#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★
জিনিয়া আজকাল বড্ড জ্বালাচ্ছে।কাজে অকাজে রাফির শরীর ঘেষে দাঁড়ায়।সবসময় ঠোঁটে নেশাময়ী হাসি লেগে থাকে।উত্তরায় ফ্লাট কিনার সময় এই অফিস থেকে রাফি মোটা অংকের লোন নিয়েছিল যা কিনা এখনো পরিশোধ করা শেষ হয় নি যার কারনে চাকরীটা ছাড়া সম্ভব না।বর্তমানে ফ্লাটের কাজ চলছে আরো টাকার প্রয়োজন এই অবস্থায় এমন ভালো চাকরি ছাড়া মুর্খতার পরিচয় কিন্তু এই মেয়ের হাবভাবে বুঝা যায় সে ও ছাড়ার পাত্রী না।রাফি চাইলেই জিনিয়ার সাথে গভীর প্রণয়ে জড়াতে পারে জিনিয়া সুন্দরী ক্যারিয়ার স্যাটেলড কিন্তু না ওই যে একজন মায়াবীনি আছে বুকের ভেতর ফুসফুসে ছড়িয়ে দিয়েছে প্রেমের বিষাক্ত বাতাস।এই বাতাস উপেক্ষা করে অন্য রমনীতে লিপ্ত হবে রাফি?না কখনোই পারবেনা।কিন্তু ইদানীং জিনিয়ার কার্যকলাপ দেখে যে কেউ ভাববে রাফির সাথে জিনিয়ার প্রেম ঘটিত কোন সম্পর্ক।যখন তখন মুগ্ধ চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে থাকবে, রাফি নিজের দিকে তাকায় আর ভাবে কত সুন্দর ছেলেই আশেপাশে আছে কিন্তু এই শ্যামলা বর্নের তাকেই কেন মেয়েরা পছন্দ করে।অবশ্য রাফির শরীরের গড়ন নজর কাড়া।পেটানো শরীরে বলিষ্ঠ বক্ষপিঞ্জর যখন নিশ্বাসের সাথে উঠানামা করে তখন যেকোনো মেয়ের নজর আটকাবে।সিল্কি চুল যখন বেখেয়ালে কপালে আছড়ে পড়ে তখন যে কোনো মেয়ে রাফির মাঝে আছড়ে পড়তে চাইবে।রাফির দেহের সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে তার চোখ কি যে মায়া লেপ্টানো ওই দুটো চোখে টানা টানা দীপ্তিময় চোখে তাকালে মনে হবে জ্বলে টইটুম্বুর হয়ে আছে।রাফি যখন পলক ফেলে ঘন পাপড়ি জন্য খুব মোহনীয় লাগে।আরেকটা ব্যাপার হল রাফির চোখ দুটো জন্মকাজল।যে কেউ দেখলে ভাববে রাফি চোখে বুঝি সুরমা দেয় কিন্তু না এটা সে জন্মগত ভাবে পেয়েছে,তার মা রাফিয়ার চোখ এমন ছিল তার মায়ের এই চোখের গড়নটাই পেয়েছে।বিধাতা রাফির শরীর,মন,ব্যবহার, আত্মমর্যাদাবোধ,এমনভাবে তৈরি করেছে যে চাপা গায়ের রংয়ের তুলনা করা বড্ড বেমানান।রাফির দিকে তাকালে ভুলেও মনে হয় না ইশ আরেকটু ফর্সা যদি হত বরং এটাই মনে হয় রাফিকে শ্যামলা রঙ মানায়।খুব বেশিই মানায়।রাফি তার ত্রিশ বছরের জীবনে এটা বুঝেছে যে মেয়েরা শ্যামলা ছেলেদেরই বেশি পছন্দ করে।রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।জিনিয়ার থেকে একমাত্র মুক্তির পথ এই চাকরি ছেড়ে দেয়া কিন্তু তা আপাতত হচ্ছে না রাফির দুশ্চিন্তায় মাইগ্রেনের ব্যাথা বাড়ে।
নোহার খালা আছমা বেগম বড়ই দুশ্চিন্তায় আছে।রান্নাঘরের নজরকাড়া দৃশ্য কোনভাবেই উনার মন থেকে যাচ্ছে না।রাফির সাথে কি নোহার কিছু চলছে?কই কখনো তো দুজনকে একত্রে দেখা যায় না।তাহলে নোহার এত এক্সট্রা যত্ন কেন রাফির প্রতি বাবা মা নেই এই মায়া থেকে নাকি নোহা আর রাফি দুজনে প্রেম করছে?তাহলে রান্নাঘরে দুজনের চোখের ভাষা অন্য কথা বলছিল না?কেমন করে রাফি তাকিয়ে ছিল নোহার দিকে।আছমা বেগমের শরীর রাগে রি রি করে উঠে।তার এতদিনের সাজানো স্বপ্ন কোনভাবেই বানচাল হতে দেয়া যাবে না।রাসেলকে আজই ফোন করে দেশে আসতে বলতে হবে নাহলে দেখা যাবে এই মেয়েকে রাফিই বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে।
আছমা বেগমের একমাত্র সন্তান রাসেল কানাডা জব করে।কানাডা যাবার পড়ে আছমা আর আছমার হাজবেন্ড তার বোনের বাসার কাছে এসেছে সেই উছিলাই মাঝেমধ্যে আসা হয় কোন কোনদিন রাতেও থাকা হয়।নোহাকে রাসেলের জন্যই পছন্দ করে রেখেছেন।তিনি বেঁচে থাকতে কোনভাবেই ওই রাফি নোহাকে বিয়ে করতে পারবে না।আছমা ভেবে অবাক হয় তার আপার আক্কেল জ্ঞান একেবারেই নাই এমন একটা জোয়ান ছেলে ঘরে রেখেছে যেখানে কিনা উনার একটা সুন্দরী মেয়ে আছে?আগে রাসেল আসুক দেখা যাক কি হয়।
————–
নোহা চুপিচুপি রাফির রুমে ঢুকে গেল।বুক ধুকপুক করছে।কিন্তু এই বৃষ্টিভেজা বিকেলে তার বড় ইচ্ছা করছে রাফির গায়ের মাতাল করা ঘ্রানে আষ্টেপৃষ্ঠে মেখে ঘুমোতে।নিশি আলতো পায়ে আলমারির সামনে দাঁড়ায়।শব্দহীন ভাবে আলমারী খুলে।রাফির মেরুন রঙের শার্ট হাতে নেয়।নাকের কাছে নিয়ে বড় করে শ্বাস নেয়।বুকে বয়ে যায় প্রশান্তি মুখে ফুটে হাসি।শার্টটা জড়িয়ে ধরে নোহার অনুভব হয় সে রাফিকেই বুঝি ধরল।শার্টের উপর অসংখ্য চুমু দেয়।তারপর নিজেই লজ্জায় শার্ট দিয়ে মুখ লুকিয়ে হাসে।একি সুখ!প্রেমে একি আনন্দ!নোহা শার্টটা যথাস্থানে রেখে যেইনা আলমারি বন্ধ করতে যাবে তখনি চোখে পড়ল একটা লাল গিফট বক্স।নোহা ধরবেনা ধরবেনা করেও নিজের কোতুহল ধমন করতে না পেরে খুলে দেখে ভেতরে কি,বক্স খুলে নিশি হতভম্ব।না খুললেই বুঝি ভাল হতো।একটা কালো সুতির শাড়ি,কালো কাচের চুড়ি,কালো টিপ,কালো কানের দুল।সাথে ছোট চিরকুট,
এই মায়াবতী,
“”এই কালো শাড়ীটা পড়ে একবার আমার সামনে আসবে প্লিজ?এই ভয় পেলে?হুম!ভয় পেও না বেশি কিছু করব না শুধু কপালে একটু সুখের পরশ দেব।কি?তিতির পাখির মতো নরম শরীরে আমার পরশ সইবে তো?আর হ্যাঁ বুকের কালো তিলটা অবশ্যই দেখাবে মনে থাকবে?”
চিরকুট পড়ে নোহার গলা শুকিয়ে গেল।বুকে অসহনীয় যন্ত্রনা হচ্ছে। রাফি তাহলে ওইদিন সত্যি কথাই বলেছিল।তার প্রেমিকা আছে শুধু প্রেম নয় তাদের সম্পর্ক অনেক এগিয়ে গিয়েছে এটা চিঠি দেখলেই বুঝা যাচ্ছে।চোখের পানি খরস্রোতা নদীর মতো ছুটে গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে।ঠোঁট ফুলে উঠেছে।
রাফির মাইগ্রেনের ব্যাথা এতটাই বেড়েছে যে শেষে ছুটি নিয়ে বাসায় হাজির হল।শব্দহীন হয়ে দরজা খুলল,নোহা কোনভাবে যদি বুঝে যায় আগেই চলে এসেছে তাহলে এসে জিজ্ঞেস করবেই কি সমস্যা। রাফি এখন কাউকে তার আশেপাশে চায় না।দরজা যেভাবে খুলেছিল সেভাবেই বন্ধ করে পিছনে ফিরে চমকালো।যার ভয়ে এত চুরি করে রুমে আসা সেই স্বয়ং তার রুমে উপস্থিত।আলমারি খুলে কিছু দেখছে রাফি কিছু না বলে নোহার পিছনে গিয়ে দাড়াল।এই মেয়ের শরীরের ঘ্রান রাফির নেশা ধরিয়ে দেয়।তাইতো দূরে থাকতে বলে।রাফি বুঝতে পারে নোহা কাঁদছে।নিজেকে সামলে উঁকি দিয়ে দেখে তারা স্পেশাল মানুষটার জন্য কেনা গিফট বক্স নোহা দেখে নিয়েছে হাতে ধরা আবোলতাবোল মনে লেখা চিরকুট রাফি একপ্রকার ছিনিয়ে নিল সবকিছু।
নোহা চমকে পাশে তাকায়।চোখে পানি,নাক লাল,ঠোঁট ফুলে মুখের অবস্থা একাকার।নোহা কিছু বলেনা চোখের পানি ফেলে রাফির দিকে তাকিয়ে আছে।রাফির গোপন জিনিসে হাত দেয়াতে রেগে গেছে ধমকে বলল,
—“কারো জিনিস হাত দিতে হলে পারমিশন লাগে।”
নোহা নিশ্চুপ হয়ে গেছে।এমনটাই কি হওয়ার ছিল?এত ভালোবাসা, এত মায়া সব রাফি পায়ে ঠেলে কিনা অন্য নারীতে আশক্ত।এত ভালোবেসেও তার মাঝে আশক্ত করতে পারল না?নিজের ব্যর্থতায়
নোহার ভাঙ্গা হৃদয় থেকে হাহাকার ঠেলে আসে।কষ্টে ঠোঁট ফুলে কান্না আসে।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনরকমে গলায় শব্দ এনে চিরকুটটা নির্দেশ করে বলল,
—“এর জন্যই কি আমার এত ভালোবাসার কোন দাম নেই রাফি?”
রাফি বুকে সুক্ষভাবে সুইয়ের খোচা অনুভব করল।নিজেকে খুনের আসামি মনে হচ্ছে।নোহার কান্নাভেজা মুখ, ফুলে উঠা ঠোঁট, আর এই প্রথম তাকে বুজে আসা গলায় নাম ধরে ডাকা।রাফির নিজেকে পাগল মনে হল।এমন গিফট বক্স এভাবে রেখে যাওয়া তার উচিত হয় নি।আবার সেদিন জ্বরের ঘোরে একটা চিরকুট লেখেও রেখেছিল।শিট শিট।
নোহা এখনো উত্তরের আশায় রাফির দিকে তাকিয়ে আছে।
রাফি নিজেকে সামলানোর জন্য চোখের দৃষ্টি এদিক ওদিক নিল।তারপর কড়া গলায় বলল,
—“বের হয়ে যা এখনি।”
নোহা আরো কয়েকপলক তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।রাফি বিছানায় বসে দু হাত দিয়ে চুল খামচে ধরে।এত যন্ত্রণা।এত যন্ত্রনা। না।আর এই বাসায় থাকা যাবে না।আজকেই দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে।
–চলবে–