#সুখের খোঁজে….(পর্ব -৬)
#মৌমিতা হোসেন
মায়ের সাথে কথা বলার মাঝেই সেতু, সাজিদ ও দৌড়ে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,’আপা তুমি কি শ্বশুর বাড়ি গিয়ে আমাদের ভুলে যাবে?’
নিতু ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে,’তোদের ভুলে যাবো কীভাবে রে। তোদের আমি অনেক ভালবাসি। প্রতিদিন ফোনে কথা বলবো আমরা।আর যখনই সুযোগ পাবো দেখা করতে চলে আসবো।’
দুজন মিলে একটা হাসি দেয় ।যদিও নিতুর ভেতরটা অস্থিরতায় ভরপুর থাকে। তবে ওদের সেটা বুঝতে দেয়না। মুখে একটা হাসি দিয়ে ওদের জরিয়ে ধরে।এর মাঝে বরপক্ষ চলে আসে। নিতুর খালামনি তাড়াতাড়ি এসে খবরটা দেয়। সাথে সাথে সেতু সাজিদ বোন কে ছেড়ে দৌড়ে গেটের কাছে চলে যায়।সেতুর মা,খালাও যায়। তৌসিফ কে শেরওয়ানীতে বেশ ভালো লাগছিলো। সবাই মিলে গেইট ধরে। পাঁচ হাজার টাকা দিলেই বরসহ সবাইকে ভেতরে ঢুকিয়ে বসতে দেয়।এর মধ্যে কাজী সাহেব চলে আসেন। বিয়ে পড়ানো হয়। তৌসিফ কে কবুল বলতে বললে সাথে সাথেই বলে দেয়।
নিতু ভেতরেই থাকে। ওকে কবুল বলতে বললে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।ও কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। ভালো খারাপ মিলিয়ে এক মিশ্র অনুভূতি ওকে ঘিরে ধরে। সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে এই ভেবে কষ্ট পায়। আবার তৌসিফ কে এই কয়দিনেই মনে মনে পছন্দ করে ফেলেছে তাই ভালোও লাগছিলো। অবশেষে সবার বারবার বলায় কবুল বলে। সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে মোনাজাত ধরে। মিষ্টি মুখ করে।কবুল বলার পরে নিতু কে এনে তৌসিফ এর পাশে বসানো হয়।
তৌসিফ এর বন্ধুরা নিতু কে দেখেই বিভিন্ন মজা করতে থাকে। তৌসিফ চোখ তুলে দেখে নিতু কে।বেশ ভালো লাগছিলো নিতু কে। আর অন্যদিকে নিতু ভয়ে,লজ্জায় তৌসিফ এর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলোনা। খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হলে আসে বিদায় পর্ব।
প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনেই এই দিনটায় এক ভিন্ন ধরনের আবেগ কাজ করে। নতুন একজন জীবনসঙ্গী পায় যার সাথে তাকে জীবনের বাকিটা সময় কাটাতে হবে। সুখের দুখের সঙ্গী হিসেবে সবসময় পাশে থাকবে।তার অধিকার ঐ নারীর ওপর থাকবে সবচেয়ে বেশি। নতুন পরিবার, নতুন মানুষ, নতুন নিয়ম এক কথায় সব কিছুই নতুন।এই নতুন এর মাঝে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। তাদের সবাইকে আপন করে নিতে হবে। অন্যদিকে জন্ম থেকে এই পর্যন্ত যারা ভালোবেসে লালন পালন করে বড় করেছে,এতো দিনের আপনজন তাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ।এই কবুল শব্দটা বলার সাথে সাথে তার ওপর এতো দিনের প্রিয় মানুষ গুলোর অধিকার কমে যাবে অনেক টাই। নিতু ভাবতে থাকে কি এক অদ্ভুত নিয়ম।
নিতুর মা আকবর আলি কে বলে,”বেয়াই সাহেব আজ থেকে আমার মেয়েকে আপনাদের হাতে তুলে দিলাম।ওর বাবা নেই। আপনি আজ থেকে ওর বাবা। মেয়েটা আমার সহজ সরল।কোন ভুল করলে ওকে বুঝিয়ে বলবেন।”
“অবশ্যই বেয়ান। এটাও কি বলতে হবে? আমার কোন মেয়ে নেই।আজ থেকে নিতু আমার মেয়ে। ইনশাআল্লাহ ও আমাদের পরিবারে ভালো থাকবে।চিন্তা করবেন না।”এ কথা বলে আকবর আলির কেঁদে দেয়।
সালেহা তৌসিফ এর হাতে নিতুর হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে।এতো দিনের আদরের মেয়ে যখন অন্যের হাতে তুলে দিতে হয় তখন কোন মা কি না কেঁদে থাকতে পারে? তৌসিফ এর দিকে তাকিয়ে শুধু বলে,”বাবা আমার মেয়টার দিকে খেয়াল রেখো।আজ থেকে ও তোমার আমানত।”
নিতু তৌসিফ এর হাত ছেড়ে মাকে ধরে কাঁদতে থাকে। সাজিদ,সেতুও কাঁদে। অবশেষে বিদায় পর্ব শেষ করে সবাই মিলে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিতু গাড়িতে উঠে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পরে।ঘুমের মাঝে কখন যে তৌসিফ এর কাঁধে মাথা রাখে সেটা আর নিতু টের পায়না।
এদিকে নিতুর এতো কান্না, বিয়ের এতো নিয়ম, সবার এতো কথায় তৌসিফ খানিকটা বিরক্ত হয়। অবশেষে জ্যাম পাড়ি দিয়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা পর তৌসিফ রা ওদের বাসায় এসে পৌঁছায়। তখনই তৌসিফ এর ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে। নিতু ঘুম ভাঙতেই নিজের অবস্থান দেখে খানিকটা বিব্রতবোধ করে। বুঝতে পারে যে গন্তব্যে চলে এসেছে।চাচি শ্বাশুড়ি নামতে বললে নিতু আস্তে করে গাড়ি থেকে নামে। পুরোনো তিনতলা বাড়ি। একটু ঘিঞ্জি এড়িয়া। সামনে তাকিয়ে দেখে তৌসিফ অপেক্ষা না করে বাড়ির ভেতর ঢুকে পরেছে। একটু অবাক হয় তৌসিফ এর এমন আচরণে।এই মানুষটার ভরসাতেই তো সবাইকে ছেড়ে নিতু এই বাড়িতে এসেছে।
যাক এর মধ্যে সুন্দর মিষ্টি চেহারার তিনজন মেয়ের ডাকে নিতু ওদের দিকে তাকায়। তিনজনই ওকে ভাবী ডাকে। মনে মনে ভাবে যে ওরা হয়তো কোন আত্মীয় হবে। ওদের হাত ধরে নিতু বাড়িতে প্রবেশ করে।দোতলায় নিতু কে তৌসিফ এর রুমে নিয়ে যাওয়া হয়।খাটে বসার পর নিতু ঘরের দিকে একবার তাকিয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করলো। রুমটা খুব বড় না হলেও মোটামুটি সাইজের। রুমে আসবাব বলতে ওদের বাড়ি থেকে দেয়া খাট, আলমারি, পুরোনো ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা টেবিল আর চেয়ার আর পুরোনো একটা ওয়াড্রব।ওয়ালে একটা ছবি টাঙানো।খাটে বসে ভালো ভাবে বোঝা যাচ্ছেনা।
মেয়েগুলোর মধ্যে একজন বললো,”ভাবি আমি বিথি,আর ওরা হলো সাদিয়া আর জুঁই। আমি আর সাদিয়া দুজন বোন। আমি ক্লাস নাইনে পড়ি আর সাদিয়া টেন এ পড়ে।আমরা তোমার ছোট চাচা শ্বশুর এর মেয়ে।আর জুঁই আপু অনার্সে পড়ে।আপুর এক বড় ভাই আছে তপু ভাই।তপু ভাই আর তৌসিফ ভাই একই বয়সের। তপু ভাই পড়ালেখা শেষ করে এখন চাকরি খুঁজছে।।ওরা বড় চাচার ছেলে-মেয়ে।”
বিথিকে থামিয়ে দিয়ে জুঁই বলে ,”এবার চুপ কর বিথি। সারাদিন ভাবির ওপর অনেক ধকল গেছে।রেস্ট নিতে দে।তোর অতিরিক্ত বকবক বন্ধ কর।”
জুঁই এবার নিতু কে বলে,”ভাবি তুমি কিছু মনে করোনা।বিথি এমনি। বেশি কথা বলে। তুমি বয়সে আমার ছোট হলেও বড় ভাইয়ের বৌ তাই ভাবি ডাকতে হবে তোমাকে। তবে আমরা কিন্তু সবাই তোমাকে তুমি করেই বলবো।”
নিতুর কাছে এই তিন বোনকেই বেশ ভালো লাগে।কথা শুনেই বুঝলো এরা বেশ মিশুকে। নিতু হাসি দিয়ে বলে,”কোন সমস্যা নেই আপু আমাকে আপনারা তুমি করেই বলবেন।”
এর মধ্যে দুই চাচি রুমে আসে।বড় চাচি বলে,”এই তোরা সব বের হ রুম থেকে। মেয়েটাকে একটু রেস্ট নিতে দে।আর নিতু কিছু প্রয়োজন হলে আমাদের বলো। আমি ওপরে থাকি আর ছোট নিচ তলায় থাকে।এই বাসায় শুধু ভাই আর তৌসিফ থাকে।মা ছাড়া সংসার তাই একটু এলোমেলো।আস্তে ধীরে তুমি নিজের মতো করে সাজিয়ে নিও।”
এই কথা বলে রুমে কিছু খাবার,পানি রেখে মেয়েদের নিয়ে সবাই বের হয়ে যায়। নিতু মনে মনে শান্তি অনুভব করে।কারন বাসার প্রায় সব মানুষকেই নিতুর ভালো লাগে।মা, সাজিদ, সেতুকে মিস করে নিতু।সেতুর পড়শু পরীক্ষা নাহলে ও আসতো নিতুর সাথে। হঠাৎ বেল এর শব্দে তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে বেল বাজছে।রাত বারোটা কখন বেজে গেছে টের পায়নি নিতু। হঠাৎ ভাবনায় এলো যেই মানুষটার জন্য ও আজ এই বাড়িতে এসেছে সেই মানুষটিকে এই তিন ঘন্টায় একবার ও রুমে আসেনি।ওর খোঁজ খবর নেয়নি। একটু খারাপ লাগে নিতুর।কেমন এক ভিন্ন অনুভূতি,ভয়,শঙ্কা সব মিলিয়ে অপেক্ষায় থাকে নিতু।
ভাবনার মাঝেই ক্লান্ত নিতু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি। হঠাৎ কোমরে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে নিতুর।বেশ ভয় পায়।হাত সরাতে নিলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,”এতো ছটফট করছো কেনো? আমি তৌসিফ তোমার বিয়ে করা স্বামী।বাসর রাতটা ঠিক মতো পালন করতে দাও।”
নিতু থমকে যায়।ভয় পায় আর কিছুটা বিরক্ত হয়।।যেই মানুষটার সাথে এখন পর্যন্ত কোন কথাই হয়নি, শুধু দেখেছে।তার পছন্দ,অপছন্দ, ভালোলাগা সম্পর্কে কিছুই জানেনা, এমনকি কবুল বলার পর থেকেও এ পর্যন্ত কোন কথা বলেনি বা সামনেও আসেনি সেই মানুষটা হঠাৎ এভাবে এসে জড়িয়ে ধরার মানে কি? নিতুর বান্ধবীদের কারোর এখনো বিয়ে হয়নি।আর বেশি লাজুক হওয়ায় এসব ব্যাপারে কারো সাথে কখনো কথাও হয়নি।আর কি বা বয়স হয়েছে নিতুর।মাত্র সতেরো পেরিয়ে আঠারোতে পা রেখেছে।বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এতো কম বয়সে নিতু কে কখনোই বিয়ে দিতো না।যাই হোক এসব কারনে নিতুর এসব ব্যাপারে জ্ঞান অনেক কম।
এসব ভাবনার মাঝেই তৌসিফ নিতু কে ওর দিকে ফিরিয়ে আরো কাছে টেনে নেয়। তৌসিফ এর স্পর্শ নিতুর একটুও ভালো লাগছিলো না। আতিক ভাই যখন নিতু কে ছুঁয়ে দিয়েছিলো তখনও নিতুর এমনি ভালো লাগেনি। নিতু বাধা দিতে গেলে তৌসিফ রেগে গিয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে।জোর করেই অধিকার খাটায় নিতুর ওপর। তবে সেটা শুধুই শারীরিক অধিকার। এখানে মনের কোন মিলন ছিলোনা। তৌসিফ এর কামড়ে, আঁচড়ে নিতুর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। নিতু কষ্টে,ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে। তৌসিফ ওর কাজ শেষ করে ওপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরে।
ভোরে পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।চোখ মেলে পাশে তাকাতেই তৌসিফ কে দেখতে পায়। গভীর ঘুমে নিমজ্জিত তৌসিফ কে দেখলে মনে হচ্ছে কতোটা নিষ্পাপ ও। হঠাৎ নিতুর রাতের কথা মনে পড়ে যায়। উঠতে গিয়ে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে উঠতে। শরীরে এক টুকরো কাপড় নেই।চুড়ি ভেঙে হাত কেটে গেছে। বিছানায় রক্তের দাগ।কোন রকম শাড়িটা বুকের কাছে ধরে নামতে গিয়ে দেখে হাঁটতে পারছে না। কিন্তু কেনো?এর কারনটাও বুঝতে পারছেনা। এলোমেলো পায়ে হেঁটে অনেক কষ্ট করে ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা লাগিয়েই নিচে বসে কান্না শুরু করে নিতু। খুব কষ্ট হয় নিতুর।আয়নায় নিজের শরীরের এতো দাগ,রক্ত দেখে নিজেকে নোংরা মনে হয়। মায়ের কথা খুব করে মনে পড়ে।
অনেক সময় ধরে গোসল করে বের হয়ে দেখে তৌসিফ তখনও ঘুমাচ্ছে।ও আস্তে করে শাড়ি বের করে কোনরকম পড়ে। চুপচাপ বসে থাকে চেয়ারটাতে।কি করবে বুঝতে পারছিলো না।এর মধ্যে তৌসিফ এর ঘুম ভাঙলে নিতু কে দেখে রাতের কথা মনে পড়ে। তবে ওর মাঝে কোন অনুতপ্ততা কাজ করেনা।আড়মোড় ভেঙে নামতে গিয়ে বিছানায় রক্তের দাগ দেখে হাসি দিয়ে মনে মনে বলে,”আমি তাহলে সলিড জিনিস পেয়েছি।”
নিতু টেবিলের পাশেই জানালার দিকে তাকিয়ে ছিলো। তৌসিফ নিতুর শরীর ঘেসে দাড়াতেই নিতু ভয় পায়।সরে যেতে চাইলে তৌসিফ আবারো নিতু কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে মৃদু স্বরে বলে, “আমি ওয়াশরুম থেকে বের হবার আগে চাদরটা পাল্টে ফেলো।আলমারিতে চাদর আছে।আর হ্যা এরপর থেকে এতো ছটফট করবে না। সমানতালে সাড়া দিলে তোমারো ভালো লাগবে। নতুবা কষ্ট পাবে।”কথাগুলো বলেই দ্রুত পায়ে হেঁটে ওয়াসরুমে চলে গেলো তৌসিফ।
চলবে…..