#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৮)
#মৌমিতা হোসেন
সেতু, সাজিদ বোন দুলাভাই কে পেয়ে ওদের রুমে থেকে আর বেরই হচ্ছেনা। দুলাভাই এর সাথে নানান গল্প জুড়ে দেয়। নিতু খালা আর মায়ের সাথে রান্না ঘরে শ্বশুর বাড়ির গল্প করতে থাকে।সবার কথা খুব ভালো বললেও তৌসিফ এর ব্যাপারে যে ও কোন কথাই বলছেনা সেটা সালেহা ভালো ভাবেই খেয়াল করলো।এর মাঝে নিতুর হাতের কাটা দাগ,ক্লান্ত চোখ কোন কিছুই সালেহার চোখে এড়ায়নি। সালেহা মনে মনে ভয় পায় ভাবে মেয়েকে কি তবে ভুল জায়গায় বিয়ে দিলো? তৌসিফ এর কথা জিজ্ঞেস করলে বারবার এড়িয়ে যায় নিতু। নিতু ভেবেছিলো মাকে তৌসিফ এর কথা বলবে। কিন্তু মায়ের সাথে কতোটুকু শেয়ার করা যায়?এসব ব্যাপার কি মায়ের সাথে আলাপ করা যায়? এই নিয়ে দ্বন্দ্বে পরে কিছু বলতে পারেনা। সালেহা বুঝতে পারছিলো নিতুর সমস্যা।তাই বোনকে আড়ালে ডেকে সময় সুযোগ মতো নিতুর সাথে আলাপ করতে বলে।
সন্ধ্যায় প্রতিবেশীরা আসে নিতু আর জামাই এর সাথে দেখা করতে। এভাবেই দুপুর, সন্ধ্যা পার হয়। এতো নিয়ম,এতো মানুষ সব দেখে তৌসিফ এবার বিরক্ত হতে থাকে।তৌসিফ নিতু কে কয়েকবার ডাকলে সেতুকে নিয়ে এসে যখন যেটা লাগবে সেটা দিয়ে আবার দ্রুত ওর সামনে থেকে চলে যায়। এতে তৌসিফ আরো বেশি বিরক্ত হয়।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় বসে তৌসিফ নিতুর অপেক্ষা করতে থাকে।এমন সময় সাজিদ রুমে এসে তৌসিফ এর পাশে শুয়ে পরে। তৌসিফ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলে,”সাজিদ তুমি এখানে কেনো? নিতু কোথায়?”
ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে সাজিদ উত্তর দেয় ,”ভাইয়া আমি আপনার কাছে ঘুমাবো।মায়ের শরীর খারাপ হওয়ায় আপু মায়ের সাথে থাকবে।”
তৌসিফ এর মেজাজ যেনো মুহুর্তেই খারাপ হলো।ও খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো যে এটা নিতুর চালাকি। শ্বশুর বাড়ি তার ওপর বাড়ি ভর্তি মেহমান তাই তৌসিফ কিছু বলেনা। চুপচাপ বাড়ান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা। হালকা বাতাস বেশ ভালো লাগতে থাকে ওর।ভাবতে থাকে সারাদিনের কথা। শ্বাশুড়ি মাকে ওর ভালোই পছন্দ হয়।মা নেই তাই হয়তো মায়ের আদর পেতে ভালো লাগে। খুব যত্ন করে খাওয়ায় ওকে,গল্প করে, খাওয়ার সময় পাশে বসে থাকে।তাই অনেক দিন পর মনে হলো ও একটু তৃপ্তি সহকারে খেতে পেরেছে। বাসায় মা না থাকায় বেশিরভাগ সময় একা একাই খায় ও।আগে বাবা দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকতো।চাচিরা আদর করলেও সবাই যে যার সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। তৌসিফ এর জন্য যেনো কারো সময় ছিলোনা।তাই এইচএসসি পরীক্ষার পর আস্তে আস্তে বন্ধুদের পাল্লায় পরে একটু বেপরোয়া হয়ে যায়। পড়ালেখার সমাপ্তি ঘটায়।সব দিক দিয়ে তপু ভালো তাই সবাই তপুর প্রশংসা করে এতে তপুর প্রতি ওর হিংসা জন্মায়।জিদ করে বন্ধুদের নিয়েই সময় কাটাতে থাকে তৌসিফ।
হঠাৎ নিতুর ডাকে পেছনে ফিরে তাকায় তৌসিফ। বিরক্ত হয়ে বলে,”কি চাই? এখানে এসেছো কেনো? তুমি যে ইচ্ছা করেই সাজিদ কে পাঠিয়েছো সেটা আমি ভালোই বুঝতে পেরেছি।”
নিতু শাড়ির আঁচল আঙুলে পেচাতে থাকে। তৌসিফ এর রাগ দেখে খানিকটা ভয় পায়।সাহস করেই বলে,”আসলে মায়ের শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যায় তাই আমি আর খালা মায়ের কাছে থাকতে চাই। পানি রেখে যাচ্ছি। কিছু লাগলে ডাকবেন। আমি এসে দিয়ে যাবো।”
কথা শেষ হতেই তৌসিফ নিতুর কাছে এসে বলে,”আমার তো তোমাকে দরকার। বিয়ে করেছি কি বৌ মায়ের কাছ থাকবে বলে?”
এই কথা বলে নিতু কে জড়িয়ে ধরতে নিলে নিতু আবারো তৌসিফ কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় আর এক দৌড়ে চলে যায় রুম থেকে। তৌসিফ খুব বিরক্ত হয়।ও ভাবে মেয়েটার সমস্যা কি?যখনই কাছে যায় তখনই এমন করে।বেশ রাগ হয় ওর।
নিতু মুলত জোর করে মায়ের কাছে থাকে। সালেহা প্রথমে রাজি না হলেও পরে নিতুর কান্না দেখে রাজি হয়।ভাবে একটা রাতই তো।থাকুক না হয়।
এদিকে নিতুর খালা সন্ধ্যার পরপরই নিতুর সাথে কথা বলতে বলতে ওর মন খারাপের কারন আর তৌসিফ এর ব্যাপারে সব কিছু জানতে চায়। নিতু যতোটুকু বলা যায় তার সবটাই বলে।খালা নিতু কে বোঝায় সংসার জীবন সম্পর্কে।আর বোনকেও ব্যাপারটা জানায়। যেহেতু শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালো। নিতু কে এই দুই দিনেই বেশ ভালোবাসা দিয়েছে,আর মা ছাড়া বড় হওয়া তৌসিফ এর কথাও তার জানা তাই সালেহা ভাবে আস্তে আস্তে সব হয়তো ঠিক হয়ে যাবে।আর তাই সালেহা ঠিক করে এ ব্যাপারে কথা বলবে মেয়ের সাথে। রাতে মায়ের কাছে ঘুমানোর জন্য আবদার শুনে তাই সালেহা প্রথমে অমত করলেও পরে আর কিছু বলেনা।
সেতু ঘুমিয়ে পড়লে সালেহা মেয়েকে নিয়ে বাড়ান্দায় বসে।নিতু মায়ের কোলে মাথা রাখতেই সালেহা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।সালেহা বলে,”আজ তোকে কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবি।”
“হ্যা মা শুনবো।বলো।”
সালেহা বলতে থাকে”বিয়ের পর মেয়েরা সকল আপনজনদের ছেড়ে এক নতুন পরিবারে, নতুন পরিবেশে যায়। সেখানে কোন কিছুই প্রথম প্রথম মেয়েদের ভালো লাগে না।খাপ খাওয়াতে, নতুন মানুষদের আপন করতে যথেষ্ট সময় লাগে।কারো মানসিকতাই হয়তো তোর সাথে মিলবে না।যদি কারোর সাথে মিলে যায় তবে বুঝতে হবে তোর ভাগ্য ভালো। সমস্যা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদেরকেই মানিয়ে নিতে হয়।তোর কাছ থেকে শুনে মনে হলো তোর শ্বশুর বাড়ির সবাই বেশ ভালো। শুধু তৌসিফ এর ব্যাপারেই তুই চুপ আছিস। নতুন পরিবারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো ও। তৌসিফ এর পছন্দ,অপছন্দ, ভালোলাগা,মন্দলাগা সব কিছুই তোর আপন করে নিতে হবে। ছেলেটা মায়ের আদর পায়নি।তাই যথেষ্ট পরিমাণে ভালোবাসা দিয়ে ওকে ঘরমুখো করতে হবে।”
একটু থেমে আবার বলে,”তোর বাবা বেঁচে নেই। আমি চাইলেই যেকোন কিছু করতে পারিনা। আমি বুঝতে পারছি তৌসিফ এর কোন ব্যাপারে তোর হয়তো সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এখানে আমার কিছুই করার নেইরে মা। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেমন খুব সহজ তেমনি খুব কঠিন। খুব হিসেব কষে চলতে হয়। একটু ধৈর্য ধর দেখবি আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। খুব শীঘ্রই সুখের খোঁজ পাবি । অপেক্ষা কর মা।তোর তরফ থেকে কখনো জামাই কে কোন অভিযোগ করার সুযোগ দিসনা।এমন কিছু কখনো করিসনা যাতে আমার অসম্মান হতে পারে।”
এতোক্ষণ মায়ের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো নিতু।সব বুঝলেও ওর প্রতি তৌসিফ এর আচরন ওর বোঝার বাইরে ছিলো।এই দুই দিনে তৌসিফ এর ব্যবহার ওর একটুও ভালো লাগেনি। তবুও মায়ের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারলো না। নিতু বুঝে নিলো যে বিয়ের পর মেয়েরা পর হয়ে যায়। তখন চাইলেই আর মায়ের কাছে ফিরে আসা যায়না।নিতুর চোখ থেকে পানি ঝরছ।তাই অস্ফুট স্বরে বললো,”চিন্তা করোনা মা। আমি চেষ্টা করবো সবার মন রক্ষা করে চলতে। কখনো কাউকে কোন অভিযোগ করতে দেবো না।”
সালেহা ও মেয়েকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে।
পরদিন সকালে নাস্তা খাওয়ার পরেই তৌসিফ বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে নিতু কে বলে রেডি হতে। নিতু ভেবেছিলো রাতে যাবে। কিন্তু তখনই রেডি হতে বললে করুন চোখে একবার তৌসিফ এর দিকে তাকায় আর একবার মায়ের দিকে তাকায়। সালেহা বলে,”দুপুরে খেয়ে গেলে ভালো হতো না?”
তৌসিফ এমনিতেই নিতুর ওপর রেগে ছিলো।তাই আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,”মা আমার কিছু কাজ আছে। আবার আসবো নাহয়।আজ যেতে হবে।”
সালেহা আর কিছু বলার সাহস পায়না।মেয়ের পছন্দের কিছু খাবার বানিয়েছিলো সেগুলো রেডি করতে চলে যায়। সেতু, সাজিদ বেশ মন খারাপ করে।নিতুও চুপচাপ রেডি হতে চলে যায়।এর মাঝে নিতু আর তৌসিফ কেউ কারো সাথে আর কোন কথা বলেনি।যাওয়ার সময় নিতু খুব কাদে।ওর একটুও যেতে ইচ্ছে করছিলো না। তৌসিফ শ্বাশুড়ি কে আশ্বাস দেয় যে আবার নিয়ে আসবে নিতু কে।
বাসায় ঢুকতেই আকবর আলি একটু অবাক হয়।কারন ওদের রাতে আসার কথা ছিলো। তৌসিফ কে জিজ্ঞেস করতেই ও বলে”কিছু কাজ আছে আর ভালো লাগছিলো না তাই চলে এসেছে।”
নিতু মন খারাপ করে রুমে গিয়ে বসে থাকে।এর মধ্যেই তৌসিফ রুমে এসে দরজা লাগিয়ে নিতুর কাছে আসলে ওর খুব অশ্বস্তি হয়।পানি আনার নাম করে বাইরে যেতে নিলে তৌসিফ আটকায়।হাত ধরে বলে,”তোমার সমস্যা কি?সব সময় পালিয়ে বেড়াও কেনো?ঐ বাসায় যাওয়ার পর থেকে একবার ও কাছে আসো নি। কারন টা কি?”
নিতু হাত ছাড়াতে নেয় কিন্তু পারেনা।ও ভয় পায়। কাঁপা কন্ঠে বলে,”আমি হাতে ব্যাথা পাচ্ছি।হাত ছাড়ুন।”
তৌসিফ নিতু কে জরিয়ে ধরে। কপালে চুমু খায়। মনে মনে বলে,”কিছু একটা আছে এর মাঝে। নাহলে এই দুই দিনেই নিতুর প্রতি কেমন আসক্তি অনুভব করবে কেনো। মেয়েটাকে দেখলেই ওকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়।কেমন জানি এক অস্থিরতা ঘিরে ধরে।”
নিতু নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু ব্যার্থ হয়।এই দুই দিন নিতু কে কাছে না পাওয়ার জিদ যেনো পুরন করে তৌসিফ।ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়।নিতুর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরে। আজকেও নিতুর খুব কষ্ট হয়।তাই প্রথমে বাধা দিলেও পরে মায়ের কথা মনে করে চুপ হয়ে যায়। ভালো না লাগলেও,মন থেকে না চাইলেও তৌসিফ এর কথার ওপর কথা বলা যাবে না।কারন তৌসিফ ওর স্বামী।আর এটা তার অধিকার।মায়ের কথা মেনে চলতে হবে তাকে।তাই মনকে শক্ত করে নিতু।
আর তৌসিফ যেনো এভাবে নিতুকে কাছে টেনেই ওর ভেতরের অস্থিরতা কমালো। তৌসিফ নিজের প্রয়োজন পুরন করে ফ্রেশ হয়ে নিতু কেও ফ্রেশ হতে বলে চলে যায় বাইরে। নিতু মনকে শক্ত করে। ফ্রেশ হয়ে সুন্দর লাল টকটকে একটা শাড়ি পরে।এর মধ্যে জুঁই, সাদিয়া ,বিথি চলে আসে ওর সাথে দেখা করতে। সবাই মিলে বেশ গল্প করে। জুঁই, সাদিয়া র পড়া আছে তাই ওরা একটু পরে চলে যায়।বিথির নিতু কে খুব পছন্দ হয় তাই ও থাকে। গল্পের এক পর্যায়ে নিতু বলে,”বোন আমাকে এ বাসাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাবে?”
চলবে…..