#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -১৮)
#মৌমিতা হোসেন
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে কি বলবে ভেবে পায়না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ নিতু কে দেখে হাসে।বলে,”ঠিক আছে চলো শুয়ে পরি।”
নিতু ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে দরজা লাগানো। তৌসিফ শুয়ে পরেছে।চোখ বন্ধ দেখে মনে মনে খুশি হয়।বলে,”আলহামদুলিল্লাহ মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে।”আস্তে গিয়ে খাটের এক পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে।ঘুম চোখে ধরা দিতেই যাচ্ছিলো অমনি তৌসিফ এর স্পর্শে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।এই অবস্থায় ও কি করবে বুঝতে পারছিলো না। এতো দিন পরে কাছে আসতে চাচ্ছে বাধা দিলে আবার যদি রেগে যায়। তাছাড়া বাধা দেয়া হয়তো ঠিকও হবে না।তাই কিছু বলেনা চুপ থাকে।
তৌসিফ নিতু কে ওর দিকে ফিরিয়ে একদম কাছে এনে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভয় পেওনা নিতু। তোমার ঐ সব কাজ আর করবো না।যতোক্ষনে না তুমি নিজ থেকে আমার কাছে আসতে চাও। তোমার কথা মতো নাহয় দু’জন দু’জনকে ভালো করে একটু জানি। নাকি বলো? তবে ….তাই বলে এই যে জড়িয়ে ধরা, একটু ভালোবাসা, একটু কাছে আসা ওসব কিন্তু বন্ধ হবে না। এটুকু চলবে।আর একটা কথা তোমাকে আমার অনেকটাই জানা হয়েছে। বাকিটা অল্প দিনেই জেনে নেবো। তুমিও বেশি দেরি করো না প্লিজ।এতো সময় হয়তো অপেক্ষা করতে পারবো না”কপালে আলতো আদর দিয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে রাখে।
নিতু যেনো জমে বরফ হয়ে যায়। পুরোটাই এক অন্য রকম অনুভুতি।এই কদিনেই মানুষটির এতো পরিবর্তন ও ঠিক মানতে পারছেনা। তবে খুব ভালো লাগে নিতুর।তাই আর নড়াচড়া না করে চুপচাপ শুয়ে থাকে।আজ তৌসিফ এর শরীরের ঘ্রানটাও ভালো লাগছে।এতো দিনে তো কখনো এমন লাগেনি । দুজন কখন যে ঘুমিয়ে পরে টেরই পায়না।
খুব ভোরে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে নিতুর।চোখ খুলে একদম সামনেই তৌসিফ কে দেখে রাতের কথা মনে পরে। তৌসিফ কে আজ ওর অনেক ভালো লাগে। রাতের কথা মনে পড়তেই বেশ লজ্জা পায় ।আস্তে করে ওর হাতটা সরিয়ে উঠে যায়।ওযু করে নামাজ পড়ে। বারান্দায় যেতেই টিয়া পাখিটাও ডাকে। পাখির সাথে একটু কথা বলে, গাছে পানি দেয়।আজ সকাল টা বেশ ভালো লাগছে নিতুর।এর মাঝে কলিং বেল বাজলে গিয়ে দরজা খুলে দেখে রাহেলা খালা এসেছে। ওনাকে দেখেই সালাম জানায়।বলে,”কেমন আছেন খালা?”
রাহেলা নিতু কে দেখে খুব খুশি হয়। সালামের উত্তর দিয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপনে কেমন আছেন বৌমনি?কখন আইছেন? এতো দিন কেউ বাপের বাড়ি থাকে? আপনেরে ছাইরা এই কয়দিন ইট্টুকো ভালো লাগে নাই। একলা একলা এই বাসায় এহন আর কাম করতে ভালো লাগে না।”
নিতু খালার কথায় হাসে।বলে ,”এতো কথা একবারে জানতে চাইলে উত্তর দেবো কীভাবে খালা? আগে ভেতরে আসো। রান্নাঘরে চলো কাজ করি আর উত্তর দেই।”
রাহেলা লজ্জা পায়। বলে,”রাগ হইয়েননা বৌমনি।চলেন ।”
দুজন বেশ গল্প করতে করতে নাস্তা বানায়।আকবর আলি উঠে গেলে ওনাকে নাস্তা দিয়ে তৌসিফ কে ডাকতে যায়। রুমে এসে দেখে এখনো ঘুমাচ্ছে। নিতু কি করবে বুঝতে পারেনা।ডাকলে যদি আবার রাগ করে।এই ভাবতে ভাবতেই তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। একটু অবাক হয়।বলে,”আপনি উঠে গেছেন?বাবা নাস্তা খেতে বসেছে। আপনিও আসুন।”
নিতু তৌসিফ এর কাপড় বের করে দেয়।ফ্রেশ হয়ে নাস্তা খেতে আসলে আকবর আলি বলে ওনার সাথে দোকানে যেতে।
তৌসিফ বলে,”প্লিজ বাবা আমাকে এখন আর কিছু বলো না। দোকানে এখনি বসতে চাইনা।”
আকবর আলি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। জানে যে বলে লাভ নেই। তাই চুপ থাকে। শুধু বলে,”তোর যা ইচ্ছা তাই কর। আমি আর কখনো দোকানে যেতে বলবো না তোকে।”
নিতুর খারাপ লাগে শ্বশুর এর জন্য।বয়স হয়েছে তবুও কতো খাটে। একটু দোকানে গেলে বাবাকে কাজে সাহায্য করলে কি এমন ক্ষতি হয় এই মানুষটার?
নাস্তা শেষ করে শ্বশুর চলে যায়। নিতু তৌসিফ এর কাপড় বের করে রেখে আসতে নিলে তৌসিফ ডাকে নিতু কে। বলে,”কাপড় ঢুকিয়ে রাখো। আমি আজ বাসায় থাকবো। বাইরে যাবো না।”
আবার অবাক হয় নিতু।বলে,”আচ্ছা ঠিক আছে।”কাপড় গুলো জায়গা মতো রেখে রান্নাঘরে যেতে নেয়। অনেক কাজ বাকি।এর মাঝে তৌসিফ ডাকে,”কোথায় যাচ্ছো?”
“জ্বী রান্নাঘরে।কাজ আছে।”
“কোন কাজ নেই। এখানে এসে বসো। তোমার সাথে সময় কাটানোর জন্য আমি বাইরে যাবো না।আর তুমি কিনা আমাকে রেখে রান্নাঘরে যাচ্ছো?”
নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।চুপ করে এসে বসে। তৌসিফ বেশ খুশি হয়। নিতুর সামনে বসে বলে,”রাতে ঘুম হয়েছে?”
“হুম হয়েছে।”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“হুম”
“তুমি এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে রাজি হলে কেনো? তোমার বাসায় দেখলাম অনেক বই। তোমার ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার গাইড। মানে তো তোমার পড়ালেখা করার ইচ্ছা ছিলো। তাহলে কেনো বিয়ে দিয়ে দিলো তোমাকে?”
“বাবা নেই। মাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো।তাই সব মিলিয়ে মা বললো।আর আমি মায়ের কোন কথা ফেলতে পারি না তাই রাজি হয়েছি।”
“ওওও।আচ্ছা এখন যদি তোমাকে আবার পড়ার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে কি তুমি পড়বে? আমার আবার পড়ালেখার প্রতি তেমন ঝোঁক নেই। তবে তুমি যদি চাও তাহলে বলো ভেবে দেখবো তোমাকে পড়ানো যায় কিনা।আর না চাইলে কোন জোর নেই।”
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে বেশ খুশী হয়।পড়ুক না পড়ুক তৌসিফ এর কথা শুনে,কাল থেকে ওর ব্যবহারে মনে হলো আবার একটু একটু করে ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। এতো গুলো বয়সে অন্য কারো জন্য কখনো মনে এমন ভালো লাগা কাজ করেনি। নিতু হাসি মুখে বলে,”ঠিক আছে বলবো।”
তৌসিফ নিতুর হাত ধরতে যাবে এমন সময় রাহেলা বৌমনি ডাকতে ডাকতে রুমে আসে। তৌসিফ খুব বিরক্ত হয়। নিতু তাড়াতাড়ি দুরে সরে বলে,”আমি যাচ্ছি। অনেক কাজ পড়ে আছে।”
তৌসিফ হেসে দেয়।বলে,”আচ্ছা যাও।”
এর মাঝে ওর বন্ধুরা ফোন দিলে কাজ আছে বলে বেরিয়ে পরে।যাওয়ার সময় এই প্রথম তৌসিফ নিতুর কাছে থেকে বিদায় নিয়ে যায়। ভালো লাগে নিতুর।আর বাইরে যাচ্ছে দেখেও একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে নিতু।পুরুষ মানুষ সকালে কাজে চলে যাবে রাতে ফিরবে এটাই দেখে এসেছে এতো গুলো বছর ধরে।এই বাসায় এসে তাই তৌসিফ কে সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে দেখে অথবা বাসায় বসে থাকতে দেখে নিতু বেশ বিরক্ত হতো।এখনো হয়।কেনো যে মানুষ টা বাবাকে কাজে সাহায্য করেনা এটা নিতুর মাথায় আসে না।
নিতু রান্না শেষ করে গোসল করে, নামাজ পড়ে উঠতে না উঠতেই দেখে তৌসিফ চলে এসেছে। হাতে বেলি ফুলের মালা। এতো তাড়াতাড়ি এসেছে তাই বেশ ভালো লাগে নিতুর।কারন আজ রান্নার সময়ে খালার কাছে শুনেছে গতো কয়দিন তৌসিফ কেমন বেপরোয়া সময় কাটিয়েছে। খাওয়া,গোসল সব কিছুই ছিলো এলোমেলো।আজ তাই তৌসিফ কে দেখে মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগলো মনে,”আপনি কি তবে আমার জন্যই আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেন? ফুলের মালাটা কি আমার জন্য?”
এমন সময় তৌসিফ সামনে দাঁড়িয়ে তুড়ি বাজায়।বলে,”তোমার কি বিরবির করার রোগ আছে?কি বলছো জোরে বলতে পারোনা?”
তৌসিফ এর কথায় ওর দিকে তাকায় মুচকি হাসে।আর তৌসিফ নিতু কে দেখে অপলক। ঘোমটা মাথায় পুরো বৌ বৌ লাগছে। ফুলের মালাটা নিতু কে দেয়।বলে,”এটা তোমার জন্য। খোঁপায় লাগালে দেখতে দারুন লাগবে তোমায়।এক জায়গায় গিয়েছিলাম ফেরার পথে সামনে পরলো তাই নিয়ে এলাম তোমার জন্য।”
নিতু চরম অবাক হয় আর খুব খুশি হয়। মালাটি নিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ওপর রাখে। তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে বলে,”ধন্যবাদ উপহার এর জন্য। আমি খাবার দিচ্ছি ফ্রেশ হয়ে খেতে আসুন।”
নিতুর মুখে হাসি দেখে তৌসিফ ও বেশ খুশি হলো।এই প্রথম ওর দিকে তাকিয়ে এভাবে হাসতে দেখলো নিতু কে।প্রিয় মানুষ কে একটু খুশি করতে পারলেই যে এতো ভালো লাগে সেটা আগে বোঝেনি তৌসিফ। আগে কখনো এমন আনন্দ পায়নি ও।অবশ্য এক বাবা ছাড়া আপন বলতে আর কাউকেই ও কখনো ভাবতে পারেনি।ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া শেষ করে তৌসিফ রুমে এসে নিতুর অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু এমন সময় দুই চাচি আর বোনেরা আসায় তৌসিফ এর আশা ভরসা সব শেষ হয়ে যায়। নিতু ও এতো দিন পর সবাইকে পেয়ে গল্প জুড়ে দেয় সবার সাথে। তৌসিফ কিছু সময় রেস্ট নিয়ে বাইরে চলে যায়। নিতু কে এতো হাসি খুশি দেখে ভালো লাগে সাথে একটু মন খারাপ হয় ।কারন ওর সাথে কখনো নিতু এভাবে হাসেনি। তৌসিফ যাওয়ার আগে নিতু কে জোরে জোরে ডাকতে থাকে। নিতু ডাক শুনে দৌড়ে যায়। বলে যে,”কি হয়েছে? কিছু লাগবে?”
“আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ইচ্ছে হলে ফুলের মালাটা খোঁপায় লাগিও। ফিরতে রাত হবে। তোমাদের গল্প শেষ হোক তারপর নাহয় আসি। এখানে আমার সাথে কথা বলার মতো সময় কারো নেই।”
নিতু একটু মন খারাপ করে।কারন নিতুও চাচ্ছে তৌসিফ এর সাথে সময় কাটাতে। অস্বস্তি হচ্ছে,ভয়, লজ্জা সব লাগছে তবুও চাচ্ছে মানুষটাকে জানতে। কিন্তু বাসায় মেহমান এলে তাদের রেখে কি রুমে বসে থাকা যায়?তাই তৌসিফ এর কথার কোন উত্তর দেয়না। চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ কথা শেষ করে যাওয়ার সময় নিতুর গালে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।
নিতু সাথে সাথে আবার চমকে যায়, হার্টবিট বেড়ে যায়। গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ওভাবে। বিথি এসে নিতু কে এভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,”কি হয়েছে ভাবি? এভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো?”
নিতু গাল থেকে হাত সরিয়ে ফেলে।বলে ,”কোই কিছু হয়নি তো বোনু।চলো চা বানাই।চাচিরা সবাই বসে আছে।”
নিতু চা, নাস্তা দেয় সবাইকে। সবাই গল্প করে একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সন্ধ্যার পর নিতু মা, সেতু এদের সাথে ফোনে কথা বলে।একা একা সময় কাটায়। হঠাৎ ফুলের মালাটা দেখলে খোঁপায় লাগায়। একটা টিপ পরে।আজ কেনো জানি তৌসিফ এর জন্য অপেক্ষা করতে ভালো লাগছে।রাতে দশটার দিকে তৌসিফ আর বাবা একসাথে বাড়ী ফেরে। তৌসিফ বাসায় আসার পর থেকে লজ্জায় নিতু রুমে যায়না। খাবার গরম করে শ্বশুর কে ডেকে তৌসিফ কে ডাকতে যায়।
এদিকে এতোটা সময় পরে বাসায় আসার পরেও নিতু রুমে না আসায় তৌসিফ একটু রাগ করে। বারান্দায় টিয়া পাখির দিকে তাকিয়ে বলে,”তোর নিতুর মনে একটু ও মায়া নেই জানিস পাখি? এতোটা সময় পর ফিরেছি অথচ এখনো সামনে আসছেনা।এসব কি মানা যায় বল?”
নিতু রুমে এসেই দেখে তৌসিফ কোথাও নেই। ধীরপায়ে বারান্দায় যায়। তৌসিফ কে দেখে মিনমিন স্বরে বলে,”খাবার গরম করেছি। খেতে আসুন।”
তৌসিফ ফিরে তাকায়। নিতু কে দেখে বলে,”আমি খাবো না।ক্ষিদে নেই।”
নিতু বুঝতে পারে যে তৌসিফ অভিমান করে এসব বলছে।তাই আবারো সাহস করে বলে,”রাগ করছেন কেনো? মানে মেহমান থাকলে কি আমি তাদের ফেলে রুমে বসতে পারি?তারা তখন আমাকে খারাপ ভাববে না?তাই……”
“তাই এখন এতো রাতে আসার পরেও সামনে আসোনি?এখনো কি মেহমান আছে?”
“না মেহমান ছিলোনা। আমার কাজ ছিলো।”বলে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওকে দেখছে।আবারো অস্বস্তি হয় ওর ।চোখ নামিয়ে ফেলে। তৌসিফ এতোক্ষণে নিতুর দিকে তাকিয়ে দেখে মুগ্ধ হয়। কপালে টিপ, খোঁপায় ফুল এতেই যেনো দারুন লাগছিলো নিতুকে । তৌসিফ নিতুর কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নেয়। কপালে, গালে চুমু খায়। নিতু আবারো বরফের মতো জমে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আকবর আলির ডাকে এক ধাক্কায় তৌসিফ কে সরিয়ে দৌড়ে রুম থেকে চলে যায়। তৌসিফ এর বিষয়টা বুঝতে একটু সময় লাগে।ঘোর কাটলে নিজেই আপনমনে হেসে দেয়। নিতুর খোঁপায় মালাটা দেখে মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়। বাবার ডাকে একটু পরে তৌসিফ ও খেতে যায়।
চলবে………
#সুখের খোঁজে…..(পর্ব-১৯)
#মৌমিতা হোসেন
সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শেষ করলে সব গুছিয়ে নিতু রুমে গিয়ে দেখে তৌসিফ বিছানায় বসে মোবাইল চালাচ্ছে। নিতু কিছু না বলে বিছানায় এক পাশে শুয়ে পরে। সারাদিন এর কাজে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। তৌসিফ ও সাথে সাথে মোবাইল রেখে নিতু কে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পরে। নিতুর প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি হলেও পরে ভালো লাগে। তৌসিফ এর চোখেও নিতুর ক্লান্ত চেহারা ধরা পরে তাই আর কোন কথা বলেনা। নিতু কে আরেকটু বেশি কাছে পাওয়ার ইচ্ছে জাগলে ও মনকে মানায় তৌসিফ। অপেক্ষায় থাকে নিতুর হ্যা বলার।নিজ থেকে কাছে আসার।
এরপর বেশ কিছু দিন এভাবেই কাটে দুজনের। তৌসিফ প্রায় প্রতিদিন নিতুর জন্য ফুলের মালা নিয়ে আসে। একদিন কাঁচের চুড়ি নিয়ে আসে , আবার একদিন টিপ।এসব আনলে নিতুর মুখে যে একটা মিষ্টি হাসি দেখতে পায় সেটা দেখতে তৌসিফ এর খুব ভলো লাগে ।সময় পেলেই দুজন টুকটাক গল্প করে। নিতুর সাথে গল্প করতে,ওর সান্নিধ্য পেতেও তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে।এরই মাঝে যখন খুব ইচ্ছে হয়েছে একটু ছুঁয়ে দিয়েছে নিতুকে। ঐ সময় নিতুর লাজুক চেহারা দেখতেও খুব ভালো লেগেছে।খুব ইচ্ছে থাকলেও গভীর ভাবে ছোঁয়ার অনুমতির অপেক্ষায় দিন গুনছে প্রতিমুহূর্ত। নিতু কে দেখলেই ওর সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। বাইরে গেলেই বাড়ি ফেরার তাগাদা অনুভব করছে আজকাল। নিতু কে বারবার অযথাই ফোন দেয় ও। একটু কথা বলে আবার লাইন কেটে দিয়েছে। মানে সব কিছুতেই এক অস্থিরতা অনুভব করছে তৌসিফ। নিতুর সব কিছুই ভালো লাগে।একেই মনে হয় লোকে ভালোবাসা বলে। তবে এটা প্রকাশ করবে কীভাবে সেটা ওর জানা নেই। নিতুর প্রেমে পুরোপুরি এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তৌসিফ। নিতুর মাঝেই তৌসিফ ওর সুখ খুঁজে পাচ্ছে।
অপরদিকে তৌসিফ এর উপহার আনা, বারবার ফোন দেয়া, হঠাৎ কিছু না বলে কাছে চলে আসা,ওর কেয়ার করা সব কিছু নিতুর ভালো লাগতে শুরু করে।মনে এক ভিন্ন অনুভূতির আগমন হয়।এক ভিন্ন সুখ। তৌসিফ বাইরে গেলেই অপেক্ষায় থাকে তৌসিফ এর ফেরার। ফুলের মালা যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে। তৌসিফ ফেরার আগে নিজেকে সাজাতে ভালো লাগে, একটু পরপর আয়নায় নিজেকে দেখতে ভালো লাগে, তৌসিফ যখন নিতু কে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে সেটাও ভালো লাগে। অপেক্ষায় থাকে কোন অজুহাত দেখিয়ে গল্প শুরু করার।হঠাৎ ছুঁয়ে দেয়া, জড়িয়ে ধরে ঘুমানো এসবই ভালো লাগে নিতুর। আগের মতো বিরক্ত লাগে না কোন কিছুতে। অস্বস্তি অনুভব হয়না। প্রায়ই ঘুমন্ত তৌসিফ কে লুকিয়ে দেখে।এটাও ভালো লাগে নিতুর।মনে মনে বলে, এবার মনে হয় জীবনে সত্যিকারের প্রেমে পরে গিয়েছি। তৌসিফ এর প্রেমে।এমন কটকট করা রাগি মানুষটার যে কখনো এমন পরিবর্তন হবে আর এই মানুষের প্রেমে পড়বে সেটা কখনো ভাবেনি নিতু। সামনে হয়তো দুজন একসাথে সুখের সাগরে ভাসবে সেই অপেক্ষায় আছে নিতু।
মোবাইলে এখন তৌসিফ এর নাম্বার টা সেইভ করে রেখেছে। নিতুর মনে পরে তৌসিফ এর বলা কথাটা। নিতু অনুমতি দেয়ার আগ পর্যন্ত তৌসিফ ওকে আর পুরোপুরি ভাবে কাছে টানবে না।
আকবর আলি ব্যবসার কাজে আজ একটু ঢাকার বাইরে গিয়েছে।কাল বা পড়শু ফিরবে।একা একা তৌসিফ এর অপেক্ষায় আছে নিতু।আজ নিতুর খুব ইচ্ছে হচ্ছে তৌসিফ এর সান্নিধ্য পেতে।মনে মনে ঠিক করে আজ একটু বেশিই সাজবে। চোখে কাজল, কপালে টিপ, হাতে চুড়ি সবই পরে নিতু। একটা নীল রঙের শাড়ি পড়ে। নিজেকে আয়নায় দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়,খানিক লজ্জাও পায়। ভালোবাসার কথাটা মুখে কখনো বলতে পারবে না।তাই নিতু একটা কাগজে শুধু “ভালোবাসি”শব্দটা লিখে টেবিলে রেখে দেয়।এমন সময় কলিংবেল এর শব্দে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দেখে তৌসিফ এসেছে। হাতে সেই নিয়মমতো বেলি ফুলের মালা।
তৌসিফ মালাটা নিতুর হাতে দিতে গিয়ে ওকে দেখে চমকে যায়।অসম্ভব সুন্দর লাগছে নিতু কে। নিতু একটু লজ্জা পেয়ে মালাটা নিয়ে রুমে চলে যায়। খোঁপায় মালাটা লাগিয়ে তৌসিফ এর জন্য কাপড় বের করে দেয়। দ্রুত রান্না ঘরে যায়।তৌসিফ রুমে এসে নিতুর এলোমেলো কাজ, চিন্তাযুক্ত চেহারা দেখে ভাবে কি ব্যাপার আজ আবার কি হলো নিতুর।এতো অস্থির লাগছে কেনো ওকে?এসব ভাবতে ভাবতে টেবিলে রাখা কাগজটা চোখে পড়ে। লেখাটা দেখে ঠিক বুঝতে পারেনা যে নিতু কি বলতে চাচ্ছে। কাগজটা রেখে তৌসিফ ফ্রেশ হতে যায়। এসে দেখে নিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। নিতু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি নিয়ে খেলছে আর আপনমনে হাসছে। নিতুর এই বৃষ্টির সাথে খেলা করার দৃশ্য তৌসিফ মুগ্ধচোখে দেখতে থাকে। বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে। এমন সময় হঠাৎ কারেন্ট চলে যায়। নিতু ভয় পেয়ে রুমে ঢুকতে নিলেই তৌসিফ এর সাথে ধাক্কা খায় । তৌসিফ ওকে ধরে ফেলে তাই আর পরে যায়না।
তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”এভাবে ছোটাছুটি করছো কেনো আজ?আর বৃষ্টির মাঝে এখানে কেনো দাঁড়িয়ে আছো?”
নিতু কিছুই বলেনা। তবে তৌসিফ কে দেখে লজ্জা পায়। চলে যেতে নিলে তৌসিফ হাত ধরে আটকায়।বলে,”নিতু টেবিলে একটা চিরকুট পেলাম ওটা কার জন্য?”
নিতু কি বলবে ভেবে পায়না।ভীষন লজ্জা পায়।চুপ থাকে। তৌসিফ আবার জিজ্ঞেস করে। নিতু তখনও কিছু না বলে শাড়ির আঁচল আঙুলে প্যাচাতে থাকে । বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই আলোর ঝলকানিতে নিতু কে এভাবে দেখে তৌসিফ এর খুব ভালো লাগে।মনে আবার কিছু ইচ্ছেরা উকি দেয়। তৌসিফ নিতুর সামনে গিয়ে ওর হাত ধরে। নিতু চোখ তুলে ওর দিকে তাকায় । তৌসিফ আস্তে আস্তে বলে,”তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে নিতু। তুমি সামনে থাকলে সব ভালো লাগে। তুমি…. তুমি এতো সুন্দর কেনো নিতু?আসোলে আমি মনের কথা ওভাবে ঠিক গুছিয়ে বলতে পারিনা। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?মা মারা যাওয়ার পর তোমার মতো করে কেউ আমার যত্ন করেনি জানো? তোমার যত্ন পেতে আমার খুব ভালো লাগে।বিয়ের পর প্রথম দিকে আমার করা ব্যবহার এর জন্য আমি খুবই দুঃখিত।ওসব মনে রেখো না প্লিজ।আর আমাকে ছেড়ে কখনো যেওনা। মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে…. আমি মনে হয় তোমাকে অনেক ভালোবাসি।মনে হয় না সত্যি অনেক ভালোবাসি।”
নিতু এতোক্ষণ ধরে তৌসিফ এর কথা শুনছিলো।এই কটকট করা মানুষটা যে কখনো এভাবে ভালোবাসার কথা বলবে সেটা নিতু কল্পনাও করেনি। নিতুর চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। এটা আনন্দের অশ্রু, সুখের অশ্রু। তৌসিফ নিতু কে কাঁদতে দেখে চিন্তায় পরে যায়।বলে,”আমার কোন কথায় কি তুমি মন খারাপ করলে?কষ্ট পেলে?আচ্ছা যাও তোমার আমাকে ভালোবাসতে হবে না। তবে আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যেওনা প্লিজ।কারন এখন আর আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবোনা।”
নিতু এবার আরো জোরে কাঁদে ।বৃষ্টির পানি গায়ে এসে পড়তে থাকে।তৌসিফ নিতুর চোখের পানি যত্ন সহকারে মুছে দেয়।গালে হাত রেখে বলে,”কেনো কাঁদছো তুমি? কথায় কথায় কাঁদো, আবার তোমাকে ধরার আগেই ছোটাছুটি করো কেনো?”
নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”আমিও আপনাকে ভালোবাসি।”বলে তৌসিফ এর বুকে মুখ গুজে দেয়। তৌসিফ নিতুর কথা শুনে আনন্দে কি করবে বুঝতে পারেনা।
তৌসিফ বলে,”এজন্য কান্না করছো? এতে কাঁদার কি হলো?”দুগালে হাত রেখে কপালে আদর দিতেই টিয়া পাখিটি বলে ওঠে, “ভালোবাসি, ভালোবাসি।”আর ডানা ঝাপটাতে থাকে।
নিতু, তৌসিফ দু’জনই তখন হেসে দেয়। ঘরে চলে আসে। ততোক্ষণে কারেন্টও চলে আসে ।নিতু তাড়াতাড়ি তোয়ালে দেয় তৌসিফ কে। মাথা মুছতে বলে। নিতুও তোয়ালে দিয়ে নিজের মাথা মুছে খাবার দিতে যেতে নেয়।আর তখনই তৌসিফ ওর হাত ধরে কাছে টেনে আনে। পরম আকুতি নিয়ে বলে,”একটা কথা বলি নিতু?”
“হুম বলুন।”
“আজ কি তোমাকে ভালোবাসার অনুমতি দেবে? একটু গভীর ভাবে ভালোবাসতে খুব ইচ্ছে করছে আজ।”
নিতু তৌসিফ এর কথা শুনে চোখ নামিয়ে ফেলে।কি বলবে বুঝতে পারেনা। এভাবে কি কেউ কখনো অনুমতি চায়?আর এক্ষেত্রে ও কীভাবে অনুমতি দেবে? কী বলবে তৌসিফ কে?এতো সুন্দর করে কেউ কিছু চাইলে কি সেটা না করা যায়?আর আজতো ওর নিজের ও ইচ্ছে আছে শতোভাগ। কিন্তু সেটা ও বলবে কীভাবে?এসব ভাবনার মাঝে কিছু একটা ভেবে তৌসিফ ওর হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে নিতু তৌসিফ এর হাত ধরে।কানের কাছে মুখ নিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,”অনুমতি দিলাম ।”বলেই লজ্জায় দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকে নিতু।
তৌসিফ হেসে দেয়। প্রাপ্তির হাসি। নিতুর হাত দুটো সরিয়ে নিতু কে দেখতে থাকে। নিতু কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কপালে,গালে আদরে ভরিয়ে দেয়।এই ছোঁয়া ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। নিতু তৌসিফ এর সব ছোঁয়াতেই শিহরিত হয়। তৌসিফ লাইট অফ করে নিতু কে কোলে তুলে বিছানায় নিয়ে যায়। বাইরে সারারাত ঝুম বৃষ্টি হতে থাকে। প্রকৃতি সাজে নতুন রুপে।আর তৌসিফ নিতু একে অপরের মাঝে ডুবে থাকে। সারারাত একে অপরের ভালোবাসায় মত্ত থাকে, সুখের সাগরে ভাসতে থাকে দুজন। ভোরের দিকে দুজনের চোখে ঘুমেরা ধরা দেয়।
সকালে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।চোখ খুলে নিজেকে তৌসিফ এর বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পায়।চোখ তুলে তৌসিফ এর ঘুমন্ত মুখটা দেখতে থাকে। মনের অজান্তেই মাথায় চুলের মাঝে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজেকে আজ খুব সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে।খালা চলে আসবে তাই তৌসিফ এর হাত সরিয়ে উঠতে যাবে এমন সময়ে তৌসিফ একটানে আবার কাছে এনে জড়িয়ে ধরে। গলায় আদর দিতে থাকে। শরীরে চলে হাতের অবাধ্য বিচরন।নিতুর দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। লজ্জা নিয়ে কাঁপা কন্ঠে বলে,”সকাল আটটা বেজে গেছে।খালা চলে আসবে। উঠতে দিননা।”
“না উঠতে দেবো না। আমার কাছে থাকো ।আজ খালাকে আসতে মানা করে দাও। বাবাও তো বাসায় নেই।আজ ইচ্ছেমতো বৌকে ভালোবাসবো।”
নিতু অবাক হয় তৌসিফ এর কথায়।বলে,”কি ….কি বলছেন?সব কাজ আমি একা কীভাবে করবো?আর খাওয়া দাওয়া…..”
তৌসিফ নিতু কে আর কথা বলার সুযোগ দেয়না।দখল করে নেয় অধর। নিতু বুঝতে পারে তৌসিফ কে আর বাধা দিয়ে লাভ নেই।তাই চুপ থাকে। কিছুক্ষণ পরে নিতু কে ছেড়ে মোবাইল হাতে নিয়ে রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে আসতে মানা করে দেয়। নিতু খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার প্রিয় মানুষটার দিকে।দুজনের চোখে মুখে এক বিশাল প্রাপ্তির হাসি। নিতু চোখ নামিয়ে ফেলে। লজ্জা পায় খুব।
তৌসিফ নিতুর গালে হাত রেখে বলে,”আমার মতো একজন মানুষ কে ভালোবাসার জন্য,আমার জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দেয়ার জন্য মানে….সব কিছুর জন্য তোমাকে এতো এতো ধন্যবাদ। আমার মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এভাবেই আমার পাশে সর্বক্ষণ আমি তোমাকে চাই। কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা যেনো।”
তৌসিফ এর কথা শুনে নিতুর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে।এই অশ্রু কষ্টের না আনন্দের, অনেক বড় প্রাপ্তির। অবশেষে জীবনে তৌসিফ নামক সুখের খোঁজ পেলো ,একজন ভালোবাসার মানুষ পেলো সেই আনন্দের অশ্রু। নিতু তৌসিফ কে জড়িয়ে ধরে উত্তর দেয়,”কখনোই কোথাও যাবোনা আপনাকে ছেড়ে। কখনো না।”
তৌসিফ ও নিতুর পিঠে হাত রেখে পরম শান্তির, তৃপ্তির হাসি দেয়।চোখ বন্ধ করে শক্ত করে বুকের মাঝে আগলে রাখে।
চলবে……