#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-আঠারো
মাহবুবা বিথী
রাগে ফুলে ফেঁপে ঘন্টা দুয়েক পরে জোহরা রুমে এসে দেখে সুচরিতা ঘুমিয়ে আছে। আসলে ও ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। গজ গজ করে জোহরা বললো,
—–ভাবি উঠো। তোমার মেয়েকে বেস্ট ফিডিং করাও। বাচ্চা বিয়ানো মেয়েলোকের এতো ঘুমাতে নেই। মা হওয়া সহজ কথা নয়।
জোহরা গজগজানিতে সুচরিতা শোয়া থেকে উঠে বললো,
——আপু এতো তাড়াতাড়ি দু,ঘন্টা পার হয়ে গেল।
——তোমার কি ধারনা আমি দু ঘন্টা পার না করে চলে এসেছি?
সুচরিতার কাছে ঘন্টার হিসাব ঠিকমতোই আছে। তারপরও না জানার ভান করে বললো,
——–ঘুমিয়েছিলাম তো তাই সময়ের হিসাবটা বুঝতে পারিনি।
——–কি কপাল তোমার! মনে হয় আমার কপালটা তোমার কপালের সাথে ঘষে নেই। ভাগ্যগুনে মানুষের এমন শ্বশুরবাড়ি জোটে। আমরা তিনবোন বাচ্চা হওয়ার সময় মায়ের কাছে চলে এসেছি। যত ঝামেলা আমার মায়ের কাঁদে। তোমার মা,তো কিছুই টের পেলো না। এই কারনে তোমার মুখ দিয়ে এতো বড় বড় কথা বের হয়। কি করে পারলে মেজ আপাকে বড় বড় কথা শুনাতে? তোমার ডেলিভারীর দিন পুরোটা সময় স্বামী, সংসার, চাকরি, ফেলে তোমার কাছে থাকলো। মানুষের ভুল তো হতেই পারে? ভুল থেকেই তো মানুষ শিক্ষা নেয়।
——আমার মা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু আপনার ভাই দেয়নি। আর একটা কথা সত্যি বলেছেন, বড় কপাল করে আপনাদের বাড়ির বউ হয়েছি। ভাগ্যিস আমার সাথে আপনাদের কপালটা ঘষা দেননি তাহলে আপনাকেও আমার মতো শ্বশুর বাড়ির প্যারা সহ্য করতে হতো। এভাবে গায়ে ফুঁ লাগিয়ে সংসার করতে পারতেন না। আর এটাকে ভুল বলে না। এটাকে বলা হয় অন্যায়। আমার সাথে অন্যায় হয়েছে। আমি এর প্রতিবাদ করেছি। এখানে আমি দোষের কিছু দেখছি না।
——তলানীতে আর কিছু না থাক কিন্তু লম্বাচওড়া কথার বুলি সংরক্ষিত আছে যেটা যখন তখন বের করে আওড়ানো যায়।
——আপনারও তো মেয়ে আছে। তার সাথে এমন হলে আপনি কি করতেন? আল্লাহপাক বাঁচিয়ে রাখলে আমিও দেখব। অরিনের বেবি হওয়ার সময় আপনি কি করেন?
—-তুমি কি আমার মেয়েকে অভিশাপ দিচ্ছো?
——অভিশাপ কেন দিবো? এটা তো প্রসঙ্গক্রমে বলা। আপা আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আমি এই বিষয়টা নিয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।
লাঞ্চের সময় হলো। জোহরা লাঞ্চ করতে হাসপাতালের ক্যান্টিনে চলে গেল। হাসপাতাল থেকে সুচরিতার রুমে খাবার দিয়ে গেল। ও লাঞ্চ করে ওষুধ খেয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলো।
হিমেল আজ অফিসে গিয়ে শান্তিতে অফিস করতে পারছিলো না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যাবার পর ওর মনে হয়েছিলো জোহরা আর সুচরিতাকে একসাথে হাসপাতালে রাখা ঠিক হলো না। না,জানি কি দক্ষ যজ্ঞ ব্যাপার ঘটে যায় কে জানে?ও কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। কিছু একটা সমস্যা হলেই অভিযোগের তীর ওর দিকে উঠবে। মেয়েদের তো কোনোটাতেই কোনো সমস্যা নেই। ওরা কষ্ট পেলে কাঁদতে পারে। কিন্তু এই সমাজে পুরুষের দুঃখ কষ্ট কেউ বুঝে না। তারউপর পুরুষের কাঁদা নিষেধ। পুরুষের চোখে পানি দেখলে সমাজ সংসার তাকে কাপুরুষ বলে। নারী যদি স্বামীকে বেশী ভালোবাসে সমাজ সংসার তাকে স্বামী সোহাগী বলে। আর পুরুষ যদি বউকে বেশী ভালবাসে সমাজ সংসার তাকে স্ত্রৈণ বলে। কি অদ্ভুদ এই সমাজ ব্যবস্থা। নাহ্ হিমেল আর কাজে মন বসাতে পারলো না। কোনোরকমে লাঞ্চটা সেরে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা দিলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা বাজে। ড্রাইভারকে একটু তাড়াতাড়ি চালাতে বললো। এই সময় রাস্তাটা একটু ফাঁকা থাকে। হিমেল ভালো করেই জানে ওদের বাড়িতে কূটনামীর বিষ কে ছড়ায়? ওর মেজভাবিটা হীনমন্যতা থেকে সুচরিতার নামে কূটকচাল করে। হিমেল সবই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। মতিঝিল থেকে খুব তাড়াতাড়ি গ্রীনরোডে পৌঁছে গেল। কেবিনে এসে ও দেখে ননদ ভাবি দুজনে দুদিকে মুখ করে শুয়ে আছে। ওর পায়ের শব্দে জোহরা বিছানা থেকে উঠে বসে বললো,
—–তুমি কখন এলে? তোমার না সন্ধায় আসার কথা।
——না, মানে কিছু বিল পেমেন্ট করার জন্য হাসপাতাল থেকে ফোন দিয়েছিলো। আজ আর অফিসে যাচ্ছি না। তুই বাসায় চলে যেতে পারিস।
——আমার ও আর হাসপাতালে থাকতে ভালো লাগছে না। জীবনে আর একবার শিক্ষা হলো যেঁচে কখনও কারো উপকার করতে নেই।
——কেন কি হয়েছে?
——-তোর বউকে জিজ্ঞাসা করিস।
——নীচে ড্রাইভার আছে। তোকে নামিয়ে দিতে বলিস।
জোহরা চলে যাবার পর সুচরিতা শোয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল। সুচরিতার হাফ ভাফ দেখে হিমেল আর ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। তবে ও সুচরিতার সাথে স্বাভাবিক কথা বার্তাও বন্ধ করে দিলো।
জোহরার বাসা শ্যামলীর রিং রোডে। কিন্তু ও বাসায় না ফিরে আগে কল্যানপুরে মায়ের বাড়িরদিকে রওয়ানা দিলো। ওখানে পৌঁছাতে সন্ধা হয়ে গেল। ডোরবেল চাপতেই কারিমা এসে দরজা খুলে বললো,
—–আপু আপনি এসময়? আপনার তো আজ রাত পর্যন্ত হাসপাতালে থাকার কথা।
—–যেচে কখনও কারো উপকার করতে হয় না বুঝলে। মা কোথায়?
——আম্মা নামাজ পড়ছে।
——কেন আপা কোনো সমস্যা?
——আমার মাথাটা ধরেছে। আমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনো।
কারিমা মনে মনে একটু বিরক্ত হয়। ওর ননদগুলো বাড়িতে আসলেই সবার আগে অর্ডার করবে। মানুষ তো ভদ্রতা করে দুটো স্বাভাবিক কথা বলে তারপর না হয় চায়ের কথা বলে। এমন ভাবকরে ভাইয়ের বউগুলো যেন এক একটা কাজের বুয়া। ও কিচেনে চা বানাতে গেল। ওর শাশুড়ী মা নামাজ শেষ করে ড্রইংরুমে জোহরার সাথে দেখা করতে গেলেন। মাকে দেখেই জোহরা বললো,
—–বিয়ের পর খুব আদর দিয়ে তো মাথায় তুলেছিলে। তুমি বলেছিলে না, তোমার ছোটো ছেলের বউ নাকি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। ছোটো ছেলের বউ নাকি ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।
এমনসময় কারিমা চায়ের কাপ নিয়ে এসে ছোটো ননদের হাতে তুলে দিয়ে তার কথায় ফোড়ন কেটে বললো,
—–সুচরিতা ভাজা মাছ তো উল্টে খেতে তো জানে তারপর কাঁটাও ছাড়াতে জানে।
——ঠিক বলেছো মেজ ভাবি। মা তুমি রাশ এখনি টেনে ধরো। নইলে কিন্তু বেকায়দায় পড়ে যাবে।
—–এবার হাসপাতাল থেকে আগে বাড়ি আসুক।তারপর দেখাবো মজা। সাহসটা ভালোই বেড়েছে। আমার মেয়েদের অপমান করার স্বাধ আমি চিরদিনের মতো মিটিয়ে দিবো।
কারিমা শ্বাশুড়ী রাগের তাপটা আর একটু বাড়িয়ে দিতে বললো,
——এক গাদা টাকা খরচ করে সেই তো মা মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিলো। তারপরও দেখেন গলার কেমন জোর।
——সব কিছুর হিসেব আমি কড়ায় গন্ডায় নিবো। জোহরা রাত হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন হাসপাতালে ছিলি। বাড়ি গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে। ড্রাইভারকে বল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
জোহরা চলে যাবার পর কারিমার শাশুড়ী টিভিতে জি বাংলার সিরিয়াল দেখতে বসলেন।
সাতদিনপর সুচরিতা আর হিমেল বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলো। বাড়ি ফিরতে ওদের দুপুর দুটো বেজে যায়। ওর শাশুড়ী বাচ্চাটাকে কোলে নিলো না। সুচরিতাও সেধে শাশুড়ীর কোলে বাচ্চা তুলে দিলো না। ও নিজের রুমে এসে অবাক হয়ে গেল। এই সাতদিনে ওর ঘরটা কেউ একটু পরিস্কার করেনি। বুয়াকে বললেই তো পরিস্কার করে দিতো। মানুষের কমসেন্স দেখলে অবাক লাগে। ও একটা সিজারের পেশেন্ট। হাসপাতালে গিয়ে ওর সাথে ঝগড়া করার সময় সবার হাতে ছিলো। কিন্তু ওর ঘরটা পরিস্কার করার ক্ষেত্রে কেউ একটু ভুমিকা রাখতে পারলো না। অগত্যা ও বিছানার চাদর চেঞ্জ করলো। নিজের পোশাক বদলে বাচ্চাকে কোলে নিলো। হিমেল ঘর ঝাড়ু দিয়ে ময়লা বিনে ফেলে দিলো। সুচরিতা ওর অভ্যর্থনার বাহারে যারপরনাই অবাক হলো। মেয়ে বাচ্চা জন্ম দিয়ে ও যেন বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ ওর ননদদের সবারই মেয়ে সন্তান। বড় ভাসুরের শুধু একটা ছেলে বাচ্চা আর বাকি সবার মেয়ে। শাশুড়ী মা বাচ্চাকে তো কোলে নিলেন না এমনকি কাছে এসে বাচ্চার মুখটা পর্যন্ত দেখলেন না। বাচ্চাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে সুচরিতা আর হিমেল বাড়ির সবার সাথে টেবিলে খেতে বসলো।
ভাত মুখে দিয়ে সুচরিতা খুব অবাক হলো। প্রচন্ড ঝাল দিয়ে আজ যেন তরকারি গুলো রান্না করেছে। মেনু দেখে ও যারপরনাই অবাক হয়েছে। কাঠালের এঁচোড়ের তরকারি গরুর মাথার মাংস দিয়ে বুটের ডাল আর মাছের ডিমের বড়া। অন্য সময় এই খাবারগুলো খুবই মুখরোচক। কিন্তু সদ্যহাসপাতাল থেকে ফিরে এই খাবারগুলো খেতে ইচ্ছে করছে না। মুখে দেওয়ার সাথে সাথে সুচরিতার বুক পেট জ্বলে গেল। কেন জানি ওর মনে হলো কারিমা ইচ্ছা করে এই কাজ করেছে। হিমেলও ভাত খেতে পারছিলো না। প্রতি লোকমায় পানি খেতে হচ্ছে। রেগে গিয়ে কারিমাকে বললো,
——তোমার ঝালের ডিব্বায় কি ঝালের গুড়া আরো ছিলো? সেটুকুও কেন ঢেলে দিলে না। ঝাল দিলে যদিতরকারী মজা হয় তাহলে সবাই একগাদা ঝাল দিয়ে তরকারী রান্না করতো। আজ অবদি মায়ের কাছে রান্নাটা ঠিকমতো শিখলে না।
ওর মা একটু বিরক্ত হয়ে বললো,
——কারিমা যে রান্না করেছে এটাই তোদের ভাগ্য। আমি তো এ বেলা বাচ্চা জন্ম দিয়ে ও বেলায় রান্না করে তোদের খাইয়েছি। তোর বউ খেতে না পারলে নিজে যেন রান্নার দায়িত্ব নেয়।
চলবে
#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-উনিশ
মাহবুবা বিথী
ভাত খাওয়ার পর সুচরিতার পেটের ভিতর জ্বলুনি শুরু হলো। বিছানায় শুয়ে শুধু ছটফট করলো। গ্যাসের ওষুধ খাওয়ার পর জ্বলুনি কিছুটা কমলো। কিন্তু বাচ্চাটা মায়ের বুকের দুধ মুখে দেওয়া মাত্রই চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। মনে মনে সুচরিতা কারিমার উপর প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে হিমেলকে বললো,
——-মেজ ভাবির আজকেই তরকারিতে এতো ঝাল দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো।
——আসলে ঐ মহিলার আক্কেল বুদ্ধি কম।
——আমি তোমার সাথে একমত হতে পারলাম না হিমেল। আমি শিওর ভাবি ইচ্ছে করেই এই কাজটা করেছে।
——এতে ভাবির লাভটা কি?
——আমি অশান্তিতে থাকবো। আমাকে পেইন দেওয়া। এগুলো হচ্ছে এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা। অন্যকে পেইন দিয়ে নিজে আনন্দিত হয়।
বাচ্চাটা একটানা কেঁদেই যাচ্ছে। হিমেলের মা বাচ্চার কান্না শুনে আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না। সুচরিতার রুমে এসে দেখে ও বাচ্চাটার কান্না থামাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু বাচ্চাটার কান্না যেন আরো বেড়েই চলেছে। এসব দেখে হিমেলের মা সুচরিতাকে বললেন,
——-ওকে আমার কোলে দাও। তুমি ইস্ত্রি দিয়ে একটা কাপড় গরম করে দাও। আমি দিদিভাইয়ের পেটে সেক দিয়ে দিচ্চি। ও আরাম পাবে।
আসলে সেক দেওয়ার পর বাচ্চাটা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো। হিমেলের মা বাচ্চাটাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো।
অবস্থা বেগতিক দেখে কারিমা শাশুড়িমায়ের রুমে গিয়ে কান্নার অভিনয় করে বললো,
——আমার জন্য মনে হয় বাচ্চাটা কষ্ট পেলো। আমার খুব খারাপ লাগছে মা।
——তুমি আসলেই আজকে তরকারিতে ঝাল বেশি দিয়ে ফেলেছো।
——আপনার ছেলের চিন্তায় আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করে না। আজ ছ,মাসের উপর হয়ে গেল এখনও কোনো চাকরি হলো না। এদিকে আমার আর জেবার খরচ চালাতে ছোটো ভাই হিমশিম খাচ্ছে। এর মধ্যে আবার সুচরিতার বাচ্চা হলো সিজার করে। কত টাকা ছোটোভাইকে ওর পিছনে ঢালতে হলো।
——আমি তো বুঝি মেজ বৌ তোমার মনের অবস্থা। আর হিমেলের সমস্যা কি? ওকে আমি কষ্ট করে মানুষ করি নাই? আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে তো আর বড় হয়নি। গু মুত সাফ করে আস্তে আস্তে বড় করে তুলেছি। লেখাপড়া শিখিয়েছি। ব্যবসা করার জন্য টাকা দিয়েছি। তাহলে ভাই হয়ে ভাইয়ের বিপদে কেন পাশে দাঁড়াবে না? তুমি এগুলো নিয়ে একদম টেনশন করো না। আর সোহেলকেও জানাবে না। ছেলে আমার বিদেশ বি,ভূয়ে একা থাকে।
——মা, সুচরিতা কিছুদিন ওর বাপের বাড়ি ঘুরে আসুক। ওর মা ভাইবোন ওর একটু দেখাশোনা করুক। আর ছোটোভাইও মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা করুক। বাচ্চা হওয়ার কারনে আট দশদিন তো ঠিকমতো অফিসে যেতে পারে নাই।
——হুম কথাটা তুমি ঠিক বলেছো।
শাশুড়ীর মনে কথাটা বেশ ধরলো। এই সুযোগে হিমেলকে আবার নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া যাবে। এই ছেলেটাকে নিয়ে তার অনেক আশা। উড়ে এসে জুড়ে বসা কারো জন্য নিজের আশা আকাঙ্খাকে উনি জলাঞ্জলি দিতে পারবেন না। তাই
রাতে খাবার টেবিলে হিমেলের মা কথাটা হিমেলের কানে তুলে দিলেন। কারিমা মনে মনে খুব খুশি হলো।ওর শয়তানি কেউ বুঝতে পারেনি। আসলে ইচ্ছে করেই ও তরকারীতে ঝাল বেশি দিয়েছে। সুচরিতার উপর পুষে থাকা বহুদিনের রাগ ঢালতে পেরে খুব ফুরফুরে মেজাজে আছে। তাই গদগদ হয়ে সুচরিতার উপর আলগা মায়া দেখিয়ে বললো,
——যাও কটাদিন বাপের বাড়ি ঘুরে এসো। নাতনী পেয়ে খালাম্মা খালুজান খুব খুশি হবেন। আমি এদিকটা সামলে নিতে পারবো।
সুচরিতাও আর মুখে কিছু বললো না। তবে কারিমার চালাকি ও ঠিক বুঝে ফেললো। কারিমার সাথে এই বোঝাপড়াটা ভবিষ্যতের জন্য তুলে রেখে একটু চিন্ডায় পড়ে গেল। ওর বাবা অসুস্থ। ওদের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো হলো না। সুসমিতা পড়ালেখার পাশাপাশি একটা এনজিওতে মাঠ কর্মী হিসাবে জয়েন করেছে। তবে বাপের বাড়ি যাওয়ার সময় সুচরিতা নিজের খরচ বাবদ কিছু টাকা হিমেলের কাছে চেয়ে নিলো। পরদিন সকালে হিমেল সুচরিতার হাতে হাজার তিনেক টাকা দিয়ে ওকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি রওয়ানা হলো। যাত্রাবাড়ি পৌঁছাতে ওদের দুপুর বারোটা বেজে যায়। যদিও সুসমিতা, ওর বাবা মা শোভন সবাই খুশী মনে সুচরিতাকে বরণ নিলো। কিন্তু খোকন ওদের এই অভাবের সময় বাচ্চা নিয়ে এ বাড়িতে ওর বোনের চলে আসায় বিরক্ত হলো। এমনকি বড় দুলাভাই হিমেলের সাথে ভালো করে কথাও বললো না। পায়ের উপর পা তুলে ড্রইংরুমে বসে থাকলো। এসব দেখে সুচরিতা ওর মায়ের কাছে খোকনের আচরণের কথা বলতে গেলে ওর মা উল্টো সুচরিতাকে রাগ দেখিয়ে বলে,
——তোমার জীবন তো গুছিয়ে দিয়েছি। ভালো প্রতিষ্ঠিতো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছি। আমার বাকি ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত কি হবে সেই চিন্তায় আমি অস্থির। ভাইবোনগুলির জন্য তোমার এখন চিন্তা করা উচিত। সেটা না করে উল্টো তুমি ওদের পিছনে পরে আছো।
সুচরিতা আর কিছু বললো না। ও জানে ওর মা ভাইদের প্রতি একচোখামি করে। তাই চুপ করে থাকা বাঞ্জনীয় মনে হলো। হিমেলও খোকনের আচরণে মনে মনে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললো না। তবে সুচরিতার বাবা খুব খুশি। নাতনীকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। উনার কথা জড়িয়ে যায়। সেই জড়ানো অবস্থায় হিমেলের সাথে কথা বলছে। সুচরিতার মাকে হিমেলের জন্য ভালো রান্নার আয়োজন করতে বলছে। এর মাঝে শোভনকে নিয়ে হিমেল বাজারে গেল। তিনকেজি ওজনের রুই মাস দুটো দেশী মুরগী একটা গরুর মাথার সাথে দু,কেজি গরুর মাংস পোলাওয়ের চাল কিনে আনলো। শোভন খুব খুশি। আজকে বাড়িতে হেবি খাওয়া দাওয়া হবে। কিন্তু খোকন ওর মাকে গিয়ে বললো,
——পরের ছেলের জন্য হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাওয়ালেও পর সবসময় পরই থাকে কোনোদিন আপন হয় না। তোমার প্রতি দায়িত্ব তোমার মেয়ের জামাইরা কোনোদিন করবে না। এক গাছের ছাল কোনোদিন আর এক গাছে জোড়া লাগে না। আমার খুব অসহ্য লাগে তুমি যখন দুলাভাই আসলে কোমর বেঁধে রান্না করো। আর তোমার মেয়েটাও স্বার্থপর। শ্বশুর বাড়িতে বান্দির মতো কাজ করে আর বাপের বাড়তে এসে নবাবজাদি সাজে। আর এটাও জেনে রাখো এই আমাকেই তোমার সব দায়িত্ব পালন করতে হবে।
পাশের রুম থেকে সব কথাই সুচরতার কানে আসলো। ও শুধু ভাবতে লাগলো কি দুর্ভাগ্য ওর! মা তো ওর হয়ে দুকথা খোকনকে বলতে পারতো। সেটা না করে ওর সবকথাই নিরব হয়ে শুনে গেল। অথচ ওর বাবা যখন হাসপাতালে ছিলো বাচ্চাটা পেটে নিয়েও ও হাসপাতালে গিয়েছে। অথচ একটা দিনের জন্য খোকন হাসপাতালে যায়নি। সেই ছেলে করবে দায়িত্ব পালন? সুচরিতার হাতেই ওর ভাইবোন মানুষ হয়েছে। ও ভালো করেই জানে কে কেমন? খোকন বরাবরের মতো স্বার্থপর। যাই হোক সুচরিতা কথাগুলো হজম করে নিলো। হিমেলের সামনে এসব ও আনতে চায় না। দুপুরে পোলাও, মুরগীর ঝাল মাংস গরুর মাথার মাংস ভুনা করা হলো। সাথে ছিলো মাছভাজি। সুসমিতা ওর মাকে কাজে সাহায্য করলো।সুচরিতার পেটে সেলাই থাকার কারনে বাচ্চাটা নিয়ে শুয়েই থাকলো। ও মনে মনে হিমেলের উপর একটু খুশী হলো। নিজের মা ভাইবোনকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা সময় সুচরিতা অনেকদিন পর কাটালো। যদিও খোকনের আচরণগুলো ওকে কাঁটার মতো আঘাত করে তবুও মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষমা করে দিলো।
সুচরিতা আর ওর মেয়েকে শ্বশুর বাড়িতে রেখে রাতের ডিনার করে হিমেল বাড়ির পথে রওয়ানা হলো। রাতে সুচরিতার মা এসে ওকে বললো,
——বাচ্চা দেখে তোর শাশুড়ী কি বললো?
——এখানে কি বলার আছে?
——উনি তো আশা করেছিলেন তোর ছেলে হবে?
——কে কি আশা করলো সেটা আমার কাছে কোনো ম্যাটার করে না। আল্লাহপাক আমার জন্য যেটা মঙ্গল মনে করেছেন সেটাই আমাকে দান করেছেন।
—–তোর সাত মেয়ের পর হয়ত ছেলে হবে।
—-এটা আপনি কি করে বুঝলেন?(সুচরিতা বিরক্ত হয়ে)
——জন্মের পর বাচ্চার নাড়ী দেখে বুঝা যায়।
——এগুলো বলা ঠিক না। আল্লাহপাক নারাজ হন। আপনি কেন শুধু শুধু এসব কথা বলে পাপের ভাগীদার হচ্ছেন?
খোকন এসে ফোড়ন কেটে বললো,
——আমিও দোয়া করি তোমার একের পর এক মেয়েই হোক। আমাকে তো ছোটোবেলা থেকে জ্বালিয়েছো। আমি তোমার ভাই। অথচ তুমি আমাকে সহ্য করতে পারো না। আল্লাহপাক যেন তোমাকে ছেলে না দেন।
——আম্মা ওকে চুপ করতে বলেন। আর শকুনের দোয়ায় কোনোদিন বুড়ো গরু মরে না।
সুচরিতার মা দেখছে অবস্থা বেগতিক তাই খোকনকে বললেন,
——এই তোর সামনে পরীক্ষা। যা পড়তে বস।
খোকন চলে যাওয়ার পর সুচরিতার মা ওকে বললো,
—–তুই খোকনের কথায় কিছু মনে করিস না। সামনে ওর ফরমফিলাপ আছে, মডেল টেস্ট দিতে হবে। এসবের জন্য টাকার দরকার। এখনও টাকা ম্যানেজ করতে পারি নাই। আবার ভর্তি কোচিং এর খরচ আছে। কিভাবে যে কি করবো মাথায় কোনো কিছু কাজ করছে না।
চলবে