সুখের খোঁজে পর্ব-১৬+১৭

0
721

#সুখের খোঁজে….(পর্ব-১৬)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে শ্বশুর এর পাঞ্জাবি পরে।যদিও আনইজি লাগছিলো তবুও কিছু করার নেই।কারন ও তো কোন কাপড় সাথে করে আনেনি।অভ্যাসবশত ভেজা তোয়ালে বিছানার ওপরেই রেখে দেয়। চুল আঁচড়াতে থাকে এমন সময় নিতু ট্রে হাতে রুমে ঢোকে। বিছানায় ভেজা তোয়ালে দেখে খানিক বিরক্ত হয়।টেবিলে ট্রে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে তৌসিফ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। নিতু মাথা নিচু করে ফেলে।বলে,”নাস্তা এনেছি খেয়ে নিন।দুপুরের খাবার হতে সময় লাগবে।তাই মা পাঠিয়েছে।”

নিতুর সেই আগের স্টাইলে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলা কথা তৌসিফ কে খুব আকর্ষন করছিলো।ও শুধু নিতু কে দেখছিলো। হঠাৎ কোমরে কারো হাতের ছোঁয়ায় নিতু চোখ ওপরে তুলে তৌসিফ এর দিকে তাকায়। খুব কাছে চলে আসে তৌসিফ।যতোটা কাছে এলে একে অপরের নিঃশ্বাস এর শব্দটাও শোনা যায়। উপলব্ধি করা যায় একে অপরকে ততোটা কাছে। নিতুর খুব অস্বস্তি হয়। খুব।এতো দিন পর আবার কেমন জানি লাগতে থাকে।আর তৌসিফ এর মনে হাজারো নিষিদ্ধ ইচ্ছেরা উকি দিতে থাকে।এক হাত নিতুর গালে রাখতেই দরজায় নক করার শব্দে নিতু তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ায়। দৌড়ে দরজার কাছে যায়। দরজা খুলে দেয়।দেখে মা তৌসিফ এর জন্য চা নিয়ে এসেছে।মনে মনে ভাবে,” এই লোকটা দরজা লাগালো কখন?”

তৌসিফ ও একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সালেহা রুমে এসে বলে,”তোমরা খেয়ে গল্প করো বাবা।চা খেলে ভালো লাগবে।”

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”জামাইয়ের কিছু লাগবে কিনা খেয়াল রাখিস।”

সালেহা রুম থেকে যাওয়ার সময় আবার দরজা চাপিয়ে রেখে যায়।এতো দিন পর জামাই এসেছে ওদের একটু প্রাইভেসি দরকার ভেবে মনে মনে হাসে।

এদিকে মা’কে দেখে নিতু প্রথমে বেশ খুশি হয়।মনে মনে ভাবে মায়ের সাথে কাজের অজুহাত দেখিয়ে ও বাইরে চলে যাবে। কিন্তু কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে দরজা চাপিয়ে চলে যাওয়ায় হতাশ হয়। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আঙুলে শাড়ি প্যাচাতে থাকে।

এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে ওর ধ্যান ভাঙে।”ওখানে দাঁড়িয়ে শাড়ি প্যাচাবে নাকি সামনে আসবে? মানে কি খাবো দেবে তো?বৌ সামনে বসে থাকবে। স্বামী বৌ কে দেখবে আর খাবে। এতে যে এতো তৃপ্তি সেটা আগে জানা ছিলোনা।”

নিতু যেনো আজ সব কিছুতেই অবাক হচ্ছে।এই কটকট করা লোকটার মুখে আজ এতো সুন্দর সুন্দর কথা ওর ঠিক হজম হচ্ছেনা। হঠাৎ ওর মাথায় আসে লোকটা আবার ওর কাছে আসার জন্য এমন নরম কথা বলছে নাতো।এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে চমকে তাকিয়ে দেখে সামনে দুহাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে বললো,”কি বসবেনা সামনে? আমাকে খেতে দেবে না?”

নিতু তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে চলে আসে।বলে,”হুম আসুন না।”

তৌসিফ নিতুর সামনেই বসে খেতে থাকে।আর অপলক নিতু কে দেখতে থাকে। নিতু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।কি করবে বুঝতে পারছে না।কতোক্ষনে এর খাওয়া শেষ হবে আর ও এখান থেকে পালাবে সেই অপেক্ষায় আছে নিতু। খাওয়া শেষ হলেই নিতু ওগুলো রেখে আসার জন্য বাইরে যেতে নেয়।তখনি তৌসিফ বলে,”পালাচ্ছো কেনো?বসো একটু কথা বলি।”

নিতু যেনো আজ তৌসিফ এর সব কথাতেই অবাক হচ্ছে।বলে,”আমার সাথে কথা!! হুম বলুন শুনছি।”

“এভাবে না ।বিছানায় এসে বসো। একটু গল্প করি। তোমার সম্পর্কে জানি।”

নিতুর মনে আবারো ভয়।বলে,”বিছানায় কেনো? এখানেই ঠিক আছে। বলুন তাড়াতাড়ি। ওখানে আমার সমস্যা হয়।”

তৌসিফ হয়তো বুঝলো নিতু কেনো এমনভাবে কথাগুলো বলছে।তাই বেশ মজা পেলো আর উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। নিতু সেই হাসি শুনে আবারো তৌসিফ এর দিকে তাকালো। হাসিটা বেশ সুন্দর।যেকোন নারীর মন কেড়ে নেয়ার মতো হাসি। তবে ওকে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।এই কদিনে কেমন রুগ্ন লাগছে তৌসিফ কে।তাই আনমনেই জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে আপনার? আপনি কি অসুস্থ ছিলেন গতো কদিন?এমন রুগ্ন দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”

তৌসিফ হাসি বন্ধ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। নিতুর দিকে তাকিয়ে একটু অভিমানের স্বরেই বললো,”এটা জানা কি খুব দরকার?এমন জঘন্য মানুষ সুস্থ নাকি অসুস্থ সেটা জেনে কি লাভ বলো।”

তৌসিফ এর এমন উত্তর শুনে নিতুর খারাপ লাগে।কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।এমন সময় তৌসিফ আবারো বললো,”উত্তর দিলেনা তো।এই জঘন্য মানুষ টাকে এই কদিনে মনে পড়েনি একবারও?একবারের জন্যও তো খবর নাও নি।”

নিতুর কথা বলতে আর ইচ্ছা হয়নি।কি বলবে?ওতো খবর নিয়েছে খালার কাছে থেকে। তৌসিফ এর সাথে কি ওর এমন সম্পর্ক এখনো হয়েছে যে ফোন করে খবর নেবে?এসব ভাবতেই তৌসিফ ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। বাহুতে কারো স্পর্শ পেয়ে দেখে তৌসিফ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।চোখ নামিয়ে ফেলে নিতু। তৌসিফ কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,”তোমাকে আর খবর নিতে হবে না দুরে বসে বসে।সেই সুযোগ আর দেবো না তোমাকে।ব্যাগ গুছিয়ে রাখো। বিকেলে বাসায় যাবো আমরা । আমার বৌ আমার কাছে থাকবে। আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও থাকা আর চলবে না”

কথা শেষ করে কানে আলতো চুমু খেয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে বারান্দায় চলে যায় তৌসিফ।

তৌসিফ এর সব কথা নিতুর বোধগম্য হয়না। তবে খারাপ লাগে না। ভালো লাগে আজ।আজ ওর কথায় কিছু একটা ছিলো। এরই মাঝে আপন মনে বলে ওঠে,”তবে তাই বলে হুট করে বললেই হবে নাকি।আজকেই কেনো যেতে হবে?আরো কদিন থাকলে কি হবে?আর এই যে যখন তখন কাছে আসা এসব কি।” আর ভাবলোনা নিতু।ট্রে নিয়ে রান্নাঘরে চলে আসে।

এসে দেখে সাজিদ, সেতু চলে এসেছে ‌। ওরা দুলাভাই এর সাথে দেখা করতে আগ্ৰহি।দুজনই ফ্রেশ হয়ে রুমে গিয়ে তৌসিফ এর সাথে গল্প জুড়ে দেয়। তৌসিফ কে এতো সুন্দর করে ওদের সাথে গল্প করতে দেখে নিতুর খুব ভালো লাগে।বলে,মানুষটা মনে হয় ততোটাও জঘন্য না।যতোটা আমি ভেবেছিলাম।”কথাটা বলে আপন মনেই হাসে। নিতু আর রুমে যায়না। মাকে কাজে সাহায্য করতে নেয়।

বেশ কিছু সময় অতিবাহিত হয়। দুপুরে খাবার রেডি হলে জামাইকে খেতে ডাকতে বলে সালেহা। নিতু সেতুকে বলে,”যাতো তোর দুলাভাই কে ডেকে নিয়ে আয়।”

“ঠিক আছে যাচ্ছি।”বলে উঠতে নিলেই সালেহা বেগম এর ধমকে বসে পরে।

একটু রাগী চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”তোর বুদ্ধি এতো কম হলো কবে থেকে নিতু?সেই কখন থেকে ছেলেটা একা বসে আছে। কয়বার যেতে বললাম গেলি না। এখন খেতে ডাকতে বলছি সেটাও সেতুকে বলছিস?তুই গিয়ে ডেকে নিয়ে আয়।”

নিতু রান্না ঘরে আসার সাথে সাথেই সালেহা বেগম নিতু কে বলে রুমে যেতে। জামাই এর সাথে গল্প করতে কিন্তু নিতু এটা সেটা করে এতোটা সময় কাটায়। তৌসিফ এর সামনে যেতে কেমন যেনো লাগছিলো ওর।আর গেলেই আবার ব্যাগ গোছাতে বলবে তাই আর যায়নি। কিন্তু এখন মায়ের আদেশ আর অমান্য করতে পারলো না।তাই রুমে যায় ডাকতে।

সেই যে গেছে মেয়েটা আর একবারের জন্যও এসে দেখে যায়নি । এতোটা সময় একা একা থেকে তৌসিফ বিরক্ত বোধ করছে আর নিতুর কথাই ভাবছে।কখন বিকেল হবে আর বাসায় যাবে সেই অপেক্ষায় থাকে।সময় কাটাতে সিগারেট ধরায়। নিতু ডাকতে গিয়ে দেখে রুমে ধোয়ায় ভরা। বাজে সিগারেট এর গন্ধে রুমটা ভরে গেছে। পেট গুলিয়ে বমি পায় নিতুর। রেগে বিরবির করে,”বাজে অভ্যাস জীবনেও যাবেনা লোকটার। এগুলো মানুষ খায়?”

তৌসিফ বলে,”বিরবির না করে যা বলবে জোরে বলো।আর এতোক্ষণে তোমার আসার সময় হলো? আমার কিছু লাগবে কিনা একবার ও জানতে ইচ্ছে হয়নি?”

নিতু চোখ তুলে তাকায়।বলে,”না আসোলে আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলাম। মা’কে সাহায্য করছিলাম। খেতে চলুন।মা ডাকছে আপনাকে।”সিগারেট এর গন্ধে মাথা ধরে যাচ্ছিলো তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে নিলে তৌসিফ এবার বিরক্ত হয়। রেগে হাতটা ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।বলে,”তুমি এমন কেনো নিতু?”

নিতু কিছুই বুঝতে পারেনা। কিছু বলবে এরই মাঝে সেতু, সাজিদ রুমে আসে তৌসিফ কে নিয়ে যেতে। তৌসিফ সাথে সাথে হাত ছেড়ে দেয়। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করে। তৌসিফ খুব তৃপ্তি নিয়ে খায় ।মনে হচ্ছে অনেক দিন পর পেট ভরে খেলো। শ্বাশুড়ি মা খুব যত্ন করে তৌসিফ কে খাওয়ায়। এতে তৌসিফ এর মায়ের কথা বারবার মনে পড়ছিলো। খাওয়ার সময় সালেহা নিতু কে বলে,”নিতু মা খাওয়া শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে রাখিস। তৌসিফ বলেছে আজ তোকে নিয়ে যাবে।”

তৌসিফ সামনে থাকায় নিতু আর কিছু বলতে পারেনি। খাওয়া দাওয়া শেষ হলে নিতু ওর মায়ের ঘরে যায়। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,”মা একটা কথা বলি?”

“হুম বল,এতো অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হবে?”

“মা আমি তোমার কাছে আরো কয়েকদিন থাকি?এখনি যেতে ইচ্ছে করছে না।”

সালেহা বেগম নিতুর দিকে তাকিয়ে ওর হাত ধরে পাশে এনে বসায়।এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,”এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে এসেছিস। বিয়ের পর মেয়েদের এতো দিন বাবার বাড়ি থাকতে হয়না। ওখানে তোর শ্বশুর, তৌসিফ একা। শ্বশুর অসুস্থ মানুষ।তোর শ্বাশুড়ি নেই তাই ওনাদের দায়িত্ব তোর হাতে।বেয়াই তোকে অনেক স্নেহ করে মা।ফোন করে বারবার তোর খবর নিয়েছে গতো কয়দিন। এমনটা সবার ভাগ্যে হয়না।তাই ওনার দিকে খেয়াল রাখিস,সেবা করিস।আর জামাই এর অবস্থা দেখেছিস? তোকে ছাড়া কেমনটা হয়ে গেছে। ছেলেটার মা নেই মাকে নিশ্চই খুব মনে করে।ও খুব করে কারো যত্ন চায় সেটা ওকে আজ দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি।তাই জামাই এর দিকেও খেয়াল রাখবি।”

“মন খারাপ করিস না। এবার যা। আগে সম্পর্ক ঠিক কর তোদের। স্বামী -স্ত্রী বিয়ের পর দুরে দুরে থাকতে হয়না।যতো দুরে থাকবি দুরত্ব ততোই বাড়বে।মাত্রই বিয়ে হলো তোদের। পাশাপাশি থেকে,কথা বলে সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। কাছাকাছি থাকলে দেখবি দিন দিন ভালোবাসা ও বাড়বে ।মনে কিছু আসলে কথা বলে সমাধান করে নিবি।এখন যা। চারটা বেজে গেলো।ব্যাগ গুছিয়ে ফেল।”কথাগুলো বলে সালেহা মেয়ের কপালে চুমু খায়।

নিতু আর কিছু বলার সুযোগ পায়না।আস্তে উঠে নিজের রুমে চলে আসে। সে-ই সিগারেট এর গন্ধ এখনো যায়নি। রুমে কোথাও তৌসিফ নেই। উঁকি দিয়ে দেখে বারান্দায় বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে। নিতু খুব বিরক্ত হয়।ভাবে, “এগুলো মানুষ এতো খেতে পারে? কীভাবে থাকবো আমি এই মানুষটার সাথে।”

তাড়াতাড়ি রুমে এয়ার ফ্রেশনার দেয় যাতে গন্ধটা কিছুটা হলেও চলে যায়।ব্যাগ গোছাতে থাকে।এর মাঝে তৌসিফ ঘরে এসে বলে,”নেশা দিয়েই নেশা কাটাতে হয়। সিগারেট নামক নেশা ততোক্ষণ ছাড়তে পারবোনা যতোক্ষন না তুমি নামক নেশা টা পুরোপুরি আমার কাছে ধরা দিচ্ছো।তাই এতো কপাল কুঁচকে, মনে মনে বকে কোন লাভ নেই।”

নিতু চুপচাপ শোনে। কিন্তু কিছুই বোঝে না।তাই ও ওর কাজ করতে থাকে।

চলবে…..

#সুখের খোঁজে….(পর্ব -১৭)
#মৌমিতা হোসেন

নিতুদের রওনা দিতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে যায়। সালেহা বেগম নিতুর শ্বশুর এর জন্য খাবার, মিষ্টি, তৌসিফ এর জন্য পিঠা,নাড়ু অনেক কিছু দিয়ে দেয়। সাজিদ, সেতু সবাই খুব মন খারাপ করে।নিতু মা’কে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে। কিন্তু কেঁদেই বা কি হবে।যেতে তো হবেই।

সিএনজিতে নিতু মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে মায়ের কথা ভাবছিলো।চোখ থেকে না চাইতেও পানি পড়ছে নিতুর। আজকাল রাস্তায় খুব যানজট। গরমে ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছে । খুব বিরক্ত লাগছে নিতুর। তৌসিফ এর থেকে বেশ দুরত্ব রেখেই বসেছিলো নিতু। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ ওর শরীর ঘেসে বসে আছে।আর এক হাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিচ্ছে। নিতু সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। তৌসিফ এর এই কাজে নিতু বেশ খুশি হয়। তৌসিফ বলে,”এতো কাঁদছো কেনো? মাথা ব্যথা হবে।যেতে সময় লাগবে। তুমি চাইলে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাতে পারো।”

নিতু যেনো সকাল থেকে তৌসিফ এর সব কথায় বারবার শুধু অবাক হয়েই যাচ্ছে। নিতু মাথা নাড়ে।বলে,”দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”আবার বাইরে তাকায়।

প্রায় আটটার দিকে ওরা বাসায় এসে পৌঁছায়। মাথায় কারো হাতের আলতো স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর। জেগে দেখে বাসার সামনে চলে এসেছে।কখন যে তৌসিফ এর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে টেরই পায়নি। তাড়াতাড়ি সিএনজি থেকে নামে। ভাড়া মিটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নিলেই দেখে জুঁই,বিথি, সাদিয়া সব দাঁড়িয়ে আছে। বিথি দৌড়ে এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে।বলে,”এতো দিন কেউ বাবার বাড়ি থাকে? তোমাকে কতো মিস করেছি জানো? তোমাকে ছাড়া আমাদের গল্প যেনো জমছিলোই না। তুমি কি পাষান গো ।আর ভাইয়ার অবস্থা দেখো তোমাকে ছেড়ে এই কদিনেই কেমন দেবদাস হয়ে গেছে।”হঠাৎ মাথায় কারো হাতের থাপ্পর খেয়ে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।

বিথি সাথে সাথে চুপ হয়ে যায়। মিনমিন করে বলে,”ভাইয়া আমি তো শুধু বলেছি যে….”

তৌসিফ আর কিছু বলতে দেয়না।বলে ,”একদম চুপ। সারাদিন বকবক করতে না পারলে তোর ভাত হজম হয়না তাইনা?মাত্রই তো এলাম। ঘরে যেতে দে আগে।তারপর বকবক করিস।আর এ সময়ে এখানে কি করিস? সবাই গিয়ে পড়তে বস যা।”সবাই চুপ হয়ে যায়।

নিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”চলো ওপরে।পরে ওদের সাথে কথা বলো যতো মন চায়।”

নিতু তৌসিফ এর কথায় আজ বারবার চমকে যাচ্ছে। তবে কিছু বলেনা চুপ থাকে। এতোটা পথ জার্নি করে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।বিথির গালে হাত দিয়ে বলে,”এখন যাই বোনু। একটু রেস্ট নেই। কাল কথা হবে ইনশাআল্লাহ।”

বিথি একটু মন খারাপ করে আর কোন কথা বলেনা। সবাই যে যার কাজে চলে যায়। নিতু তৌসিফ এর পেছনে পেছনে হেঁটে বাসায় আসে।আকবর আলি এখনো বাসায় আসেনি।খাবার গুলো ঠিক মতো রেখে নিতু রুমে যেতে নেয়। নিতুর মনে হচ্ছে অনেক দিন পর নিজের ঘরে এসেছে। রুমে ঢুকেই এলোমেলো অবস্থা দেখে আবারও নিতু প্রচন্ড বিরক্ত হয়। নিতু বিরবির করে,”একটা মানুষ এতোটা অগোছালো কীভাবে হতে পারে?মাত্র এই কদিনে রুমটার কি বাজে অবস্থা বানিয়েছে।এখন এটা কীভাবে পরিস্কার করবো আমি?”

তৌসিফ এসেই ওয়াশরুমে ঢোকে।বেশ কদিন পরে সেইভ করে একটু ফ্রেশ লাগছে নিজেকে।বের হয়েই ভেজা তোয়ালে আবার বিছানায় রাখে। নিতু কে একা একা কথা বলতে দেখে বলে,”এভাবে একা একা বিরবির করে লাভ নেই। এতো দিন বাবার বাড়ি থাকলে ঘরের অবস্থা এমনটাই হবে।”

তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু আর কিছু বলেনা।তোয়ালে নিয়ে বারান্দায় যায় নাড়তে। পাখিটা নিতু কে দেখেই নিতু নিতু বলে ডাকা শুরু করে।নিতু ও পাখিটাকে আদর করে, খাবার দেয়।পাখির ভালোবাসা দেখে নিতুর খুব ভালো লাগে।আর অপরদিকে তৌসিফ ও নিতুর প্রতি পাখির ভালোবাসা দেখে অবাক হয়। নিতু গাছগুলো দেখে মন খারাপ করে। ফুল নেই।গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে এই অল্প কদিনের অবহেলায়। তাড়াতাড়ি গাছে পানি দেয়। তৌসিফ এসব কিছুই পর্যবেক্ষণ করে।

নিতু ঘরে ঢুকলেই নিতু কে উদ্দেশ্য করে বলে,”গাছের মতো অন্য একজনের ও এমন অবস্থা।কারো অনাদরে, অবহেলায় ভেতরটা শুকিয়ে যাচ্ছে ।কেউ যদি এভাবে আমারও যত্ন নিতো….”

তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু কি বলবে বুঝতে পারেনা। চুপচাপ রুমে গুছিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।আর তৌসিফ বসে বসে নিতু কে দেখতে থাকে অপলক।বন্ধুরা ফোন দেয়। বাইরে যেতে বলে কিন্তু আজ আর ঐদিকে কোন মনোযোগ নেই ওর।তাই ওদের না করে দেয়।একা একা আনমনে বলে,”আজ আর বাইরে বের হবোনা।আজ নিতু কে দেখবো মন ভরে।”

নিতু ফ্রেশ হয়ে নীল রং এর একটা সুতি শাড়ি পরে। ফর্সা নিতু কে একেবারে চমৎকার লাগছে দেখতে। একেবারে বৌ বৌ। তৌসিফ যতোই নিতু কে দেখছে ততোই ওর অস্থিরতা বাড়ছে। খুব করে ওকে কাছে পেতে ইচ্ছে করছে। নিতু কে ডাকে তৌসিফ।বলে,”আমার পাশে একটু বসবে নিতু? একটু গল্প করি।”

নিতু ভাবে,এই মানুষটার আজ হলো কি?সেই সকাল থেকে আবোলতাবোল বকছে। আবার ডাক দিলে তাকায় তৌসিফ এর দিকে।খানিক মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে। তৌসিফ কে বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন দেখতে। তবে মনে হলো চুলগুলো যদি কেটে একটু সেট করে তাহলে আরো ভালো লাগবে দেখতে।এরই মাঝে তৌসিফ এর হাসি দেখে সাথে সাথে মাথা নিচু করে।বলে,”বাবা মনে হয় চলে এসেছে। বাবার সাথে দেখা করবো।বাবাকে খাবার দেবো।এখনতো….বসার সময় নেই।কাজ শেষ করে আসি?”

তৌসিফ আবার হাসে।আজ ওর মন ভালো। খুব ভালো।তাই হাসি চাপিয়ে রাখার মানেই হয়না।আস্তে নিতুর কাছে এসে কোমরে হাত দিয়ে কাছে টেনে নেয়। কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে,”আর কতো অজুহাত দেখিয়ে পালাবে তুমি? তুমি এমন হলে কেনো নিতু? কেনো এমন করো আমার সাথে?”

হঠাৎ এমন কান্ডে নিতুর ভেতরে কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি দেখা দেয়। তৌসিফ এর নিঃশ্বাস এর শব্দ শুনতে পায় নিতু। তৌসিফ এর এতো দিন এর ছোঁয়া আর এখনের ছোঁয়ার মাঝে অনেক পার্থক্য। আজকে তৌসিফ এর কাছে আসায় আগের মতো ততোটা বিরক্ত লাগছে না। তৌসিফ এর বলা কোন কথাই আজ নিতু বুঝতে পারছেনা।এ যেনো এক ভিন্ন তৌসিফ। নিতু কাঁপা কন্ঠে উত্তর দেয় ,”অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে খেতে দেবো।আর বাবাও মনে হয় চলে এসেছে।তাই যেতে চেয়েছি।”

তৌসিফ আবার হাসে। নিতুর গালে হাত রাখে। বলে,”ঠিক আছে যাও।”আবার কপালে চুমু খেয়ে নিতু কে ছেড়ে দেয়।

নিতুর হাত, পা কাঁপতে থাকে। কিছু বোধগম্য হচ্ছেনা আজ। চুপচাপ দুহাত কচলাতে কচলাতে চলে যায়।আর তৌসিফ নিতুর কান্ড দেখে হাসতে থাকে।

নিতু গিয়ে দেখে আকবর আলি চলে এসেছে। ঘরের মেইন দরজার দুটো চাবি দুজনের কাছে থাকে। তৌসিফ এর মা মারা যাওয়ার পরে এই ব্যবস্থা নেয়।কারন অনেক সময় তৌসিফ দেরি করে আসে আবার অনেক সময় তিনি নিজেই।তাই দুজনের মধ্যে কারোর যেনো দরজা খোলার অপেক্ষা করতে না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।অবশ্য নিতু আসার পর থেকে কেউ এলে দরজা খোলার দায়িত্ব টা ওই নিয়েছে।গতো কদিন ও না থাকায় আবার আগের নিয়মে চালু হয়েছিল।নিতু শ্বশুর এর সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে বলে,”কেমন আছেন বাবা? এতো দেরি করে ফিরলেন যে?”

আকবর আলী এতো দিন পর ছেলের বৌকে দেখে খুব খুশি হয়। সালামের উত্তর দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।বলে,”আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা। দোকানে কাস্টমার বেশি।সব গুছিয়ে আসতে সময় লাগে একটু। বুঝিস তো। ছেলেটা সাথে গেলে এতো কষ্ট হতো না।তুই কেমন আছিস?বেয়াইন ভালো আছে তো?কখন এসেছিস?”

“এইতো আটটার দিকে এসেছি। ভালো আছি বাবা। বাসার সবাইও ভালো আছে।”একটু থেমে নিতু আবার বলে,”বাবা হাত মুখ ধুয়ে আসেন আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।মা আপনার জন্য খাবার দিয়ে দিয়েছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। তৌসিফ কি বাসায় নাকি বাইরে?”

“বাসায় বাবা।ডাকবো?”

“আজ একসাথে খাবো। ওকেও ডেকে আন।”

“ঠিক আছে বাবা।”

ছেলে এ সময়ে বাসায় আছে শুনে বেশ ভালো লাগলো। সবাই একসাথে খাওয়া দাওয়া শেষ করলো।আজ বাবা-ছেলে দুজন তৃপ্তি সহকারে খেলো। সবাই যে যার রুমে চলে গেলে নিতু সব গুছাতে থাকে আর ওর চিন্তাও বাড়তে থাকে।রুমে যাবে কি যাবে না সেই দ্বন্দে ভুগতে থাকে ও।এই কদিন বেশ ভালোই ছিলো নিতু।আজ সকাল থেকেই তৌসিফ এর কোন কথা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা। তবে ওর এলোমেলো কথা খারাপ ও লাগছে না।তাই বলে আবার বিয়ে বলতে সবাই যেই সম্পর্ক বোঝাতে চায় যা এতো দিন ধরে হয়েছে তেমন শারীরিক সম্পর্ক চাচ্ছেনা নিতু। তৌসিফ এর সাথে ও মন খুলে অনেক কথা বলতে চায়। ওকে মন থেকে ভালোবাসতে চায়। হয়তো ও ভালোবেসেও ফেলেছে। নিতু চায় তৌসিফ ও ওকে ভালো ভাবে জানুক,ভালোবাসুক ।তারপর নাহয় ওসব হোক।এসব ভাবনার মাঝেই তৌসিফ এর ডাক শুনে তাড়াতাড়ি রুমে যায় নিতু।

তৌসিফ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আকাশের তাঁরা দেখছিলো। নিতু কে বললো,”দরজা লাগিয়ে আমার কাছে এসো।”

নিতুর আবার অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পরে বলে,”দরজা লাগাতে হবে কেনো?কেনো ডেকেছেন বলুন?”

তৌসিফ চোখ, কপাল কুঁচকে তাকায়। মৃদু হেসে বলে,”দরজা খোলা রেখেই তুমি আমার সাথে থাকবে? মানে কীভাবে?”

নিতু চোখ তুলে তৌসিফ এর দিকে তাকায়। একটু অবাক হয় ওর কথায়।কি বোঝাতে চাইছে তৌসিফ? খুব টেনশন হয় নিতুর। ঘামতে থাকে। তবে কি ওসব কাজের কথা ইঙ্গিত দিচ্ছে? খুব কাছে কারো উপস্থিতি অনুভব করে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ দাঁড়িয়ে আছে। তৌসিফ নিতুর হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে যায় । খানিক দুরত্ব রেখে তৌসিফ দাঁড়ায়।নিতুও চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ জিজ্ঞেস করে,”এই কদিন খুব আনন্দে ছিলে তাইনা?এই কদিনে আমার কথা মনে পড়েনি তোমার?”

নিচের দিকে তাকিয়ে নিতু।উত্তর দেয়,”হুম। মানে…. পড়েছে মনে।”

“তবে একবার এর জন্য ফোন দাওনি যে?”

“আপনিও তো দেননি ফোন।আর…”

“আর কি?বলো।”

“আর যেহেতু আপনিও ফোন দেননি। আমি আগ বাড়িয়ে ফোন দিয়ে আপনাকে কি বলবো?আর তাছাড়া….”

“তাছাড়া কি?”

“যদি আপনি রেগে যান ,বকেন তাই আপনাকে ফোন দেইনি।”

তৌসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।বলে,” আমি কি তোমার সাথে সারাক্ষন রাগ করি নিতু?”

“রাগ করেন কিনা জানিনা। তবে স্বাভাবিক ভাবে কথাও তো বলেন না। আমার আপনাকে দেখলেই অস্থির লাগে।টেনশন হয়।”

তৌসিফ কি বলবে বুঝতে পারছে না।এর পুরো দোষ অবশ্য ওর নিজের।তাই তপ্ত শ্বাষ ফেলে বলে,”আর ভয় পেওনা,টেনশন করোনা। তোমার কিছু লাগলে বা কোন কথা থাকলে এখন থেকে আমাকে নিশ্চিন্তে বলবে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলি?”

“হুম বলো।”

“আমার পায়ে ব্যাথা করছে।এখন তাহলে শুয়ে পড়ুন। আমিও ঘুমাতে যাই?”

তৌসিফ এতোক্ষণ নিতু কে দেখছিলো আর ওর কথা শুনছিলো। শুয়ে পড়ার কথা শুনে তৌসিফ মুচকি হেসে বললো,”শুয়ে পড়ার আজ এতো তাড়া কেনো তোমার?”

নিতু কিছুই বোঝে না।ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে তৌসিফ এর দিকে।কি বলবে ভেবে পায়না।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে