#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৯]
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাস্তা তৈরি করে টেবিলে রাখলো অনুভা। শান্তা সবে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হয়েছেন। খাবার টেবিলের সম্মুখে এসে পুত্রবধূর কাণ্ড দেখেই অবাক হলেন তিনি। এগিয়ে এসে বিষ্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন,“এমা তুমি এর মধ্যেই নাস্তা তৈরি করে ফেলেছো?”
“হ্যাঁ।”
“সবিতা তো এখনো এলোই না। একা একা কেন এসব করতে গেলে বলো? আমিই তো ওকে সঙ্গে নিয়ে করে নিতাম সবটা।”
মিহি স্বরে উত্তর দিলো অনুভা,“ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাই ভাবলাম করে ফেলি। এমনিতে আমি রান্নাবান্না করতে পারি মা। আপনি কী রাগ করলেন?”
মেয়েটির নমনীয়তা দেখে প্রসন্ন হন শান্তা। এগিয়ে এসে মাথায় হাত রেখে বললেন,“রাগার মতো কিছু করেছো নাকি? যদি করেও থাকো তবুও কখনো রাগবো না। তোমার এই মায়াভরা মুখের দিকে তাকালে সহজে কারো রাগ আসবে বলে তো মনে হয় না।”
প্রত্যুত্তরে কী বলবে বুঝতে পারলো না অনুভা। তবে লজ্জা পেলো খানিকটা। রোজকার মতো আজও হানিফ শেখ এবং শ্রাবণ মিলে হাঁটতে বেরিয়েছে।
বেলা বাড়তেই বাপ-ছেলে বাড়িতে ফিরে এলো। নাস্তা সেরে একেবারে গোসল করে নিলো শ্রাবণ। আজ তার ক্লাস আছে। শার্ট ইন করে গলাতে টাই ঝুলাতেই নজরে পড়ল অনুভাকে। মিহি হেসে এগিয়ে গিয়ে সম্মুখে দাঁড়ালো তার। অনুভা ভ্রু কুঁচকায়। শুধায়,“কী?”
শ্রাবণ গম্ভীর স্বরে নির্দেশ দেয়,“দাড়াঁও।”
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় অনুভা। প্রশ্ন করে,“এবার?”
“নাও টাইটা বেঁধে দাও দ্রুত।”
“নিজে বেঁধে নাও।”
“বিয়ে করেছি কী নিজে বাঁধার জন্য নাকি? একটা দায়িত্ব আছে না তোমার?”
কথা বাড়ায় না অনুভা। নিরবে টাইটি বেঁধে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে প্রচেষ্টায় সে সফলও হয়। টাই বাঁধা হতেই তার সামনে থেকে সরে আয়নার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ায় শ্রাবণ। চুলে হাত দিয়ে তা ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
নিরবতা ভাঙে অনুভা। নিচু স্বরে বলে,“একটা কথা ছিলো।”
নিজের কাজ করতে করতেই শ্রাবণ উত্তর দেয়,“হ্যাঁ বলো।”
“আসলে আমি চাইছিলাম আবার নতুন করে একটা জব করতে।”
হাত থেমে যায় শ্রাবণের। ঘাড় ঘুরিয়ে অনুভার পানে তাকায়। সেই দৃষ্টি দেখতেই অনুভা পুনরায় বলে ওঠে,
“আগের চাকরিটা এখানে আসার আগেই আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওখানে আর চাকরি করাটা আপুর পছন্দ নয়। তাই চাইছিলাম অন্য কোথাও যদি ট্রাই করি।”
তৎক্ষণাৎ শ্রাবণ কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তাকে বলতে না দিয়েই অনুভা বলে উঠলো,“আমি চাচ্ছি না আপুর উপর সবকিছু চাপিয়ে দিয়ে নিজে ভালো থাকতে। আর না চাইছি কারো সাহায্য। আমি শুধু ওদের পাশে থাকতে চাই।”
বাঁধা দিতে পারলো না শ্রাবণ। মৃদু হেসে বললো, “তোমার যা ইচ্ছে তুমি করতে পারো নোভা। তোমার কোনো কিছুতেই আমি বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না।”
“তোমার বাবা-মা? যদি উনাদের সঙ্গে একটু কথা বলে নিতে।”
“বাবার মনে হয় না এতে কোনো আপত্তি থাকবে তবে মা বললেও কিছু বলতে পারে। মাকে না হয় আমি বুঝিয়ে বলবো।”
প্রসন্ন হেসে ধন্যবাদ জানালো অনুভা। প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো শ্রাবণ। এগিয়ে এসে স্ত্রীর ললাটে চুম্বন এঁকে বিদায় নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে।
কাজের মেয়েটা এসেই ঘরদোর পরিষ্কার করতে লেগে পড়েছে। আজ কী রান্না করবেন স্বামীর থেকে সে পরামর্শ নিয়ে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলেন শান্তা।
রোজকার মতো আজও বাড়িতে সুফিয়া, তাঈম, মাজেদা ব্যতীত আর কেউ নেই। কলিং বেল বাজার শব্দে ভেজা হাতটা পরনের জামার মধ্যে মুছেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো মাজেদা। দরজা খুলে দুজন পুরুষকে দেখে বেশ অবাক হলো। পুরুষ দুজনের বয়সের পার্থক্য অনেক। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আরেকজন প্রাপ্ত বয়স্ক। মাজেদা হেড়ে গলায় বললো, “আপা বাড়িত নাই। বেশি দরকার হইলে পরে আইয়েন। আর কম দরকার হইলে আমারে কন।”
বয়োজ্যেষ্ঠ লোকটি বললেন,“আমি অর্থি আর অনুর বড়ো চাচা। ওগো মায় বাড়িত নাই? থাকলে ডাইকা দাও একটু। কথা আছে।”
লোকটির পানে প্রগাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো মাজেদা। ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়ার সাহস হলো না। যদি লোকটা মিথ্যে বলে থাকে? তখন! কী হবে তখন? বললো,“আপনেরা এইহানেই দাঁড়ান আমি খালারে ডাইকা আনি।”
কথাটা বলেই দরজা ভিড়িয়ে সুফিয়াকে ডাকতে চলে গেলো মাজেদা। উনারা বাহিরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। বেশ কয়েক মিনিট বাদে দরজার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন সুফিয়া।পরিচিত মানুষগুলোকে দেখে বড়োই আশ্চর্য হলেন তিনি। তাদের ভেতরে এসে বসার আমন্ত্রণ জানালেন।
বড়ো চাচা জোরপূর্বক হেসে জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছো অর্থির মা? অর্থি আর অনু কই? অফিসে?”
সুফিয়া কঠোর ভঙিতে বললেন,“অর্থি অফিসে আর অনু তার শ্বশুর বাড়িতে।”
চমকান উপস্থিত দুজনেই। শুধান,“অনুর বিয়া হইলো কবে?”
“হয়েছে অনেকদিন আগেই তা আপনারা হঠাৎ কী মনে করে এখানে? ঠিকানাই বা পেলেন কীভাবে?”
সঙ্গে আসা মেজো চাচার ছেলে আসিফ উত্তর দিলো, “আসলে চাচী আগে যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ওখানেই গিয়েছিলাম কিন্তু জানতে পারলাম আপনারা নাকি বাড়ি বদলে ফেলেছেন তারপরেই ওই পুরোনো বুয়ার সঙ্গে দেখা হলো। সে নাকি পাশের ফ্ল্যাটেই কাজ করে। তো ও-ই দিলো এই ঠিকানাটা।”
“তা আসার কারণ?”
আসিফকে ইশারায় কিছু বললেন বড়ো চাচা। সেই ইশারা বুঝতে পেরেই কাঁধে থাকা অফিস ব্যাগটি থেকে কয়েকটি টাকার বান্ডেল বের করল আসিফ। রাখলো সেন্টার টেবিলের উপরে। বড়ো চাচা নতজানু চিত্তে বললেন,“এই পাপের বোঝা লইয়া আর টিকতে পারতাছি না বৌমা। সম্পত্তি বুঝাইয়া দিতে চাইলাম কিন্তু তোমার মাইয়ারা তো আর ওয়ারিশ লইতে চায় না। রাগ করছে চাচাগো উপরে। হেগো রাগ করনডাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো এই ভার লইয়া আর ভুগতে পারতাছি না। তাই তুমগো তিনজনের পাওনা সম্পত্তির টাকা তুমগো বুঝাইয়া দিতে আইলাম। ফিরাইয়া দিয়া আমগো পাপ আর বাড়াইয়ো না। এইগুলা সব তুমগো।”
বিমূঢ় দৃষ্টিতে টাকার বান্ডেলগুলোর পানে তাকিয়ে রইলেন সুফিয়া। এই টাকা, হ্যাঁ এই টাকাগুলোই তো সকল অশান্তির মূল। এই টাকার জন্য মানুষ অন্যায় করে, অপমান সহ্য করে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় আরো কত কি।
উনার ভাবনার মধ্যেই বড়ো চাচা এবং আসিফ বিদায় নিয়ে প্রস্থান করল সেখান থেকে। সুফিয়া কিছু বলতে পারলেন না। এতদূর হতে আসা মানুষ দুজনকে চা বিস্কুট খাওয়ার কথা বলতে পারলেন না। উনারা চলে যেতেই মাজেদা গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে এলো। তখনও টাকাগুলো স্পর্শ করলেন না সুফিয়া। ঠাঁয় বসে রইলেন নিজ স্থানে। কতকিছুই না ভাবতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ করেই তিনি উপলব্ধি করলেন মানুষ তার কর্মফল দুনিয়াতে হলেও কিছুটা পেয়ে যায়। যা কামরুল হাসান পেয়ে গেছেন। আর উনাকেও মেয়েদের নিয়ে সেই কর্মফল ভোগ করতে হয়েছে শুধুমাত্র ওই অসৎ টাকায় জীবন যাপন করেছিলেন বলে। তবে কী কর্মফল ভোগার শাস্তি শেষ হয়ে এলো? ঘুচে গেলো সকল দুঃখ?
________
বিকেলটা পুরো শেখ বাড়ি একেবারে নিরব থাকে। হানিফ শেখের চা এবং বইয়ের নেশা। বিকেলে বাড়ি থেকে বের হয়ে পছন্দের দোকানে গিয়ে চা খেয়ে তিনি যান লাইব্রেরিতে বই পড়তে। ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে শ্রাবণ কখনো বাড়ি ফিরে আবার কখনো বা কোনো বন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে বের হয়। আজও তাই। শান্তা সোফায় বসে আছেন একা।কাজের মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন অনুভাকে ডেকে নিয়ে আসতে।শাশুড়ির ডাকে মিনিট দুয়েক বাদেই ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলো অনুভা। মিহি স্বরে শুধালো,“ডাকছিলেন মা?”
নিজের সম্মুখে রাখা একটি মোড়া দেখিয়ে শান্তা বললেন,“হ্যাঁ ডেকেছি। বসো এখানে। তা একা একা ঘরে কী করছিলে?”
এখানে বসতে বলছেন কেন উনি? বুঝতে পারলো না অনুভা। তবুও বাধ্য মেয়ের মতো বসলো সেথায়। উত্তর দিলো,“তেমন কিছু না।”
পাশে রাখা তেলের বাতিটি থেকে তেল নিয়ে তার মাথায় হাত রেখে শান্তা শাসনের ভঙিতে বললেন,“চুলে তেল দাও না কত বছর ধরে? এভাবে চুলের অযত্ন করলে তো জটা বুড়ি হতে বেশি সময় লাগবে না মা।”
লজ্জা পেলো অনুভা।ইতস্তত কণ্ঠে বললো,“ব্যস্ততার কারণে সময় হয়ে ওঠেনি কখনো তাছাড়া তেল দেওয়ার কথাও মনে পড়েনি।”
“সে যা হয়েছে হয়েছে, বিয়ের পর এসব অনিয়ম চলবে না। সর্বপ্রথম নিজের যত্ন তারপর বাদ বাকি কাজ। বুঝলে মেয়ে?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। শান্তা বিলি কেটে কেটে তার মাথায় তেল লাগিয়ে দিচ্ছেন। কয়েক মিনিট নিরবতার পর অনুভা বলে উঠলো,“আপনার মধ্যে না শাশুড়ি শাশুড়ি ভাবটা নেই।”
হাত থেমে যায় শান্তার। ভ্রু যুগল কুঁচকে শুধান,“কী? শাশুড়ি ভাব নেই? তাহলে কী ভাব আছে শুনি?”
“মা মা ভাব। আপনাকে নিজের মা মনে হচ্ছে। শাশুড়িরা তো এমন হয় না, এমন হয় মায়েরা।”
অধরে হাসি ফোটে উঠলো শান্তার। মাথায় আলতো করে চাটি দিয়ে বললেন,“আমি তো তোমার মা-ই হই।”
অনুভা নিঃশব্দে হাসে। শান্তা আবারো মনোযোগ দেন তেল লাগানোতে। ফাঁকে ফাঁকে শাশুড়ি বউমার মধ্যে চলতে থাকে গল্প গুজব। তেল দেওয়া শেষ হতেই উঠে দাঁড়ায় অনুভা। শুধায়,“চা খাবেন মা?বানিয়ে আনবো?”
“আনবে? আনো তবে। নিজের হাতের চা খেতে খেতে অরুচি ধরে গেছে মুখে।”
হাসি মুখে চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেলো অনুভা। বাড়ির কলিং বেল বাজতেই দরজার কাছে এগিয়ে যান শান্তা। সদর দরজা খুলতেই চমকে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গে। সৌহার্দ্য দাঁড়িয়ে আছে পকেটে হাত গুজে। লাগেজ হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে ড্রাইভার। মাকে দেখতেই মুচকি হেসে বললো,“হাই মা।”
বিষ্ময় ভরা কণ্ঠে শান্তা প্রশ্ন ছুঁড়েন,“তুই? এখন এখানে? আসবি যে সেকথা তো জানালি না।”
“তোমরা কী আমায় কিছু জানাও নাকি যে আমি তোমাদের জানাবো? সরো ভেতরে ঢুকি।”
দরজার সম্মুখ হতে সরে দাঁড়ালেন তিনি। সৌহার্দ্য ভেতরে প্রবেশ করল। ড্রাইভার লোকটিও লাগেজ গুলো ভেতরে দিয়ে চলে গেলেন। তখনি রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপ হাতে ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হলো অনুভা। অপরিচিত একজন পুরুষকে দেখে খানিকটা হকচকিয়ে উঠলো। চায়ের ট্রে টা সেন্টার টেবিলের উপর রেখে ভালো করে মাথায় টেনে নিলো ঘোমটা। সৌহার্দ্য প্রশস্ত হেসে উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি আমার ভাবী?”
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অনুভা।অপরিচিত পুরুষটির পানে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকায়। চেনা চেনা ঠেকে কিন্তু চিনতে পারে না। তার দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরেই সৌহার্দ্য পুনরায় বললো,“আরে আমি সৌহার্দ্য। চিনলে না?”
দুদিকে মাথা নাড়ায় অনুভা। অধরের হাসিটা যেনো মুহূর্তেই মিলিয়ে গেলো সৌহার্দ্যের। রাগ হলো বড়ো ভাইয়ের উপর। যাকে বলে ভীষণ রাগ। নতুন ভাবীর কাছে তাকে নিয়ে কোনো গল্পই করেনি ভাইয়া? ছেলেটার নিভে যাওয়া হাসি দেখে কিছু একটা আঁচ করতে পারলো অনুভা। জোরপূর্বক হেসে বললো,
“শ্রাবণের ছোটো ভাই?”
পূর্বের হাসিটা আবারো মুখশ্রীতে ফিরে এলো সৌহার্দ্যের। বললো,“হ্যাঁ। ভাইয়া বলেনি আমার কথা?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অর্থাৎ বলেছে। তৎক্ষণাৎ ভাইয়ের উপর থেকে সকল রাগ যেনো বিলীন হয়ে গেলো সৌহার্দ্যের। আগ্ৰহভরা লোচনে চেয়ে শুধালো,“কী কী বলেছে?”
শান্তা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলের কাণ্ড কারখানা দেখছিলেন এবার এগিয়ে এসে কড়া গলায় বললেন, “ঘরে গিয়ে বাহিরের পোশাক ছেড়ে তারপর আয়। খাবার বাড়ছি আমি। বিমানে কিনা কী খেয়েছিস তার তো ঠিক নেই। খাওয়া-দাওয়া শেষে ভাবীর সঙ্গে আলাপ হবে।”
মায়ের কথায় অত গুরুত্ব দিলো না সৌহার্দ্য। সোফায় বসে হাতে তুলে নিলো চায়ের কাপ। বড়ো করে চুমুক বসিয়ে তৃপ্তি সূচক শব্দ করল মুখ দিয়ে। প্রশংসা করে বললো,“ভালো চা বানাও তো ভাবী।”
শান্তা ফের রাগত স্বরে বললেন,“ভারি অধঃপতন হয়েছে দেখছি তোর! মেহুর মতো ফ্রেশ না হয়েই খেতে শুরু করে দিয়েছিস?”
“তুমি এমন করছো কেন মা? আগে ভাবীর সাথে কথা বলবো তারপর ঘরে গিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে একটা ঘুম দিবো। রাতে ঘুম হয়নি।”
অনুভা সৌজন্য হেসে বললো,“আগে বিশ্রাম নিন তারপর না হয় গল্প করা যাবে। আমি তো এখানেই আছি।”
“কী বলো ভাবী? আমি শুধু তোমার জন্য এতদূর থেকে ছুটে এলাম। বাই দ্য ওয়ে তুমি আমায় আপনি বলছো কেন? দেবরকে কে আপনি বলে? ভাইয়াকে তুমি বলবে অথচ ভাইয়ার ছোটো ভাইকে আপনি! ছ্যাহ। তুমি করে বলবে ঠিক আছে?”
এবারো উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। প্রসন্ন হাসে সৌহার্দ্য। চায়ের ট্রে টা নিয়ে উঠে যায়। নিজ কক্ষের দিকে যেতে যেতে বলে,“মাথাটা ধরেছে। চা ভর্তি দুটো কাপই আপাতত আমার প্রয়োজন। পরে কথা হবে ভাবী। টাটা।”
ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে উদাস কণ্ঠে শান্তা বলেন,“এই ছেলে দুটোকে নিয়ে একদম পারি না। দুয়েকটা স্বভাব ব্যতীত বাকি সব দুই ভাইয়ের মধ্যে একেবারে মিল।”
শাশুড়ির চিন্তিত মুখ দেখে নিঃশব্দে হাসে অনুভা।
________
রোজকার মতো রাতে বাড়ি ফিরতেই মাজেদা দরজা খুলে দিলো। ভেতরে প্রবেশ করতেই মাকে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে দেখতে পেলো অর্থিকা। মাজেদার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“মা এখানে বসা? কখন থেকে?”
“খালায় তো হেই দুপুর বেলা থাইক্কাই এনে বইয়া রইছে। আমনের চাচা আর চাচতো ভাই আইছিল। তারা যাওনের পর থাইক্কাই চাচী এনে বওয়া। আমি অনেক ডাকলাম কিন্তু আমার লগে কোনো কথাই কইলো না।”
চিন্তিত হলো অর্থিকা। চাচা এসেছিল বাড়িতে? কোন চাচা? কিই বা বলে গেলো মাকে? মায়ের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মাজেদার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,“তাঈম কোথায়?”
“ওয় তো সন্ধ্যা বেলায় খাইয়াই ঘুমায়।”
“আচ্ছা তুমি ওর কাছে যাও।”
তৎক্ষণাৎ চলে গেলো মাজেদা। অর্থিকা মায়ের মাথায় হাত রেখে ডাকলো,“মা! ও মা! মা গো!”
চোখ মেলে তাকালেন সুফিয়া। মেয়েকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন। মায়ের বিমর্ষ রূপ দেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে অর্থিকা শুধালো,“কী হয়েছে তোমার? শুনলাম দুপুর থেকে নাকি এখানেই বসে আছো? কোন চাচা এসেছিল? কেন এসেছিল?”
টেবিলের নিচ থেকে টাকাগুলো মেয়ের সম্মুখে রাখলেন সুফিয়া। বললেন,“তোর বড়ো চাচা এসেছিল। টাকাগুলো দিয়ে গেলো।”
“কীসের টাকা এগুলো?”
“তোদের দু বোনের পাওনা টাকা।”
“তুমি নিলে কেন? এতদিন যখন তাদের সাহায্য ছাড়া চলতে পেরেছি বাকি জীবনটাও পারবো।”
গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়ের পানে তাকান সুফিয়া। যেই দৃষ্টিতে রয়েছে শুধুই কঠোরতা। মায়ের এমন দৃষ্টির সঙ্গে পূর্ব পরিচিত নয় অর্থিকা। তাই চুপ রইলো উনার সামনে। উনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,“নিজের অধিকার একচুল পরিমাণের জন্যও ছাড়বি না অর্থি। এগুলো তোদের দুই বোনের ওয়ারিশের অর্থ। কারো দয়া নয়। নিজের ভাগেরটা নিজের কাছে রাখ আর অনুরটা অনুকে বুঝিয়ে দিস। আরেকটা কথা, তাঈম ছেলে। ওর ভবিষ্যৎ আছে। ওর নিজের বাবার সবকিছুর উপর ওর অধিকার আছে। ও যখন বড়ো হবে ওকে তোর ননদদের করা অন্যায়ের কথা জানাবি। ওকে ওর অধিকার বুঝে নিতে বলবি। কিচ্ছু ছাড়বি না, কিচ্ছু না। ওর বাবার কী কম আছে? ওর বাবার সব ওর, শুধুই ওর। মানুষের জীবনে মন্দ দিন আসে কেন জানিস? যাতে আশেপাশে থাকা মুখোশ পরিহিত মানুষগুলোর আসল রূপ চিনতে পারি সেই জন্য। দিনশেষে রব ছাড়া কেউ থাকে না পাশে। তাই কাউকে কখনো বিশ্বাস করবি না মা। দুই বোন মিলেমিশে থাকবি সবসময়। কেউ কারো উপর হিংসে করবি না। আমি যদি মারা যাই একদম কাঁদবি না, কষ্ট পাবি না। শুধু মাকে মাফ করে দিস, বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করে যাস।”
বুকটা কেঁপে উঠলো অর্থিকার। আজ যেনো তার সামনে বসে আছে অন্য একজন মানুষ। নিজেকে সামলাতে না পেরে মাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো অর্থিকা। কেঁদে উঠলো হো হো করে। সুফিয়া পাথরের মূর্তির ন্যায় চুপচাপ বসে মেয়ের কান্না শুনতে লাগলেন। কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলো না উনার মুখশ্রীতে। কী কঠিন ব্যক্তিত্বের মানুষ তিনি!
চলবে _________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:৩০]
আজ অর্থিকা অফিসে যায়নি। অসুস্থতার বাহানায় ছুটি নিয়েছে। গতকাল রাতেই ফোন করে ছোটো বোন আর বোন জামাইকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বাড়িতে।কড়াকড়িভাবে বলে দিয়েছে আজই আসতে হবে দুজনকে। সকাল সকাল মাজেদাকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করে নিয়ে এসেছে অর্থিকা। বাড়িতে যেনো রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে।
বারোটা নাগাদ বাড়িতে এসে পৌঁছায় শ্রাবণ এবং অনুভা। কলিং বেল চাপতেই দরজা খুলে দেয় মাজেদা। তাদের দেখা পেয়েই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,“ছোডো আপা আর দুলাভাই আইসা পড়ছে!”
তার আনন্দময় চিৎকারে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হাসলো অনুভা। প্রশ্ন করল,“কেমন আছো মাজেদা আপা?”
“ভালা আপা তবে আপনাগো দেইখা এখন আরো ভালা আছি।”—-বলেই দরজার সম্মুখ হতে সরে দাঁড়ালো মাজেদা।
অনুভা এবং শ্রাবণ ভেতরে প্রবেশ করল। সঙ্গে আনা মিষ্টান্ন, ফলমূল, বাচ্চাদের চকলেট চিপস এর প্যাকেটগুলো সেন্টার টেবিলে রাখলো। অর্থিকা এসে উপস্থিত হলো সেখানে। মৃদু হেসে তাকে সালাম দিলো শ্রাবণ। সালামের জবাব নিয়ে মিষ্টি হাসলো অর্থিকা। সুফিয়ার সঙ্গে দেখা করে আসতেই নিজের ঘরে তাকে বসতে বলে ঘর থেকে বের হলো অনুভা।
এখনো রান্না শেষ হয়নি। অর্থিকাও সেখানেই। ঘর থেকে তাঈমকে কোলে নিয়ে সেখানে এসে উপস্থিত হলো অনুভা।চুলায় বসানো কড়াইয়ের পানে তাকিয়ে শুধালো,“হুট করে এত জরুরী তলব? বেশ তো মা- মেয়ে মিলে জোরজবরদস্তি করে আমায় শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিলি অথচ এখন ঠিকই মিস করছিস তাই না?”
খুন্তি নাড়ানো থামালো অর্থিকা। বললো,“কেন শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না বুঝি?”
“একদম না, জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছিলি তাহলে আসবো কেন?”
মুচকি হাসে অর্থিকা। রান্নাঘর থেকে নিজ কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় অনুভা। যেতে যেতে তাঈমের উদ্দেশ্যে বলে,“চলো তোমায় খালুর কাছে দিয়ে আসি। ব্যাটাকে ইচ্ছেমতো জ্বালাতন করবে ঠিক আছে বাবা?”
তাঈম আদতে কিছু বুঝতে পারলো কিনা বোঝা গেলো না। শুধুই অনুভার গলা জড়িয়ে ধরে তার মুখের পানে তাকিয়ে রইলো। শ্রাবণ বসে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। তখনি তার কোলে বসিয়ে দেওয়া হলো তাঈমকে। নড়েচড়ে উঠলো শ্রাবণ। ডান হাত ব্যারিকেটের মতো বাচ্চাটির পেছন দিয়ে ধরে রাখলো। অত্যন্ত গম্ভীর কণ্ঠে অনুভা বলে উঠলো,“নাও বসে বসে বাচ্চা সামলানো শিখো।”
মেয়েটির কথায় আপনাআপনি অধরে হাসির রেখা ফোটে ওঠে শ্রাবণের। ঠিকভাবে তাঈমকে নিজের কোলে বসিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে,“নোভা রাণী কী আমাকে বাবা বানাতে চাইছে নাকি? তা গতকাল রাতে বললেই তো হতো, বাসর টাসর একেবারে সেরে ফেলতাম।”
ভড়কে গেলো অনুভা। লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। আমতা আমতা করে বললো,“মুখে কিছু আটকায় না তোমার? নির্লজ্জ, অসভ্য।”
“তিনদিন ধরে বউয়ের সঙ্গে একঘরে থাকছি অথচ কোনো অসভ্যতামিই করলাম না তাহলে অসভ্য হলাম কী করে?”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই অনুভার নিকট মনে হলো তার কান দিয়ে হয়তো এবার আশ্চর্য জনক ভাবেই ধোঁয়া বের হবে। রাগে, লজ্জায় কক্ষ ত্যাগ করার উদ্দেশ্যে যেতে যেতে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো, “শিক্ষক মানুষের ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকা উচিত। যা তোমার মধ্যে নেই। হুটহাট বেফাঁস কথা বলে দেওয়া অসভ্য পুরুষ একটা।”
“শিক্ষকরা কী বাপ হচ্ছে না? তাছাড়া সাইন্সের ছাত্র ছিলাম বলে কথা বুঝোই তো।”
এ কথাটাও পুরোপুরি কর্ণগোচর হলো অনুভার। ফোঁস ফোঁস শব্দ করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে স্থানটি পুরোপুরিভাবেই ত্যাগ করল সে।
হাসলো শ্রাবণ।পূর্ণ দৃষ্টিতে তাঈমের মুখপানে তাকালো। গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে ডাকলো,“তামু বাবা।”
তাঈম মুখ তুলে চাইলো অপরিচিত লোকটির পানে। এই মুখটা তার নিকট অপরিচিতই। বিয়ের দিনও দুজনার দেখা হয়নি। অর্থিকা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল। নইলে ছেলেটা জেগে থাকলেই অনুভার কোলে চড়ে বসে থাকতো। বাচ্চাটির দৃষ্টি দেখে মিষ্টি হাসলো শ্রাবণ। শুরু করল তার সঙ্গে ভাব জমানো।
রান্নাঘরে এসে উঁকি দিলো অনুভা। অর্থিকা সেখানে নেই। অগত্যা বড়ো বোনের কক্ষে প্রবেশ করল সে। এখানেও তাকে না পাওয়ায় এবার গেলো মায়ের ঘরে। সেখানেই পেয়ে গেলো বোনকে। বিছানায় মায়ের পাশে বসে আছে অর্থিকা। কথা বলছে দুজনে। অনুভা এসে শামিল হলো তাদের কথোপকথনে। তখনি দুটো টাকার বান্ডেল তার দিকে এগিয়ে দিলো অর্থিকা। টাকাগুলো দেখে চমকায় অনুভা। শুধায়,“এতগুলো টাকা! কোত্থেকে এলো?”
সুফিয়া উত্তর দেন,“তোর বড়ো চাচা আর আসিফ এসেছিল। ওরাই দিয়ে গেলো তোদের দু বোনের ওয়ারিশের টাকা আর আমার স্বামী স্বত্ব।”
“ওরা দিলো আর তুমি রেখে দিলে? এটা কী ঠিক হলো মা? এতদিনকার কষ্টটা বৃথা গেলো না তবে?”
“এটা তোদের পাওনা, ওরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছে তাই দিয়ে গেছে। এতে তোর কষ্ট কেন বৃথা যাবে? বাবা-মায়ের জন্য যতটা কষ্ট করেছিস দেখবি আল্লাহ তার উত্তম প্রতিদান দান করবেন। সবসময় দোয়া করি আমার মেয়েরা যাতে সুখী হয়। তাই নিজের অধিকার বুঝে নে মা।”
এ ব্যাপারে কিছুক্ষণ নিরব রইলো অনুভা। তারপর বলে উঠলো,“আমার এসব চাই না মা। এখন তো আমার বিয়েই হয়ে গেছে তাই আমি আর এসব দিয়ে কী করবো? টাকাটা বরং আপুই রেখে দিক। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”
সঙ্গে সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করল অর্থিকা। বললো,“কেন লাগবে না? অবশ্যই লাগবে। এটা তোর পাওনা। তাছাড়া আমি প্রথমে ভেবেছিলাম শ্রাবণের সামনেই কথাটা বলবো কিন্তু পরে ভাবলাম তুই যদি কিছু মনে করিস।”
মুচকি হাসলো অনুভা। প্রত্যুত্তরে বললো,“ওর সামনে বললেই কী না বললেই কী? ওর উত্তরটা আমার জানা। ও সরাসরিই বলে দিতো এসব নোভার লাগবে না আপু। নোভার দায়িত্ব আমার। ওর ইচ্ছা অনিচ্ছা পূরণের দায়িত্বও আমার। তাই আপনি রেখে দিন এগুলো।”
হতাশ কণ্ঠে অর্থিকা শুধালো,“নিবি না তবে?”
“না, এটা আমার তরফ থেকে আমার তাঈমের জন্য উপহার। ও তো আমারও ছেলে তাই না? ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা তো আমারও দায়িত্ব।”
আঁখি যুগল ভিজে উঠলো অর্থিকার। শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো ছোটো বোনকে। দু বোনের মিল মহব্বত দেখে সুফিয়া আড়ালে চোখের পানি মুছলেন আঁচলে। রবের নিকট মনে মনে দোয়া করলেন যাতে চিরকাল দু বোন এমন মিলেমিশেই থাকে। তাদের মধ্যকার ভালোবাসা, সম্মান যেনো অটুট থাকে।
________
সন্ধ্যা হতেই শ্বশুর বাড়ি থেকে স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় শ্রাবণ। কিন্তু মাঝপথে এসেই থেমে যায় গাড়ি। অনুভা ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকায়। তার চাহনির অতো তোয়াক্কা না করে সিট বেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে সে। ঘুরে এসে অনুভার পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে কোমল স্বরে বলে,“নেমে এসো।”
“কেন? এখানে আবার কী?”
“এত প্রশ্ন কেন করো বলো তো নোভা। আমি কী তোমায় এখানে রেখে চলে যাবো নাকি?”
“সেকথা বললাম কখন?”
“তাহলে নামছো না কেন?”
গাড়ি থেকে নেমে পড়ল অনুভা। সে নামতেই গাড়ির দ্বার বন্ধ করে গাড়ি লক করল শ্রাবণ। আগে আগে হাঁটতে লাগলো বাম দিকের পথ ধরে। অনুভাও হাঁটছে তার পিছুপিছু। কয়েক মিনিট হাঁটার পর ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,“যাচ্ছি কোথায়?”
“কোথাও না।”
“তাহলে হাঁটছি কেন?”
“এমনি, কেন? ভালো লাগছে না?”
প্রত্যুত্তর করল না অনুভা। আশেপাশে ভালো করে দেখতে লাগলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা ধানমন্ডি লেকের কাছাকাছি চলে এসেছে। চারিদিকে আলোতে আলোতে ঝলমল করছে। ক্ষণে ক্ষণে হেঁটে যাচ্ছে কতশত কপোত কপোতী। এই রাতের আঁধারে আশেপাশের আলোয় চকচক করছে লেকের পানি। এতটা মুগ্ধ হয়ে এর আগে কখনো রাতের শহর হেঁটে হেঁটে দেখা হয়নি অনুভার। হঠাৎ সে অনুভব করল তার হাতটা পরম আবেশে কেউ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। আপনাআপনি অধরে হাসির রেখা ফোটে উঠলো তার। সম্মুখে চাইলো পুরুষটির পানে। শ্রাবণ তাকে টেনে নিজের পাশাপাশি নিয়ে এলো। পায়ে পা মিলিয়ে দুজনে হেঁটে চলেছে অনির্দিষ্ট গন্তব্যে।
অনুভা ফিসফিসিয়ে শুধালো,“বাড়ি ফিরবে না?”
“এত তাড়া কীসের? দু তিনটে বাচ্চা রেখে এসেছো নাকি?”
“হুসস, সবসময় ফাজলামো মার্কা কথা।”
হাসে শ্রাবণ। বলে,“তাহলে ফেরার কথা জিজ্ঞেস করছো কেন বারবার? সময়টা উপভোগ করো। দেখো আজকের আকাশটা সুন্দর না অনেক?”
পূর্ণ দৃষ্টিতে আকাশ পানে তাকায় অনুভা। আকাশে অর্ধ খাওয়া চাঁদ। মেঘহীন পরিষ্কার আকাশটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তারা।সত্যিই রাতের আকাশটা অদ্ভুত সুন্দর। বললো,“হুম সুন্দর তবে শুধুই আজকের আকাশ নয় বরং আকাশ প্রতিদিনই সুন্দর দেখায়।”
“উহু আমার কাছে তো মনে হচ্ছে বিগত দিনের আকাশের চেয়ে আজকের আকাশটাই বেশি সুন্দর।”
“কেন কেন? আজকে কী বিশেষ কিছু?”
“হুম।”
“কী?”
গাঢ় দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকায় শ্রাবণ। অনুভার উৎসুক দৃষ্টিও তার পানেই নিবদ্ধ। সেই দৃষ্টি দেখে মুচকি হেসে টেনে দেয় অনুভার গাল। বলে,“কারণ আজকে আমার পাশে আমার নোভা আছে। তাই আজকের রাত, আজকের ওই আকাশ আর সময়টা আমার কাছে সবচেয়ে সুন্দর এবং বিশেষ দিন।”
বুকের ভেতরে কৈশোরের সেই নিদারুণ অনুভূতি ছুঁয়ে যায় অনুভার। লাজুক হেসে সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। পরনে আকাশী রঙের শাড়ি, মাথায় ম্যাচিং হিজাব, কাজল কালো চোখ। এতকিছুর মধ্যে এই হাসিটাই যেনো প্রয়োজনীয় ছিলো খুব। মন ভরে প্রিয়তমাকে দেখে নিলো শ্রাবণ।এক ফাঁকে দৃশ্যটি মোবাইলে করে নিলো ক্যামেরা বন্দি। টের পেয়ে গেলো অনুভা। বিচলিত কণ্ঠে বললো,“এই এই তুমি ছবি তুললে কেন হ্যাঁ?”
“আমার নাতি-নাতনিদের দাদীর ছবি আমি তুলেছি এতে কার কী শুনি?”
এবার শব্দ করেই হেসে উঠলো অনুভা। মনে পড়ে গেলো সেই দেখা হওয়ার তৃতীয় দিনে শ্রাবণের বলা নাতি-নাতনি নিয়ে ঢপ মারা গল্পটা। হেসে বললো, “তুমি যে একটা মিথ্যুক তা কী জানো শ্রাবণ?”
“কী মিথ্যে বললাম? কখন বললাম?”
“তুমি আমায় বলেছিলে তোমার বাবা নাকি র্যাব কিন্তু তোমার বাবা তো কলেজের একজন অধ্যক্ষ ছিলেন।”
“তাহলে দেখো! তখন তোমার মাথায় কতটা গোবর ছিলো। নইলে ওই মজাটাকে কী তুমি সত্যিই ভেবে নিতে? তবে এটা অবশ্য ঠিক ছিলো, তখন আমার নাতি নাতনিদের দাদী হিসেবে আমি তোমায়ই সিলেক্ট করে রেখেছিলাম আর বানিয়েও নিলাম।”
“তা কোথায় তোমার সেই নাতি-নাতনি?”
“ফিউচারে বসে আছে। টাইম ট্রাভেল মেশিন থাকলে ঠিক দেখিয়ে নিয়ে আসতাম।”
মাঝেমধ্যে ছেলেটার এসব উদ্ভট কথা শুনলেই খুব হাসি পায় অনুভার। যৌবনের ভেতরে চাপা পড়ে থাকা সেই কৈশোরের চঞ্চলা তরুণী জাগ্ৰত হয়ে ওঠে।
________
বাহির থেকেই ডিনার সেরে বাড়ি ফিরলো দুজন। ড্রয়িং রুমে বসে হানিফ শেখ, শান্তা এবং সৌহার্দ্য মিলে কিছু একটা আলোচনা করছিল। অনুভা চলে গেলো ঘরে। আর শ্রাবণ ওখানে গিয়ে বসলো। প্রশ্ন করল,“কী নিয়ে কথা হচ্ছে?”
তিন জোড়া দৃষ্টি স্থির হলো শ্রাবণের পানে। হানিফ শেখ বললেন,“আমি আর দেরি করতে চাইছি না। সৌহার্দ্য এসে গেছে এবার তোদের দুই ভাইয়ের বৌ ভাতের অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলতে চাই।”
“তারিখ ঠিক করেছো?”
“প্রান্তির বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি। এই সপ্তাহের মধ্যেই সেরে ফেলবো।”
“এই জন্য এত তাড়াতাড়ি?”
সৌহার্দ্য ভ্রু বাঁকিয়ে ঠেস দিয়ে বলে উঠলো,“বিয়ে করার সময় তো একটুও দেরি করোনি তাহলে বৌ ভাতের জন্য দেরি করতে হবে কেন? কোনো দেরি টেরি চলবে না। অনুষ্ঠান করলে এ সপ্তাহেই করতে হবে।”
“তড় সইছে না যেনো?”
“কেন তড় সইবে? বিয়ে করেছি সবাইকে জানাতে হবে না? নইলে তো পরে দেখা যাবে রাস্তা দিয়ে বউ নিয়ে হাঁটছি পাড়ার লোকেরা অন্যকিছু ভেবে কুটনৈতিক আলোচনা শুরু করে দিবে।”
“হয়েছে বুঝি সব, তোর যে কীসের জন্য তড় সইছে না সব বুঝি।”—–বলেই সিঁড়ির দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ।
সৌহার্দ্যও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বড়ো ভাইয়ের পিছুপিছু যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল,“কী বোঝো তুমি হে?”
“বউ ছাড়া একা একা ভালো লাগছে না তাই তো দ্রুত অনুষ্ঠানের নাম করে বউকে ঘরে তুলতে চাইছিস।”
থতমত খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। আমতা আমতা করে বড়ো গলায় বললো,“আর তুমি? তুমি যে বিয়ে করেই ভাবীকে নিয়ে সংসার করছো তার বেলা? নিজের বেলা ষোলো আনা তাই না?”
“বড়ো ভাই হই সম্মান দিয়ে কথা বল।”
“আমিও ছোটো ভাই হই আদর দিয়ে কথা বলো।”
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই বাঁকা দৃষ্টিতে ভাইয়ের পানে তাকায় শ্রাবণ। ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে সৌহার্দ্যের গাল দুটো জোরে জোরে টেনে দিয়ে বলে,“ওলে আমার ভাইটা। আদর লাগবে তোমার তাই না? আসো আসো একটা চুমু দেই।”
বলেই নিজের মুখ এগিয়ে নিলো সৌহার্দ্যের দিকে। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো সৌহার্দ্য। আর্তনাদ করে বললো, “ব্যথা পাচ্ছি ছাড়ো। ও মা কিছু বলো না ভাইয়াকে।”
তাকে ছেড়ে দিলো শ্রাবণ। ঘাড় চেপে ধরে উপরে উঠতে উঠতে বিদ্রুপ করে বললো,“যখনি পারিস না তখনি বাবা-মাকে ডাকাডাকি তাই না? বাচ্চামি স্বভাব গেলো না আবার সে নাকি সংসার করবে।”
“হ্যাঁ সংসার ধর্ম শুধু তোমার জন্যই তৈরি হয়েছে।”
“আবার কথা? মুখের মধ্যে টেপ লাগিয়ে রাখবো।”
সোফায় বসেই হানিফ শেখ এবং শান্তা দেখে গেলেন ছেলেদের কর্মকাণ্ড। দুটো চোখের আড়াল হতেই একে অপরের পানে তাকিয়ে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আসলেই দুটোর বাচ্চামি স্বভাব এখনো গেলো না। নইলে কী এখনো একটা আরেকটার পেছনে এভাবে লেগে থাকে?
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)