#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৮]
পরিবারের ভীষণ আদরের মেয়ে হওয়ায় ছোটো থেকেই বেশ জেদি এবং স্পষ্টভাষী মেয়ে ছিলো অনুভা। তাই চোখের সামনে নিজের সঙ্গেই এমন একটি অন্যায় হতে দেখে রাগ হলো তার। হেল্পার লোকটি ভাড়া উঠিয়ে পেছন থেকে যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখনি অনুভা তার উদ্দেশ্যে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“এখন না আপনি আমায় বলে গেলেন হাফ ভাড়ার নিয়ম নাকি বন্ধ হয়ে গেছে? তাহলে ওই ছেলেটার কাছ থেকে কেন পুরো ভাড়া না নিয়ে হাফ ভাড়াই নিলেন?”
লোকটির চোখেমুখে নেই কোনো অনুশোচনার ছাপ। তার সোজাসাপ্টা জবাব,“আপনার কাছে কৈফিয়ত দিমু ক্যান?”
“কৈফিয়ত দিবেন কেন মানে? অবশ্যই দিতে হবে। অন্যায় করবেন আর তা বললেই দোষ হয়ে যাবে? আইন মানবেন না আবার পক্ষপাতীত্ব করবেন?”
লোকটি রেগে গেলো। মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো তার ভাষা। শুরু হলো দুজনার মধ্যে তর্কাতর্কি। বাস ভর্তি এত এত লোক তারপরেও কেউ যেনো দেখেও দেখছে না কিছু। কেউই এগিয়ে এলো না প্রতিবাদের জন্য। এদিককার বাস হেল্পারগুলো খুব খারাপ হয়। এতদিন তা শুধু অনলাইন প্লার্টফর্মেই শুনে এসেছিল অনুভা। আজ তার প্রমাণও সামনাসামনি পেয়ে গেলো। এসব জঘন্য ভাষার সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় মেয়েটি। একপর্যায়ে থেমে গেলো সে। থেমে গেলো তার কণ্ঠনালী। কিন্তু লোকটি যেনো কিছুতেই থামার নয়। পেছন থেকে কয়েকজন পাবলিক এবার কণ্ঠে বিরক্তি লেপ্টে হেল্পারের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“এত কথা কীসের তোমার? এবার অন্তত থামো। বাচ্চা মেয়েদের সঙ্গেও ঝামেলা করতে হবে তোমাদের? তোমরা পারোও বটে।”
লোকটি তৎক্ষণাৎ বিশ্রি একটা হাসি দিলো। মুখ বিকৃত করে বলে উঠলো,“এইডা বাচ্চা মাইয়া? এহন ধইরা রে***”
শেষের কথাটা ছিলো চরম নোংরা এবং বিশ্রি। যা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হতভম্ব হয়ে যায় অনুভা। ঘৃণায় রি রি করে ওঠে পুরো দেহ। ইচ্ছে করে এখনি নেমে পড়তে বাস থেকে। অথচ তার পাশেই বসে ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ বয়সী নারী। তিনি চাইলেই উনার সামনে একজন নারীর অপমানিত হওয়া দেখে করতে পারতেন প্রতিবাদ। কিন্তু করলেন না। বরং না শোনার ভান ধরে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন বাহিরের দিকে। ততক্ষণে হেল্পার লোকটি গিয়ে দাঁড়ালো দরজার সম্মুখে। ওখানে দাঁড়িয়েই কুদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনুভার পানে।
দৃষ্টিটা লক্ষ্য করতেই অনুভা বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখলো নিজের কলেজ ব্যাগ।মাথায় হাত দিয়ে দেখে নিলো হিজাবটা ঠিক আছে কিনা।গাড়ি এসে থামলো ফার্মগেট। নামার সময় হয়েছে। সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। লোকটি এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখে এখনো সেই বিশ্রি হাসিটা। মুহূর্তেই সারা দেহে জেঁকে ধরলো ভয়। ইতোমধ্যে কয়েকজন নেমেও গেছে বাস থেকে। ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে দ্রুত নামার জন্য। দুরুদুরু বুকে বাস থেকে নিরাপদে নেমে গেলো অনুভা। লোকটি যে কিছু করেনি তাতে অবাকও হলো বেশ। সাথে মনে মনে রবের নিকট আদায় করল শুকরিয়া।
ভাবনার মধ্যেই পথিমধ্যে থমকে দাঁড়ায় অনুভা।কারো চেঁচানোর শব্দে পিছু ফিরে তাকায় সে। সঙ্গে সঙ্গেই ভীষণ চমকে যায়।হেল্পার লোকটি পড়ে আছে রাস্তায়।বাস থেকে ছিটকে পড়ার কারণেই তার এমন আর্তনাদ। এমন শক্তপোক্ত লোকটা নিচে পড়ল কী করে? মাথায় প্রশ্নটা হানা দিতেই রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে উপরে তাকায় অনুভা। দেখতে পায় একটি ছেলেকে। যে বাস থেকে নামছে। বাস থেকে নেমেই হেল্পারের কলার ধরে টেনে দাঁড় করায়। মুষ্টিবদ্ধ হাত খানা দিয়ে লাগিয়ে দেয় শক্তপোক্ত কয়েকটা ঘুষি। সঙ্গে সঙ্গে হেল্পারের ঠোঁট কেটে বের হতে লাগলো তরল তাজা র’ক্ত। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে রাস্তায়। গোল হয়ে সকলে দেখে যাচ্ছে ঘটনাটা। বাস থেকে নেমে এলো ড্রাইভার। ছেলেটাকে থামানোর উদ্দেশ্যে কর্কশ কণ্ঠে বলতে লাগলো,“ওরে এমনে মারতাছেন ক্যান?গরীব পাইয়া আমগো উপরে জুলুম করতাছেন মিয়া?”
যুবক ছেলেটার চোখেমুখে রাগ সুস্পষ্ট। ড্রাইভারের সামনেই হেল্পারকে আরো কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো। তারপর রাগত স্বরে বললো,“গরীব! বাসের মধ্যে মেয়েদের সঙ্গে খারাপ ভাষা প্রয়োগ করার সময় মনে থাকে না তোমরা গরীব? দুইদিন পরপর অপকর্ম ঘটানোর সময় এসব মনে থাকে না? কেউ প্রতিবাদ করতে আসলে সিমপ্যাথি পাওয়ার জন্য নাকে কেঁদে এসব বলো তাই না?”
ততক্ষণে কয়েকটা বাস থেমে গেছে। পরিচিত কয়েকজন এগিয়ে এলো। তাদের পোশাক আশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরাও ওই হেল্পার আর ড্রাইভারদের দলেরই লোক। তারা চড়াও হলো প্রতিবাদ করা যুবকটির উপর। এরপরেও যেনো ছেলেটা ছাড়ার পাত্র নয়। যুবক বয়সটাই এমন। এই বয়সে এদের রাগ থাকে বেশি, অন্যায়ের প্রতিবাদে তারাই দৃপ্ত ভূমিকা পালন করে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝামেলাটা বেশ বড়ো হয়ে গেলো। ভিড় ঠেলে হাতে হকি স্টিক নিয়ে যুবকটিকে সঙ্গ দিলো আরো কয়েকজন যুবক। সম্ভবত এরা যুবকটিকে চেনে। সবাই সমবয়সী। হয়তো বন্ধু হবে। হেল্পারের অবস্থা আধমরা। রাস্তার পাবলিক পুরো ঘটনাটা জানার পর তারাও যুবকদের পক্ষ নিলো। বোঝা গেলো এই হেল্পারদের দ্বারা তারাও অতিষ্ট। শুধু ব্যক্তিগত গাড়ি নেই বলে বাধ্য হয়েই এসব বাসে চড়তে হয় তাদের। অনুভা বুঝতে পারলো তাকে হেনস্থা করার কারণেই যুবকটি মূলত ওই হেল্পারকে এভাবে পিটিয়েছে।
ভয় কেটে চোখেমুখে ফোটে উঠলো হাসির রেখা। সামনে এগোনোর জন্য ঘুরে পা বাড়াতেই অনুভব করল কেউ ছুটে এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। অনুভা তাকালো আগন্তুকের পানে। এবারো চমকালো। এতক্ষণ যেই যুবক তার জন্য মারপিট করল সেই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। ছেলেটা হাপাচ্ছে। ফর্সা মুখশ্রীতে জমেছে ঘাম। এখনো চেহারায় তার রাগ বিদ্যমান।
দ্রুত ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার সম্মুখে ধরলো অনুভা। যুবকটি বিলম্ব না করে তা নিজের হাতে নিয়ে নিলো। পাশেই একটা ফাঁকা স্থানে বসে এক দমে শেষ করল বোতলের অর্ধেক পানি। তারপর বোতলটি ফেরত দিয়ে বললো,“হাঁটতে থাকো।”
সরু দৃষ্টিতে তাকায় অনুভা। ধন্যবাদ দিবে ভেবেও আর না দিয়ে হাঁটা ধরে সামনে। ছেলেটাও তার সঙ্গী হয়। হাঁটতে হাঁটতে শুধায়,“নাম কী?”
উত্তর দেয় না অনুভা। অপরিচিত একজন ছেলেকে নাম বলা অনুচিত ঠেকে। তার ভাবভঙ্গি টের পেতেই যুবকটি ফের বলে,“আমি শেখ মাহাথির শ্রাবণ। ডাক নাম অবশ্য শ্রাবণ তবে তুমি চাইলে যেকোনো একটা নামে ডাকতেই পারো।”
এবার পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে যুবকটির পানে তাকায় অনুভা। চেহারা সুরৎ মাশাআল্লাহ। পোশাক আশাকেও বোঝা যাচ্ছে ভালো পরিবারের ছেলে। কিছুক্ষণ আগে যেভাবে প্রতিবাদ করল এতেও বোঝাই যায় খারাপ কোনো মতলব যে তার নেই। শ্রাবণ পুনরায় প্রশ্ন করল,“থাকো কোথায়?”
এবার উত্তর না দিলেই যেনো নয়। মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,“মিরপু্র।”
“তাহলে এখানে কী?”
“কোচিং এ যাচ্ছি।”
“কোচিং? এডমিশন কোচিং?”
“হুম।”
“কোন কোচিং সেন্টার?”
“ইউসিসি।”
“ওহ বেশ ভালো। আমিও ওদিকেই যাচ্ছি। চলো তাহলে একসঙ্গে যাওয়া যাক।”
হাঁটতে হাঁটতেই ছেলেটির পানে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায় অনুভা। শুধায়,“আপনিও কী ওখানে কোচিং করেন?”
ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয় শ্রাবণের। কেমন এক দৃষ্টিতে তাকায় অপরিচিত মেয়েটির পানে। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। অনুভূতি শূন্য চোখ জোড়া চিকচিক করে ওঠে অনুভার। চঞ্চল কণ্ঠে ফের শুধায়,“তার মানে তুমি আমার ব্যাচের? এবার এইচএসসি দিয়েছো তাই না?”
পথিমধ্যেই থমকে দাঁড়ায় শ্রাবণ। আপনি থেকে এক লাফে তুমিতে নেমে গিয়েছে মেয়েটা? আচ্ছা মেয়েটার আক্কেল জ্ঞান বলে কি কিছুই নেই? তাকে দেখে কি সদ্য এইচএসসি পাস যুবক মনে হয়?এবারও তার নিরবতায় উত্তরটা হ্যাঁ ধরে নিলো অনুভা। তাড়া দিয়ে বললো,“দাঁড়িয়ে আছো কেন? তাড়াতাড়ি চলো। ক্লাস শুরু হয়ে গেলে তো বকা খেতে হবে।”
সত্যিটা বলতে চেয়েও আর বললো না শ্রাবণ। হুট করেই মাথায় চেপে ধরলো দুষ্টু বুদ্ধি। মেয়েটার কথাতেই সায় দিয়ে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। অনুভা প্রশ্ন করল,“তুমি কোন বিভাগের?”
“বিজ্ঞান। তুমি?”
“মানবিক।”
দুজনার মধ্যে আর কোনো কথা হলো না। কোচিং বিল্ডিং এর সামনে আসতেই বিদায় নিয়ে ভেতরে ঢুকতে নিলো অনুভা। তৎক্ষণাৎ তাকে পিছু ডাকলো শ্রাবণ,“শোনো মেয়ে।”
থামলো অনুভা। ছেলেটার চোখে চোখ রেখে বললো,
“অনুভা।”
ললাটে ভাঁজ পড়ে শ্রাবণের। অনুভা পুনরায় বলে,
“আমার নাম অনুভা হাসান।”
যা বলার জন্য ডাকলো তাই বলার জন্যই এবার উদ্যত হলো শ্রাবণ। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,
“যানবহনে চলাকালীন আর কখনো এমন ঝামেলা বাঁধাবে না। এইসব ড্রাইভার, হেল্পাররা ভালো নয়। এদের অনেক বড়ো গ্যাং আছে। দেখলে না তখন কতগুলো এসে জড়ো হলো? একা একটা মেয়ে তার উপর মেয়ে দেখলেই পুরুষরা সুযোগ খোঁজে বুঝোই তো নাকি?”
“তো কী করবো? লোকটা তো পক্ষপাতীত্ব করল। ওই ছেলের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিলো আর আমার কাছ থেকে নিলো ফুল!”
“ওই ছেলে ভার্সিটির ছাত্র। ওর সঙ্গে এমনটা করলে পুরো ভার্সিটির পোলাপাইন এসে গাড়ি আটকে দিবে তাই সঠিক ভাড়াই নিয়েছে। শেষে কী বাজে কথা বললো তোমায়? কোনো ছেলেকে কী এসব বলতে পারতো? যখন নামছিলে তখনও তো বাজে ভাবে ছুঁতে চেয়েছিল।”
আঁতকে উঠলো অনুভা। লোকটার হাসি দেখে তার এমন কিছুই মনে হয়েছিল কিন্তু নিরাপদে নামতে পেরে সেসবে আর পাত্তা দেয়নি। এবার তার কাছে সবটা পরিস্কার হলো। শ্রাবণই তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে তাকে রক্ষা করেছে? সব মিলিয়েই ওভাবে মেরেছে!চোখেমুখে মুহূর্তেই প্রকাশ পেলো কৃতজ্ঞতা। ছোট্ট করে বললো,“ধন্যবাদ তোমাকে।”
“এবার যাও, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে সেদিনের মতো চলে গেলো অনুভা। ভেবেছিল এটাই হয়তো তাদের প্রথম এবং শেষ দেখা কিন্তু তার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গুণে গুণে একদিন পরই আবারো দেখা হলো দুজনার। বরং এটাই ছিলো তাদের সাক্ষাৎ এর সূচনা লগ্ন।
কোচিং থেকে বাড়ি ফিরে পুরো ঘটনাটাই বড়ো বোনকে জানায় অনুভা। ঘটনার বিবরণ শুনে অর্থিকা রেগে গেলেও পরক্ষণেই প্রতিবাদ করা ছেলেটার প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে। একদিন বাদে আবারো ক্লাসের দিনক্ষণ চলে আসে। সেদিন আর কোনো ঝামেলাই পোহাতে হলো না অনুভাকে।
কোচিং ক্লাস শেষ হতে হতে তখন দুপুর। যহরের আজান কিছুক্ষণ আগেই পড়েছে। তখনও পুরোপুরি শীতকাল আসেনি। সূর্যের তাপ প্রখর। মাথার উপর ছাতা ধরে রোদ থেকে বাঁচার জন্য সামনের দিকে পা চালাচ্ছে অনুভা। তখনি কেউ পেছন থেকে ডেকে উঠলো,“নোভা!”
নামটা নিজস্ব না হলেও অনুভার নিকট মনে হলো এই সম্বোধনটা তার জন্যই। চলন্ত পা দুটো থেমে গেলো তার। পেছনে ঘুরার আর প্রয়োজন হলো না। ছেলেটি তার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো। ছেলেটিকে দেখে চিনতে তেমন একটা অসুবিধে হলো না অনুভার।এ তো শ্রাবণ! কোনো সামাজিকতা না দেখিয়েই তার হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিলো শ্রাবণ। আশেপাশে তাকিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,“কী রোদ! ভাগ্যিস ছাতাটা নিয়ে এলে তুমি। নইলে আমার স্কিনটা আজ কালো করেই ছেড়ে দিতো এই সূর্যি মামা।”
চট করে রাগ হলো অনুভার। রাগলে স্বভাবসুলভ তার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতীক্রম ঘটলো না। রাগত স্বরে বললো,“তুমি আমার ছাতা নিলে কেন? দাও বলছি।”
“বললাম না রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার সুন্দর স্কিনটা কালো হয়ে যাবে।”
“তো আমার যে রোদ লাগছে। আমি বুঝি কালো হবো না?”
কয়েক সেকেন্ড ভাবলো শ্রাবণ। তারপর বললো,“তা অবশ্য ঠিক। চলো তবে দুজনে ভাগাভাগি করে নেই।”
“প্রয়োজন নেই।”
রাগ দেখিয়ে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো অনুভা। শ্রাবণও হাঁটতে লাগলো তার পাশাপাশি। জিজ্ঞেস করল,“আচ্ছা তোমার বাবা যেনো কী করে নোভা?”
“নোভা নয় আমার নাম অনুভা।”
“অনুভা? ওহ, সেদিন অতো খেয়াল করিনি। পরে মনে করতে গিয়ে মনে হয়েছিল তোমার নাম নোভা।”
“সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা তুমি কী একটু বলদ টাইপের মেয়ে?”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই চরম আশ্চর্য হলো অনুভা। বলদ তাও আবার সে? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে শ্রাবণের পানে তাকালো। শ্রাবণের মুখশ্রীতে সিরিয়াসনেস। বললো,“পুলিশ অফিসারের মেয়ে হয়ে পথে ঘাটে ঝামেলা বাঁধিয়ে কিনা হয়রানির শিকার হয়ে চলে আসো? তখন যদি হেল্পারের সামনে জোর গলায় বলতে, আমার বাবা পুলিশ। আমি পুলিশের মেয়ে। তাহলে কী আর ওই লোকটা অসব বলার সাহস পেতো?”
টনক নড়ে উঠলো অনুভার। ঠিকই তো! তখন যদি এ কথাটা বলতো তাহলে তো আর এত ঝামেলা তাকে পোহাতেই হতো না।বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বুদ্ধিমতি হলেও ছোটো থেকেই অনুভার উপস্থিত বুদ্ধিটা কম। খানিকক্ষণ নিরব থেকে বললো,“মনে ছিলো না। তাই বলে যে আমি বলদ এমনটাও নয়। তা তুমি কী করে জানলে যে আমার বাবা পুলিশ?”
ক্লাস শেষে কামরুল হাসান থানার গাড়িতে করেই মেয়েকে নিতে এসেছিলেন। তখনি তাকে পুলিশের লোগো লাগানো গাড়িতে উঠতে দেখে এমন কিছুই আন্দাজ করেছিল শ্রাবণ। তবে এখনি প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না সে। শুধালো,
“আমাকে দেখে কী তোমার সদ্য এইচএসসি পাস করা যুবক মনে হয়?”
“তা অবশ্য হয় না। লেখাপড়ায় গ্যাপ গেছে নাকি তোমার?”
“উহু, কোনো গ্যাপই যায়নি। ব্রাইট স্টুডেন্ট আমি।”
“ওহ, তাহলে হয়তো দেরিতে স্কুলে ভর্তি হয়েছো তাই না? এটা কোনো ব্যাপারই না। কলেজে আমার ইয়ারের কত স্টুডেন্ট দেখলাম যারা আমার থেকেও বয়সে অনেক বড়ো।”
“তুমি আসলেই একটা বলদ।”
মুহূর্তেই রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো অনুভার। যদিও বোন তাকে প্রায়সই বলদ উপাধিটা দিয়ে থাকে তবুও এ কথাটা শুনলেই তার রাগ হয়। ঘোর প্রতিবাদ করে বললো,“দেখো আর একবারও কিন্তু এমন কথা বলবে না।”
“বলদকে বলদ বলবো না তো কী বলবো? শুরু থেকেই না জেনে আমায় নিজের ব্যাচমেট বানিয়ে দিলে? যাই হোক, শোনো মেয়ে জাবিতে কিন্তু মাস্ট এক্সাম দিবে এবং ভালো একটা প্রিপারেশনও নিবে। দোয়া করি তোমার যাতে জাবিতেই হয়ে যায়।”
“শুধু জাবিই কেন? সব জায়গায় তো ঢাবিকেই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়।”
“কারণ জাবিতে তোমার জন্য আমি আছি। আমার ক্যাম্পাসেই কিন্তু তোমাকে দেখতে চাই নোভা খুকুমণি। তোমাকে আমি যত্ন সহকারে রোজ র্যাগ দিবো। ঠিক আছে?”
কথাটা শেষ করেই অনুভার হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে শীষ বাজাতে বাজাতে প্রস্তান করল শ্রাবণ। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অনুভা। ছেলেটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে পূর্বের স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। শ্রাবণের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো।
তার মানে ছেলেটা তার ব্যাচমেট নয়? ভার্সিটিতে পড়ুয়া সিনিয়র ভাই? এত সিনিয়র ভাইকে কিনা শুরু থেকেই ‘তুমি’ সম্বোধন করে এসেছে সে? নিজেকে সত্যি সত্যিই এবার বলদ বলে মনে হলো অনুভার। তখন অমন একটা পরিস্থিতিতে ছিলো তার উপর? আর কিছু ভাবতে পারলো না অনুভা। বাড়ির পথে যাওয়া ধরলো। তবে এই ঘটনাটা যে মোটেও আপুর কাছে বলা যাবে না তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো। আপু জানলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে তা সে নিশ্চিত। ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেকে আরো বলদ প্রমাণ করার কোনো মানেই হয় না।
চলবে _________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:০৯]
তারপর পুরো দুটো সপ্তাহ কেটে গেলো কিন্তু শ্রাবণের দেখা আর মিললো না। যেভাবে হঠাৎ করেই ছেলেটা উদয় হলো ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো। পথে যাতায়াতের সময়ও বারবার অনুভার আনমনা মন এদিক ওদিক খুঁজে ফিরেছে তাকে। অনুভা খুব করে চাইলো এই অদ্ভুত ছেলেটির সঙ্গে তার আবার দেখা হোক। স্রষ্টা তার এই চাওয়াটাও শুনলো। সেই একই স্থানে আবার দেখা হলো দুজনার। অনুভা খেয়াল করল দুজনার মধ্যে যতবার দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই হুট করে কোত্থেকে যেনো উদয় হয়ে তাকে পিছু ডেকেছে শ্রাবণ। আর প্রথম দুবারই অবাক হয়েছে অনুভা। তবে এবার আর কোনো অবাক হয়নি সে। হয়েছে চরম রাগ।
পেছন থেকে ডাক পড়ল,“এই ঘুষখোরের মেয়ে!”
অনুভা থমকায়। হতবিহ্বল দৃষ্টিতে পিছু ফিরে। তার পাশে এসে দাঁড়ায় শ্রাবণ। শুধায়,“প্রেম ট্রেম করো নাকি? কোথায় তোমার প্রেমিক মহাশয়?”
“কষ্মিনকালেও এ পথে পা বাড়াইনি তার আগে বলুন আপনি আমায় কী বলে ডাকলেন?”
“কই কী বলে ডাকলাম?”
“অবশ্যই ডেকেছেন। আপনি আমায় ঘুষখোরের মেয়ে বলে ডেকেছেন। এখন আবার তা অস্বীকার করছেন?”
শ্রাবণের চোখেমুখে ফোটে ওঠে দুষ্টুমির ছাপ। একটু ঝুঁকে এসে ফিসফিস করে বলে,“তোমার বাবা পুলিশ না? তাহলে ভুল কী বললাম?”
“আমার বাবা পুলিশ বলেই কী ঘুষখোর?”
শ্রাবণের সহজ উত্তর,“হ্যাঁ।”
“এসব আজেবাজে ধারণা বাদ দিয়ে মনটা পরিস্কার করুন।”—অনুভার কণ্ঠে ভীষণ তেজ। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো ঝড়ের গতিতে।
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। তার হাঁটার সঙ্গী হলো।বললো,
“রাগলে মেয়ে মানুষদের অনেক সুন্দর লাগে।”
প্রত্যুত্তর করল না অনুভা। শ্রাবণ বুঝলো মেয়েটা তার সঙ্গে কথা না বলার ফন্দি এঁটেছে। বললো,“তুমি কী আমায় মিস করছিলে এ কদিন?”
কথাটায় কাজ দিলো। অনুভা ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,“আজব তো! আপনাকে আমি মিস করবো কেন?”
“এই দাঁড়াও দাঁড়াও এতক্ষণ তো আমি খেয়ালই করিনি। তুমি আবার একলাফে আপনি ডাকে চলে এসেছ কেন?”
“কারণ আপনি আমার সিনিয়র।”
“সিনিয়রদের বুঝি আপনি বলে সম্বোধন করতে হয়?”
“হ্যাঁ।”
“এখন নিশ্চয়ই ভাইয়া বলেও ডাকবে? দোয়া করি আমাকে ভাইয়া বলে ডাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেনো তোমার মুখ খসে পড়ে।”
হাঁটার মধ্যে আবারো দাঁড়িয়ে পড়ল অনুভা। ভ্রু দ্বয় কিঞ্চিৎ কুঁচকে শুধায়,“অভিশাপ দিচ্ছেন?”
“হুম দিলাম। তবে ভাইয়া বলে ডাকলেই কিন্তু অভিশাপটা লেগে যাবে।”
নিশ্চুপ অনুভা। হাস্যজ্জ্বল মুখখানা এবার গম্ভীর হলো শ্রাবণের। বললো,“শুরুতেই আপনি বলে সম্বোধন করলে না হয় মেনে নিতাম। কিন্তু তুমি থেকে আপনিতে নামা খুবই অন্যায় একটি কাজ। আমি অন্যায় সহ্য করতে পারি না। যারা অন্যায় করে তাদেরকে ওই হেল্পারের মতোই পেটাতে ইচ্ছে করে।”
“পেটানোর হুমকি দিচ্ছেন আমায়? আমায় পেটাবেন?”
“এমন করে বলছো কেন? পেটালে কী করবে? তোমার পুলিশ বাপকে গিয়ে নালিশ করবে?”
“দরকার হলে তাই করবো।”
“এটা করা একদম অনুচিত হবে।”
“কেন?”
“কারণ তোমার বাপ পুলিশ হলে আমার বাপ হচ্ছে র্যাব। তুমি তোমার পুলিশ বাবাকে আমার কথা বললে তোমার বাবা আমায় জেলে ভরতে চাইবেন। তখন আবার তাকে বাঁধা দিতে চলে আসবে আমার র্যাব বাবা। শুরু হবে পুলিশ আর র্যাবের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে শত্রুতা। তাদের মধ্যে শত্রুতা হলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যে থমকে দাঁড়াবে নোভা।”
“তাদের দ্বন্দ্বের সঙ্গে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কী সম্পর্ক?”
“অনেক সম্পর্ক আছে। তোমার এই ছোটো মাথায় তা ঢুকবে না। তার আগে কাল কী হয়েছে সেটা শুনো।”
“কী হয়েছে?”
“গতকাল নৈশ প্রহরে আমি যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঠিক সেই সময়টায় স্বপ্নে দেখলাম আমার নাতি- নাতনিরা কান্না করছে।”
“নাতি-নাতনি কোত্থেকে এলো? আপনি কী বিয়ে করেছেন?”
“আরে বলদ মেয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নাতি- নাতনিরা।”
“আমাদের?”
“হুম।”
“তা কী বললো?”
“বললো, দাদা গো দাদীকে বলো যাতে তার পুলিশ বাপের কাছে তোমার নামে নালিশ না করে। নালিশ করলে তো তোমার বিয়ে হবে না। বিয়ে না হলে আমাদের বাবা-মায়েরাও পয়দা হবে না। তারা পয়দা না হলে আমাদের কী হবে? দেখেছো তাদের কী কষ্ট?”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভা। হাঁটতে হাঁটতে বলে,“ভালো গল্প বলতে পারেন তো আপনি? নিশ্চয়ই সাহিত্যের ছাত্র?”
“না তো।”
“তাহলে?”
“এইসব আগের যুগের আপনি আজ্ঞা বন্ধ করে পুরোনো ফর্মে ফিরে এসো। শুরুতে তুমি তুমি বলে যেভাবে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছিলে সেভাবেই তুমি করে বলো।”
“মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছি?”
“অসহ্য, ন্যাকা একটা মেয়ে।”
“তুমি অসহ্য, তুমি ন্যাকা।”—রাগান্বিত স্বরে কথাটা বলে থামলো অনুভা।
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। রয়েসয়ে বললো,“আমার সাবজেক্ট কেমিস্ট্রি। তুমি চাইলে কিন্তু আমাদের মধ্যে একটা কেমিস্ট্রি হতেই পারে।”
“ভালো ফ্লাটিং করতে পারো তো!”
“উহু পারি না,তবে তোমার উপর এপ্লাই করে অভিজ্ঞ হবো ভাবছি।”
“সাভারের পোলাপাইন মিরপুর, ফার্মগেট দিয়ে কী করো? যাও সাভারে যাও,নিজের ভার্সিটির মেয়েদের সঙ্গে ফ্লাটিং করো গিয়ে।”
“আমি ধানমন্ডির ছেলে। মিরপুরে গিয়েছিলাম খালার বাড়িতে। কথা ছিলো সেদিন রাতটা থেকে পরেরদিন বাড়ি ফিরবো কিন্তু আমার মন টিকছিল না ওখানে তাই কাউকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে পড়ি।”
“তাহলে ফার্মগেটে কী?”
“তোমাদের পাশের কোচিং সেন্টারে এডমিশনের জন্য কেমিস্ট্রি পড়াই। যদিও সেদিন আমার ক্লাস ছিলো না তবুও একটা প্রয়োজনে গিয়েছিলাম।”
“ওহ, তাহলে তো অনেক পরিশ্রম করতে হয় তোমাকে তাই না?”—অসহায় হয়ে গেলো অনুভার মুখশ্রী।
মৃদু হাসলো শ্রাবণ। বললো,“কীসের পরিশ্রম?সপ্তাহে একদিন ক্লাস। তার উপর এ বছর থেকেই শুরু করেছি। জীবনে অনেক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে বুঝলে মেয়ে?”
উপর নিচ মাথা নাড়ালো অনুভা। বাসে উঠার আগ পর্যন্ত কথা বলে তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সেদিনের পর থেকে আবারো নিরুদ্দেশ হলো শ্রাবণ। অনির্দিষ্ট কালের জন্য আবারো হারিয়ে গেলো ছেলেটা। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েটার ভেতরে জেগে ওঠা বিভিন্ন অনুভূতি নামক আগুন নিভে গেলো চট করে। ফেরার পথে কত যে ছেলেটার দেখা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে অনুভা তার কোনো হিসেব নেই। বারবার চেয়েছিল যাতে আবারো দেখা হয় তাদের কিন্তু হলো না। কোচিং এর ক্লাস শেষ হলো। সেখান থেকে দেওয়া হলো বিদায়। ভেতরে জ্বলন্ত ছোট্ট আশার আলো নিভে গেলো। অনুভা বুঝতে পারলো তাদের মধ্যে যে আর কখনোই দেখা হবে না।
হুট করেই একজন এলো তারপর প্রেমের উষ্ণতা ছড়িয়ে হারিয়ে গেলো অজানায়। ততদিনে এডমিশন নিয়ে মাথায় হাজারো চিন্তা অনুভার। সময় তার গতিতে চলতে লাগলো। দেখতে দেখতে একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হলো। ফলাফল দিলো। প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় না পেয়ে মনক্ষুণ্ণ হলো অনুভার। তবে তা সাময়িক। জবিতে মন মতো সাবজেক্ট পেয়ে সেখানেই ভর্তি হয়ে গেলো।
ভার্সিটির হাওয়া গায়ে লাগলো। মেয়েটা হয়ে উঠলো আগের থেকেও চঞ্চল। কিন্তু মেয়েটার চঞ্চলতা কারো নিকট সহ্য হলো না। তার সেই চঞ্চলতা প্রেম নামক অসুখে রূপান্তর করতে আবারো তার জীবনে চলে এলো সেই সুপুরুষ। ভার্সিটিতে পা রাখার মাস তিনেক পার হয়েছে তখন।নতুন নতুন অনেক বান্ধবী জুটেছে অনুভার। ক্লাস শেষে একেক জনের একেক গল্প শুনে হাসতে হাসতে বের হলো ভার্সিটির ভেতর থেকে। আশেপাশে কোনো খেয়াল নেই তার। অদূরে কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তাকে। দেখা শেষ হতেই ডাকলো,“নোভা!”
এই নামটা অনুভার চেনা। বিশেষ মানুষের দেওয়া সংক্ষিপ্ত একটি নাম। পুরোনো ভাবেই থেমে গেলো তার পা জোড়া। বান্ধবীরা অনেকটা পথ ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে। পেছন ফিরতেই বিষ্ময়ে মুখশ্রীর আদল বদলে গেলো অনুভার। নিজের চোখকে তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠিক দেখছে তো সে? সাদা একটি গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। চোখে সানগ্লাস, পায়ে সাদা কেস, পরনে হাফ প্যান্ট, কালো রঙের টি-শার্ট তার উপরে আবার সাদা একটা শার্ট যার বোতামগুলো খোলা। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। উচ্চস্বরে বললো,“দেখা শেষ হলে দ্রুত কাছে এসো।”
হঠাৎ করেই যে আবারো এভাবে দেখা হবে দুজনার কষ্মিনকালেও তা ভাবতে পারেনি অনুভা। বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো ছেলেটার সম্মুখে। তার মনে যখন বিভিন্ন প্রশ্ন আর মান অভিমানের পাল্লা ওঠা-নামা করছিল ঠিক তখনি শ্রাবণ বলে উঠলো,“এটা তো কথা ছিলো না নোভা।জাবিতে না গিয়ে তুমি জবিতে কী করছো?”
“জাবিতে তো পরীক্ষাই দেইনি।”
“কেন দাওনি?”
“ফরমই তো তুলতে পারিনি। এইচএসসিতে আমার ইংরেজির পয়েন্ট খুবই খারাপ। টেনেটুনে পাস যাকে বলে। জাবির ফরম তুলতে তো ইংরেজিতে ভালো একটা পয়েন্ট লাগে।”
কয়েক সেকেন্ড কিছু ভাবলো শ্রাবণ। তারপর বললো,“ওহ, এটা তুমি আমায় আগে বলবে না? ওদিকে তোমাকে স্পেশাল ওয়েলকাম জানানোর জন্য তোমার অপেক্ষায় আমি বসে ছিলাম।”
“আগে কীভাবে বলবো? তোমার সঙ্গে কী আমার কোনো যোগাযোগ ছিলো? নাকি তোমার ফোন নাম্বার ছিলো?”
শ্রাবণ বাম ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,“নাম্বার লাগবে?”
ভড়কে গেলো অনুভা। খানিকটা লজ্জাও পেলো। কিন্তু সেই লজ্জাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শ্রাবণ বলে উঠলো,“তোমার লাগলেও আমি আমার নাম্বার তোমায় দিবো না।”
“কেন দিবে না?”
“আমার ইচ্ছে।”
“তা এতদিন পর কোত্থেকে উদয় হলে বলো তো? সেদিনের পর থেকে আর দেখাই পেলাম না তোমার।”
“আমায় খুঁজেছিলে নাকি?”
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ভিতু হলো মন। উপরে উপরে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখলো অনুভা। হুটহাট কারো প্রতি আবেগী হয়ে অনুভূতি প্রকাশ করার মেয়ে সে নয়। দক্ষভাবে মিথ্যে বললো,“না তো। তোমায় খুঁজবো কেন? তা জানলে কী করে আমি যে এখানে আছি?”
“জানাটা কী কঠিন কোনো কাজ নাকি?তবে তোমার উপর আমি চরম ক্ষুব্ধ নোভা।”
“কেন?”
“জাবিতে পরীক্ষা না দেওয়ার ব্যাপারটা মানলাম কিন্তু জাবির ভাই ঢাবির কাছে কেন গেলে না?”
“গিয়েছিলাম কিন্তু ওখানেও এই ইংরেজিই বাঁধ সাধলো। এক মার্কের জন্য ইংরেজিতে ফেইল।”
“ইংরেজিতে নিশ্চয়ই প্রচন্ড দুর্বল তুমি?”
“হুম অনেক।”
“শুরুতে আমায় কেন জানালে না? তাহলে আমি তোমার স্পেশাল ক্লাস নিতাম।”
ছোটো ছোটো চোখ করে ভ্রু যুগল কুঁচকে শ্রাবণের পানে তাকিয়ে রইলো অনুভা। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“তোমাকে আমার একদম সুবিধার মনে হচ্ছে না। সত্যি করে বলো তো কয়জনের এমন স্পেশাল ক্লাস নাও?”
“স্পেশাল তো দূরে থাক তবে নরমাল ভাবেও কারো ক্লাস নেই না। নিজে ক্লাস করেই কুল পাই না তার উপর অন্যের ক্লাস নেওয়ার সময় কোথায়? তবে কোচিং এ ক্লাস নিতে গিয়ে দেখলাম কয়েকটা মেয়ে সম্ভবত আমার উপর ফিদা হয়ে গেছে। কয়েক মাস ধরে জোঁকের মতো ম্যাসেঞ্জারের পেছনে লেগে থেকে প্রেম নিবেদন করছে।”
“স্বাভাবিক। এত সুন্দর স্যার থাকলে যে কেউই প্রেমে পড়বে। তবে আমার হচ্ছে কপাল পোড়া। জীবনে এত সুন্দর একটা স্যার-ই পেলাম না।”
ভ্রু নাচায় শ্রাবণ। অধরে দুষ্টু হাসি। ফিচেল কণ্ঠে বলে,“তুমি চাইলে কিন্তু আমি তোমার প্রেমের টিচার হতেই পারি।”
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো অনুভা। তৎক্ষণাৎ প্রসঙ্গ বদলে ফেললো শ্রাবণ। পুরোনো প্রসঙ্গ টেনে বললো,“ভেবেছিলাম পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ায় তোমায় বড়োসড়ো একটা ট্রিট দিবো। কিন্তু তোমার কাছে আসতে গিয়েই তো আমার বাবার অনেক গুলো পেট্রোল খরচ হয়ে গেলো। ভবিষ্যৎ এ আরো কত যে পেট্রোল খরচ হবে তার তো হিসেবই নেই। দেখা যাবে পেট্রোলের টাকা জোগান দিতে গিয়ে বাড়িঘর বেচে দেউলিয়া হয়ে গেছে আমার বাবা।”
মুচকি হাসলো অনুভা। কথাটার অর্থ সহজেই বুঝে গেলো। বললো,“রাবিতেও আমার হয়ে গিয়েছিল কিন্তু বাবা কিছুতেই অতদূরে যেতে দিলো না। তাই এখানেই সাবজেক্ট চয়েস দিয়েছিলাম আর মনমতো পেয়েও গেলাম।”
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। বললো,“তোমার ঘুষখোর পিতা মহোদয় এই একটা ভালো কাজ অন্তত করেছেন। যার কারণে উনার প্রতি আমি সন্তুষ্ট।”
“বাবাকে একদম ঘুষখোর বলবে না। আমি কিন্তু রেগে যাবো।”
“সত্যি কথা শুনতে তিতাই লাগে। তিতা কারো পছন্দ নয়।”
মুখ বাঁকালো অনুভা। সেদিনের পর থেকে তাদের সম্পর্কের গভীরতা যেনো বৃদ্ধি পেলো।এভাবেই পুরো দু দুটো বছর একসঙ্গে পথ চললো দুজন। দুজনার দেখা হতো অনিয়ম করে। শুরুর মতোই হুটহাট করে হারিয়ে যেতো শ্রাবণ। আবার হুট করেই কোত্থেকে উদয় হয়ে পিছু ডাকতো অনুভার। অন্যান্যদের মতো তখনও তাদের মধ্যে বিনিময় হয়নি ফোন নাম্বার। অথচ তখন সকলের হাতে হাতেই স্মার্ট ফোন। শুরু থেকেই অনুভার মনে হয়েছে এই পুরুষটা অদ্ভুত। খুবই অদ্ভুত। স্যোশাল মিডিয়ার যুগ থাকার পরেও একজন আরেকজনের ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপসহ কোনো জায়গায় যুক্ত ছিলো না। একটা সময় এই অদ্ভুত ছেলেটার প্রেমে পড়ল অনুভা। যাকে বলে মারাত্মক প্রেম। তবে কখনোই প্রকাশ করা হলো না। দুই বছরে অনেক গুলো মাস, দিন পাড়ি দেওয়ার পরেও তাদের সম্পর্কের কোনো নাম হলো না। কিন্তু দুজনই দুজনার অনুভূতি বুঝতো। বুঝতো চোখের ভাষা।
এই দুই বছরে একবারের জন্যও কেউ কারো সীমা লঙ্ঘন করেনি। কেউ কারো আঙ্গুল স্পর্শ করেনি। বান্ধবীরাও যখন জিজ্ঞেস করতো, তোদের মধ্যে কী প্রেম চলছে? অনুভার উত্তর ছিলো, না। তখন আবারো প্রশ্ন আসতো, তাহলে চলছেটা কী? অনুভা জানতো না। আসলেই তাদের মধ্যে চলছেটা কী?
বছর ঘুরতেই বাড়িতে অর্থিকার বিয়ের কথাবার্তা উঠলো। বড়ো বোনের বিয়ে নিয়ে অনুভার অনেক পরিকল্পনা ছিলো। যা শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হলেই উৎফুল্ল হয়ে তাকে জানাতো। তন্ময় ছেলেটা ছিলো খুবই ভদ্র, মিশুক এবং হাসিখুশি প্রকৃতির একজন পুরুষ।বাবা হয়তো তার ভেতরে আরো ভালো কোনো গুণ দেখেছিল। নয়তো কী আর নিজের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য এতো উতলা হয়ে ওঠেন? তবে এর ভেতরেই অনুভা লক্ষ্য করল বাবা-মায়ের যে কিছু একটা হয়েছে। তাদেরকে আগের মতো আর হাসি
খুশি দেখা যায় না। সবসময় চিন্তিত থাকে। মেয়েদের দেখলেই লুকোচুরি ভাব। অনুভা কিছু একটা আঁচ করে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল,“কোনো সমস্যা বাবা? তুমি কি অসুস্থ?তোমাকে ইদানিং কেমন যেনো লাগছে।”
প্রথমে কামরুল হাসান ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণেই জোরপূর্বক হেসে উত্তর দেন,“কী সমস্যা হবে?অফিসে কাজের চাপ বেশি, বুঝলি? তার উপর তোর বোনের বিয়ে। বিয়ের পর আমাদের ছেড়ে কত দূরে চলে যাবে অর্থি? ভেবেই তো আমার বুকটা কেঁপে উঠছে।”
বাবার কথায় নিজের মনটাও চট করে খারাপ হয়ে গেলো অনুভার। সত্যিই তো! বোন চলে গেলে যে খুব কষ্ট হবে তার। কি করে থাকবে তাকে ছাড়া?
মাস খানেকের মধ্যেই বিয়ের হইচই পড়ে গেলো বাড়িতে। চাচা জেঠাদের কথায় ঠিক হলো বিয়ে হবে গ্ৰামের বাড়িতে। মন খারাপ হলো অনুভার। তার মানে শ্রাবণের সঙ্গে দেখা হবে না অনেকদিন! ভাবনা গুলো মস্তিষ্কে হানা দিতেই ধক করে উঠলো তার বুক।
তারপরের দিনই ক্লাস মিস দিয়ে মনে সাহস নিয়ে এই মেয়েটাই একা একা চলে গিয়েছিল সেই সাভারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। কিন্তু গিয়ে যেনো তার মাথায় হাত। চট করে মনে পড়ল যার জন্য এতদূর ছুটে আসা তার তো মাস চারেক আগেই গ্ৰাজুয়েশন শেষ হলো! মন খারাপ নিয়ে ফেরার জন্য পা বাড়াতেই সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হয়ে গেলো সে পথেই।
সেদিন শ্রাবণের মুখটা দেখে কি খুশিই না হয়েছিল অনুভা। প্রথমবারের মতো এই পুরুষটাকে সে চমকাতে দেখেছে। তার সামনে এসে সটান করে দাঁড়িয়ে চমকায়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেছিল,“তুমি! এখানে কী করছো? কার সঙ্গে এসেছো এতদূর?”
ঠোঁট চেপে তখন হাসছিল অনুভা। কোনো ভণিতা ছাড়াই উত্তর দেয়,“আপুর বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে পনেরো দিনের জন্য পরিবারের সঙ্গে গ্ৰামে যাচ্ছি। পরশু দিন রওনা দিবো। তাই কাল দেখা হওয়ার কোনো চান্স নেই, গোছগাছ করতে হবে। আর আজও যে তুমি আসবে না তা আমি নিশ্চিত ছিলাম।”
“তাই বলে একা একা চলে এলে? পথে যদি কোনো বিপদ হতো?”
“হতো’র চিন্তা কবে করো তুমি? হয়নি তো। এখানে এসে আমার মনে পড়ল তোমার তো গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট। কথাটা মনে পড়তেই মন খারাপ হলো। তোমার বলা প্রথমদিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো। সত্যিই আমি একটা বলদ। সময়ের কথা সময়ে মনে না পড়ে অসময়ে মনে পড়ে।”
“ভাগ্যিস অসময়ে মনে পড়ে। তাই তো আমাদের পথ চলাটা দীর্ঘ হলো।”—-বলেই মুচকি হাসলো শ্রাবণ।
“তা তুমি এখানে এ সময়?”
“প্রয়োজনে এসেছিলাম।তোমার ভাগ্য ভালো আমার প্রয়োজনটা ছিলো তাই তো দেখা হলো।”
সেদিন অনেকক্ষণ দুজনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। ওইটাই জীবনের প্রথম আনন্দঘন দিন ছিলো অনুভার। সেদিনই তার জীবনে এতটা স্বাধীন ভাবে ঘুরতে পেরেছিল মেয়েটা। তারপর শ্রাবণ নিজ দায়িত্বে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় অনুভাকে। যদিও সেদিন ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গিয়েছিল। মায়ের থেকে অনেক বকাও খেতে হয়েছিল তাকে। তবে ভাগ্য ভালো ছিলো যে বাবা সেসময় বাড়িতে ছিলেন না। নইলে বাবার বকাও মিস যেতো না।
চলবে _______
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)