোটোদের মতো কথা বলা উচিত। এভাবে কথা বললে মানুষ তোমাকে বেয়াদব বলবে।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-পঁচিশ
মাহবুবা বিথী

দ্রব্যমুল্যের দামের উর্দ্ধগতিতে জীবন বড়ই বেসামাল। ডলারের দাম বাড়ার কারনে হিমেলের ব্যবসার অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। ওর কারখানার শ্রমিকদের বেতন ঠিকমতো দিতে পারছে না। যার কারনে অনেককে ছাঁটাই করতে হচ্ছে। সোহেল ওর সংসারের সব দায় হিমেলের উপর চাপিয়ে বিদেশে বসে আছে। এদিকে আবার সংসারের চাপ হিমেলকে নিতে হচ্ছে।
এতো সমস্যা সত্বেও হিমেল ওর মাকে জেবার ভর্তির জন্য পঞ্চাশহাজার টাকা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। ওর মা জেবাকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেয়। অগাস্টের এক তারিখ থেকে জেবার ক্লাস শুরু হবে। হিমেল ভাবছে এখনি সুচরিতা কলেজে যেতে পারছে না। আর জেবার ক্লাস শুরু হলে কারিমা জেবাকে নিয়ে স্কুলে যাবে তখন সুচরিতার কলেজে যাওয়া মনে হয় আর সম্ভব হবে না। কারণ তৈয়বাকে দেখার দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। অগত্যা হিমেল ওর অফিসের পিয়ন কামালের দেশের বাড়ি থেকে একটা দশ বছরের মেয়েকে নিয়ে আসে। মেয়েটার নাম লাকি। ও কামালের চাচাতো ভাইয়ের মেয়ে।
সেদিন অফিস থেকে ফেরার পথে লাকিকে নিয়ে হিমেল বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। পথে গাড়ি থামিয়ে হিমেল লাকির জন্য দুটো জামা আর প্যান্ট কিনে নেয়। বাসায় পৌঁছাতে সন্ধা ছ,টা বেজে যায়। ড্রাইভার মতিকে গাড়ি গ্যারেজ করতে বলে লাকিকে নিয়ে ডোরবেল বাজায়। কারিমাও জেবাকে নিয়ে সেসময় ওর রুমে শুয়েছিলো। সুচরিতাও তৈয়বাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। অগত্যা হিমেলের মা এসে দরজা খুলে দেয়। লাকিকে দেখে বলে,
——এ আবার কাকে সাথে করে নিয়ে আসলি?
——তৈয়বা আর জেবার সাথে খেলার জন্য ওকে নিয়ে এসেছি।
——এই উটকো ঝামেলাটা আনার আগে আমাকে তো একবার জিজ্ঞাসা করতে পারতি?সেটা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন বোধ করলি না। সত্যি তোকে যত দেখছি অবাক হয়ে যাচ্ছি। কবে থেকে তোর কাছে আমি এতো গুরুত্বহীন হয়ে গেলাম?
—–মা, তুমি শুধু শুধু সহজ জিনিসটাকে জটিল করে তুলছো। অগাস্টের এক তারিখ থেকে জেবার ক্লাস শুরু হতে যাচ্ছে। আজ জুলাই মাসের পঁচিশ তারিখ। আবার সুচরিতারও ক্লাস চলছে। তোমার পক্ষে তৈয়বাকে দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। আবার মেজ ভাবিও জেবাকে নিয়ে স্কুলে থাকবে। তাহলে সবচেয়ে বেশী সমস্যা তোমার হবে। সেটা চিন্তা করেই আমি লাকিকে নিয়ে আসলাম। তোমার তো খুশী হওয়ার কথা।
——তোর বিয়ের পর থেকে তুই আমার কিসে খুশী আর কিসে অখুশী সেটা ভুলে গিয়েছিস। যদি আমার খুশী আর অখুশীর মর্যাদা তোর কাছে থাকতো তাহলে নিষেধ করা সত্বেও সুচরিতাকে মাস্টার্সে ভর্তি করে দিতে তোর বাঁধতো। কিন্তু তুই আমার অমতকে বুড়ো আঙ্গুলে দেখিয়ে বউয়ের কথা মতো কাজ করলি।
এ কথা বলে উনি ওজু করতে ওয়াশরুমে চলে যান। মাগরিবের আযান শোনা যায়। সুচরিতারও ঘুম ভেঙ্গে যায়। রুমে বসে মা ছেলের সব কথাই ওর কানে এসেছে। ও ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে নেয়। হিমেল লাকিকে কিচেনে বসিয়ে রেখে রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে নেয়। সুচরিতা ওয়াশ রুম থেকে বের হলে হিমেল বলে,
——মেয়েটাকে নিয়ে আসছি। ওকে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার নিতে বলো। আর দুটো নতুন জামা প্যান্ট নিয়ে এসেছি। সেখান থেকে একটা জামা ওকে পড়তে বলো। আমাদের বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলা করবে একটা পরিছন্নতার ব্যাপার আছে।
——তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। নামাজ পড়ে ওকে গোসল করতে বলবো। এরপর নতুন জামাটা ও পরে নিবে।
সুচরিতার মনটাতে এতো যন্ত্রণার মাঝেও ভালোলাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়লো। হিমেল ওর কথা ভাবে এই ভাবনায় শাশুড়ীর সব গালমন্দ যেন ওর মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। নামাজ শেষ করে লাকিকে ক্লিন করিয়ে নেয়। তারপর ওকে ভাত খেতে দিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দেয়। সুচরিতার শাশুড়ী নামাজ শেষ করে কিচেনে এসে লাকিকে ভাত খেতে দেখে বলে,
——-দু,দিনেই এতো কষ্ট করে গড়ে তোলা সংসার লাটে উঠবে। এক এক করে আপদ এসে এ জুটছে এ সংসারে।
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ করে নিজের রুমে এসে দড়াম করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। এরপর উনার বড় ছেলের কাছে ফোন দিয়ে কেঁদে কেঁদে হিমেলের ব্যাপারে নালিশ জানায়।
হিমেল নামাজ শেষ করে ড্রইংরুমে টিভি ওপেন করে রাত আটটার খবর দেখতে বসে। সে সময় মোবাইলটা বেজে উঠে। স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখে যশোর থেকে রোমেল ফোন দিয়েছে।
—–হ্যালো ভাইয়া কেমন আছো?
——ভালো। আজ আবার মায়ের সাথে কি সমস্যা হলো?
——তেমন কিছু না। তৈয়বাকে দেখাশোনার জন্য একটা অ্যাসিসটেন্ট এনেছি এতেই মায়ের যত বিরক্তি। আর না এনে উপায় ছিলো না। জেবাকে প্লেতে ভর্তি করা হয়েছে। ভাবি ওকে নিয়ে স্কুলে যাবে। সুচরিতাও কলেজে যাবে। মাকে তো বাসায় কিছু সময় একা থাকতে হবে। এটা তো বিপদজনক। আবার তৈয়বার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। মায়ের সুবিধার জন্য তো ওকে নিয়ে আসছি। এতেও মায়ের আপত্তি।
——যাই হোক মাকে একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করিস। বুঝতে তো পারছিস বয়স বাড়ছে সেই সাথে মানসিকতার ও পরিবর্তন ঘটছে। আসলে মা মনে হয় একটু ইনসিকিউরিটিতে ভুগছে। যাই হোক তোর কাছে যেহেতু মা আছে তাই তোকেই খেয়াল রাখতে হবে। ফোন রাখছি। আল্লাহ হাফেজ।
হিমেলের প্রচন্ড বিরক্তি অনুভব হলো। এই সংসারটা এমন যে নিজের কলিজেটা বের করে দিলেও কারো মন পাওয়া যায় না। সুচরিতা হিমেলকে চা দিয়ে ওর শাশুড়ী মায়ের চায়ে দুধ চিনি মেশাতে গেলে কারিমা এসে সুচরিতাকে বাঁধা দিয়ে বলে,
——-মায়ের চা আমি বানিয়ে নিচ্ছি। তোমার হাতের বানানো চা মা মুখে দিবেন না।
সুচরিতা মনখারাপ করে ঘরে এসে বসে থাকলো। আল্লাহপাকের কাছে ধৈর্য আর সহ্যের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করলো। লাইট অফ করে তৈয়বাকে নিয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলো কষ্ট পেতে পেতে ওর পিঠ আজ যেন দেয়ালে টেকেছে। জীবন আর সংগ্রাম,সংগ্রাম আর জীবন সুচরিতার জীবনে যেন একই সুত্রে গাঁথা। আল্লাহপাক ছাড়া ওকে সাহায্য করার কেউ নেই। আল্লাহ না করুন যদি কোনো কারনে ওর সংসারটা ভেঙ্গে যায় বাপের বাড়িতেও ওর ঠাঁই হবে না। মেয়েটাকে নিয়ে তখন পথে পথে ভিক্ষা করা ছাড়া ওর আর কোনো উপায় থাকবে না। যত কষ্টই হোক ওকে এখানে টিকে থাকতে হবে। ওর বিশ্বাস একদিন ওর দিন ফিরবে। উপরে একজন আছেন। যিনি সবার মালিক এবং সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবীর মানুষের কাছে ওর দুঃখ কষ্টের মুল্য নাই থাকতে পারে। তারা ওর সাথে ট্রিক্স এর গেইম খেলতে পারে। কিন্তু সুচরিতার মন সাদা কাপড়ের মতো পরিস্কার। সেটা জানে অন্তর্যামী আল্লাহপাক। তাই বেলা শেষে ও ঠিক ওর পুরুস্কার পাবে। এই বিশ্বাস ওর আছে। এসব ভাবতে গিয়ে কখন যে তন্দ্রা এসে ওর দুচোখে ভর করেছে সুচরিতা টের পায়নি। হিমেলও একসময় ওর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ বিকট চিৎকারে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে ওর রুমের দরজার সামনে জেবা চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে,
——আমি চাচীর ঘরে এসেছি বলে চাচী আমাকে লাথি মেরে ফেলে দিলো।
সুচরিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে জেবার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, এই মেয়ে কতটা বিপদজনক!অবলীলায় মিথ্যে বলে যাচ্ছে। হিমেলের ও ঘুম ভেঙ্গে যায়। ও বিছানায় উঠে বসে। তারপর বিছানা থেকে নেমে জেবাকে বললো,
——তুমি মিথ্যে কথা কবে শিখলে? চাচী তো আমার পাশে শুয়ে ঘুমিয়েছিলো।
——-না চাচ্চু আমি মিথ্যা বলি নাই। তুমি বরং দেখতো পাও নাই। কারণ তুমি ঘুমিয়েছিলে।
এর মাঝে কারিমাও দৌড়ে এসে হিমেলকে বললো,
——ছোটো ভাই আপনি এসব কি বলছেন? শিশুরা হচ্ছে ফোরেস্তাদের মতোন।জেবা জানেই না মিথ্যা কথা কিভাবে বলতে হয়। আপনি শুধু শুধু ওকে মিথ্যাবাদী বানাচ্ছেন। বরং সুচরিতা কতটা হীন মানসিকতার সেদিকে লক্ষ্য রাখুন।
রেগে গিয়ে জেবাকে কোলে নিয়ে পিঠে কিল মেরে কারিমা বললো,
——কেন আসিস এদের রুমে? তোরে যে এতো বারণ করি আমার কথা শুনিস না কেন? তোর কি একদম লাজ শরম নাই।
কথা শুনে সুচরিতা বিছানা থেকে নেমে কারিমার সামনে এসে বললো,
——জিহ্বায় লাগাম দেন ভাবি। যখন যা মনে আসে তাই বলবেন না। আপনি বিবেকহীন হতে পারেন। এই যে সোহেলভাই ইটালী গিয়েছে আজ অবদি একটা কানা পয়সা পাঠাতে পারেনি। অথচ আপনাদের সমস্ত খরচ হিমেল বহন করে যাচ্ছে। আমি প্রতি মাসে বিশ টাকা বেতনে পড়াশোনা করছি। অথচ জেবার বেতন পাঁচহাজার টাকা। আমি ভর্তি হয়েছি পাঁচহাজার টাকা দিয়ে। আর জেবার ভর্তির খরচ পঞ্চাশ হাজার। আমাকে শান্তিতে থাকতে না দেন অন্তত যে মানুষটা মুখে রক্ত তুলে আপনাদের সব চাহিদা পূরণ করছে তাকে একটু শান্তি দেন।
কাঁদতে কাঁদতে কারিমা সুচরিতাকে বলে,
—–সুচরিতা তুমি আমাকে খোঁটা দিলে। আজ আমার স্বামী দেশে থাকলে তোমার কাছে আমার এতো কথা শুনতে হতো না। আমার বাবা তো আমাকে বলেছিলো বাড়ি গিয়ে থাকতে।শুধু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে যাইনি। মা জেবাকে চোখে হারায়। বড় নাতনী বলে কথা। আর স্বামী ছাড়া থাকতে কেমন অসহায় লাগে এটা তুমি বুঝবানা। কারণ তুমি আমার অবস্থায় পড়োনি।
এদের দু,জায়ের তর্ক বিতর্কে হিমেলের মা এসে সুচরিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
——তুমি আমার সংসারে এতো কথা বলার কে? আকাশ থেকে টুপ করে হিমেল পড়েনি। ওকে লেখাপড়া শিখিয়েছি। ব্যবসা করার টাকা দিয়েছি। তবেই না আজ ও গার্মেন্টস এর মালিক হয়েছে। তুমি শিল্প পতীর বউ হয়েছো। সুতরাং তুমি আমার সংসারে মাথা গলাবে না। আমার সংসারে কে কিভাবে থাকবে সেটা আমার সিদ্ধান্তে হবে। সবাই তোমার মতো রশি ছাড়া গরু হয়ে ঘুরে বেড়াবে না।
শাশুড়ীর কথায় আশকারা পেয়ে কারিমা বললো,
—–মা, আমি এই জন্য এখানে থাকতে চাইনি। জেবাকেও স্কুলে ভর্তি করাতে চাইনি। শুধু আপনার কথার দাম দিতে গিয়ে আজ আমাকে এতোগুলো কথা হজম করতে হলো।
কারিমা আর ওর শাশুড়ী চলে যাবার পর সুচরিতা ভাবতে লাগলো, জেবা কেন ওর নামে মিথ্যা বললো। আসলে ওর বা কি দোষ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখতে পাচ্ছে এ বাড়িতে সবাই সুচরিতার পিছনে লেগে থাকে। এতে সুচরিতা প্রতিমুহুর্তে বিব্রত হয়। এটা জেবার কাছে এক ধরনের বিনোদন। তাই আজ ও নিজেই সুচরিতাকে বিব্রত করে যৌথ পরিবারের এই অসুস্থ বিনোদনে অংশ নিয়েছে। যেটা অদূর ভবিষ্যতে জেবার জীবনে কখনই সুফল বয়ে আনবে না।

যাইহোক এভাবে নিত্য কথার জ্বালায় সুচরিতার জীবন তরীটা বয়ে যেতে লাগলো। ও সব জ্বালা সয়ে লেখাপড়াটা চালিয়ে গেল।ফাইনাল পরীক্ষার ছ,মাস বাকি আছে। পরীক্ষাটা হয়ে গেলে ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
সংসারের বেশীরভাগ কাজ এখন সুচরিতাকে সামলাতে হয়। স্বামীর বিরহে কারিমা দুঃখীভাব ধরে সারাক্ষণ শাশুড়ী মায়ের কাছে বসে সুচরিতার নামে নানা কূটকচালী করে বেড়ায়। এমন কি সাহায্য করার জন্য অনেক সময় লাকিকেও কাছে পায় না। শুধু ও যখন কলেজে যায় সে সময়টা লাকি তৈয়বাকে সঙ্গ দেয়। এ ছাড়া লাকির টিকিটা ও দেখতে পায় না। যখনি সুচরিতা খোঁজ করে তখনি দেখে জেবার কাজ করে বেড়াচ্ছে। নয়ত গোসল করাচ্ছে কখনও বা টয়লেটে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তৈয়বাকে খাওয়ানোর সময় লাকির একটু দরকার পড়ে। আর সে সময়টাতেই কারিমা ইচ্ছে করেই লাকিকে জেবার টয়লেটের কাজে ব্যস্ত রাখে। সবই সুচরিতা বুঝতে পারে। এদিকে রাত জেগে ও পড়তে পারে না। শাশুড়ী মায়ের নিষেধ আছে। কারণ পুরো ঘর অন্ধকার না হলে উনি ঘুমাতে পারেন না। সুচরিতা এটাও বুঝে শাশুড়ী মা ওকে পড়াশোনা করার সুযোগ দিতে চান না। কিন্তু এতেও সুচরিতা দমে যায় না। কলেজের লাইব্রেরীতে বসে পড়াশোনা করে। এজন্য ছুটির দিন ছাড়া ক্লাস না থাকলেও প্রতিদিন কলেজে যায়।
সেদিনও সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুরের জন্য তরকারীটা রান্না করে রাখে। কারিমা জেবাকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে শুধু ভাতটা রাঁধে। এরমাঝে তৈয়বাকে গোসল করে সুচরিতা খাইয়ে দেয়। তারপর ঘুম পাড়িয়ে নিজে গোসল সেরে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডী হয়। এমন সময় ডোর বেলটা বেজে উঠে। সুচরিতা এসে দরজা খুলে দেয়। দেখে ওর ভাসুর সোহেল দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে