#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-১৪
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★
পিকনিক স্পটে যাওয়ার পরে সবাই নিজ ইচ্ছামতো ঘুরল।একসময় নোহা আর নিশি মিলে ঠিক করল ভূতের বাড়িতে ঢুকবে।তাদের সাথে সাথে রাফি,শিহাব আর রাসেলও গেল।ভুতের বাড়ি দেখতে অদ্ভুত একটা গুহার মতো।ভেতরে ঢুকে লম্বা সরু রাস্তা কেমন গা ছমছমে পরিবেশ।চারদিকে আত্মাদের হাসি-কান্নার শব্দে পরিবেশ আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।অন্ধকারে লীল,লাল টিমটিমে আলোর সামনে সাদা কাপড়ে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে বুকের পাখি বুঝি ভয়ে কাঁপে।প্রথমে রাসেল গেল,নিজেকে সাহসী প্রমানিত করতে,নোহার সামনে বীরপুরুষ সাজতে সেই সবার প্রথমে গেল। তারপর নোহা।নোহার পরে রাফি,তাদের পেছনে চোখে চোখে কথা বলে নিশি আর শিহাব গেল।
নোহা যখন সামনে গেল এক ভয়ংকর বুড়ি বিশ্রীভাবে হেসে দাত বের করে ভয় দেখাল।নীল লাইটের মাঝে এটা খুবই ভয়ংকর লাগল ।রাসেল নিজেকে সামলে সামনে এগিয়ে গিয়ে আরেক দরজা দিয়ে ঢুকল।কিন্তু নোহা সামনে এগুতে সাহস পেল না।তার খুব ভয় লাগছে।এখানে আসা উচিত হয়নি।পিছনে রাফি দাঁড়িয়ে আছে ইচ্ছে করলেই তার হাত ধরা যায় কিন্তু নোহা ধরবে না।সে ঠিক করেছে রাফি না চাইলে আর কখনোই নোহা ছুঁবে না।নোহার শরীর কাঁপছে রাফি বুঝতে পেরে আলতো হাতে কোমড়ে হাত রেখে কাছে টেনে নিল।নোহা লম্বায় রাফির বুকের সমান,বুকের কাছে নাকটা লাগাতেই চিরপরিচিত সেই মাতাল করা পুরুষালী ঘ্রান নাকে লাগল।নোহা লম্বা শ্বাস নিয়ে ফুসফুস ভরে নিল।রাফি নিশ্চুপভাবে নোহাকে দেখল,কি করবে রাফি?নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিজেই যে শেষ হয়ে যাচ্ছে।এই যে এখন মাথায় সব ভয়ংকর চিন্তা এসে ভীর করছে,অনূভুতিরা বুকের মাঝে ধাক্কাধাক্কি করে বেরিয়ে আসতে চাইছে।রাফি চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল।চোখ খুলে বলল,””চল।””
নোহা কিছু না বলে সামনে এগিয়ে গেল,মাঝে-মাঝে ভয়ে রাফির শার্ট খামচে নিজেকে আড়াল করল।রাফি খুব আদরে নিশির কোমড় ধরে রেখেছে ভয় পেলে আরেকটু কাছে টানছে।রাফি ফোস করে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,
—“তোর হিরো তো তোকে ফেলেই পালাল! ”
নোহা ভ্রু কুচকে বলল,
—“আমার হিরো মানে?”
রাফি চোয়াল শক্ত করে বলল,
—“যার সাথে আজকাল সময় কাটে সে।”
নোহার চেহারা দেখে বুঝা গেল সে বুঝে নি,তাই রাফি নিজেই বলল,
—“বিদেশী ছাগলটার কথা বলেছি।”
নোহা এবার বুঝতে পারল।অবাক হয়ে বলল,
—“আমি মোটেই বলি নি সে আমার হিরো।”
রাফি দাতে দাত চেপে বলল,
—“তা আজকে সবাই চোখে দেখেছে।”
নোহা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—“উনি অনেক রিকোয়েস্ট করছিল তাই উনার সাথে যাওয়া।আর কিছু না।”
রাফি ভ্রুকুটি করে বলল,
—“তোর মতো খারাপ মেয়েরা এমন করবে এটাই স্বাভাবিক।”
নোহা রাগে কেঁদে দিল।তখনি তাদের ভুতের বাড়ি ঘুরা শেষ হল।তাই নোহা রাফিকে ছেড়ে দৌড়ে বের হয়ে গেল।রাফি ধীরস্থির ভাবে বেরিয়ে আশেপাশে চোখ ভুলিয়ে দেখল,রাসেল নোহাকে টিস্যু দিচ্ছে চোখ মোছার জন্য।রাফি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরাল।সিগারেটের ধোয়া আকাশের দিকে ছেড়ে ভাবল,জীবনের সমস্যাগুলো যদি এমন করে উড়িয়ে দেয়া যেত!!
নিশি আর শিহাব নোহা রাফিকে একসাথে দেখে দাঁড়িয়েছিল।থাক একটু একলা,তাও যদি দু’টো নীড় হারা পাখি কাছাকাছি আসে।দুজনের মনের আগুন নিভাতে পারে।নোহা আর রাফি যাওয়ার পরে নিশি আর শিহাব সামনে গেল তখনি একটা সাদা মমি ধুপ করে ভয়ংকর গুঙ্গানী দিয়ে সামনে চলে এল।নিশি ভয়ে শিহাবকে আঁকড়ে ধরে।অদ্ভুত পরিবেশে এমন কিছু দেখলে যে কেউই ভয় পাবে।শিহাব হেসে বুকে চেপে ধরল।কতদিন ধরে বুকের ভেতর তৃষ্ণায় খা খা করছে আজকে বুকে শীতল বাতাস বয়ে যাক।শিহাব বুঝে গেছে নিশিও তার প্রতি দুর্বল,কিন্তু সামনেই পরিক্ষা ছিল তাই এতদিন দূরে রেখেছে।হাতের বাধন শক্ত করে বলল,
—“ভূতের ভয় থেকে বাচাতে হলেও ভালোবাসি পাখি!”
নিশি হতবম্ভ হয়ে শিহাবের দিকে তাকাল।এই ভূতের বাড়িতে এভাবে কেউ প্রপোজ করে?লোকটা এমন কেন?নিশি নাক ফুলিয়ে বলল,
—“এটা প্রেম নিবেদনের জায়গা হলো!”
শিহাব নিশির কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
—“আমার বেলী কাছে থাকলে সব যায়গাই প্রেমময়।”
নিশি লাজুক হেসে মাথা নাড়ায়।
ঘুরার এক পর্যায়ে নিশিকে শিহাব তাজমহলের কাছে ডাকল।নিশি নোহাকে সাথে নিয়ে গিয়ে দেখল শিহাব রাফি আর রাফিদের সামনের ফ্লাটের সেই পিচ্ছি মেয়ে জোহা।জোহা রাফির মোবাইল দিয়ে তার পাশে বসেই গেমস খেলছে।রাফি ভ্রু কুচকে নোহার দিকে তাকিয়ে আছে।নোহা চোখে চোখ রাখল না,চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে এটা সেটা দেখল।শিহাব নিশিকে চোখের ইশারায় পাশে বসতে বলল।পরিবারের লোক থাকায় দুজনে একান্ত সময় কাটানো হচ্ছে না।নিশি নোহা দুজনেই বসল।তখনি নোহার বাবা হাবিব এলেন এসে বলেন,
—“রাফি একটু আসবি?”
রাফি সভয়ে জানতে চাইল,
—“কেন চাচ্চু?কোন সমস্যা!”
হাবিব হেসে বলল,
—“সমস্যা!বিরাট সমস্যা!
রাফি জানতে চাইল,
—“কি!”
হাবিব সাহেব হেসে বললেন,
—“সবার পেটে ইদুর দৌড়চ্ছে।খাবার রেডি করব তুই হেল্প কর আয়।”
উনার কথার ধরনে সবাই হেসে ফেলে।উনি লোকটাই এমন সবাইকে হাসাতে ভালোবাসে।এই যে রাফিকে নিজের ছেলের থেকেও বেশী আদর করে।খুব বিশ্বাস,আস্তা,ভরসা যে রাফির উপর।তাই তো সব কাজেই উনার রাফিকে চাই।রাফি থাকলে উনি পরম নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।রাফি উঠে যাওয়ার পরে শিহাব বসে থাকলোনা সে ও উঠে গেল।নিশি গাল ফুলিয়ে শিহাবের দিকে তাকাতেই বলল,
—“একটু পরেই আসছি।”
দুজনেই চলে যাবার পরে নিশি নোহা জোহাকে কাছে টেনে নিল।নিশি বলল,
—“জোহা তুমি কি আমার মোবাইল দিয়ে টিকটিক দেখতে চাও?”
জোহা মাথা নাড়িয়ে নিশির মোবাইল নিলে নিশি রাফির মোবাইল হাতে নিয়ে নিল।নোহাকে চোখ মেরে বলল,
—“কোন শালী আমার বোনের চকলেট-বক্সে হাত দেয়?আজকে একদম মোবাইল চেক করে দফারফা করে ফেলব।”
নোহা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
—“যানতে পারলে খবর আছে!”
নিশি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে
বলল,
—“ধুর!তুই না বললি কোন জিনিয়াকে ভালোবাসে।চল গ্যালারি দেখি।”
নোহা মাথা নেড়ে সায় জানাল।জিনিয়ার সাথে কিভাবে ছবি তুলে তা দেখার লোভ সামলাতে পারল না।নিশি গ্যালারি উপেন করে দেখল প্রথমের ফোল্ডারে রাফির নিজের ছবি পাশে বন্ধুরা আছে।আরেকটা ফোল্ডারে কিছু প্রাকৃতিক ছবি।নিচের একটা ফোল্ডারের নাম মাই হিডেন হার্ট।দুজনে গোলচোখ করে ফাইল উপেন করল,ফাইল উপেন করে দুজনেই অবাক।শুধু অবাক বললে ভুল হবে বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে মোবাইল ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে আছে,নোহার হাজার হাজার ছবি।সবগুলোই কান্ডিড পিক।নোহা অবাক নয়নে নিশির দিকে তাকাল।নিশি বল,
—“দোস্ত রাফি ভাইয়া তোর এত পিক তুলছে আর তুই জানিস না!নাকি দুজনে তলে তলে শেষ!”
নোহা মাথা নেড়ে বলল,
—“আমি যানি না।উনি তো আমাকে পছন্দই করে না কিভাবে জানব?”
হঠাৎ নিশির হাতের চাপে গ্যালারি থেকে মিউজিক ফাইলে ডুকে যায়।সেখানে দেখা যাচ্ছে অনেক রেকর্ডিং অডিও।নিশি চালু করে দেখল সব নিশির গাওয়া গান।দুজনেই অবাক হল।তাহলে কেন রাফি এমন করে কেন?নিশি আবার গ্যালারিতে গেল,
নিশি সবগুলো ছবি দেখতে দেখতে একপর্যায়ে সেদিন রাতের তোলা কিছু ছবি সামনে এল,নোহা রাফির বুকে বিড়ালের মত মিশে আছে আর রাফি একহাতে জড়িয়ে মুখে এক তৃপ্তির হাসি দিয়ে সেলফি নিয়েছে।ঠোঁটের কাটা জায়গা তখনো লাল হয়ে রক্তের কথা জানান দিচ্ছিল।নিশি এটা দেখে নোহাকে কিছু বলার আগেই নোহা মুখে হাত দিয়ে কেঁদে ফেলে।নিশি মোবাইল জোহার হাতে দিয়ে নোহাকে কিছু বলার আগেই নোহা ছুটে ওয়াশরুমের খুঁজে বের হয়।একটু দূরেই রাফি’রা খাবার রেডি করছিল নোহাকে এভাবে ছুটতে দেখে রাফি সটান দাঁড়িয়ে যায়।নোহা রাফিকে এক পলক দেখল তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে দিল।
এত ভালোবাসলে প্রকাশ করেনা কেন?কিসের এত ভয়?কেন কাছে টানেনা?কেন এত খারাপ ব্যাবহার?
—চলবে—