সুখের খোঁজে পর্ব-২৪+২৫

0
745

#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -২৪)
#মৌমিতা হোসেন

সময় স্রোতের মতো বয়ে যেতে থাকে। তুলির বয়স এখন চার বছর।স্বভাব একেবারে নিতুর মতো হয়েছে। ঠান্ডা মেজাজের,গুলুমুলু ,আর দেখতে একেবারে মায়ের মতো।বাবা বলতে অজ্ঞান।বাবার কলিজার টুকরা হলো তুলি। রাতে দোকান থেকে আসার পর থেকে বাবার সাথে আঠার মতো লেগে থাকে। বাড়ির প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে হওয়ায় সবার আদরে আদরে বেশি আহ্লাদি হয়ে গেছে তুলি।তাই একটুতেই কেঁদে দেয়।

এই চার বছরে অনেক শুভ কাজ হয়েছে। তপু ভাই আর তৌসিফ এর মধ্যকার সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ভালোবাসা এখন দেখার মতো।সব বিপদে, আনন্দে একজন অন্যজনের পাশে থাকে সর্বক্ষন। দুই বছর আগে তপু ভাই বিয়ে করেছে। অফিসের এক কলিগ এর সাথে বিয়ে হয়।নাম জাকিয়া।বেশ ভালো মেয়েটা।এক ছেলে হয়েছে বয়স আট মাস।

জুঁইয়ের বিয়ে হয়েছে তিন বছর চলছে।বেশ ভালোই আছে। প্রথমে তো বিয়ে করতেই চায়নি। পড়ালেখা না শেষ করে নাকি বিয়েই করবে না। কিন্তু ভালো পাত্র পেয়েছে বলে সবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে যায়। শ্বশুর বাড়ি মিরপুরে। সবাই বেশ অমায়িক। জুঁই কে বেশ ভালোবাসে।ওর এক ছেলে নাম জাহিন।বেশ দুষ্টু।যখনি আসে টুকটুক করে হেঁটে বেড়ায়।আধো আধো বুলিতে কথা বলে।

সাদিয়া ইডেন কলেজে ভর্তি হয়েছে। দ্বিতীয় বর্ষের ক্লাস এখনো শুরু হয়নি।ওর জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে। ভালো ছেলে পেলেই হয়তো বিয়ে দিয়ে দেবে।

আজকে তুলি সকাল বেলাতেই কান্না করতে করতে এসে তৌসিফ কে বলছে,” বাবা দেখো জাহিন কাল আমার খেলনা ভেঙে ফেলেছে।”

হাসপাতালে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো এমন সময়ে তুলির ঘুম ভাঙতেই কালকের বিচার আজ দিচ্ছে কেঁদে কেঁদে। তৌসিফ তুলিকে কোলে বসিয়ে আদর দিয়ে বলে,”ও তো ছোট ভাই তোমার।তাই না বুঝেই ভেঙে ফেলেছে মা । তাই কেঁদো না মা আমার। আমি আরেকটা এনে দেবো তোমাকে হলো তো?”

তুলি কান্না থামিয়ে হাসি দিয়ে বলে,”ওকে আমার জন্য কিটক্যাটও আনবে বাবা। জাহিন এর জন্য আনবে না।ও দুষ্টু।”

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে দাও মামনি।দাদা ভাইয়ের কাছে যেতে হবে।দাদা ভাইয়ের অসুখ করেছে তো। সাথে সাথে তুলি আবার গাল ফুলিয়ে বলে ,”আমাকে নিয়ে যাও বাবা। আমি দাদাভাই কে দেখবো।”

“ঠিক আছে নিয়ে যাবো।”বলেই বুকের ভেতর কেমন যেনো করে ওঠে তৌসিফ এর।আজ এক সপ্তাহ ধরে আকবর আলি আইসিইউ তে আছে। বার্ধক্য জনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলো অনেক আগে থেকেই।এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ স্ট্রোক করে।সেই থেকেই হাসপাতালে ভর্তি।ডাক্তার সব আশা ছেড়ে দিয়েছে। ওনাকে দেখার জন্যই জুঁই কাল এসেছে এই বাসায়।
এমন সময় নিতু তাড়াহুড়ো করে এসে তৌসিফ কে বলে,”আসুন নাস্তা দিয়েছি।খেয়ে তাড়াতাড়ি যান হাসপাতালে।আর কি খবর হয় আমাকে জানাবেন। আমার ভালো লাগছে না কিছুই।”

“তোমাকে না কতোবার বলছি নিতু যে এ সময়ে এভাবে দৌড়ঝাপ করো না। একটু আস্তে কি কাজ করা যায়না?”

“ছয় মাস চলছে।এখন আবার কি সমস্যা হবে? আমি যেতে চাচ্ছি আপনার সাথে।প্লিজ আমাকে নিয়ে যান। আমি বাবাকে দেখতে চাই। সাতটা দিন ধরে বাবা হাসপাতালে। সবাই যাচ্ছে। আপনিও যাচ্ছেন। আমার কি দেখতে ইচ্ছে করেনা?”

“অবশ্যই করে। কিন্তু এই অবস্থায় তোমাকে এতো দুরে হাসপাতালে আমি নিয়ে যাবো না। অসুস্থ হয়ে যাবে।আর এই সময়টা বিপদজ্জনক।ডাক্তার এবার তোমাকে সাবধানে থাকতে বলেছে।তাই হেয়ালি করোনা নিতু রানি।”কথার মাঝে হঠাৎ হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। তৌসিফ রিসিভ করে কথা বলতে বলতে ধপ করে বিছানায় বসে পরে। নিতু কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। নিতু ভয় পেয়ে যায়।উদ্বেগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে ,”কি হয়েছে ? আপনি কাঁদছেন কেনো?কে …কে ফোন করেছে?”

“হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে।বাবা.. আমার বাবা আর নেই নিতু।”বলে কাঁদতে থাকে তৌসিফ।নিতু ও কেঁদে দেয়।কি করবে ভেবে পায়না।এরই মধ্যে তপুও খবর পেয়ে দৌড়ে ওপরে আসে। তৌসিফ কে এসে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। সবাই মিলে হাসপাতালে যায়। নিতুর শরীর খারাপ থাকায় ওকে আর সাথে করে নিয়ে যায়না।

একসাথে অনেক সমস্যা থাকায় আবারো স্ট্রোক করে। এবার আর ডাক্তার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারেনি।হাসপাতালের ফর্মালিটিজ শেষ করে আকবর আলির লাশ নিয়ে ফিরতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। এলাকার স্থানীয় আর ভালো মনের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন আকবর আলি।তাই অনেক লোক তার জানাজায় শরীক হয়।এশার নামাযের পর জানাযা হয়।

সালেহা বেগম সাজিদ, সেতুকে নিয়ে দুপুরেই চলে আসে। নিতু শ্বশুর এর মাঝে নিজের বাবাকে খুঁজে পেয়েছিলো। অনেক ভালোবাসা পেয়েছে।তাই ওনার মৃত্যু মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। সবাই কেঁদেই যাচ্ছে।আর তুলি তো দাদাভাই দাদাভাই করে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো কিছু সময় আগে।

তৌসিফ এর মায়ের কবরের পাশেই আকবর আলির দাফন সম্পন্ন হয়।মেনে নিতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয়। তাই তৌসিফ ও বাবার মৃত্যু মেনে নিয়েছে।ঐ যে সময় সব ঠিক করে দেয়। তেমনটাই হয়েছে।নিজে শক্ত হয়ে নরম মনের নিতু রানিকে সামলে নিয়েছে। সালেহা বেগম কিছু দিন থেকে চলে গেছে।সময় যেতে থাকে। নিতু তৌসিফ দুজন দুজনকে খুব সুন্দর ভাবে সামলে নিয়েছে। বাবাকে হারানোর শোক অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে।

নিতুর ডেলিভারি ডেটও চলে এসেছে। দুইদিন ধরে নিতুর শরীর খারাপ। প্রেসার বেড়ে গেছে।তাই এবার আর রিস্ক না নিয়ে আগেই ডাক্তার এর সাথে পরামর্শ করে নিতু কে হাসপাতালে ভর্তি করায় তৌসিফ।সব পর্যবেক্ষণ করে ডাক্তার বলে,”এবার মনে হয় সিজার করতে হবে তৌসিফ সাহেব। তা না হলে একটু রিস্ক ‌হয়ে যাবে।প্রেসার গতো এক সপ্তাহ ধরে অনেক বেশি,আর বাচ্চার নড়াচড়াও কম। তাই তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিন।”

“আপনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করুন। নিতুর ব্যাপারে আমি কোন রিস্ক নিতে চাইনা। জটিলতা মনে করলে সিজার করে ফেলুন।”খুব চিন্তাযুক্ত অবস্থায় কথাগুলো বলে তৌসিফ।

ডাক্তার বলে,” ঠিক আছে। সব যদি ঠিক থাকে তাহলে কাল সকালে অপারেশন করে ফেলবো ইনশাআল্লাহ। আপনি প্রস্তুতি নিয়ে নিন।”

“ঠিক আছে।”তৌসিফ নিতুর কেবিনে গিয়ে সব জানালে নিতু বলে,”নরমাল ডেলিভারি হলে ভালো হতো না?”

“না ভালো হতো না।কোন রিস্ক চাইনা।”বলেই নিতু কে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খায়।বলে,”অনেক ভালোবাসি তোমাকে নিতু।বাবা আমাকে ফেলে চলে গেলো। তোমাকে আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লাগবে।একদম আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত লাগবে।”

নিতু কেঁদে দেয়।বলে,”আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। আপনি যেটা যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে।”

এরই মাঝে তুলি ঘুম থেকে উঠে বাবা -মায়ের আদর দেখে গাল ফোলায়।বলে,”আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সবাই পঁচা।”

তৌসিফ, নিতু দুজনই তখন তুলিকে দেখে ওর কথা শুনে হেসে দেয়। পরদিন নতুন বাবু কিনে আনবে শুনে রাগ ভেঙে যায়। খিলখিল করে হাসতে থাকে দুজনের ছোট পরীটা।

পরদিন সকালে সিজার করবে।তাই চাচিরা,তপু, জুঁই সবাই এসে হাজির হয়। সবার কাছ থেকে দোয়া নেয় নিতু।চাচিরা সাহস দেয়।আর সালেহা বেগম মেয়েকে মুখে মুখে সাহস দিলেও ভেতরে খুব টেনশন করতে থাকে। তৌসিফও খুব চিন্তায় থাকে। নিতু কে ওটিতে নেয়া হয়।

বেশ কিছু সময় পর নার্স বাইরে এসে তৌসিফ কে খুঁজলে তৌসিফ দৌড়ে সামনে যায়। নার্স বলে,”আলহামদুলিল্লাহ এবার ছেলে হয়েছে। মিষ্টি না খাইয়ে যাবেননা কিন্তু।”

তৌসিফ বাবুকে কোলে নিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ। আমার এক বাবা চলে গেছে আর এক বাবা কে আল্লাহ তায়ালা দিয়েছে।”বলে তাকিয়ে দেখতে থাকে।চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু পরে দুই ফোঁটা। আজ বাবার কথা মনে পরে যায় ।এবার আর এই ছোট্ট বাবুকে কোলে নিতে ভয়, সংকোচ হয়না। উপস্থিত সবাইও বেশ খুশি হয়।তপু এসে কানে আযান দেয়। নিতু সুস্থ আছে জেনে সবাই চিন্তামুক্ত হয়।

সবাই নতুন বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত এমন সময় তুলি এসে কান্না শুরু করে দেয়।বলে,”আমার ভাইয়াকে কেউ আমাকে দেয়না। সবাই পঁচা।”

সবার হঠাৎ খেয়াল হয় তুলির কথা। তাড়াতাড়ি তুলিকে বসিয়ে ওর কোলে নতুন বাবুকে ধরে। ওমনি তুলি ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে ছোট বাবুকে আলতো ছুঁয়ে দেয়।আর খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে । তুলিকে দেখে অন্যরাও সবাই হেসে দেয়।

নিতু কে কেবিনে দেবে সন্ধ্যায়। ততোক্ষণ পর্যন্ত তৌসিফ এর অস্থিরতা ছিলো দেখার মতো। দুবার বিভিন্ন অজুহাতে নিতু কে গিয়ে দেখে আসে। পরেরবার নার্সরা আর ঢুকতে দেয়না।বলে একটু পরেই কেবিনে দেবে তাই আর যেনো এখানে না আসে। নিতু কে নিয়ে বারবার বিভিন্ন প্রশ্ন করায় নার্সরাও কিছুটা বিরক্ত হয়। আবার হাসাহাসিও করে। তৌসিফ বিষয়টা বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই।কারন কেবিনে দেয়ার আগ পর্যন্ত ওর টেনশন কমবে না।

অবশেষে সন্ধ্যায় নিতু কে কেবিনে দিলে তৌসিফ এর মনে শান্তি আসে। দু’চোখ ভরে অনেক সময় ধরে নিতু কে দেখে। নিতুর ক্লান্ত,বিদ্ধস্ত,ব্যাথায় কাতর চেহারা দেখে তৌসিফ বুকের মাঝে ব্যাথা অনুভব করে। নিতুর চোখগুলো ফুলে আছে।ব্যাথায় অনেক কেঁদেছে বোঝা যাচ্ছে।একজন মা কতো শতো কষ্ট করে একটা সন্তান জন্ম দেয়। এতোটা কষ্ট মা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কেউ কখনো সহ্য করতে পারবেনা।আর তাই তো মায়ের সাথে কারো তুলনা নেই।এজন্যই তো আল্লাহ মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত এর কথা বলেছেন।

এসব ভাবনার মাঝেই নিতু তৌসিফ এর দিকে হাত বাড়ালে তৌসিফ এর ধ্যান ভাঙে। নিতুর হাত ধরে বলে,”কিছু লাগবে নিতু রানী? খুব কষ্ট হচ্ছে?”

“হুম অনেক ব্যাথা হচ্ছে।নড়তে পারছিনা।”

তৌসিফ নিতুর কষ্ট দেখে কি বলবে বুঝতে পারেনা। প্রথমবার নরমালে হওয়াতে এসব সম্পর্কে তৌসিফ এর তেমন ধারণা ছিলোনা। কিন্তু এবার….. অপারেশন শব্দটা শুনলেই ওর কেমন জানি ভয় ভয় লাগতে থাকে।তিন দিন নাকি হাসপাতালে থাকতে হবে।আর তার ওপর নিতুর এই ব্যাথায় ভরপুর মুখ দেখে তৌসিফ এর আর কিছুই ভালো লাগে না। তবুও শান্তনা দেয়।বলে,”চিন্তা করোনা।ঔষধ দিচ্ছেতো। দেখবে ব্যাথা কমে গেছে। চুপচাপ শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

তৌসিফ পাশে বসে নিতুর মাথায় হাত বোলাতে থাকে।

চলবে……

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -২৫)
#মৌমিতা হোসেন

নিতু কে কেবিনে দেয়ার পর সবাই বাসায় চলে যায়। সালেহা বেগম,বিথি আর তৌসিফ থেকে যায়। সবাই মিলে তুলিকে নেয়ার অনেক চেষ্টা করলেও নিতে পারেনি।কান্না করে অস্থির।তুলির কান্না দেখে শেষমেষ নিতুই নিষেধ করে ।তুলির আজ ওর মায়ের কাছে অনেক আবদার।কোন কিছুই অন্যের কাছে করতে চায়না। খুব বায়না ধরে। হাসপাতালে এই তিন দিন তুলি খুব বিরক্ত করেছে নিতু কে। নিতু অবশ্য খুব ঠান্ডা মাথায় তুলিকে মানিয়েছে।আদর দিয়ে, বুঝিয়ে,শাষন করে। তৌসিফ সবটাই অবাক হয়ে শুধু দেখেছে।

সালেহা, বিথি, সাদিয়া সবাই পালা করে হাসপাতালে থেকেছে। সবার ওপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে।অবশ্য এই ধকল আরো কিছুদিন যাবে।কারন ডাক্তার বলেছে, বাসায় গিয়েও নিতু কিছুদিন কোন কাজ করতে পারবে না।বেশ কিছুদিন বিশ্রাম নিতে হবে।

তিন দিন পর নিতু বাসায় যায়। এবার খুব কষ্ট হচ্ছে নিতুর। হাঁটতে, বসতে সব কাজেই অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হচ্ছে‌। নিতুর অবস্থা দেখে তৌসিফ বেশ টেনশন এ পড়ে যায়। দোকানে দুটো ছেলে আছে ওদের ওপরে দায়িত্ব দিয়ে তৌসিফ সারাক্ষন নিতুর খেয়াল রাখতে শুরু করে ‌। পনেরো দিন পর সালেহা বেগম চলে যান। সাজিদ,সেতুর পড়ালেখায় বেশ ক্ষতি হচ্ছিলো তাই যেতে হয়। নিতুর অবশ্য এখন হাঁটতে, বসতে সমস্যা হয়না। তবে ভারি কিছু করা যে নিষেধ। বিথি, সাদিয়া যখন সময় পায় তখন আসে। বাবুকে নেয় খেয়াল রাখে। রাহেলা খালা সংসার এর কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে।

আর তৌসিফ প্রায় দেড় মাস দোকানে ঠিকমতো যায়না। একবার গিয়ে কিছু ক্ষন থেকে হিসেব বুঝে টাকাপয়সা নিয়ে আবার চলে আসে ।পুরোপুরি নিতু কে সময় দেয়। তুলির খেয়াল রাখে। নিতু তৌসিফ এর সব কর্মকাণ্ড দেখে আর অবাক হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডা অনেক আগে থেকেই বন্ধ তৌসিফ এর। বাচ্চাদের ক্ষতি হবে তাই সিগারেট খাওয়া অনেক কমিয়ে দিয়েছে।যেই মানুষটা কোন কিছুর কোন দায়িত্ব নিতে চাইতো না।সে এখন দুই সন্তানের বাবা। নিতু,বাচ্চা সবার কতো খেয়াল রাখে। নিতুর নিজেকে খুব সুখী একজন মনে হয়।

তৌসিফ ছেলের নাম রাখে নাহিন। ছেলে-মেয়ে, নিতু কে নিয়ে তৌসিফ এর সুখের সময় কাটতে থাকে। দোকানে গিয়ে কতোবার যে নিতু কে ফোন দেয় তার কোন হিসেব নেই। একবার নিতুকে দেখার বাহানায় আবার একবার ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলার বাহানা করে। প্রতিদিন দোকান থেকে আসার সময় বাচ্চাদের জন্য আবদার মতো বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসে।আর নিতুর জন্য আনে বেলি ফুলের মালা।নাহিন হওয়ার পর আকিকার দিনে খুশিতে তৌসিফ নিতু কে বলেছিলো,”আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর প্রাপ্তি হলে তুমি।তোমার মাঝে আমি পৃথিবীর সকল সুখ খুঁজে পেয়েছি।এই সুখ নামক তোমাকে আমি কখনো হারাতে চাইনা।তুলির পরে নাহিন কে পেলাম। সত্যি আমি যে কতোটা সুখি সেটা তোমাকে ঠিক ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা। আমার এলোমেলো জীবনটাকে তুমি গুছিয়ে নিয়েছো।আজ আমার জীবনটাকে এতো রং দিয়ে রঙিন করার জন্য তোমার কি লাগবে বলো।কি উপহার দিলে তোমার মন ভরবে। তুমি খুশি হবে। আমারও মনে হবে যে আমি তোমায় কিছু দিয়েছি।”

নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে বলে,” আপনি আমাকে এতোটা ভালোবাসা দিয়েছেন যে এর ভারই আমি সহ্য করতে পারছিনা।তাহলে এই এতো ভালোবাসার পর আমার আর কি চাওয়ার থাকতে পারে বলুন। আরো কিছু চাওয়ার সাহস আমি দেখাই কি করে?”

“এসব বললে হবেনা। কিছু একটা তো চাইতেও হবে। উপহার হিসেবে আমি তোমাকে দিতেই পারি।তাই তাড়াতাড়ি বলো তোমার কী চাই!”

নিতু একটু ভাবে তারপর তৌসিফ এর হাত দুটো ধরে বলে,”এই যে আপনার হাত দুটো ধরেছি। এই দুটো হাত কখনো ছেড়ে যাবেন না। আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনার সাথে বাঁচতে চাই,সুখে দুঃখে সব সময় আপনাকে আমার পাশে চাই, আমরা পড়ালেখা শেষ করতে পারিনি কিন্তু আমি চাই আমাদের সন্তানেরা পড়ালেখা শেষ করুক, মানুষের মতো মানুষ হোক ।আর এক্ষেত্রে যেনো আপনি আমাকে সাহায্য করেন।”

“আর কিছু চাইনা? ভেবে বলো নিতু রানি।পরে কিন্তু চাইলেও পাবেনা।”বলে তৌসিফ মিটমিট হাসতে থাকে।

নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ এর মনোভাব।তাই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”লাগবে আর একটা জিনিস।”

“হুম বলো বলো কি লাগবে।”

“এতো দিনের মতো আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিদিন দোকান থেকে আসার সময় আমার জন্য বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবেন। এটা আমার খুব পছন্দের।

তৌসিফ নিতুর কথা শুনে হেসে দেয়। নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,”বৌ তুমি আজীবন এমন বোকা,নরম তুলতুলেই থেকো।এই নরম ,বোকা বৌকে আমি অনেক ভালোবাসি। অনেক। প্রতিদিন যদি বেলি ফুলের মালা না পাই তাহলে?তখন অন্য ফুল দিয়ে মালা গেঁথে আনলে হবে তো?”

“হুম হবে। বেলি ফুল আমার খুব পছন্দের। কিন্তু যদি না পান তখন আর কি করার।তখন অন্য ফুলের মালা আনবেন। আপনার আনা সব কিছুই আমার পছন্দ। খুব পছন্দ।”

নিতুর দিকে তাকিয়ে ওর কথা গুলো শুনতে থাকে তৌসিফ। কপালে চুমু খেয়ে বলে,”কাল থেকে রোজ আসার সময় আমি তোমার জন্য বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসবো।আর না পেলে অন্য ফুলের হলো তো?”

নিতু হেসে দেয় বলে,” হুম হলো।”

সময় যেতে থাকে।নাহিনের বয়স এখন দুই বছর। তুলিকে স্কুলে দিয়েছে গতো বছরই।এখন নার্সারিতে পড়ে।নাহিন অনেক দুষ্টু হয়েছে। সারাক্ষন ওদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয় নিতু কে।স্কুলে নিয়ে যাওয়া, নিয়ে আসা, রান্না, নাহিন কে সামলানো।সব মিলিয়ে নিতু ক্লান্ত হয়ে যায়। তবে সন্ধ্যা হতেই তৌসিফের অপেক্ষায় থাকে। সারাদিন বাসায় থাকে না মানুষ টা। অনেক পরিশ্রম করে। একবারে রাতে বাসায় ফেরে । তবে যতোই ঝামেলায় থাকুক ফুলের মালা আনতে ভোলে না নিতুর ভালোবাসার মানুষ টা।কেনো যে ওকে এতো ভালোবাসে সেটাও বোঝেনা।আজ রাত প্রায় দশটা বেজে গেলো এখনো তৌসিফ আসেনি। নিতুর ফোনটাও ধরছে না।এক পর্যায়ে ফোন বন্ধ আসছে।লাইন ঢুকছেনা।তাই খুব চিন্তা হতে থাকে নিতুর। বাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে অপেক্ষায় থাকে তৌসিফের। অবশেষে রাত এগারোটায় কলিং বেল বাজতেই নিতু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তৌসিফ এসেছে।ডান হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ। সাথে তপুও আছে। নিতু দেখেই অস্থির হয়ে যায়। কেঁদে দেয় তৌসিফ কে ধরে।

নিতু কাঁদতে কাঁদতে বলে,”কি হয়েছে আপনার?কি হয়েছে বলুন? আমি সেই সন্ধ্যা থেকে ফোন করেই যাচ্ছি। আপনার ফোন কোথায়?আর ….আর এসব কীভাবে?”

তপু নিতুর অবস্থা দেখে বলে,”নিতু শান্ত হও। আগে ভেতরে ঢুকে বসতে দাও তৌসিফ কে।তারপর বলছি আমি।”

তৌসিফ কে দেখে নিতুর আর খেয়াল ছিলো না যে পাশেই তপু ভাই দাঁড়িয়ে আছে। নিতু তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে বলে,”দুঃখিত ভাইয়া।আসোলে ওনার অবস্থা দেখে আপনি যে দাঁড়িয়ে আছেন খেয়াল করিনি।”

“বুঝতে পেরেছি।এখন আগে তৌসিফ কে বসতে দাও।এরপর কিছু খাইয়ে ঔষধগুলো খাওয়াও।”এই কথা বলে তপু নিতুর হাতে একটা ঔষধের প্যাকেট দেয়।

নিতু প্যাকেট রেখে তাড়াতাড়ি তৌসিফ কে ধরে ড্রইং রুমে বসায়।এরপর বলে,”ভাইয়া বসেন আর প্লিজ আমাকে বলেন এসব কীভাবে হয়েছে?”

তপু আড়চোখে তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”কিরে আমি সব বলবো নাকি তোরটা তুই বলবি?”

তৌসিফ শান্ত চোখে তপুর দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি নিজেই বলবো।তুই বাসায় গিয়ে রেস্ট নে। আমার জন্য আজ অনেক কষ্ট করেছিস। অনেক ধন্যবাদ ভাই।”

“বাবারে বাবা ভাই ডাকছিস আবার ধন্যবাদ দিচ্ছিস? দেবো পিঠে বারি।তুই রেস্ট নে।আর কিছু লাগলেই ফোন দিস।”

“হুম অবশ্যই ফোন দেবো। এভাবেই আমার পাশে থাকিস।আর আমার অনুপস্থিতিতে আমার পরিবারটার ও খেয়াল রাখিস।”

একটু রেগে গিয়ে তপু বলে,”হয়েছে এবার থাম।”

আস্তে করে তৌসিফ এর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”এবার আগে তোর এই বাচ্চা বৌকে সামলা।আর কিছু ক্ষন গেলে কান্না করতে করতে নিতুই অসুস্থ হয়ে যাবে। দুজনকে একসাথে সামলাতে পারবো না আমি।”

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ছোট বোনু কান্না বন্ধ করে ওকে ঔষধ খাওয়াও।আর যে কোন সমস্যা হলে ফোন দিতে ভুলে যেওনা যেনো। ভাইটা সব সময় তোমার পাশে আছি মনে রেখো।”

তপু চলে গেলে দরজা লাগিয়ে নিতু তৌসিফ এর সামনে এসে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে।আর বলে,”এখন কি বলবেন দয়া করে ?আপনার এমন অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”

তৌসিফ বাম হাতটা নিতুর মাথায় রাখে।নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”চোখটা মোছ। একটুতেই এতো কাঁদো কেনো তুমি? তুমি কাঁদলে আমার বুকের ভেতরটা কেমন অস্থিরতায় ছেয়ে যায়। সেটা কি তুমি বুঝতে পারো না?”

নিতু আরো জোরে কান্না শুরু করে আর বলতে থাকে,” ঠিক আছে আর কাঁদবো না।এখন বলুন এই অবস্থা কীভাবে হয়েছে?”

নিতুর অবস্থা দেখে এই কষ্টের মাঝেও তৌসিফ হেসে দেয় আর বলে,”পাশের দোকানটা আমি কিনে নেবো।আজ ওটার জন্য এডভান্স তিন লক্ষ টাকা দেয়ার কথা ছিলো। ভেবেছিলাম এবার তোমার জন্মদিনে তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো।তাই তোমাকে আগে বলিনি। কিন্তু দেখো সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে আমি নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম।”

“মানে?”

নিতু কে পাশে বসতে ইশারা দেয়। নিতু উঠে এসে পাশে বসে বলে,”বলুন এখন।”

“টাকা নিয়ে বারোটার দিকে আমি ঐ ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য বের হই।কেউ মনে হয় আগে থেকেই আমাকে অনুসরন করছিলো।যাওয়ার পথে কোথা থেকে একটা বাইক সামনে এসে দাঁড়ায়।ব্যাগ নিতে চাইলে আমি বাধা দেই আর তখনই ওরা ছুড়ি দিয়ে আমার হাতে আঘাত করে।মাথায় পিস্তল দিয়ে বারি দিয়ে টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয়।আর লোকজন জরো হবার আগেই ওরা টাকা নিয়ে বাইকে পালিয়ে যায়।”তৌসিফ কথা বলতে বলতে হাঁপাতে থাকে।সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে পরে।

নিতু সাথে সাথে অস্থির হয়ে বলে,”থাকে আর বলতে হবে না এখন। রুমে চলুন কিছু খেয়ে ঔষধ খেয়ে ঘুমাবেন।”

তৌসিফ নিতুর হাত ধরে আস্তে আস্তে রুমে যায়। মাথাটা কেমন ঘোরাচ্ছে।শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছে। রুমে গিয়ে ড্রেস পরিবর্তন করে,ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে।এসবেই নিতু সাহায্য করে তৌসিফ কে।এরপর খাবার এনে খাইয়ে দেয়।ঔষধ দেয়। তৌসিফ শুয়ে পরলে নিতু পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।এক পর্যায়ে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়লেও মাঝরাতে ব্যাথায় জ্বর চলে আসে। নিতু খুব চিন্তায় পরে যায় তৌসিফ কে দেখে। আবার মাথায় পানি ঢালে,জ্বরের ঔষধ খাওয়ায়। তৌসিফ এর ঘুমাতে রাত সাড়ে চারটা বেজে যায়। তৌসিফ কে দেখে নিতুর খুব কষ্ট হয়।নিতুর চোখে সারারাত ঘুমেরা ধরা দেয়না।চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকে তার খুব প্রিয় মানুষ টার দিকে।

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে