সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৭+২৮

0
561

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৭]

সাড়ে নয়টা বাজতেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল শ্রাবণ। ড্রয়িং রুমে পা ফেলতেই দেখা মিললো সোফায় বসে থাকা মায়ের। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো,“খেতে দাও মা। একেবারে খেয়েদেয়ে তারপর ঘরে যাই।”

পুত্রের কথায় বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না শান্তা। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,“পারবো না। ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে নিজে নিয়ে খা।”

হঠাৎ মায়ের এমন আচরণে চমকায় সে। শুধায়, “তোমার আবার কী হলো?”

“কী হবে?”

“তাহলে এভাবে বললে কেন?”

“ভালো করেই তো বলেছি। কোনো নিয়ম-কানুনের বালাই নেই। বাহির থেকে এসেই মা খাবার দাও! ফ্রেশ হওয়ার আগে কোনো খাবার নেই, ঘরে যা।”

“তোমার গায়েও বাবার বাতাস লেগেছে মনে হচ্ছে?”

পুত্রের কথায় চোখ পাকিয়ে তাকালেন শান্তা। মায়ের চাহনিতে আর কথা বাড়ায় না শ্রাবণ। গুণগুণ আওয়াজে ঠোঁটের আগায় গান তুলে পা বাড়ায় নিজ কক্ষের দিকে। হাতঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো পরনের পোশাক বদলাতে। তার কয়েক মিনিট অতিক্রম হতেই তোয়ালে হাতে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।

সম্মুখে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো একজন শাড়ি পরিহিত রমণীকে। মেয়েটি দরজার দিকে সোজা হেঁটে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ ভ্রু যুগল কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। ললাটে সরু কয়েকটা ভাঁজের উৎপত্তি ঘটলো। পেছন অংশ দেখেই অতি সহজে যেনো চিনে ফেললো রমণীটিকে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,“নোভা!”

পা জোড়া থেমে গেলো অনুভার। পেছন ফিরে তাকাতেই মিলিত হলো দু জোড়া দৃষ্টির। শুকনো ঢোক গিললো শ্রাবণ। পল্লব ঝাপটালো বেশ কয়েকবার। ঠিক দেখছে তো সে? এ কী সত্যিই অনুভা? তার সম্মুখে অনুভা দাঁড়িয়ে আছে? কিন্তু এ কী করে সম্ভব?

এই মুহূর্তে নতুন বধূর ন্যায় স্বামীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে লজ্জায় অনুভার লাল নীল বর্ণ ধারণ করা উচিত তবে তা যেনো তার জন্য খাটলো না। ভেতরে ভেতরে সে ক্ষীপ্ত। বিরক্তির সহিত শুধালো,“হা করে তাকিয়ে আছো কেন? কখনো দেখোনি?”

“তুমি কী সত্যিই এখানে দাঁড়িয়ে আছো নোভা?”

“কই না তো, নিশ্চয়ই তুমি কল্পনা দেখছো।”–কথাটা বলেই নিরস মুখে বিছানায় এসে বসলো অনুভা। এতক্ষণ সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সেখান থেকে শাশুড়ির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দরজার দিকে এগোলেও এখন আর গেলো না।

পূর্বের স্থানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে যেনো কষ্ট হচ্ছে তার। অনুভা! ও এখানে এলো কোত্থেকে? আচ্ছা হুটহাট যেখানে সেখানে মেয়েটাকে দেখার অসুখ হলো নাকি তার? মাথা দুদিকে ঝাঁকিয়ে বিছানার আরেক পাশে বসে পড়ল শ্রাবণ। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি এখানে কী করে নোভা? কখন এলে?”

“এইতো সাতটা সাড়ে সাতটা নাগাদ।”

“হঠাৎ এখানে এলে? কীভাবে কী?”

“তোমার নাকি একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে? তাই তোমার বাবা-মা গিয়ে ধরে বেঁধে নিয়ে এলো আমায়। সিরিয়াসলি শ্রাবণ! তুমি এতটা ঠোঁট কাটা স্বভাবের? বিয়ে করতে না করতেই বউ পাগল হয়ে গিয়েছো?”

মনে মনে হাসলো অনুভা। কিন্তু বাহিরে নিজেকে রাখলো যথেষ্ট গম্ভীর। শ্রাবণের ভাবভঙ্গি দেখে তার মনে কী চলছে তা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু বেচারা যে ঘোরের মধ্যে আছে তা খুব টের পেলো অনুভা। তাকে আরো ঘাবড়ে দিতে বলে উঠলো,“তা কোথায় ছিলে এতক্ষণ?গাড়ি তো তোমার গ্যারেজেই পড়ে আছে, তাহলে? নতুন কাউকে পেয়েছো নাকি? যার সঙ্গে এতক্ষণ টাইম স্পেন্ড করে এলে?”

থতমত খেয়ে গেলো শ্রাবণ। মিনমিনে স্বরে বললো,“কী বলো এসব? আমি তো লেকের কাছাকাছিই ছিলাম।”

“কার সঙ্গে?”

“বন্ধু।”

“সত্যিই বন্ধু নাকি বান্ধবী?”

“তুমি কী আমায় সন্দেহ করছো নোভা?”

“সন্দেহ করা উচিত নয় বলছো?”

“অবশ্যই নয়।”

নিরুত্তর রইলো অনুভা।প্রসঙ্গ বদলালো শ্রাবণ। ক্ষীণ স্বরে বললো,“বাবা-মা যে তোমাকে নিয়ে আসতে যাবে এ প্রসঙ্গে সত্যিই কিছু জানতাম না আমি। ওরা তোমায় জোর করে নিয়ে এসেছে তাই না? তুমি কী রাগ করেছো?”

পূর্ণ দৃষ্টিতে পাশে বসা ছেলেটির পানে তাকায় অনুভা। চোখেমুখে তার অপরাধবোধ বিরাজমান। শুধালো,“রাগলে কী করবে তুমি?”

“রাগ ভাঙাবো।”

“কীভাবে?”

“আদর করে।”

ভড়কে গেলো অনুভা। গম্ভীর মুখে কী করে এসব কথাবার্তা বলতে পারে এই ছেলেটা? দৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিলো। অস্বস্তি জেঁকে ধরলো তাকে। যা খুব ভালো করেই খেয়াল করল শ্রাবণ। মনে মনে ভারি মজা পেলো। তখনি নিচ থেকে ডাক এলো শান্তার। গলা উঁচিয়ে ডাকছেন,“মেহু এই মেহু!”

“আসছি মা।”—-বলেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো শ্রাবণ। অনুভার পানে তাকিয়ে বলে গেলো,“মা ডাকছে। তুমি বসো, আমি আসছি।”

সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আশেপাশে খুঁজতেই মাকে খাবার টেবিলের সামনে পেয়ে গেলো শ্রাবণ। পুত্রের জন্য খাবার বাড়ছেন শান্তা। তাকে আসতে দেখেই বললেন,“খিদে লেগেছে বলে তখন চেঁচামেচি করলি আর এখন ঘর থেকে বেরই হচ্ছিস না। ব্যাপার কী?”

“তোমরা আমায় না জানিয়েই নোভাকে আনতে চলে গেলে? এটা কী ঠিক করলে মা? জোর করে একটা মেয়েকে অপরিচিত পরিবেশে এনে ফেলা কী উচিত হলো?”

“বেশ করেছি এনেছি। ছেলের বউ থাকতে বাড়িতে একা একা বসে থাকবো কেন?”

“তাই বলে?”

কথার মধ্যিখানেই ছেলেকে থামিয়ে দিলেন শান্তা। ধমকের সুরে বলে উঠলেন,“চুপ থাক তুই। তোর বেশি সমস্যা হলে আমি আমার বউমাকে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিবো।তারপর শাশুড়ি বউমা মিলে সারারাত বসে বসে গল্প করবো।”

মায়ের কথায় আঁতকে উঠলো শ্রাবণ।আমতা আমতা করে বললো,“অন্য ঘরে যাওয়ার প্রসঙ্গ কোত্থেকে আসছে? আমার বউ আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমিও না মা।”

মুচকি হাসেন শান্তা। বলেন,“এবার খেয়ে নে তাড়াতাড়ি।”

“দাঁড়াও ওকে ডেকে আনি।”

“আমি আমার বউমাকে খাইয়ে দাইয়েই ঘরে পাঠিয়েছি বুঝলি। এখন তুই খেলে আমি ঘুমাতে যাবো।”

আর কথা বাড়ালো না শ্রাবণ। চুপচাপ বসে পড়ল খেতে।

চাঁদের আলোয় আলোকিত চারিদিক। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশপানে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনুভা। শ্রাবণের ঘরের এই বারান্দাটা একদম খোলামেলা। বিশাল বড়ো বারান্দার একপাশে সাড়িবদ্ধ কয়েকটা ফুলের গাছ। পরিবেশটা মনোযোগ সহকারে উপভোগে ব্যস্ত অনুভা। তখনি পেছন থেকে কেউ তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। পুরুষালী স্পর্শে কেঁপে উঠলো মেয়েটির দেহ। যা সহাস্যে টের পেলো শ্রাবণ। ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,“আয়হায় নোভা আমি তো তোমায় জড়িয়ে ধরলাম! এবার কী হবে?”

প্রত্যুত্তর করতে পারলো না অনুভা। কণ্ঠনালী তার কাঁপছে। মস্তিষ্ক থেকে হারিয়ে গেছে শব্দমালা। গোপনে, নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। হাতের বাঁধন শক্ত করল আরো। আলতো করে চুম্বন এঁকে দিলো স্ত্রীর উন্মুক্ত ঘাড়ে। সর্বাঙ্গ কেঁপে ওঠে অনুভার। চটজলদি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে শ্রাবণের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তারপর তার মুখোমুখি ফিরে কোমর ঠেকায় রেলিংয়ে। মুচকি হাসে শ্রাবণ। এগিয়ে গিয়ে রেলিংয়ের হাতলে দু হাত দুদিকে রেখে স্ত্রীকে ফের আবদ্ধ করে নিজের বাহুডোরে। তৎক্ষণাৎ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনুভা বলে ওঠে, “একদম অসভ্যতামি করার চেষ্টা করবে না।”

“কী করবে করলে?”

থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। আমতা আমতা করে বললো,“কেন করবে? বিয়ে হতে না হতেই অসভ্যতামি করতে হবে কেন?”

“উহু ভুল বললে, বিয়ের আগে করলে তা অসভ্যতামি হতো কিন্তু আমি তো বিয়ের পর করছি তাই এটা হচ্ছে আদর, ভালোবাসা।”

এবারো দমে গেলো অনুভা। খুঁজতে লাগলো যুক্তি। গাঢ় দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল শ্রাবণ। পিঠ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো খোলা। মৃদু বাতাসে এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে তা। পরনে সবুজ রঙের কাতান শাড়ি। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল। কপালের বাম দিকে দুয়েকটা ছোটো ছোটো পিম্পল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেকদিন ধরে যত্ন নেয় না এই সুন্দর মুখশ্রীর। নারী যতই রূপবতী হোক না কেন, নিজের যত্ন না নিলে সেই রূপ কী আর ঝলকময় থাকে? বরং ভাটা পড়ে মলিনতায়।

শখের নারীর এত এত অপূর্ণতায়ও শ্রাবণের চোখ গিয়ে আটকালো মেয়েটির ডান গালের মাঝে ছোট্ট তিল খানার উপর। আচমকা সেখানে গাঢ় চুম্বন বসালো শ্রাবণ। তার এহেন কাণ্ডে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো অনুভা। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো এই অসভ্য ছেলেটির পানে। নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। কানের কাছে মুখ নিয়ে অভিযোগের সুরে বললো, “নিজের প্রতি এতটা অযত্ন কেন নোভা? এসব অযত্ন কিন্তু আর চলবে না। আগে যা হয়েছে হয়েছে। আমার কাছে এসব একদম চলবে না। ঠিক আছে?”

শুকনো ঢোক গিলে উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অধরে হাসি রেখেই দুজনার মধ্যে দূরত্ব তৈরি করে নেয় শ্রাবণ। ঘরের দিকে পা বাড়িয়ে কোমল স্বরে বলে,“ঘরে এসো। ঘুম পাচ্ছে।”
_______

ভোরের আলো ফোটেছে অনেকক্ষণ আগেই। ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে সাতটা বাজতেই তৈরি হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে ফ্ল্যাট থেকে বের হলো অর্থিকা। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই দেখা মিললো ফায়াজের। বাইকের উপর বসে মাথায় হেলমেট পড়ছে। তাকে পাশ কাটিয়ে গেইটের দিকে পা বাড়াতেই ভেসে এলো পুরুষালী কণ্ঠস্বর,“অফিসে যাচ্ছো নাকি অর্থিকা?”

থামলো অর্থিকা। অধরে সৌজন্য হাসি টেনে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ। তুমি?”

“আমিও, এত সকালে তো সহজে রিক্সা পাওয়া যায় না তাহলে যাবে কী করে?”

“একটু হাঁটলেই পাওয়া যাবে।”

“এত কষ্ট করার কী প্রয়োজন? এসো, আজ আমি বরং তোমায় লিফট দেই।”

“তার প্রয়োজন নেই, আমি রিক্সা করেই চলে যেতে পারবো।”

“কেন আমার সঙ্গে গেলে কী খুব অসুবিধে হবে?”

অসুবিধে অবশ্যই হবে।পর পুরুষের বাইকে কিছুতেই উঠতে চায় না অর্থিকা। তবে মনের কথা মনের ভেতরে গোপন রেখেই বললো,“তেমন কিছু না। আসছি আমি।”

আর বিলম্ব না করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করল সে। তার যাওয়ার পানে দৃষ্টি স্থির রেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বাইকে স্টার্ট দিলো ফায়াজ। বাইকে কিছু সমস্যা হওয়ার কারণে তা গ্যারেজে দিয়ে এসেছিল সপ্তাহ খানেক আগে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে সেখান থেকে আর আনাই হচ্ছিল না। তবে গতকাল রাতে গিয়েই বাইকটা বাড়ি নিয়ে এসেছে ফায়াজ। বাইক ছাড়া যাতায়াতে যে খুব সমস্যা হয় তার।

সকালের নাস্তার পাট চুকিয়ে আবারো রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন শান্তা।অনুভা এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরের দোরগোড়ায়। কিয়ৎক্ষণ শাশুড়িকে পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,“এই সময়ে আবার রান্না করছেন যে মা?”

হাতের কাজ করতে করতেই শান্তা উত্তর দিলেন,“আজ বাড়িতে তোমার খালা শাশুড়ি আর তার পুরো পরিবার আসছে। প্রায় এক বছর পর তারা আসতে চলেছে এ বাড়িতে, একটু আয়োজন না করলে কী হয় মা?”

মৃদু হেসে শাশুড়ির পাশে এসে দাঁড়ায় অনুভা। কোমল স্বরে বলে,“কী করতে হবে বলুন। আমিও আপনাকে হেল্প করি।”

“করবে? করো তবে।”—সায় জানালেন শান্তা। মনে মনে বেশ তৃপ্তও হলেন বটে। যাক অবশেষে পুত্রবধূ তো পেলেন তিনি।

আজ ক্লাস না থাকায় বাড়িতেই রয়ে গেলো শ্রাবণ। নাস্তা সেরে ঘরে এসে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে আছে সে। হানিফ শেখ পুত্রের কক্ষের সামনে এসে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন।সোজা হয়ে বসলো শ্রাবণ। অনুমতি দিতেই ভেতরে প্রবেশ করলেন হানিফ শেখ। সচরাচর পুত্রের ঘরে আসেন না তিনি। তাই উনাকে দেখে খানিকটা চমকালো শ্রাবণ।

হানিফ শেখ এসে বসলেন সিঙ্গেল সোফাটায়। সতর্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“শুনেছিস বাড়িতে যে আজ তোর খালা আসবে?”

“কই না তো।”

“না শোনারই কথা, বাড়ির খোঁজ খবর তো আর রাখিস না। যাই হোক তোর খালা কিন্তু একা নয় বরং তার পুরো গোষ্ঠী সঙ্গে নিয়ে আসছে।”

“ওহ, তা হঠাৎ করে?”

“হঠাৎ না, প্লান করেই আসছে। তোর মা তো আবার ভাই-বোন অন্ত প্রাণ। তাই তার বোনের কাছে আগে ভাগেই সবকিছু বলে দেয়। তোর বিয়ের কথাটাও বলে দিয়েছে এমনকি তোর বউকে যে বাড়িতে নিয়ে এসেছে সেটাও রুবির বুদ্ধিতেই। যদিও ব্যাপারটা আমি গতকাল রাতে ধরতে পেরেছিলাম।”

শ্রাবণ নিরুত্তর। কথাটা শুনেই কিছু একটা ভাবতে বসেছে। হানিফ শেখ পুনরায় বললেন,“তোর মামা- খালাদের স্বভাব তো আবার ভালো না। অন্যের ভুল আর খুঁত টেনে টেনে বের করে সমালোচনা করা তাদের স্বভাব। তাই ওরা এলে বউমার সাথে সাথে থাকবি। আসছে যখন বলা তো যায় না কখন কী বলে কষ্ট দিয়ে ফেলে মেয়েটাকে।”

“আমারও ব্যাপারটা অতো সুবিধার মনে হচ্ছে না। নইলে যে সারা বছরেও ব্যস্ততার কারণে বোনকে দেখতে আসতে পারে না সে কিনা হুট করেই চলে আসবে? বৌ ভাতের সময় এলেই তো দেখতে পাবে বউকে তাই না?”

হানিফ শেখ এবার কণ্ঠ আরো নিচু করে বললেন,
“তোর মা তোর খালার জায়ের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে বলেছিল না? ওই যে মেয়েটা? যাকে তোর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল।”

“হ্যাঁ, সে আবার কী করল?”

“সে কিছুই করেনি।করেছে তোর খালা। তোর মায়ের ব্রেইন ওয়াশ করে নিজের জায়ের মেয়েকে তোর ঘাড়ে গছাতে চেয়েছে। তোর মাকে তো চিনিসই। বোন যা বলবে তাই বিশ্বাস করে নিবে। তাই ওরা এলেই অনুভা মাকে কিন্তু একা ওদের সামনে ছাড়বি না। কে জানে কখন কী হয়?”

“চিন্তা করো না। এইদিকটা আমি সামলে নিবো।”

“এটা জানাতেই এসেছিলাম। কী যেনো করছিলি কর, আমি যাই এক কাপ চা খেয়ে আসি।”

বলেই বসা থেকে উঠে গেলেন হানিফ শেখ। প্রস্থান করার জন্য কয়েক পা এগোতেই পিছু ডেকে প্রশ্ন করল শ্রাবণ,“সহু কবে ফিরবে বাবা? বলেছে কিছু?”

“জিজ্ঞেস করে নে।”

“ওর অনুপস্থিতিতে বিয়ে করে নিয়েছি বলে রাগ করে আছে। কল ধরছে না।”

নিঃশব্দে হেসে পুত্রের কক্ষ ত্যাগ করলেন হানিফ শেখ। এই দুই ভাইয়ের মধ্যে দুদিন পরপরই মান অভিমান লেগে থাকে। আবার হুট করেই একসঙ্গে মিলে যায় তারা। তবুও হানিফ শেখ খুশি। যেই যুগে ভাই ভাইয়ের মধ্যে সহজে মিলমেশ থাকে না সেখানে উনার ছেলে দুটো তো আলাদা। একেবারে ভাই অন্ত প্রাণ যেনো। সারাটা জীবন তারা এভাবে মিলেমিশে থাকলেই হলো।

চলবে _________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৮]

শাশুড়ির সঙ্গে দুপুরের রান্নাবান্না শেষ করে ঘরে এলো অনুভা। আসার পথে নতুন শাড়ি আর গহনার বাক্স পুত্রবধূর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন শান্তা। ঘরে এসে বিছানার উপর বাক্সগুলো রেখে শাড়িটা নিয়ে বাথরুমে প্রবেশ করল অনুভা। সোফায় বসে স্ত্রীর সম্পূর্ণ কাজকর্ম আড়চোখে পর্যবেক্ষণ করে আবারো মোবাইলের স্ক্রীনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল শ্রাবণ।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গোসল সেরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। চুলে আধভেজা তোয়ালে জড়ানো। শাড়ির আঁচলটাও বেশ এলোমেলো তার। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কুচি ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মেয়েটি। উন্মুক্ত ঘাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু পানি। ব্লাউজের কিছু অংশও ইতোমধ্যে ভিজে গেছে। কুচি ঠিক করে আয়নায় চোখ রাখতেই দৃষ্টিগোচর হলো শ্রাবণকে। একদৃষ্টিতে ছেলেটি তাকিয়ে আছে তার পানে। ঘোর লাগা দৃষ্টি। দৃষ্টির অর্থ আঁচ করতে পেরেই মিইয়ে গেলো অনুভা। রক্ত শূণ্য হয়ে উঠলো ওষ্ঠদ্বয়।জিভ দিয়ে ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“হা করে তাকিয়ে আছো কেন? আগে কখনো দেখোনি আমায়?”

নিঃশব্দে হাসলো শ্রাবণ। বসা থেকে উঠে এগিয়ে এলো স্ত্রীর অতি নিকটে।বাহু ধরে তাকে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে। নেশালো কণ্ঠে বললো,“দেখেছি তবে এমন রূপে আগে কখনো দেখা হয়নি। নিজেকে কন্ট্রোল করা তো রীতিমতো অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে নোভা। কী করি বলো তো?”

হৃদস্পন্দন যেনো বেড়ে গেলো অনুভার। গলা শুকিয়ে আসছে বারংবার। তার লাজে রাঙা মুখটি দেখে কোমর জড়িয়ে ধরলো শ্রাবণ। টেনে নিলো নিজের অতি নিকটে। মুখ ডুবালো উন্মুক্ত গলায়। শুষে নিলো বিন্দু বিন্দু পানি। শ্বাসরোধ হয়ে এলো অনুভার। খিচ মেরে বন্ধ করে নিলো নিজের আঁখি যুগল। স্ত্রীর মুখপানে চাইলো শ্রাবণ। অধর প্রশস্ত হলো। কী মোহনীয়ই না লাগছে মেয়েটিকে! নিজেকে জোরপূর্বক সামলে নিয়ে সরে এলো স্ত্রীর নিকট হতে। সৃষ্টি করল দুজনার মধ্যকার দূরত্ব।

ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইলো শ্রাবণ। অনুভা পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো সম্মুখে। তৎক্ষণাৎ মিলিত হলো দুজনার দৃষ্টি। শ্রাবণ শব্দ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,“তুমি তো ভারি লজ্জাবতী নারী নোভা! এমন করে লজ্জা পেলে কী চলবে? সঠিক সময়ে আমাদের বিয়ে হলে দেখা যেতো একটা বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে আরেকটা তোমার গর্ভে। ডাউনলোড হবে হবে ভাব। সেখানে বিয়ে হলো কিনা এই সেদিন। তার উপর রোমান্টিক মোমেন্টে এত লাজ আর কাঁপা কাঁপি! তোমাকে নিয়ে আমি আর পারি না মেয়ে।”

শেষের কথাটা আফসোসের সুরে বলে কাবাডের কাছে চলে গেলো শ্রাবণ। কাবাডের দরজা খুলে ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজের একটি খাম বের করে আবারো এগিয়ে এলো অনুভার নিকট। খামটা বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেলো অনুভার। তার মুখে প্রশ্নের ছাপ দেখে মুচকি হাসে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,“ধরছো না কেন?”

খামটি ধরলো অনুভা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খামটি দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কী আছে এতে?”

“তোমার দেনমোহরের টাকা। দেনমোহর পরিশোধ না করে স্ত্রীকে ছোঁয়া তো আবার বৈধ নয়। তাই পুরোটা পরিশোধ করে দিলাম। রোমান্সে আমি কোনো বাঁধা চাই না নোভা। ”—-বলেই পূর্বের স্থানে গিয়ে বসলো শ্রাবণ।

অনুভা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। তার বিষ্মিত মুখায়ব দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ আনন্দ পেলো শ্রাবণ। তাড়া দিয়ে ফের বললো,“এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? সামান্য চুমুই তো খেলাম তার রিয়েকশন এখনো কাটেনি?বাকি স্টেপগুলো প্রয়োগ করতে গেলে যে তোমার কী হবে? যাও যাও দ্রুত চুল মুছে শুকিয়ে নাও। ঠাণ্ডা লেগে যাবে নইলে।”

লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে কি অবলীলায় একের পর এক লজ্জা নামক বাণ মেয়েটির দিকে ছুঁড়ে মারছে এই ছেলেটা! মুহূর্তেই খুব আফসোস হলো অনুভার। মনে মনে বললো,“হে রব আমায় কেন এর মতো একটু নির্লজ্জ বানালে না তুমি? নির্লজ্জ না হলে এর সঙ্গে তো সংসার করা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে যাবে!”

কলিং বেল বাজার শব্দ হতেই হেল্পিং হ্যান্ড মেয়েটি সদর দরজা খুলে দিলো। বেশ কয়েক বছর এখানে কাজ করার দরুন দরজার অপরপাশের মানুষ গুলোকে চিনতে অতটা অসুবিধে হলো না তার। স্বামী, সন্তান, পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন রুবি। উনারা সকলে সোফায় বসতেই হানিফ শেখ এবং শান্তার আগমন ঘটলো সেখানে। রুবি এবং উনার স্বামী আকরাম হোসেন একসঙ্গে সালাম দিলেন তাদের। সালামের জবাব নিয়ে হানিফ শেখ এবং শান্তা বসলেন সম্মুখ সোফায়।

কথার মধ্যেই রুবি বলে উঠলেন,“শুনলাম শ্রাবণের নাকি বিয়ে দিয়েছেন দুলাভাই? বউও তো নাকি বাড়িতে তুলেছেন? এত কাণ্ড ঘটে গেলো অথচ আমাদের জানানোর প্রয়োজনই মনে করলেন না একবার? সে যাই হোক আপনারা আমাদের পর ভাবতে পারেন কিন্তু আমরা তো আর তা ভাবি না। তাই সবটা জানার পরেও আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না।”

হাসলেন হানিফ শেখ। বললেন,“আসলে কাউকেই জানানো হয়নি। তবে সৌহার্দ্য দেশে ফিরলেই ভাবছিলাম দুই ভাইয়ের বৌ ভাতের অনুষ্ঠানটা একেবারে সেরে ফেলতে। তখনি না হয় সবাইকে জানাতাম।”

উনার কথায় যেনো তেমন একটা পাত্তা দিলেন না রুবি। হানিফ শেখ পুনরায় বললেন,“তুমি তো সারা বছরই ব্যস্ত থাকো শালীকা তা ব্যস্ততা কমলো? ও মা আনিকাও দেখি এসেছে! তা তোমার স্বামী কোথায়?সে এলো না কেন?”

রুবির বড়ো মেয়ে আনিকা মৃদু হেসে উত্তর দিলো,“ওর কাজের অনেক চাপ খালু। তাই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে আমিই মা-বাবার সঙ্গে চলে এলাম।”

“ওহ, তা ঠিক করেছো।”

এত সৌজন্য কথা বিরক্ত লাগছে রুবির নিকট। এবার শান্তার উদ্দেশ্যে বলেই বসলেন,“তা তোমার ছেলে আর ছেলের বউ কোথায় আপা? ডাকো তাদের। নতুন বউকে দেখার জন্যই তো এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এলাম আমরা।”

“দাঁড়া আমি নিয়ে আসি ওকে।”—বলেই পুত্রের কক্ষের দিকে ছুটলেন শান্তা।

অনুভার তৈরি হওয়া শেষ। এখন শুধু হাতে সোনার বালা দুটো পরছে। শ্রাবণ গেছে গোসল সারতে। বাড়িতে থাকলে সবসময়ই ছেলেটার গোসলের অনিয়ম হয়। আজও ব্যতীক্রম কিছু ঘটলো না। দরজায় নক করে শান্তা জিজ্ঞেস করলেন,“বউমা তৈরি হয়েছো?”

শাড়ির কুচি ধরে দ্রুত দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো অনুভা। নত স্বরে উত্তর দিলো,“জ্বি।”

গায়ে ধূসর রঙা শাড়ি। শরীরে সোনার গহনা। পুত্রবধূর এমন রূপ দেখে চমকালেন শান্তা। আনমনে বলে উঠলেন,“মাশাআল্লাহ!”

লজ্জায় আড়ষ্ট হলো অনুভা। নুইয়ে গেলো তার মাথা। মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শান্তা। বললেন,“ছেলের আমার পছন্দ আছে। দু দুটো ছেলেই চাঁদ পছন্দ করে এনেছে। তা মেহু কোথায়?”

“মেহু কে?”

“শ্রাবণ।”

“ওহ, ও তো গোসল করছে।”

“আচ্ছা তুমি এসো আমার সাথে। তোমার খালা শাশুড়ি, খালু শ্বশুর নিচে অপেক্ষা করছে।”—বলেই অনুভার মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে নিজের সঙ্গে করে নিচে নিয়ে যেতে লাগলেন শান্তা।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নিচে এসে পৌঁছালেন শাশুড়ি বৌমা। উৎসুক দৃষ্টিতে অপরিচিত মেয়েটির পানে তাকিয়ে আছেন রুবি। অধরে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সামনের খালি সোফাটা দেখিয়ে বললেন,“এখানে বসো।”

শান্তা ধরে তাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসলেন পাশে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জেরা করার ভঙিতে রুবি প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “নাম কী তোমার?”

“অনুভা।”

“আগে পরে কিছু নেই?”

“অনুভা হাসান।”

“কতদূর লেখাপড়া করেছো?”

“স্নাতক।”

“তা বাড়িতে কে কে আছে?”

“মা, বড়ো বোন।”

ভ্রু বাঁকালেন রুবি। কৌতূহল নিয়ে শুধালেন,“বড়ো বোনের কী বিয়ে হয়নি নাকি? শ্বশুর বাড়ি রেখে বাপের বাড়ি কী করে?”

“দুলাভাই মারা গেছেন তাই।”

“ওহ, তা শ্বশুর বাড়ির লোক রাখেনি তাই তো?”

মহিলার কণ্ঠে বিদ্রুপ খেলে গেলো। যা খুব ভালো করেই টের পেলো অনুভা। ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ হলো সে। নত মস্তক উঠিয়ে এবার সম্মুখ মহিলার মুখশ্রীর পানে দৃষ্টি স্থির করল। কৃত্রিম হেসে চাপা স্বরে বললো, “তা আমাদের পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেসব বলতে আগ্ৰহী নই।”

কথাটা শুনতেই উপস্থিত সকলে চমকায়। আঁধারে ছেয়ে যায় রুবির মুখশ্রী। খোঁচা মেরে বলেন,“বাহ আপা! তোর পুত্রবধূ দেখি ভালোই কথা বলতে জানে?”

হানিফ শেখ বিপরীতে বললেন,“যা যুগ পড়েছে কথা না জানলে হয় না। তা তুমি এতদূর বয়ে জেরা করতে এসেছো নাকি শালিকা?”—-বলেই শব্দ করে হাসলেন তিনি।

তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন রুবি। বড়ো বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,“দেখলে আপা? দেখলে? দুলাভাই কীভাবে আমায় খোঁচা মেরে কথা বললেন?”

“এ মা খোঁচা মারবো কেন? আমার শালিকা তুমি। শালিকার সঙ্গে একটু রসিকতা করতে পারবো না?”

দমে গেলেন রুবি। এদিকে শান্তা পড়লেন বিপাকে। কার পক্ষে কথা বলা উচিত তাই বুঝতে পারছেন না তিনি। পুনরায় অনুভার উদ্দেশ্যে রুবি প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“তা তোমার বাবা কী করে?”

“বাবা নেই মারা গেছেন।”

“ওহ, তা মরার আগে তো কিছু একটা করতেন নাকি না?”

“বাবা প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় কয়েক বছর পড়ে ছিলেন।”

“তাহলে সংসার চলতো কীভাবে? চাকরি বাকরি করতে নাকি?”

মহিলার প্রশ্নগুলো সুচের মতো শরীরে বিঁধছে অনুভার। প্রশ্নের ধাঁচগুলো বিরক্ত লাগছে তার নিকট। এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে ভেবেই তো এতবার এড়িয়ে গিয়েছে শ্রাবণকে। অথচ আজ কিনা এসবের সম্মুখীনই হতে হচ্ছে তাকে? সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট দুটো প্রশস্ত করল অনুভা কিন্তু পারলো না। তখনি সেখানে উপস্থিত হলো শ্রাবণ। মৃদু হেসে বললো,“আসসালামু আলাইকুম খালামণি, খালু।”

আকরাম হোসেন এবং রুবি জবাব নিলেন সালামের। অনুভার পাশের খালি জায়গাটায় আরাম করে বসে পড়ল শ্রাবণ। শুধালো,“তা হঠাৎ স্বপরিবারে চলে এলে যে? বিশেষ কোনো দিন নাকি আজ?”

আকরাম হোসেন হেসে বললেন,“তুই তো আমাদের না জানিয়েই বিয়ে করে নিলি কিন্তু আমরা তো আর মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারি না তাই চলে এলাম বউ দেখতে।”

খালার সঙ্গে সংসার করতে করতে খালুও যে ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলতে শিখে গেছে তা খুব ভালো করেই আঁচ করতে পারলো শ্রাবণ। অধরের হাসিটা বহমান রেখেই বললো,“নিজের ভাই-ই উপস্থিত ছিলো না আবার তোমাদের জানাবো! এত সময় কোথায়?”

অপমানে থমথমে হয়ে গেলো স্বামী-স্ত্রীর মুখশ্রী। এর বিপরীতে বিদ্রুপ করেই রুবি বলে উঠলেন,“তা তোর বউ বিয়ের আগে চাকরি করতো নাকি?”

“হ্যাঁ করতো। কেন বলো তো?”

“চাকরি করা মেয়ে বিয়ে করেছিস! তা মা সংসারের কাজকর্ম কিছু জানো নাকি? চাকরি করা মেয়েরা তো আবার ঘরের কাজকর্মে ঢেকি হয়।”

“চাকরি করার যোগ্যতা ছিলো তাই করেছে। তাছাড়া বউ এনেছি কাজের লোক তো আর আনিনি।তোমার কথায় খোঁচা খোঁচা একটা ভাইব পাচ্ছি খালামণি!ব্যাপার কী? তুমি কী অসন্তুষ্ট কোনো কারণে?”

রাগে, অপমানে রীতিমতো এবার ভেতরটা কাঁপছে রুবির। বাহিরের একটা মেয়ের সামনে এভাবে কথা শুনতে হলো উনাকে?ইচ্ছে করল এখনি এখান থেকে চলে যেতে কিন্তু তা অসম্ভব।বরং এমন কাজে আরো অপমানিত হতে হবে উনাকে। শান্তা ছোটো বোনের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই রাগ করিস না রুবি। আমি তো সবার আগে তোকেই জানিয়েছি নাকি? তাছাড়া বউমা আমার কোনোদিক দিয়ে কম নয়। তুই রেগে আছিস তো তাই তোর এমন লাগছে। দেখতে দেখতে তোরও আমার মতোই বউমাকে একদম মনে ধরে যাবে।”

এটাই দেখার বাকি ছিলো! শেষমেশ কিনা নিজের বোনও ওই মেয়ের গুণকীর্তন গাইছে?ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় দগ্ধ হলেও বাহিরে কৃত্রিম হাসলেন তিনি। এক ফাঁকে পুত্রবধূকে নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন শান্তা। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে যে। সব গোছগাছ করে টেবিল সাজাতে হবে তো।
_________

দিনের আলো বিলীন হয়ে সন্ধ্যা নামলো ধরণীতে। রাত আটটা বেজে তেতাল্লিশ মিনিট। রুবি আর তার পরিবার চলে গিয়েছে সন্ধ্যার নাস্তা সেরেই। বিছানায় এসে বসে আছে অনুভা। মিনিট দুয়েক আগে মায়ের সঙ্গে ফোনকলে কথা বলে সবার খোঁজখবর নিয়েছে সে।

শ্রাবণ এসে পাশে বসলো। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বললো,“খালামণির কথায় একদম মন খারাপ করো না নোভা। উনার কথার ধরণ একটু অমনই। তার উপর সবসময়ই আমাদেরকে উনি নিজ ছেলের দৃষ্টিতে দেখে এসেছেন তাই না জানিয়ে বিয়ে করায় একটু রেগে আছেন।”

হতাশার শ্বাস ফেললো অনুভা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “সবে তো শুরু। দেখতে থাকো না, একে একে আত্মীয়-স্বজন আসবে আর এমন ভাবে ইন্টারভিউ নিতে থাকবে। কজনকে ঠিক কদিন সামলাবে তুমি?এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জেনেই আমি বারবার এগোতে তোমায় নিষেধ করেছি কিন্তু তুমি তো নাছোড়বান্দা পুরুষ।”

তার ডান হাতের উপর নিজের বাম হাতটা রাখলো শ্রাবণ। ভরসার কণ্ঠে বললো,“যত জনকে প্রয়োজন তত জনকে থামিয়ে রাখবো। তোমার বাবার অতীত নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার শুধু তোমাকে প্রয়োজন ছিলো আর আমি তোমাকে পেয়েও গেছি নোভা।”

“তোমার বাবা-মা জানেন সবকিছু?”

ইতস্ততবোধ করল শ্রাবণ। ললাটে সরু ভাঁজ পড়ল। কণ্ঠ নেমে গেলো খাদে। বললো,“বাবা জানে কিন্তু মা তেমন কিছুই জানে না। যেদিন বিয়ে হলো সেদিনই মা তোমায় প্রথম দেখেছিল আর নামও জেনেছিল।”

“তারপরেও তোমার বাবা রাজি হলো কী করে?”

“ঘটনাটা এত জটিল বানানোর কী আছে নোভা? পৃথিবীতে কেউই সাধু কিংবা দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নয়। প্রতিটি মানুষের ব্যাকগ্ৰাউন্ড ঘাটতে গেলে কিছু না কিছু খারাপ পাওয়া যাবে। এখন মূল কথা হচ্ছে এই খারাপের মধ্যে কারোরটা প্রকাশ পায় আবার কারোরটা পায় না। নিজের স্ত্রী সন্তানদের সুখ দিতে গিয়ে ভদ্রলোক না হয় অপরাধ করেই ফেলেছে। তার জন্য মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত শাস্তিও ভোগ করে গিয়েছে। মৃ’ত্যুর পরে কী হবে তা আল্লাহ জানেন। তোমরাও তো কম সাফার করোনি তাহলে? বাবাকে জানানো প্রয়োজন ছিলো বিদায় জানাতে হয়েছে। আর মা! মাকে জানাইনি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি বলেই জানাইনি।”

পূর্বের ন্যায় নিরব বসে রইলো অনুভা। শ্রাবণ তার বাহু ধরে নিজের পানে ঘুরালো তাকে। কপোলে আলতো করে হাত রেখে বললো,“আমাদের পরিচয়টা পারিবারিকভাবে নয় নোভা। বরং যখন আমাদের দুজন দুজনার দেখা হয়েছে পরিচয় হয়েছে তখন কেউ কারো পরিবার সম্পর্কে জানতাম না আমরা। তাহলে এখন যখন আমরা মিলিত হয়েছি তখন কেন এসব নিয়ে ভাববো? ভুলে যাও অতীত। অতীত নিয়ে ভেবে ভেবে কেউ কখনো বর্তমানে সুখী হতে পারে না।”

গাঢ় দৃষ্টিতে সম্মুখে বসা পুরুষটির চোখের পানে চেয়ে কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনলো অনুভা। তারপর আলতো করে তার বুকে মাথা ঠেকিয়ে বুঁজে নিলো চোখ। আনমনে বলে উঠলো,“হু।”

মোবাইলে কার্টুন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছে তাঈম। রাতের খাবার খেয়ে মায়ের ঘরে এলো অর্থিকা। সুফিয়া তখন শুয়ে আছেন বিছানায়। ঘুমাননি এখনো। বড়ো মেয়ের উপস্থিতি টের পেতেই চোখ জোড়া মেলে তাকালেন। বিছানায় বসলো অর্থিকা। হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধালো,“এখনো ঘুমাওনি?”

“না, ঘুম আসছে না।”

“ঘুমের ওষুধ খাওনি কেন?”

“ভালো লাগে না আর।”

“ভালো না লাগলে হবে? ঘুমের ওষুধ না খেলে তো তুমি ঘুমাতেই পারো না মা।”

উত্তর দিলেন না সুফিয়া।কিছুক্ষণ নিরব থেকে প্রসঙ্গ বদলে বললেন,“অনুর সঙ্গে কথা হলো। যা বুঝলাম মেয়েটা ভালোই আছে। তোদের বাবা তো ছোটো মেয়ের সংসার আর দেখে যেতে পারলো না। জানিস রোজ তোর বাবা আমার স্বপ্নে আসে। আমার কেন জানি মনে হয় সে একদম ভালো নেই। কতবার করে আমাকে ডাকলো। নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলো।”

অর্থিকা নিরবে শুনে সেসব কথা। কিন্তু বিপরীতে বলার মতো কোনো বাক্য খুঁজে পায় না।

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে