সুখের খোঁজে পর্ব-০২

0
1008

#সুখের খোঁজে……(পর্ব -২)
#মৌমিতা হোসেন

আসিফ কাকে রেখে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছিলো না। যেহেতু তিনি একজন ডাক্তার আর ওখানে অন্য ডাক্তারদের সাথে তার ভালো পরিচয় ছিলো তাই তাড়াতাড়ি নার্সদের বলে সালেহা বেগমকে দেখতে।এরপর নিতুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,’এভাবে ভেঙ্গে পড়লে ভাবিকে কে সামলাবে মা?এখন তোরাই তোর মায়ের ভরসা।তাই তুই ভাবির পাশে বসে ওনার দিকে খেয়াল রাখ। আমি ফর্মালিটিজ শেষ করে আসছি।’

কথাগুলো বলে আসিফ চলে যায় আর হাসপাতালে সব ঝামেলা শেষ করে। এদিকে কিছুক্ষণ পরেই নিতুর মায়ের জ্ঞান ফিরে আসে।জ্ঞান ফিরতেই নিতু কে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে। সবাই মিলে লাশ নিয়ে বাসায় আসলে বাবার লাশ দেখে সেতু, সাজিদ কান্না শুরু করে। সব আত্মীয়দের কে খবর দেয়া হয়।ফজরের নামাজের পর জানাজা পড়ানো হয়। ফয়সাল সাহেব এর ভাই বোনরা গ্ৰামে গিয়ে লাশ দাফন করতে চায়। কিন্তু অনেক আগেই একবার ফয়সাল সাহেব কথা প্রসঙ্গে সালেহার কাছ বলেছিলেন যে মৃত্যুর পর ওনার লাশ যেনো বেশি সময় না রাখা হয়।আর যেনো কাছের কবরস্থানেই দাফন করা হয়।

তাই কান্নার মাঝেই সালেহা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,’না নিতুর আব্বুর লাশ এই কবরস্থানেই দাফন করা হবে। এটা ওনার শেষ ইচ্ছা।তাই এই প্রসঙ্গে কেউ আর কোন কথা না বললেই খুশি হবো।’

এই কথা শুনে কেউ আর কোন কথা বলেনি।ওনার বলে যাওয়া জায়গাতেই ওনাকে কবর দেয়া হয়। নিতুর কোন মামা নেই।একজন খালা নারায়নগঞ্জ থাকতো।খবর শুনে তিনিও চলে আসেন।কাছের আত্মীয় বলতে এই খালা আর এক চাচা, দুই জন ফুপি।ফুপি দু’জন নিতুর বাবার চেয়ে বয়সে বড়।আর চাচা ছোট। সবাই ওদের অনেক ভালোবাসে।

সালেহা বেগম কে সারা দিনে সবাই শতো চেষ্টা করেও কিছু খাওয়াতে পারছেনা।কান্না করছে আর বিলাপ করেই যাচ্ছে। নিতু বুঝতে পারছেনা ও কি করবে। বাবাকে হারানোর সাথে সাথে মায়ের এই অবস্থা নিতু যেনো কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না।রাতে নিতুর খালামনি সহ সবাই জোর করে ওর মাকে একটু খাওয়ায়।

সবাই শোকে ক্লান্ত হয়ে পড়লে নিতু বাবার ঘরে যায়।গতরাতেও বাবার সাথে কতো কথা হয়।একদিনের ব্যবধানে আজ বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছে। ভাবতেই চোখের জল গড়িয়ে পরে নিতুর চোখ থেকে।নিতু মনে মনে বলতে থাকে,’বাবা কেনো আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।কি করে থাকবো এখন বাবাকে ছেড়ে।”বাবার ছবি দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে নিতু। সারাদিন পর এই বুঝি সময় পেলো বাবার জন্য শোক প্রকাশ করার। সালেহা বেগম মেয়ের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে।দুজন মিলে কাঁদতে থাকে।যেনো কান্নার মধ্য দিয়েই মনের সকল কষ্ট বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি কান্নার মাধ্যমে সব কষ্ট ভোলা যায়…..

কেটে যায় এক সপ্তাহ। দুরের আত্মীয়রা সবাই তৃতীয় দিন মিলাদ পড়ানোর পরেই চলে যায়।ফুপুদের নিজেদের সংসারে অনেক ঝামেলা তাই ওনারা ও চলে যায়।একমাত্র চাচা আফজাল ভাইয়ের সংসার কীভাবে কী চলবে সেটা নিয়ে চিন্তায় পরে যায়।

নিতুর চাচার নিজের ব্যবসা। নিউমার্কেটে তিনটা দোকান আছে।ভালোই চলে।প্রায় ছয় বছর আগে শেষ দোকানটা নেয়ার সময় কিছু টাকা কম পরে যায় তখন ফয়সাল সাহেব তার জমানো টাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ভাই আফজাল কে ধার দেয়।আস্তে আস্তে সেই টাকা শোধ করতে বলে। কিন্তু বাজার মন্দার কথা বলে সেই টাকা এতো বছরেও ফেরত দেয়নি। আফজাল সাহেব ঠিক করে সেখান থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা সংসার চালানোর জন্য ভাবীকে দেবে। যেহেতু টাকার বিষয়টা দুই ভাই ছাড়া অন্য কেউ জানে না।তাই তিনি জানাতেও চায়না।তার ধারনা এভাবে টাকাটা দিয়ে আস্তে আস্তে যতোটুকু পারে শোধ করবে।আর না পারলে করবে না। ভাইয়ের কাছ থেকেই তো টাকাটা নিয়েছে। এই টাকা শোধ করতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। যেটুকু দেবে এতেই নিশ্চই সবাই খুশি হবে। আবার সবাই তাকে ভালো বলবে। এমনটা ভেবে চাচা আফজাল সাহেব ভাবিকে সংসার খরচের জন্য চার হাজার টাকা দিয়ে নিজ বাসায় চলে যায়।

আর যাওয়ার আগে বলে,’ভাবি জানেন তো এই বাজার দরে আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সংসার চালানো কতোটা কষ্টের। নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি।তাই খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারবোনা আপনাদের জন্য। তবে প্রতি মাস যতোটুকু পারি আমি সাহায্য করবো।’

দেবর এর কথা শুনে সালেহা কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।তাই চুপ থাকে। তবে এটা বুঝতে পারে যে সামনে তার জন্য কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

এদিকে চাচার এমন উদারতা দেখে নিতু বেশ খুশি হয়। সবাই চলে গেলে মন বেশী খারাপ হবে তাই খালাকে যেতে দেয়না সেতু, সাজিদ।এই খালা নিতুর মায়ের চেয়ে বয়সে বড়।খালু সৌদি থাকে ‌।দুজন খালাতো ভাই-বোন ।বোন রুমকি গতো বছর বিয়ে হয়ে গেছে।আর ভাই রাতুল চাকরির সুবাদে থাকে চট্টগ্রাম।খালা একাই থাকে নারায়ণগঞ্জ। সপ্তাহে একবার এসে দেখে যায় মাকে।তাই সংসার এর তেমন ঝামেলা না থাকায় নিতু,সেতুর জোড়াজুড়িতে আরো কিছু দিন থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।খালার এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় সাজিদ আর সেতু।

জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্ৰাম আসলে অনেক কঠিন।এই সংগ্ৰাম করে বাঁচতে গিয়ে বিগত দুই মাসে বাবার কথা সারাক্ষন আর মনে পড়েনা।চল্লিশ দিন পর খালামনি চলে যায়।সেতু, সাজিদ ওদের পড়াশুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিতুর রেজাল্ট দেবে পরের সপ্তাহে এটা নিয়ে ও খুব চিন্তায় পরে যায়। এদিকে সালেহা বেগম একা সংসার চালাতে গিয়ে কীভাবে কি করবে ভেবে পায়না। সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও রাতে ফয়সাল সাহেবের কথা খুব মনে পড়ে। চোখের জলে বালিস ভেজে। স্বামী নামক মানুষ টা যে সব সময় বটগাছের মতো ওদের সবাইকে সর্বক্ষণ আগলে ছায়া দিয়ে রেখেছিলো সেটা উপলব্ধি করতে থাকে প্রতি মুহূর্ত।

ফয়সাল সাহেবের কর্ম ক্ষেত্র থেকে সালেহা একটা বড় এমাউন্ট এর টাকা পায়। কিছু সেভিংস আছে। কিন্তু কোন আয় না করে জমানো টাকা খরচ করতে থাকলে এক সময় সব টাকা শেষ হয়ে যাবে।এই দুই মাসে সেটা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে।অনেক ভাবার পর খেয়াল হলো যে সে মোটামুটি সেলাই পারে।অন্যের কাছে হাত পাতা বা ছোট হবার চেয়ে কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করা ভালো হবে।তাই ঠিক করলো সেলাই করবে। অনেক বছর ধরে এখানে থাকার কারনে এলাকার সবাই মোটামুটি চেনে। এক্ষেত্রে তার বিশ্বাস সেলাই শুরু করলে এলাকায় অন্যরাও তাকে সাহায্য করবে।আর তাই নতুন একটা মেশিন কিনে সেলাই এর কাজ শুরু করে।এসব নিয়েই তিন সন্তানকে নিয়ে সুখের খোঁজে নতুন করে পথ চলতে শুরু করে সালেহা।

নিতু মায়ের চিন্তা,কষ্ট আর রাত হলেই মায়ের কান্না দেখে মন খারাপ করে। মায়ের জন্য কি করা যায় ভাবতে থাকে। কিন্তু এই ছোট্ট মস্তিষ্ক এসব নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না। দেখতে দেখতে নিতুর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ এর দিন চলে আসে। নিতুর মা মনপ্রান দিয়ে দোয়া করতে থাকে যেনো মেয়েটা অন্ততো পাশ করে। বিয়ে দিতে হলেও তো আজকাল শিক্ষিত হতে হয়। নিতু যেহেতু পড়ালেখায় ভালো না তাই ওকে নিয়ে সালেহার আশা ও কম।

নিতু মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে স্কুলে যায়। রেজাল্ট এ দেখে যে সে ‘বি ‘পেয়েছে।একটুর জন্য ‘এ’পায়নি। খুব আফসোস করে নিতু। আগে থেকেই যদি আর একটু ভালো করে পড়তো তাহলে আরো ভালো করতে পারতো। নিতুর সব বান্ধবীরা ওর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।যাই হোক পাশ করেছে এটাই বেশি। বাসায় গিয়ে রেজাল্ট বললেই মা অনেক খুশি হয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।মেয়ে যে পাশ করেছে এতেই সে অনেক খুশি। ভাবতে থাকে,আজ নিতুর বাবা বেঁচে থাকলে মেয়ের এই রেজাল্ট দেখেই অনেক খুশি হোতেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতেন। কিন্তু কপালে যেনো এই সুখটুকুই ছিলোনা।

নিতু ও বাবাকে খুব মিস করছিলো। কাঁদতে থাকে আর মনে মনে বলে,’দেখো বাবা আমি পাশ করেছি। আমি এখন থেকে আনেক ভালো করে পড়বো বাবা। তুমি কেনো আমাদের একা ফেলে চলে গেলে।’

নিতু ঠিক করে কলেজে ভর্তি হয়ে ও আরো ভালো করে পড়বে। বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে। নিতু কলেজে ভর্তি হয়।আর মন দিয়ে পড়া শুরু করে।এর মাঝে কলেজে যাওয়া আসার পথে একটা ছেলে তাকে প্রায়ই বিরক্ত করা শুরু করে। সালেহা বেগম বিষয়টা জানার পর থেকে খুব চিন্তায় পরে যায়। সংসার এর কাজ,সেলাই, বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশোনা সব মিলিয়ে অস্থির হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে নিতু কে আর পড়াবেনা।

পরদিন নিতু কলেজের জন্য রেডি হতে নিলেই মা বলে,’তোর আর কলেজে যাওয়া লাগবে না। বাসায় বসে পড়।কোনরকম পাশ করতে পারলেই হবে।’

কিন্তু নিতু তো ততোদিনে মনে মনে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে। মায়ের কথা শুনে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,’কেনো মা কলেজে যাবো না কেনো? আমি পড়বো মা। আমি পড়ালেখা করে চাকরি করবো। তোমাকে আর কষ্ট করতে দেবো না।দেখবে তখন আমাদের সংসারে অনেক শান্তি থাকবে। চাকরি নিয়ে আমি সেতু, সাজিদ কেও পড়াবো।বাবার ইচ্ছা আমি পুরন করবো।’

মেয়ের কথা শুনে সালেহা অবাক হয়।যেই মেয়ে পড়ার নাম শুনতে পারতো না।সেই মেয়েও এখন পড়তে চাচ্ছে? কিন্তু এতো প্রতিকুলতায় সে একা সবাইকে রক্ষা করতে পারবে না হয়তো।তাই আবারো বলে,’এতো কথা বলিস না নিতু ‌কলেজে যেতে নিষেধ করেছি তাই যাবিনা।বাসায় বসে পড়।’

নিতু খুব মন খারাপ করে। বারবার মায়ের কাছে অনুরোধ করায় অবশেষে মা রাজি হয়। তবে ঠিক করে দুই মেয়েকেই এখন থেকে সে নিজে নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে।আর এর মাঝে ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে।

সালেহা সাথে থাকায় এলাকার ছেলেটা আর সাহস করেনা নিতুর পিছনে লাগার বা ওকে ডিস্টার্ব করার। তবে সুযোগ খুজতে থাকে। এভাবেই কলেজের প্রথম বছরটা শেষ হয়।

কলেজে যেতে ত্রিশ টাকার মতো রিকশা ভাড়া লাগে। প্রতিদিন এতো টাকা খরচ করা নিতুর মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।কারন সেলাই করে খুব বেশি আয় করতে পারতো না। এতো সময়ও পায়না।তাই পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতে হতো।এক বেলা মাছ/মাংস/ডিম খেলে পরের বেলায় শুধু সবজি দিয়ে খায়। এভাবেই অনেক কষ্ট করে জীবন চলতে থাকে।আর রাত হলেই এতো এতো চিন্তা ঘিরে ধরে সালেহাকে।

এদিকে নিতু খুব মন দিয়ে পড়ে। বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।বাবা ছাড়া জীবনে চলার পথটা যে কতোটা কঠিন সেটা টের পেতে থাকে হারে হারে।রাতের আকাশের তারার মাঝে নিতু বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। খুব করে কাঁদে।ছোট ভাইটা যখন খাবার নিয়ে বায়না ধরে আর মা না দিতে পেরে মুখে আঁচল চেপে কাঁদে সেটা নিতুর ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয় তখন…. খুব।

আর তখন মাকে বলে,’মা ভেবো না।পড়া শেষ করে আমি চাকরি নিলেই তোমার সব কষ্ট শেষ হবে দেখো।’

নিতু জানে না সে কতোটা করতে পারবে মা আর ভাই বোনদের জন্য। তবে মাকে খুব করে আশ্বাষ দেয়।

বাবা মারা যাওয়ার পর চাচা চার /পাঁচ মাস টাকা দেয়।এরপর থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে এড়িয়ে যায়। নিতুর কাছে চাচাকে আজকাল খুব স্বার্থপর মনে হয়।ফুপিদের ও বিরক্ত লাগে।ফুপিরা ফোন দিলেই ওর মাকে শুধু নিতুর বিয়ের কথা বলে।আর এটাই নিতুর বিরক্তির কারন।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে