সুচরিতা পর্ব-১৬+১৭

0
674

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-ষোলো
মাহবুবা বিথী

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার পর সুচরিতার মনে হলো ওর বুকের উপরে চেপে থাকা কষ্টের বোঝাটা একটু হালকা হলো। ও জানে হিমেল হয়তো ওর উপরে একটু অসন্তষ্ট হবে। হোক, এসব নিয়ে ও আর মাথা ঘামায় না। হিমেলতো পারতো সিজারের সিদ্ধান্তটা একটু আগে নিতে। এতে সুচরিতার কষ্টও কম হতো। আবার ওদের বাচ্চটাকেও এতো কষ্ট সহ্য করতে হতো না। পেটের ভিতর ময়লা যাওয়াতে মেয়েটার নরম তুলতুলে শরীরটাকে সুঁচ ফোড়াতে হচ্ছে। ছ,টা এন্টিবায়োটিকের ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। এসব দেখে ওর কাছে মনে হয়েছে ওর প্রতিবাদ করা দরকার। নিজের শান্তির জন্য ও আজকে কথাগুলো শুনিয়ে দিয়েছে। প্রতিটি মানুষ যদি দিনশেষে নিজেকে ভালো রাখতে না পারে তাহলে তো বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। সুচরিতারও অধিকার আছে নিজের মতো করে ভালো থাকার। ওর বাবা অসুস্থ। মাথার উপর বড় ভাই নেই। সুচরিতার হয়ে কথা বলার মতো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। সুচরিতার হয়ে হিমেল যেটুকু প্রতিবাদ করে সেটা ও নিজের মতো করেই বলে। সুচরিতা যেভাবে চায় হিমেল তো সেভাবে কখনও বলেনি। এই কারনে সুচরিতার মনের গহীনে কষ্টের আগুনটা ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে। পুরোপুরি নিভে যায় না। জীবনের চব্বিশটা বসন্ত পার করে সুচরিতার এটুকু উপলব্ধি হয়েছে দিনশেষে প্রতিটি মানুষ একা। তাদের দুঃখ কষ্টগুলোর ধরণ আলাদা। একজন আর একজনের কষ্ট বুঝতে পারে না। সবাই নিজের মতো করেই জীবনকে পরিচালিত করে। তাই সুচরিতাও ওর মতো করে ওর জীবনের স্রোতটাকে বয়ে নিবে। এতে কার কি সমস্যা হলো সেটা দেখার দায় সুচরিতার নেই।

কেবিনে নিস্তদ্ধতা নেমে এসেছে। পরিবেশটা একটু গুমোট হয়ে আছে। ডাবল বেডের কেবিন। ওর ননস পাশের খাটে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সুচরিতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দুপুর বারোটা বাজে। সুচরিতা এটা ভালো করেই জানে তাহেরার মুখের উপর এভাবে কথা বলার ফল কি হতে পারে?
এমন সময় শোভন খোকন আর সুসমিতা খুশীতে ডগমগ হয়ে রুমে প্রবেশ করলো। কিন্তু কেবিনে এসে ওরা অবাক হয়ে গেল। দুজন,দুদিকে মুখ ফিরে শুয়ে আছে। তাহেরাকে দেখে সুসমিতা বললো,
—— আপু কেমন আছেন?
—— ভালো আছি(খুব গম্ভীরভাবে)।
——আপুর কি শরীর খারাপ?
—–না,শরীর ঠিক আছে। তোমরা হাসপাতালে আছো তো?
——তা,আছি। সন্ধের পর যাবো। আপনি বাসায় যেতে চাইলে ফ্রেস হয়ে আসতে পারেন।
—–আমার আর আসার দরকার নেই। বাকিটা তোমার বোন দুলাভাই সামলে নিতে পারবে। কালকে রেস্ট নিবো। পরশু থেকে আবার অফিস শুরু হবে।

তাহেরা সুচরিতার কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো। ওর বাসাটা টোলারবাগে। ওখানে একটা সরকারী বাসা পেয়েছে। তাহেরা স্বামী সন্ডানসহ ওখানেই থাকে। তবে এখন ও বাড়ি যাবে না। সুচরিতা ওর সাথে যা আচরণ করলো হিমেলের সাথে এর একটা বোঝা পড়া করে নিতে হবে। কল্যাণপুরে বাপের বাড়িতে পৌঁছাতে তাহেরার দুপুর দুইটা বেজে যায়। ডোরবেল বাজাতে হিমেল দরজা খুলে বলে,
——আপু তুই? হাসপাতালে সুচরিতার সাথে কে আছে?
——তোর বউয়ের যে পাখনা গজিয়েছে তাতে আর কারো দরকার পড়ে না। উনি এখন একাই একশ।
—–কি বলছিস আবোল তাবোল?
——ঠিকই বলছি। সকালে তুই চলে আসার পর তোর বউ যা,না তাই বলে আমাকে বকাবকি করলো। কি স্বার্থপর মেয়ে! যেই বাচ্চাটা হয়ে গেল অমনি খোলসের আবরণ থেকে নখগুলো বের করে আমাকে ক্ষতবিক্ষত করলো।
——দেখ আপু, এতো উপমা দিয়ে কথা না বলে আসল কথা খুলে বল।
হিমেল আর তাহেরার চিৎকার চেচাঁমেচিতে ওদের মা,কারিমা সবাই ড্রইংরুমে চলে আসলো। হিমেলের মা এসব শুনে রেগে গিয়ে হিমেলকে বললো,
——তোর বউয়ের এতোবড় সাহস কি করে হয়? ননসের মুখে মুখে কথা বলে? তোকে আগেই বলেছিলাম রাশটা টেনে ধর। আমার কথা গায়ে মাখলি না। এখন দেখ বোবার মুখে কথা ফুটেছে। ছেলে তো পয়দা করতে পারে নাই। কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে জন্ম দিলো সেই তো মেয়ে সন্তান। তাতেই তার গলার জোড় এতো বেড়েছে। ছেলে জন্ম দিলে মনে হয় আমাদের বের করে দিয়ে এ বাড়ির মালিকিন হয়ে বসে থাকতো।
——মা,তোমাদের এই এক দোষ। একটা সাধারণ সমস্যাকে তোমরা অসাধারণ সমস্যা বানিয়ে ফেল।
——-তুই তো কম যাস না। কখনও তো দেখিনি বউকে শাসন করতে?
হিমেল মায়ের কথায় কান না দিয়ে পুনরায় তাহেরাকে বললো,
——আপু, ও কেন এমন আচরণ করলো আমি তো বুঝতে পারলাম না।
——-আমাদের কারনে নাকি ওর বাচ্চা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েছে। নরমাল ডেলিভারী করার জন্য আমি আর আপা ডাক্তারকে বলেছিলাম। এটাই আমার অপরাধ। আমরাতো ওর ভালোর জন্যই বলেছিলাম।।
——বাচ্চাটার শরীরটা ভালো না বলে ও হয়তো এভাবে রিঅ্যাক্ট করেছে। তুমি কিছু মনে করো না। ও কি এখন একাই আছে কেবিনে?
——-তোর বউ কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ করতে পারে তাই বলে আমি তো করতে পারি না। আমার মনুষ্যত্ববোধ আছে। বাচ্চা দেখতে ওর ভাইবোনেরা আসছে। সন্ধা পর্যন্ত থাকবে। তাই আমি চলে আসছি।
হিমেলের মা কারিমাকে টেবিলে খাবার দিতে বলে গজগজ করে নিজের রুমে চলে আসলো। তাহেরাও ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিলো। সঙ্গে করে নিজের কাপড় না আনাতে মায়ের শাড়ি পড়ে নিলো। এরপর কারিমাকে ওর ভেজা কাপড়গুলো মেশিনে দিতে বলে টেবিলে খেতে বসলো। খাবার টেবিলে আইটেমগুলো দেখে ওর মেজাজটা অনেকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। হিমেল আর মা টেবিলে এসে তাহেরার সাথে খেতে বসলো।জেবা ঘুমিয়ে আছে দেখে কারিমাকেও ওর শাশুড়ী ওদের সাথে খেতে বললো। তাহেরা আজ খুব খুশী। ওর পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে। আজ ওর মা শুক্ত রেঁধেছে। তার সাথে মুগডাল দিয়ে রুই মাছের মাথার মুড়িঘন্ট, গরুর ভুনা মাংস আর চিচিঙ্গার চচ্চড়ি। খুব মজা করে ও ভাত খেয়ে ওর মাকে বললো,
——-আইটেমগুলো সব তুমি রেঁধেছো?
——হুম।
উনি খেয়াল করেছেন হিমেল ভাত তেমন একটা খায়নি। অন্যদিন হলে উনি হিমেলকে সাধাসাধি করতেন। কিন্তু আজ করবেন না। হিমেলেরও বুঝা উচিত ওর বউকে যে একটু সাইজ করা দরকার।
—–মনে হচ্ছে অমৃত দিয়ে ভাত খেলাম।
——কলেজে প্রফেসারি করে তো রান্নার সময় হয় না। আমি জানি তুই আজ আসবি। তাই তোর পছন্দের খাবারগুলো রান্না করলাম। যতদিন আমি বেঁচে আছি তোদের আদর যত্ন আমি নিজ হাতেই করবো। যে যুগ পড়েছে ভাইয়ের বউদের কাছে তোরা কিছু আশা করিস না।
খোঁচাটা হিমেলের মা হিমেলকে ভালোই দিলেন। হিমেল মনে মনে সুচরিতার উপর বিরক্ত হলো। কি দরকার ছিলো পরিবেশটা নষ্ট করার। ও তো ওর পাশেই আছে। হিমেল জানে, বাড়িতে থাকলে এই বিষয়টা নিয়ে ওর মা আর বোন ওকে খোঁচাতে থাকবে। তাই রেডী হয়ে মাকে বলে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এই সুযোগে কারিমাও একটু বিষ ঢেলে ওর শাশুড়ীকে বললো,
——নরমালে বাচ্চা ঠিকই হতো। আসলে ও মা হবে কিন্তু পেইন সহ্য করবে না। এইজন্য ও মনে হয় ডাক্তারকে সিজার করার জন্য আগেই বলে রেখেছিলো।
——না, মেজ ভাবি তোমার কথাটা মনে হয় ঠিক না। ওর আসলেই কিছু কম্পিলিকেশন দেখা দিয়েছিলো। কিছুতেই ব্যথা উঠছিলো না।
——-আপা যে কি বলেন? আজকাল কতো কিছু ঘটে। আমি শতভাগ নিশ্চিত সুচরিতা এই কাজই করছে। ওর বাচ্চার পজিশন খারাপ থাকলে ডাক্তার আগে থেকেই সিজার করার কথা বলতো।

চলবে

#ধারাবাহিক গল্প
#সুচরিতা
পর্ব-সতেরো
মাহবুবা বিথী

হিমেল হাসপাতালে বিকালের দিকে পৌঁছে যায়। খুব গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। সুচরিতা কোনো প্রশ্ন করলে শুধু সেটুকুর উত্তর দেয়। সুচরিতা বুঝতে পারে হিমেলের কানে বিষ ঢালা হয়ে গেছে। হিমেল যাওয়াতে সুচরিতা ওর ভাইবোনদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। গোধুলির আভা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সুচরিতার গোধুলির সময়টা ভালো লাগে না। কেন জানি মনটাকে বিষন্ন করে দেয়। রুমের মাঝে অস্বাভাবিক নীরবতা বিরাজ করছে। বাচ্চাটাও ঘুমিয়ে আছে। ও দিনে ঘুমায় রাতটা জেগে থাকে। সুচরিতার আজ সত্যি হিমেলের উপর খুব অভিমান হচ্ছে। তাই ও ভেবে রেখেছে নিজ থেকে হিমেলের সাথে ও কোনো কথা বলবে না। চোখের অশ্রুগ্রন্থি ফেটে যেন জল গড়িয়ে পড়তে চাইছে। অবরুদ্ধ কান্না গুলোকে হৃদয়ের কুলুঙ্গিতে সুচরিতা বন্দি করে রাখতে চাইছে। আসলেই জীবনের সময়গুলো মনে হয় এক আশ্চর্য যাত্রাপথ। যে পথগুলো অভিমানের মেঘের বরষায় কখনও ভিজে যায় কখনও হেমন্তের নরম রোদের আলোর মতো আলোকিত হয়ে উঠে। আবার কখনও বসন্তের হাওয়ায় শরীর ও মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। পাশের খাটে হিমেল শুয়ে আছে। দুটো খাটের মাঝে দু,ফিটের মতো দুরত্ব। সুচরিতা নিজের খাটে শুয়ে ঠিক বুঝতে পারছে হিমেল ঘুমায়নি। মটকা মেরে পড়ে আছে। হিমেলের এই বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সাথে সুচরিতা বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। আজ চার বছর হিমেলের সাথে ওর দাম্পত্যজীবন। প্রতিনিয়ত কতো কটুকথা ওকে হজম করতে হয়েছে। হিমেল কি তার খোঁজ রেখেছে? হিমেল সুচরিতার খোঁজ রেখেছে নিজের মতো করে। কিন্তু সুচরিতার মনের খোঁজটা সেভাবে হিমেল কোনোদিন রাখেনি। হা এটা ঠিক হিমেল সুচরিতার কোনো অভাব রাখেনি। খাওয়া,পড়া চিকিৎসা খরচ সবই সময়মতো বহন করেছে কিন্তু মানুষের শরীরের ভিতর একটা হৃদয় থাকে। ওর ও অনেক চাওয়া পাওয়া থাকে। হৃদয়টাও সংসারের টানাপোড়েনে মাঝে মাঝে অসুস্থ হয়। তারও চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সারিয়ে তুলতে গেলে অনেক আদর সোহাগের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ইদানিং সুচরিতা খেয়াল করেছে হিমেল আগের মতো ওর তেমন খেয়াল রাখে না। ক্রমশ যেন হিমেল ওর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সন্ধার পর ডাক্তার সুচরিতাকে দেখতে আসে। বাচ্চাটা সুচরিতার পেটের ভিতর ডেলিভারীর সময় পায়খানা করে দিয়েছিলো। তাই ওকেও এন্টিবায়োটিকের ইনজেকশন দেওয়া হচ্ছে। সুচরিতা ডাক্তারকে বলে,
—–ম্যাডাম আমি কবে রিলিজ পাবো?
——-এন্টিবায়োটিকের ইনজেকশন টা শেষ হয়ে গেলে তুমি চলে যেতে পারবে। ততদিনে তোমার বাচ্চাও সামলে উঠবে।
হিমেলও ডাক্তারের আগমনে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে। হিমেল ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে,
——ম্যাম বেবি এখন কেমন আছে?
——আল্লাহপাকের রহমতে বিপদ কেটে গেছে। তবে ডেলিভারীর সময় কন্ডিশন অনেক খারাপ ছিলো। এক্ষেত্রে অনেক সময় বাচ্চার মৃত্যু ও ঘটে যায়। আলহামদুলিল্লাহ,যাক সবকিছু ভালোভাবে পার হয়ে গেছে।
——বেবির অবস্থা যে এতোটা খারাপ ছিলো আপনারা তো বলেননি?
——আমরা তো বলছি রোগীর ডেলিভারী হতে সমস্যা হচ্ছে। জরায়ুর মুখ খুলছে না। কিন্তু আপনাদের আত্মীয় স্বজন বলছিলো নরমাল ডেলিভারী করাতে। এভাবে প্রেসার দিয়ে ডেলিভারী করলে অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়াও জোর করে সিজার করানোর ডাক্তারদের তো বদনাম আছে।
——আসলে একটা মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে গেছে। আমার আত্মীয় স্বজন বুঝতে পারেনি বিষয়টা।
——যাক, হিমেল সাহেব ওসব নিয়ে আর মন খারাপ করার দরকার নেই। এই মুহুর্তে আপনার স্ত্রী সন্তান সুস্থ আছে এটাই আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া

ডাক্তারের কথায় হিমেলের চেহারায় একটা অপরাধবোধ ফুটে উঠে। ডাক্তার চলে যাবার পর হিমেল বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
——তোমার শরীর এখন কেমন?
——-তিন ঘন্টা সময় পার হওয়ার পর মনে হলো আমার শরীর কেমন আছে?
——তুমি তো বুঝতে পারছো আমি কি ফেস করে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। আমার কপালটাই খারাপ। কেউ আমাকে বুঝতে চায় না।
——কথাটা ঠিক বললে না। আমি তোমাকে বুঝি বলে এ বাড়িতে আমাকে প্রতিনিয়ত কতো কিছু ফেস করতে হয় যার কোনোকিছুই তোমার কান অব্দি পৌঁছায় না। বলতে পারো আমি একাই সব সয়ে নেই।
——সেটা আমি জানি, কিন্তু মেজ আপার সাথে তিক্ত কথা বলার কি খুব দরকার ছিলো? শুধু শুধু বাড়ির পরিবেশটা খারাপ হলো। যা ঘটে গেছে তাকে আবার নতুন করে খোঁচানোর কি দরকার ছিলো?
——দরকার ছিলো। কারণ ভবিষ্যতে যেন এই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি না হয়। এছাড়া আমি সয়ে গেছি তাই বলে আমার বাচ্চাকে সয়ে যেতে দিবো না। আর তুমিও ভালো করে শুনে রাখো সারাজীবন এভাবে ঢাল হয়ে আমার বাচ্চাকে আমি আগলে রাখবো।
পরিবেশটাকে হালকা করতে হিমেল সুচরিতার কথায় হেসে দিলো। সুচরিতা আরো রেগে গিয়ে বললো,
——আমি তো কোনো হাসির কথা বলিনি?
—–তা বলনি। কিন্তু একটা কথা মনে হয়ে হাসি পেলো। ভাবছি পুরুষের সাহচর্য ছাড়া কোনো নারী তো একা বাচ্চা পয়দা করতে পারে না। অথচ তুমি বার বার আমার বাচ্চা শব্দটা ব্যবহার করছো। আমার বাচ্চা না বলে তোমার আমাদের বাচ্চা বলা উচিত।
—–থাক এখন আর এতো রসালো কথা বলতে হবে না। আমার শুনতে ভালো লাগছে না। এই চার বছর তোমার এ ধরনের কথা বহুত শুনছি।
——সুচরিতা তুমি অন্তত আমাকে ভুল বুঝো না।
রাতে ডিনারের সময় হলো। হাসপাতাল থেকে রুমে খাবার দিয়ে গেল। ওরা দুজনে ডিনার করে রাতে শুয়ে পড়লো। কিন্তু ওদের দুজনের ঘুমানোর উপায় নেই। বাচ্চাটার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। সুচরিতা ওকে বেস্ট ফিডিং করিয়ে হিমেলের কোলে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। রাত তিনটার সময় সুচরিতার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও তাকিয়ে দেখে পাশের খাটে হিমেল বাচ্চাটাকে কোলে ঘুম পাড়িয়ে নিজে খাটে হেলান দিয়ে বসে ঘুমাচ্ছে। হিমেলকে দেখে সুচরিতার খুব মায়া হলো। ও হিমেলকে ডেকে বললো,
—— আমাকে ডেকে দিয়ে ওকে আমার কাছে দিয়ে খাটে শুয়ে ঘুমাতে পারতে?
—— ইচ্ছে করেই তোমাকে ডাকিনি। এই সময় তোমার ঘুম দরকার। আমি তো সুস্থ মানুষ। ইনশাআল্লাহ, আমার কোনো সমস্যা হবে না।
এদিকে রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। সুচরিতা হিমেলের কোল থেকে বাচ্চা নিয়ে ওকে খাটে শুয়ে ঘুমাতে বলে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লো। ঘন্টা দুয়েক ঘুমানোর পর হিমেলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সিস্টার, আয়ারা সব রুমে চলে এসেছে। সিস্টার সুচরিতার প্রেসার মেপে ওষুধ বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। আয়া রুম ক্লিন করলো। হিমেল ফ্রেস হতে ওয়াশ রুমে চলে গেল। এর মধ্যে জোহরাও চলে আসলো। ওকে দেখে সুচরিতার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। তাই ও ঘুমের ভান করে বিছানায় শুয়ে থাকলো। হিমেল ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে জোহরাকে দেখে বললো,
——তুই কখন আসলি?
——এইমাত্র। ভাবিকে ডাকোনি? ওষুধ খেতে হবে তো।
——আসলে বাচ্চাটা রাত জাগে। সুচরিতা একদম ঘুমাতে পারে না। বাচ্চাটা ঘুমানের পর ভোরের দিকে ও একটু ঘুমিয়েছে। এখন ডেকে দিচ্ছি।
——তোমার তো কয়েকদিন অফিসে যাওয়া হয় না। আজ আমি সন্ধা পর্যন্ত ভাবির কাছে আছি। তুমি চাইলে অফিসে যেতে পারো।
জোহরার থাকার কথা শুনে সুচরিতা শোয়া থেকে উঠে বসলো। মুখে ভদ্রতার ভাব বজায় রেখে বললো,
—–আপু আপনি কখন আসলেন?
——-বেশ কিছুক্ষণ।
—–আমায় ডাকেননি কেন?
——তোমার তো একটু ঘুমানো দরকার। উঠেছো যখন ভালোই হলো। ফ্রেস হয়ে এসে নাস্তা খেয়ে ওষুধগুলো খেয়ে ফেলো।
——ভাইয়া আটটা বাজতে চললো। তুমি বাড়ি গিয়ে ফ্রেস হয়ে অফিসে চলে যাও। ভাবিকে নিয়ে কোনো চিন্তা করো না। আমি তো সন্ধা পর্যন্ত এখানে আছি।
সুচরিতা বুঝতে পারছে ওকে কথা শুনানোর জন্য ছোটো ননদকে পাঠানো হয়েছে। তাই ও আগ বাড়িয় বললো,
—–আপু আপনার তো স্কুল আছে। আপনিও চলে যেতে পারেন। আমি অনেকটা সুস্থ। একাই থাকতে পারবো।
হিমেল সুচরিতার কথা শুনে বললো,
——ও থাকতে চাইছে থাকুক। তোমার এই মুহুর্তে একা থাকা ঠিক হবে না। এছাড়া তোমার রাতে ঘুম হয় না। ওর কাছে বাবুকে রেখে তুমি একটু ঘুমিয়ে নিতে পারবে।
সুচরিতা মনে মনে হিমেলের উপর রেগে গেল। এখানেই হিমেলের সাথে ওর বিভাজন। নিজের ভাইবোনদেরকে ফেরেস্তার মতো বিশ্বাস করে। কিন্তু এরা যে সবাই ফেরেস্তা না এটাই হিমেল বুঝতে পারে না। দু,একটা শয়তান সেটা ও মানতে চায় না। যাই হোক সুচরিতা এটা বেশ বুঝতে পারছে ওর লড়াইটা ওকে একাই চালিয়ে নিতে হবে। হিমেল চলে যাওয়ার পর জোহরা ওর স্কুলের খাতা দেখতে বসলো।সুচরিতা ও ফ্রেস হয়ে এসে নাস্তা করে নিয়ে ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। ওকে শুয়ে পড়তে দেখে জোহরা বললো,
——তোমার এভাবে শুয়ে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না। কয়েকদিন তো হলো। এখন একটু হাঁটাচলা করো।
সুচরিতাও জোহরাকে বললো,
——তা অবশ্য ঠিক বলেছেন। তবে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে।
জোহরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সুচরিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। সুচরিতা সেটা দেখে বললো
—–কাজটা খুব কঠিন না। আপনার ভাতিজীকে একটু রোদ লাগাতে হবে। ডাক্তার ওকে রোদে দিতে বলেছে।
জোহরা মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললো,
—–আসলে আমার যে রোদ সহ্য হয় না। মাথাটা ধরে যায়।
——-কোনো উপায় নেই আপা। আপনাকেই যেতে হবে। আমার পেটে সেলাই থাকার কারনে আমি তো যেতে পারবো না।
অগত্যা কোনো উপায় না দেখে জোহরা বাচ্চা নিয়ে লনে চলে গেল। আর সুচরিতা মনে মনে বললো,ইট মারতে চাইলে পাটকেল খেতে হয়”এটা আপনাদের জানা উচিত। এখন রোদে বসে বদমায়েসির মাশুল দেন।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে