সুখেরও সন্ধানে পর্ব-২৫+২৬

0
545

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৫]

বসন্তের মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। সন্ধ্যে নামার পরেও অন্তরীক্ষ জুড়ে পাখির বিচরণ আর কিচিরমিচির ধ্বনিতে মুখরিত চারিপাশ। লাল টুকটুকে বধূ রূপে নত মস্তকে বসে আছে অনুভা। তার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরত্ব রেখেই পাশে বসা শ্রাবণ। সম্মুখে পৌঢ় কাজী সাহেব কাগজপত্র গোছগাছ করতে ব্যস্ত। আসা যাওয়ার পথে পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারটির সঙ্গেও দুয়েকবারের কথাবার্তায় ভালো একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে অর্থিকার। তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাই তারাও সেখানে উপস্থিত। সকলে উদগ্রীব হয়ে আছে সেই বিশেষ কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তটির জন্য। সকলের মধ্যিখানে বসেই এক যুবতী মনে উথাল পাতাল ঢেউ বইছে। ঘর্মাক্ত হাতের তালুতে অন্য হাত ঘষে চঞ্চলা কিশোরীর ন্যায় ভেবে যাচ্ছে কতকিছু। আড়চোখে তার এসব কাণ্ড অবলোকন করে মনে মনে হাসছে শ্রাবণ। এই তো আর কয়েক মুহূর্ত। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই পাশে বসা কাঙ্ক্ষিত রমণীটি শুধু তার, শুধুই তার। এই রমণীর উপর সকল অধিকার একমাত্র তার থাকবে।

ভেসে এলো কাজীর মোটা স্বর। ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। কর্ণে বেজে উঠলো প্রিয় নামটি,“শেখ মাহাথির শ্রাবণ।”

নামটা শুনতেই ভেতরটা কম্পিত হলো। থেমে গেলো হৃদক্রিয়া। পুনরায় কাজী সাহেব বলে উঠলেন,“বলুন মা কবুল।”

এই মুহূর্তে অনুভা টের পেলো তার গলা শুকিয়ে এসেছে। জিভের সাহায্যে শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিলো। চঞ্চল হয়ে উঠলো তার চোখের মণি। অর্থিকা বোনের কাঁধে হাত রেখে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,“কবুল বল অনু।”

কণ্ঠনালী কম্পিত হলো অনুভার। বিলম্ব না করে চিত্ত চিরে বেরিয়ে এলো,“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

মুহূর্তেই সকলের অধর প্রশস্ত হলো। সমস্বরে সবাই বলে উঠলো,“আলহামদুলিল্লাহ।”

কাবিন নামায় স্বাক্ষর করা শেষ হতেই শুরু হলো মিষ্টিমুখ। বিয়ের কার্য সম্পাদন হতেই অনুভাকে নিয়ে ঘরে চলে এলো অর্থিকা। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে গেলো,“তুই বসে জিড়িয়ে নে। আমি আসছি।”

অর্থিকা চলে যেতেই ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা পানির বোতল থেকে বেশ কিছুটা পানি পান করে গলা ভিজিয়ে নিলো অনুভা। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি স্থির করল আরশিতে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নিজেকে। তখনি দৃষ্টিগোচর হলো পরিচিত আরেক প্রতিবিম্বর। অনুভূতিরা চট করে শান্ত হলো। কয়েক কদম এগিয়ে ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়ালো শ্রাবণ। অধরে তার চমৎকার, প্রাপ্তির হাসি। সম্মুখে উল্টো ঘুরে দাঁড়ানো রমণীটির মাথা থেকে ঘোমটা টা চট করে ফেলে দিয়ে পকেট থেকে বের করল বেলী ফুলের মালা। এই মালাটি আনতেই তো তখন সে ছুটে গিয়েছিল নিচে। যত্ন করে তা গেঁথে দিলো স্ত্রীর খোঁপায়। নিষ্পল দৃষ্টিতে আরশির ভেতর দিয়েই পুরুষটির কর্মকাণ্ড দেখে গেলো অনুভা। তার বাহু দুটো ধরে তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো শ্রাবণ। কানের ধারে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“বলেছিলাম না তুমি শুধুই শ্রাবণের নোভা। কী মিললো তো?”

অস্বস্তি ঘিরে ধরলো মেয়েটিকে। তার অস্বস্তিকে আরো দ্বিগুন করে দিতে অপ্রত্যাশিত একটি কাজ করে বসলো শ্রাবণ। গাঢ় চুম্বন এঁকে দিলো অনুভার ললাটে। এই মুহূর্তে এসে অনুভার মনে হলো এই পুরুষটির জন্মই হয়েছে তাকে লজ্জায় ফেলার জন্য। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দুজনার মধ্যকার দূরত্ব তৈরি করে নিলো শ্রাবণ। পূর্ণ দৃষ্টিতে ছেলেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো অনুভা। শুভ্র রঙের পাজামা পাঞ্জাবীতে তাকে চমৎকার লাগছে।

মুচকি হাসে শ্রাবণ। জিজ্ঞেস করে,“আমায় সুন্দর লাগছে তাই না?”

ভড়কে গেলো অনুভা। আমতা আমতা করে শুধালো,
“হ্যাঁ?”

“যেভাবে তাকিয়ে আছো তাই তো মনে হচ্ছে।”

তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় অনুভা। নিঃশব্দে হেঁটে বিছানার এককোণে বসে পড়ে। অভিযোগের সুরে বলে,“এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না? এটা কী ঠিক করেছো?”

শ্রাবণও তার দিকে মুখ করে একপাশে বসে। বাম হাতটি মুষ্টিবদ্ধ করে সেখানে থুতনি ঠেকিয়ে তার পানে তাকায়। বলে,“আমি নেইনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থি আপু। আর আমিও সুযোগটা শুধু লুফে নিলাম আরকি। তোমার উপরে ভরসা করে থাকলে কী আর জীবন চলবে? দেখা যেতো বিয়ে না করেই একসময় আমি বুড়ো হয়ে যেতাম। এর থেকে বিয়ে সেরে নেওয়াটাই কী ঠিক হলো না? এবার তুমি যা ইচ্ছে করো, আমার কী?”

কথার বিপরীতে তার পানে চোখ পাকিয়ে তাকালো অনুভা। তার এহেন দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই থেমে গেলো শ্রাবণ। বিপরীতে উপহার দিলো মিষ্টি হাসি।
_______

রাতের অন্ধকার বিলীন হয়ে ধরণীতে আস্ফালন ঘটলো সূর্য রশ্মির। দিনের সূচনা হতেই রোজকার মতো শুরু হলো জনজীবনের ছোটাছুটি। নাস্তা সেরে অফিস ছুটলো অর্থিকা। তার পরপরই বের হলো অনুভাও। গতকাল রাতেই শ্রাবণ আর তার পরিবার ফিরে গেছে নিজ ঠিকানায়। যদিও শান্তার খুব ইচ্ছে ছিলো পুত্রবধূকে একবারে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরবেন কিন্তু শ্রাবণ তাতে বাঁধ সাধলো। সে কিছুতেই চায় না হুটহাট করে অনুভার উপর গোটা একটা সংসার আর সম্পর্ক চাপিয়ে দিতে।

অফিসে এসে চুপচাপ নিজের কেবিনে বসে পড়ল অনুভা। গতকাল কেন আসেনি এ বিষয়ে আজ কোনো জবাবদিহি করতে হলো না তাকে। নিজের মনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল কাজে।

দুপুর হতেই সুদূর কানাডা হতে কল এলো শ্রাবণের মোবাইলে। নাম্বারটা দেখেই ললাটে সরু কয়েকটা ভাঁজ পড়ল তার। কিছুটা সময় নিয়ে কলটা রিসিভ করতেই অপরপাশ হতে শুরু হলো ছোটো ভাইয়ের হাজারটা অভিযোগ। সৌহার্দ্য মুখ ফুলিয়ে বলতে লাগলো,“আমি মীর জাফর দেখিনি কিন্তু সামনে থেকে তোমাকে দেখেছি ভাইয়া। ভাই হয়ে ভাইয়ের সঙ্গে এমন বেঈমানি কী করে করতে পারলে বলো তো?”

শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“কী করেছি আমি?”

বড়ো ভাইয়ের এমন প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সৌহার্দ্য। তরতর করে বৃদ্ধি পেলো তার রাগের পারদ। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“এতটা নির্লজ্জ তুমি কী করে হতে পারলে ভাইয়া?আমায় না জানিয়ে তুমি বিয়ে করে নিলে অথচ এখন ন্যাকামি করে বলছো কী করেছি আমি? শ্যাম অন।”

“শুধু বিয়েই তো করেছি, সংসার তো আর করছি না তাই কথা একটু কম বল।”

“বিয়ে করেছো এটাই অনেক। তাও আবার না জানিয়ে। ভাই হয়ে ভাইকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না? ছিহ! মানবতা বলতে তো আর কিছুই রইলো না পৃথিবীতে। তোমার সঙ্গে কোনো কথা নেই আমার। আগামী দু দিন না না আগামী দুই সপ্তাহ কোনো কথাই বলবো না তোমার সঙ্গে। আল্লাহ হাফেজ।”

“পুরো কথা না শুনেই রেগে বোম….

এতটুকু বলেই থেমে গেলো শ্রাবণ। অপরপাশ হতে কল কাটার শব্দ হলো। কল কেটে দিয়েছে সৌহার্দ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিলো শ্রাবণ। বিয়ের বিষয়টা যে মা-ই ছোটো ভাইকে জানিয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই তার।
_______

অফিস শেষে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ফায়াজের সঙ্গে পথিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো অর্থিকার। এগিয়ে এসে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো ফায়াজ। মুচকি হেসে শুধালো,“চাকরি করো নাকি?”

হাঁটতে হাঁটতেই অর্থিকার থেকে উত্তর এলো,“হ্যাঁ।”

“ছোটো বাচ্চা রেখে চাকরি করতে সমস্যা হয় না? আর তোমার হাজব্যান্ড? সে কিছু বলে না?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে বলে,“চাকরিতে জয়েন করেছি মাসখানেক হলো। বাচ্চাকে দেখার জন্য লোক রাখা আছে তাছাড়া মাও আছে বাড়িতে।”

“ওহ, তা কী করে তোমার স্বামী? এখনো আলাপই তো করালে না।”

“সে থাকলে তো আলাপ করাবো।”

ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকায় ফায়াজ। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধায়,“মানে?”

“আমার স্বামী এক বছর আগে মারা গেছে। মৃত মানুষের সঙ্গে কী করে তোমায় আলাপ করাবো?”

পথিমধ্যে পা জোড়া থমকে গেলো ফায়াজের। এমন একটি কথা যেনো মোটেই সে প্রত্যাশা করেনি। ততক্ষণে অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছে অর্থিকা। ফায়াজ দ্রুত এসে তার কদমের সঙ্গে কদম মেলালো। মিনমিনে স্বরে শুধালো,“কীভাবে মারা গেছেন?”

“দুর্ঘটনায়।”

“ওহ, বাচ্চাকে নিয়ে তবে তুমি একাই থাকো?”

“বললাম না মা আর বোন আছে সাথে। বাবাও মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। এতদিন ছোটো বোনই সবদিক একা হাতে সামলেছে। কিন্তু আর কতদিন? ওরও তো একটা ভবিষ্যৎ আছে নাকি? তাই জোর করেই চাকরিতে জয়েন হলাম।”

মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো ফায়াজের। বিনা বাক্যে এগোতে লাগলো সামনের পথ ধরে। নিরবতা ভেঙে এবার অর্থিকা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তা তোমার কী খবর? বিয়ে সাদি করোনি? বাচ্চা কজন?”

“বউও নেই বাচ্চাকাচ্চাও নেই।”

“এমা কেন? বিয়ে করোনি?”

“করেছিলাম।”

“তাহলে?”

“বাবা-মায়ের জোরাজুরিতে পারিবারিকভাবেই বিয়েটা করেছিলাম কিন্তু যেখানে মনের মিল নেই সেখানে কী আর সম্পর্ক টিকে? সে মুক্তি চাইলো আমিও দিয়ে দিলাম মুক্তি।”

“পুরুষ মানুষ তাহলে নতুন করে আবার শুরু করলে না কেন?”

শব্দহীন হাসলো ফায়াজ। বললো,“চাইলেই কী সবাই নতুন করে শুরু করতে পারে? একই প্রশ্ন তো আমিও তোমায় করতে পারি। তবে তুমি কেন নতুন করে শুরু করলে না?”

অর্থিকার সহজ উত্তর,“তন্ময় যদি তোমার স্ত্রীর মতোই আমায় জীবিত অবস্থায় ছেড়ে যেতো তাহলে এতদিনে তার সকল স্মৃতিকে ভুলে গিয়ে আমি নতুন করে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিতাম। কিন্তু সে তো জীবিত অবস্থায় আমায় ছেড়ে যায়নি, বরং আমার হয়েই সে দুনিয়া ত্যাগ করেছে। সাথে রেখে গেছে আমাদের ভালোবাসার প্রতীক ছোট্ট ছেলেটাকে। তাহলে কেন আমি অন্য কাউকে জড়াবো নিজের জীবনে? এ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি তার ছিলাম আর মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্তও তার হয়েই থাকবো।”

কথাটা বলেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল অর্থিকা। সেখানেই থেমে গেলো ফায়াজ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে তাকিয়ে রইলো। বিড়বিড় করে বললো,“সবাই তার নিজ জায়গা থেকে সুখী। শুধু আমার জীবনেই এত এত ধোঁয়াশা, শুরুতেই আমার ডাকে তুমি সাড়া দিলে আজ হয়তো আমাদের জীবনটাও অন্যরকম হতো অর্থি।”

নাহিয়ান যেনো ইদানিং খুব করে অনুভাকে এড়িয়ে চলে। আগে যেমন দেখা হলেই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে আসতো এখন তার বিপরীত। সম্মুখে পড়ে গেলেও সৌজন্য হেসে সুন্দর করে এড়িয়ে যায় তাকে। যা খুব ভালো করেই দৃষ্টিগোচর হয়েছে অনুভার।

আজ একটু আগেই বাড়িতে ফিরে এলো নাহিয়ান। বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি।তাকে এসময় দরজার সম্মুখে দেখে মোটেও খুশি হলো না নাহিয়ান। ভেতরে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়েই তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করল,“কী ব্যাপার? ঘর থেকে বের হয়ে এলে কেন তুমি? তোমায় নিষেধ করেছি না একদম একা একা বিছানা থেকে নামবে না।”

মুখখানি মলিনতায় ছেয়ে গেলো তমার। মিনমিনে স্বরে বললো,“এমন করে বলছেন কেন? আপনি এলে কী আমি দরজা খুলে দিতে পারি না?”

স্ত্রীর মলিন মুখখানা দৃষ্টিগোচর হতেই মুচকি হাসলো নাহিয়ান। পেছন হতে জড়িয়ে ধরে সম্মুখে ধরলো আচারের প্যাকেট। আদুরে গলায় বললো,“কেন পারবে না? কিন্তু আমার বউয়ের গর্ভে যে নতুন একজন অতিথি আছে সে তো এমন দৌড় ঝাঁপে কষ্ট পাবে।”

“মাত্র দুই মাস চলছে আর এতেই আপনি যা শুরু করেছেন তাতে মানুষ পাগল বলবে আপনাকে।”

“বলুক তাতে আমার কী?”

মলিনতা দূর হয়ে হাসি ফোটে উঠলো তমার মুখশ্রীতে। আচারের প্যাকেট নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করল ঘরে। প্রেগনেন্সির খবরটা গত সপ্তাহেই হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে টের পেয়েছিল দম্পতি যুগল। আর তারপর থেকেই নাহিয়ানের বিভিন্ন আজগুবি যত্নে যেনো ক্লান্ত হয়ে উঠেছে তমা।

অফিস শেষে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে বের হতেই তানিমের মুখোমুখি হতে হলো অনুভাকে। ভেতরটা অস্বস্তিতে ফেটে পড়ল তার। তবুও বাহির থেকে যথাসম্ভব নিজেকে ধাতস্থ রেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো সে। কিন্তু পারলো না। তানিম পিছু ডাকলো,“মিস.অনুভা!”

অনুভা দাঁড়ায়। পিছু ফিরে শুধায়,“জ্বি স্যার?”

“কোনো পারমিশন ছাড়াই হুটহাট অফিস বন্ধ করা কী ভালো দেখায়? অফিসটা তো আর কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, বলুন।”

“আসলে বাড়িতে একটু প্রবলেম ছিলো তাই আসতে পারিনি আর জানাতেও পারিনি। স্যরি স্যার।”

“স্যরি বললেই কী সবটা মিটে যাবে মিস.অনুভা?”

মৃদু হাসে অনুভা। দৃঢ় কণ্ঠে বলে,“মিস নয় স্যার মিসেস.অনুভা।”

ললাটে ভাঁজ পড়ে তানিমের। চোখেমুখে প্রশ্নের ছাপ। শুধায়,“কবে থেকে?”

“এইতো গতকাল রাত থেকে।”

“গতকাল রাত? মানে? বুঝলাম না কিছুই।”

“আ’ম ম্যারিড স্যার। তাই নামের আগে মিসেস হওয়াটাই স্বাভাবিক।”

কথাটা সম্পূর্ণ বুকে গিয়ে আঘাত হানলো তানিমের। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে তাণ্ডব চালালো একটি বাক্য,‘আ’ম ম্যারিড স্যার’। শুকনো ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,“কবে হলো?”

“গতকাল রাতে।”

“হুট করে বিয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে ফেললেন?”

“মানুষটা যদি নিজের শখের হয় তবে অতিব গুরুত্বপূর্ণ কাজও হুটহাট সেরে ফেলাটা কঠিন কিছু নয়।”

“শখের মানুষ! আগে থেকেই তবে?”

“হ্যাঁ, ধরুন সেই ভার্সিটি লাইফ থেকে।”

“তাহলে এতদিন পর কেন?”

“আমিই চাইনি আমার এই কষ্টে ঘেরা অনিশ্চিত জীবনে তাকে জড়াতে কিন্তু সে যে নাছোড়বান্দা পুরুষ। কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না। ভালো যখন বেসেছে সেহেতু ভালোবাসার মানুষটিকে নাকি তার চায়ই চাই। এরপরেও আমি আর কী করে তাকে ফিরিয়ে দেই? তাছাড়া আপুও সবটা জানতো তাই বিয়েটা হয়ে গেলো।”

যা বলবে ভেবে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো তা যেনো মুহূর্তেই মূল্যহীন হয়ে উঠলো তানিমের নিকট। এতকিছু জানার পরেও কী করে নিজের অনুভূতির কথা জানাবে সে? এক লহমায় তার অনুভূতিগুলো হয়ে গেলো মূল্যহীন। ভেতরের অহমিকার পারদ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে এক নারীর জন্য সেখানে জমা হয়েছিল কিছু সুন্দর অনুভূতি অথচ সেই নারীটি কিনা এখন অন্য কারো? ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে এলো তানিমের। ভেতরে ভেতরে হেরে যাওয়াটা কিছুতেই বাহিরে প্রকাশ হতে দিলো না। শুধালো,“কে সে মহান ব্যক্তি? যাকে ফ্রেন্ড বলে সম্বোধন করেছিলেন? যে অফিসের কাছে আপনার জন্য অপেক্ষারত থাকতো রোজ, সে?”

ভেতরে ভেতরে চমকালো অনুভা। লোকটিরও তবে শ্রাবণকে দৃষ্টিগোচর হয়েছে? অধরে হাসিটা বিদ্যমান রেখেই অনুভা উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

মনে মনে ক্রোধের অনলে দগ্ধ হতে লাগলো তানিম। ইচ্ছে করল চিৎকার করে বলতে,“এসব মিথ্যে। এসব আমার ভ্রম। আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে অনুভা তাই আপনি শুধুই আমার।”

কিন্তু কিছুতেই তা বলতে পারলো না তানিম। বিবেক তাকে আটকালো। কথাটা বললে যে তার অহমিকার প্রাসাদে আঘাত হানবে তাও জানান দিলো মস্তিষ্ক। অনুভা কোমল স্বরে বললো,“বাড়ি ফিরতে হবে।আসি স্যার। আসসালামু আলাইকুম।”

উপরনিচ মাথা নাড়ায় তানিম। তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করে অনুভা।কিন্তু সেথায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয় তানিম। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে গাড়ির সম্মুখে বসিয়ে দেয় শক্তপোক্ত ঘুষি। না কিছুতেই যেনো রাগ কমছে না তার। ছোটো থেকে যা পছন্দ হয়েছে তাই তো সে পেয়ে এসেছে তাহলে আজ কেন একটা নারীকে সে পেলো না নিজ জীবনে? একি মানা যায়?

চলবে ________

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২৬]

রাত দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। বসন্ত ঋতু বিদায়ের সময় লগ্ন এসে গেছে। মৃদু ঠান্ডা বাতাসে গা ভাসিয়ে চায়ের কাপ হাতে ব্যালকনিতে বসে আছে অনুভা। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে আকাশপানে। তখনি নিঃশব্দে তার পাশে এসে চেয়ার পেতে বসলো অর্থিকা। বোনের উপস্থিতি টের পেয়েও নিরব রইলো অনুভা। নড়চড় হলো না তার চোখের মণি। কিয়ৎক্ষণ নিরব থেকে গলা ঝাড়লো অর্থিকা। বললো,“কাল অফিসে গিয়ে রিজাইন দিয়ে আসবি।”

এবার নড়েচড়ে ওঠে অনুভা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বড়ো বোনের পানে। বাম ভ্রু উঁচিয়ে শুধায়,“কেন?”

“দুই বেলা অন্যের ঝাড়ি খেয়ে এত কষ্ট করার আর কোনো প্রয়োজন নেই তাই। তুই তো বলতি তোর বস খুব রাগী, অযথা সকলের সামনে বকাঝকা করে, অপমান করে।”

“আগে করতো তবে ইদানিং ধরে আর করে না। কিন্তু তোর হঠাৎ করে কেন মনে হলো যে চাকরিটা আমার ছেড়ে দেওয়া উচিত?”

“আগে যখন ওসব কারণে মন খারাপ করে থাকতি তখন আমার কিছুই করার ছিলো না। আমি ছিলাম নিরুপায় কিন্তু এখন তো আর তেমন পরিস্থিতিতে আমরা নেই। এখন আমিও চাকরি করছি। তাই তুই বরং চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে রেস্ট নে। পরে না হয় নতুন কোনো চাকরি খুঁজে নিবি।”

বিরক্ত হলো অনুভা। বললো,“বললাম আর চাকরি পেয়ে গেলাম এত সহজ? এই চাকরিটা পেয়েছিলাম নাহিয়ান ভাইয়ের সহযোগিতায়। আর তুইও কিন্তু চাকরি পেয়েছিস শ্রাবণের সহযোগিতায়। তাই আমি আর চাই না কারো সহযোগিতায় কিছু করতে।”

“খুঁজতে খুঁজতে ঠিক একসময় না একসময় পেয়ে যাবি। তাছাড়া এখন তুই বিবাহিত মেয়ে, কদিন পর সংসারে পা রাখবি তাহলে তোর এতকিছু নিয়ে ভাবার কী প্রয়োজন বল তো? এদিকটা আমি ঠিক সামলে নিবো। অনেক তো হলো দায়িত্ব নেওয়া, আমাদের নিয়ে ভাবা। এবার না হয় আমি সব দায়িত্ব নেই?”

“তুই একা সবদিক সামলাতে পারবি না আপু। নতুন চাকরি, বেতনই বা কত তোর?”

“আল্লাহ চাইলে অবশ্যই পারবো। ছোটো বোন হয়ে তুই এতদিন সব সামলাতে পারলে আমি কেন পারবো না?”

সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুভা। কাঠ কাঠ গলায় বলে,“কিন্তু আমি তো ছাড়ছি না চাকরিটা। বিয়ে যখন হয়েছে সংসারও করবো, চাকরিটাও করবো। আশা করি শ্রাবণেরও এতে কোনো সমস্যা হবে না কারণ ও সব জেনেই তো নিজ থেকে আমায় বিয়ে করেছে।”

দমলো না অর্থিকা। স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠলো,“তুই কী কিছু বুঝিস না? নাকি না বোঝার ভান ধরে থাকিস বল তো? তোর চাকরি নিয়ে কারো কোনো আপত্তি নেই, আপত্তি হচ্ছে ওই অফিস নিয়ে। তোর মাথায় একবারও প্রশ্ন আসেনি, হঠাৎ করে কেন তোর ওই রগচটা বসের ব্যবহার কোমল হলো? কেন তোর প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলো? কেন বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলো? আর কেনই বা বাবা-মাকে এখানে পাঠিয়ে দিলো বিয়ের জন্য?”

“আমি বুঝতে চাই না। কারো অনুভূতি সম্পর্কে বোঝার ইচ্ছে আমার নেই। কে আমায় ভালোবাসলো আর কে বাসলো না তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আমার কাছে আমার অনুভূতিটাই সব। আমি উনার অফিসে কাজ করি সেই সুবাধে মাস শেষে মাইনে পাই ব্যস এতটুকুই। এর বেশি জানার কোনো প্রয়োজন তো দেখছি না।”

এবার যেনো দমে গেলো অর্থিকা। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছোটো বোনের পানে। কয়েক বছরের ব্যবধানে মেয়েটা কেমন বদলে গেলো? হয়ে গেলো কঠোর। পরিস্থিতি মানুষকে কতটাই না বদলে দেয়।

অফিস থেকে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে তানিম। আফসানা পরম মমতায় ছেলের চুলে বিলি কেটে দিচ্ছেন।কিছুক্ষণ নিরবতার পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন,“মন খারাপ?”

“না।”

“তাহলে?”

“অনুভার বিয়ে হয়ে গেছে মা।”

মোটেও চমকালেন না আফসানা। বিপরীতে বললেন,
“তো?”

বন্ধ চোখ জোড়া খুলে মায়ের পানে তাকায় তানিম। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে,“অথচ ওকে আমার ভালো লেগেছিল মা। সেক্ষেত্রে তাকে পাওয়ার কথাও তো আমার।”

“সে কোনো বস্তু বা পণ্য নয়, সে হচ্ছে একজন নারী।নারীকে পেতে হলে তার মন জয় করতে হয়। নারীকে অর্জন করতে হয়। যে তাকে পেয়েছে সে নিশ্চয়ই বিনা পরিশ্রমে তাকে পেয়ে যায়নি।”

নিরব হয়ে গেলো তানিম। ছেলের ভাবভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন আফসানা। পুনরায় বললেন,“এক মাত্র ছেলে হওয়ায় যখন যা চেয়েছিস তাই আমরা তোকে দিয়েছি তাই বলে আস্ত একটা মানুষ চেয়ে বসলেই যে তাকেও পেয়ে যাবি এটা ভাবা নিতান্তই বোকামি বাবা। চাইলেই জীবনে সবকিছু পাওয়া যায় না। কিছু জিনিস না পাওয়ার আক্ষেপ মানুষের থাকতে হয়। মেয়েটার ভেতরে তোর জন্য কোনো অনুভূতি নেই।সে শুধু তোকে অফিসের বস হিসেবেই চেনে এবং তেমন দৃষ্টিতেই দেখে। এর বেশি কিছু নয়। স্রষ্টা তাকে তোর জন্য সৃষ্টি করেননি। তাকে যার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল সে তাকে নিজের করে পেয়ে গেছে। তাই ভুলে যা সেসব। আমার তানিম তো মোটেও এমন নয় যে একটা মেয়ের জন্য সে কষ্ট পাবে। তাই না?”

পূর্বের ন্যায় নিরব থাকে তানিম। তার ভেতরে যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা কী টের পাচ্ছে মা?
________

সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো একটি। বোনের বিভিন্ন যুক্তি তর্কে ক্লান্ত হয়ে অবশেষে চাকরিটা ছেড়েই দিলো অনুভা। আজ শুক্রবার। বিকেল হতে না হতেই বাড়িতে এসে প্রবেশ করল এক জোড়া দম্পতি। তাদের দেখতেই অধরে হাসি ফোটে উঠলো অর্থিকা এবং সুফিয়ার। সোফায় এসে বসতেই চা বিস্কুট ফলমূল এনে তাদের সামনে রাখলো মাজেদা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে উনারা যে আসবেন তা যেনো উপস্থিত সকলেই আগে থেকে জানতো। সুফিয়া কথা বলছেন হানিফ শেখ এবং শান্তার সঙ্গে।

চট করে ঘরে এসে অনুভার সম্মুখে দাঁড়ালো অর্থিকা। বিছানায় বসে তাঈমের সঙ্গে গল্প করছে অনুভা। বোনকে হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে দেখেই মাথা উঁচু করে তাকালো। প্রশ্ন করার আগেই অর্থিকা বলে উঠলো,“তোর শ্বশুর শাশুড়ি এসেছে। তৈরি হয়ে বসার ঘরে আয়।”

চমকায় অনুভা। প্রশ্ন করে,“হঠাৎ উনারা? এ সময়?”

“হ্যাঁ, তুই তৈরি হ তাড়াতাড়ি।”

“শ্রাবণও কী এসেছে?”

“না শুধু উনারা দুজন। এত প্রশ্ন না করে চুপচাপ আয় তো।”

বলেই তাঈমের হাত ধরে কক্ষ ত্যাগ করল অর্থিকা। বিপাকে পড়ে গেলো অনুভা। হুটহাট চলে আসার মতো মানুষ তো উনারা নন। তবে? এ সময় কেন এলো? অলসতা ঝেড়ে ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। বাড়িতে পরিহিত কাপড় পরেই তো আর তাদের সামনে যাওয়া যায় না। তাই আলমারি খুলে বাহিরে পরার জন্য থ্রী পিছ নিয়ে তৈরি হতে চলে গেলো।

অর্থিকা এসেও বসলো সোফায়। তাঈমকে দেখতেই তাকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে এলেন শান্তা। মুচকি হেসে বললেন,“মাশাআল্লাহ। ও কী ওর বাবার চেহারা পেয়েছে নাকি?”

কিছুটা অপ্রস্তুত হলো অর্থিকা।কিন্তু তা বুঝতে দিলো না উনাদের। অধরে হাসি ফুটিয়ে উত্তর দিলো,“হ্যাঁ।”

অপরিচিত নারীটির পানে ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলো তাঈম। বাচ্চা শান্তার খুবই পছন্দের। ছেলেরা যখন ছোটো ছিলো তখন সব কাজকর্ম ফেলে তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন শুধু তাদের পানে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেগুলো কত বড়োই না হয়ে গেলো! এমনকি বিয়েও করে নিলো।

তৈরি হয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে উপস্থিত হলো অনুভা। শ্বশুর শাশুড়িকে সালাম জানিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল। শান্তা হাতের ইশারায় পুত্রবধূকে পাশে বসার ইঙ্গিত দিলেন। আহ্লাদী কণ্ঠে বললেন,“এই তো এসে গেছে আমার বউমা। তা কেমন আছো মা?”

“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আন্টি।”

মুহূর্তেই ললাটে ভাঁজ পড়ল শান্তার। কৌতূহলী কণ্ঠে শুধালেন,“কে আন্টি? কীসের আন্টি? মা বলো। কী হলো? বলো।”

ঘাবড়ে গেলো অনুভা। নিজের মায়ের পানে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো। সুফিয়া চোখের ইশারায় মেয়েকে তাই করতে বললেন। মা-মেয়ের পুরো দৃশ্যটা দৃষ্টিগোচর হলো শান্তার।মৃদু হেসে বললেন,“হুটহাট আরেকজনকে মা ডাকা একটু কেমন জানি দেখায় তাই না? তাহলে আপাতত থাক, এখনি আমাকে তোমার মা ডাকতে হবে না। তুমি বরং আমায় শাশুড়ি মা বলেই ডেকো। যখন পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে তখন না হয় শাশুড়িটা কেটে দিবে।”

ভদ্রমহিলার এত সুন্দর মনোভাবে ভেতর থেকে প্রশান্তি অনুভব করল অনুভা। মনে মনে ভাবলো, যেই পুরুষের মা এত সুন্দর অমায়িক একজন মানুষ। সেই পুরুষের এমন সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। কথার মাঝখানেই হানিফ শেখ বলে উঠলেন,“সে তোমাকে যা ইচ্ছে ডাকুক তবে আমায় কিন্তু তুমি এখন থেকেই বাবা বলে ডাকবে অনুভা মা। আর তা এখন থেকেই। এক বাবা হারিয়েছো তো কী হয়েছে? আজ থেকে আমি তোমার আরেকটা বাবা।”

এবারো প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়ালো অনুভা। জড়তায় কণ্ঠস্বর যেনো রোধ হলো তার। শান্তা বললেন,“আজ এখানে আমাদের আসার মূল কারণ হচ্ছে অনুভা মা। আমরা আমাদের পুত্রবধূকে নিজেদের সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।”

অবাক হয় অনুভা। সুফিয়া বিচলিত কণ্ঠে বলেন,
“আপনাদের বাড়ির বউ আপনারা নিয়ে যেতেই পারেন। আমরা আর কী বলবো?”

ভেতরে ভেতরে শ্রাবণের উপর রাগ জমা হয় অনুভার। কী শুরু করল এই ছেলেটা? তার মতামত ছাড়াই হুটহাট এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস পাচ্ছে কোত্থেকে সে? অনুভা ইতস্তত করে বললো,“বিয়ে হওয়ার সপ্তাহখানেক হলো। আজই ও বাড়িতে? তাছাড়া বিয়েটা তো..”

কথার মধ্যিখানেই তাকে থামিয়ে দিয়ে হানিফ শেখ কোমল স্বরে বলতে লাগলেন,“বাড়িটা যে খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে মা। ছোটো ছেলে ভীনদেশে। আর বড়োটা? সে তো নিজের চাকরি আর নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে সর্বদা। খাওয়ার সময় ব্যতীত তাকে আর দেখা যায় না তেমন। বাড়িতে আমরা দুজন বয়স্ক মানুষ। এমন করে কী আর ভালো লাগে? শ্রাবণকে সেই কবে থেকেই বিয়ের চাপ দিয়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু সে ছেলে স্পষ্ট করে বলে দিলো, তোমায় ছাড়া নাকি আর কাউকেই সে বিয়ে করবে না। তখন ওর মা বললো, তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে। তখন ছেলে আবার বলে, তুমি নাকি বিয়ের জন্য এখনি প্রস্তুত নও, যখন প্রস্তুত হবে তখনই তোমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবে। তখন আমাদের আর কী করার থাকে বলো তো?”

উপস্থিত সকলেই ভদ্রলোকের কথায় অবাক হয়। এই ছেলে বাবা-মায়ের সামনেও এতটা স্পষ্টভাষী? এভাবে কেউ সবটা বলে দিতে পারে? তবে অনুভা বোঝে এই পুরুষটির ভালোবাসা। পুরুষ যদি কোনো নারীকে সত্যিকারের ভালোবাসে তবে তার কথা তার বাবা-মায়ের সম্মুখে বলতে কখনোই সে দ্বিধাবোধ করে না। যার প্রমাণ স্বয়ং শ্রাবণ। হানিফ শেখ পুনরায় বলেন, “শ্রাবণ এ বিষয়ে জানে না। ওকে জানালে ও কিছুতেই রাজি হতো না। তোমার মতামত ছাড়া ও তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দিতে চায় না। আমরাও কিন্তু চাই না। তবে অনেক আশা নিয়ে যে এখানে এসেছি মা। খালি হাতে ফিরিয়ে দিও না। নতুন পরিবেশে তোমার কোনো অসুবিধে হবে না। যখন ইচ্ছে তখনি মা, বোন আর এই মিষ্টি বাচ্চাকে দেখতে চলে আসতে পারবে। আমাদের তরফ থেকে কোনো মানা নেই।”

উনারা যে আজই অনুভাকে নিতে আসবেন তা অর্থিকা জানতো না। তাই সে বলে উঠলো,“বিয়েটা হয়তো পারিবারিকভাবেই হয়েছে তাই বলে এভাবে শ্বশুর বাড়িতে যাওয়াটা কেমন দেখায় না? আপনাদেরও নিশ্চয়ই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশী আছে। তাই আমাদের যদি একটু সময় দিতেন আঙ্কেল তাহলে না হয় যতটা পারি একটা দিন একটু আয়োজন করে।”

হানিফ শেখ সৌজন্য হেসে বললেন,“তার কোনো প্রয়োজন নেই মা।বিয়ে হয়ে গেছে। এখন যা অনুষ্ঠানের আয়োজন করার তা আমরাই করবো। তোমাদের এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমরা আজই ওকে নিয়ে যেতে চাই। আপনাদের কোনো আপত্তি নেই তো আপা? অনুভা মা তোমার? তোমার কোনো আপত্তি নেই তো? যদি থাকে তাহলে বলতে পারো, আমরা কিছু মনে করবো না।”—-শেষের কথাটা অনুভাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন তিনি।

মা আর বোনকে ফেলে কিছুতেই অনুভা হুটহাট করে অন্য কোথাও যেতে চায় না। কী করে তাদের এভাবে ফেলে রেখে নিজে সুখের দিকে ধাবিত হবে? এ যে তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছু বলতে চাইলো অনুভা। উনারা কষ্ট পাক তবুও সে নিজের মতামত জানাবে কিন্তু সুফিয়া তখনি বলে উঠলেন,“ওর কোনো আপত্তি নেই। আপনারা নিয়ে যেতে পারেন।”

অর্থিকাও মায়ের সঙ্গে সম্মতি জানালো। আশানুরূপ উত্তর পেয়ে খুশি হয়ে গেলো দম্পত্তি যুগল। ব্যাগ গোছানোর জন্য সময় দেওয়া হলো তাকে। তাই নিরবে ঘরে চলে এলো অনুভা। তার পিছুপিছু অর্থিকাও এলো। বোনকে একান্তে পেয়েই রাগ ঝাড়ার প্রয়াস চালালো অনুভা। চাপা ক্ষোভে বললো,“সমস্যা কী তোর? হুটহাট আমারই অনুমতি ছাড়া আমার ব্যাপারে তুই সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস কেন বল তো? সাপের পাঁচ পা দেখেছিস? চাকরিতে ঢুকে চোখে সর্ষে ফুল দেখছিস? হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দিলি। এখন আবার শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবি?”

ভাবলেশহীন ভাবে বিছানায় আয়েশ করে বসলো অর্থিকা। বললো,“তো কী তোর নড়বড়ে মতামতের জন্য অপেক্ষা করবো? তোর মতামত চাইতে গেলে সেই তো বলতি, আমি বিয়ে করবো না। তোমাদের ছেড়ে আমি যাবো না। কেন যাবি না? সংসার কী পৃথিবীতে আর মেয়েরা করে না? শ্রাবণের মতো স্বামী আর অমন শ্বশুর শাশুড়ি পেয়েছিস বলে শুকরিয়া আদায় কর।”

“আপু!”

“রাগ না দেখিয়ে তৈরি হ যা।”

প্রচন্ড রাগ হচ্ছে অনুভার। এ কাদের জন্য সে এতকিছু ভাবলো? যারা কিনা তার যাওয়ার জন্য এত সুন্দর ব্যবস্থা করে দিচ্ছে? বিড়বিড় করে বলতে লাগলো অনুভা,“ঠিক আছে থাকবোই না এখানে। চলে যাবো। চলেই যাবো আমি। কাউকে দরকার নেই আমার।”

বলতে বলতে ব্যাগ গোছাতে লাগলো সে। বোনের রাগ দেখে নিঃশব্দে হাসলো অর্থিকা। আজ অনেক দিন বাদে মেয়েটিকে রাগতে দেখলো সে। দিনকে দিন পরিস্থিতির চাপে পড়ে কী কঠিন খোলসেই না আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবার যদি জীবনে তার সুখ আসে। যদি পারে এই শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে পুরোনো অনুভা রূপে ফিরে আসতে।

চলবে __________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে