#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২১]
কুয়াশার চাদরে মুড়ে আছে পুরো ধরিত্রী। শহরের রঙ বেরঙের বর্ণিল সাজে আর কোলাহলে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে রাতটা। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে জনজীবন। অফিস শেষে বাড়িতে ফিরেই ফ্রেশ হয়ে সবে আরাম করে বসেছিল অনুভা। কিন্তু তার এই আরামটা যেনো কিছুতেই সহ্য হলো না অর্থিকার। পারভিনার উপর তাঈমের সকল দায়িত্ব দিয়ে ছোটো বোনকে বগল দাবা করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল সে।
রিক্সা চলছে তার আপন গতিতে।উৎসুক দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিক দেখতে ব্যস্ত অর্থিকা। শেষ যেদিন রাতের শহরটাকে সে দেখতে বের হয়েছিল তখন তার পাশে ছিলো স্বামী তন্ময়। আর তাঈম ছিলো তার গর্ভে। জীবনের চড়াই উতরাই পেরিয়ে অবশেষে বাস্তবতাটা মেনে নিতে পেরেছে মেয়েটা। জীবনে মানুষ আসে ভালোবাসা নিয়ে তারপর একটা সময় তারা চলেও যায়। কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে চলে যায় আবার কেউ বা যায় অনিচ্ছাকৃত। তাই বলে কি সেই ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য সারাজীবন দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়িয়ে ঘর বন্দী করে রাখতে হবে নিজেকে? মোটেও নয়। ভালোবাসার প্রধান ধাপই তো হচ্ছে নিজেকে ভালোবাসা। যে নিজেকে ভালোবাসে না সে আসলে ভালোবাসতেই জানে না।
বোনের এই নির্লিপ্ত ভাবসাব দেখে বিরক্ত হলো অনুভা। শুধালো,“আচ্ছা আপু সত্যি করে বল তো আমরা যাচ্ছি কোথায়?”
“নতুন বাসা খুঁজতে।”
“এভাবে রিক্সায় ঘুরে ঘুরে?”
“বাসার খোঁজ আমি পেয়েছি। আজ শুধু দেখতে যাবো। পছন্দ হলে সব কথাবার্তাও না হয় বলে আসবো।”
পূর্বের ন্যায় চুপ করে গেলো অনুভা। কথা আর বাড়ালো না। কয়েক মিনিট বাদে রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়ল অর্থিকা। অনুভাও নামলো বোনের সাথে। ভাড়া দিয়ে হাঁটতে লাগলো তার পিছুপিছু।
কয়েক কদম হাঁটতেই পা জোড়া থামলো একটি মস্ত বড়ো বিল্ডিংয়ের সামনে। বাহিরে ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার টু-লেট ঝুলছে। অর্থিকার সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। ফাঁকা ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে দেখে পছন্দও হয়ে গেলো দু বোনের। একপর্যায়ে বাড়িওয়ালার সঙ্গে কথোপকথন সেরে সব ঠিকঠাক করে চলে এলো দুজনে। সামনের মাসের মাঝামাঝিতে গিয়েই উঠবে ওখানে।
_____________
রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এসে কেবল শুয়েছে শ্রাবণ। তখনি ঘরে প্রবেশ করল সৌহার্দ্য। শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের পাশাপাশি সেও শুয়ে পড়ল। তার উপস্থিতি টের পেতেই শ্রাবণ গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,“কী চাই এখানে?”
“তোকে চাই।”
সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ছোটো ভাইয়ের পানে তাকালো। তার এহেন দৃষ্টি দেখতেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সৌহার্দ্য। বললো, “বিয়ের পর তো আর চাইলেই আমরা দু ভাই একসঙ্গে শুতে পারবো না। বউরা তখন রাগ করবে। তাই আজ তোর সঙ্গে ঘুমাতে চলে এলাম।”
“মিথ্যে বলিস না। তোর মতলব একদম ভালো ঠেকছে না। নিজের ঘরে যা।”
শ্রাবণের সঙ্গে আরেকটু লেপ্টে গেলো সৌহার্দ্য। এক ফাঁকে চুমুও খেয়ে নিলো গালে। ছোটো ভাইয়ের এমন কাজে হতবাক, হতভম্ব শ্রাবণ। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলো। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো,“এই এই সত্যি সত্যি তো দেখছি তোর মতলব ভালো না! নিশ্চয়ই এমন কিছু চাইতে এসেছিস যা আমি কখনোই তোকে দিবো না। তাই না?”
উঠে বসলো সৌহার্দ্য। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। শ্রাবণ বাম ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধায়,
“তাহলে?”
“দেখ ভাইয়া, প্রান্তির কথা আমি সবার আগে তোকে বলেছি তাই না?”
“হুম, বলেছিস।”
“প্রান্তির ছবিও দেখিয়েছিলাম।”
“হুম তবে আমি খেয়াল করে দেখিনি।”
“সেটা তোর ব্যাপার। গতকাল সামনাসামনিও তো দেখলি।”
“মেইন টপিকে আয়।”
“তাহলে তুই কেন ভাবীর কথা আমায় বলিসনি?”
“না বললে জানলি কী করে তোর ভাবী আছে?”
দমলো না সৌহার্দ্য। নাদান বাচ্চাদের মতো বায়না ধরে বললো,“ছবিও তো দেখাসনি। দেখা না ভাইয়া একটা ছবি। কেমন দেখতে ভাবী? নাম কী তার? তোদের প্রেম কাহিনীটা অন্তত বল।”
“ছবি দেখে কাজ নেই। দেবর হচ্ছে মৃ’ত্যু সমতুল্য। তাই দূরে দূরে থাকবি বুঝলি? তাছাড়া তোদের মতো অসব লুতুপুতু প্রেম কাহিনী আমাদের মধ্যে নেই।”
মন ভার হলো সৌহার্দ্যের। বললো,“এভাবে বলতে পারলি ভাইয়া?”
“যা সত্যি তাই বললাম। বিয়ে হোক তারপর তো দেখতেই পারবি। এখন নিজের ঘরে যা।”
দমলো না সৌহার্দ্য। চট করে বালিশের পাশ থেকে তুলে নিলো বড়ো ভাইয়ের মোবাইল। শ্রাবণ নড়লো না। কিছু বললোও না। চুপচাপ দেখতে লাগলো তার কাণ্ড কারখানা। বিজয়ী হাসি হেসে মোবাইল অন করতেই মুখশ্রী থেকে হাসি বিলীন হলো সৌহার্দ্যের। মোবাইলটা লক করা।যথাস্থানে মোবাইল রেখে দিয়ে উঠে পড়ল বিছানা ছেড়ে। দরজার দিকে অগ্ৰসর হতে হতে অভিমানী স্বরে বললো,“তুই সত্যিই একটা নেমকহারাম ভাইয়া। এভাবে ছোটো ভাইয়ের থেকে সবকিছু লুকিয়ে গেলি না? সবকিছু আমি মনে রেখে দিলাম। পই পই করে হিসেব রাখলাম।”
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। গলা উঁচিয়ে বিপরীতে বললো, “তুই যেই ভুলোমনা কাল সকাল পর্যন্ত মনে থাকবে কিনা সন্দেহ। এক কাজ কর, ঘরে গিয়েই ডায়েরিতে সব লিখে রাখ।”
__________
গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি অনুভার।অফিসে বসে থাকলেও মন পড়ে আছে সেই বিছানায়। চোখ জ্বলছে ঘুমে। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো বেশ কয়েকবার। লাঞ্চ টাইম আসতে এখনো ধের দেরি। এই মুহূর্তে এক কাপ কড়া লিকারের চা হলে মন্দ হতো না। অনন্ত ক্লান্তিটা তো দূর হতো।
ভাবনা থেকে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল অনুভা। তখনি টেবিলের ফাঁকা স্থানে কেউ চা ভর্তি একটি চায়ের কাপ এনে রাখলো। তৎক্ষণাৎ চমকে উঠলো সে। ঘাড় উঁচিয়ে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো আজগরকে। পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো লোকটি। বললো,“আপনে কাজে অমনোযোগী ম্যাডাম। তাই স্যার কইছে চা খাইয়া শরীর চাঙ্গা কইরা কাজে মন দিতে।”
কথাটা শেষ করে প্রস্থান করলেন আজগর। ভিতু হলো অনুভার মন। আশেপাশে তাকিয়ে এবার তাকালো সম্মুখে লাগানো সিসি ক্যামেরার পানে। খুব রাগ হলো নিজের উপর। জেনেবুঝে এই ভুলটা করল কী করে সে?কে জানে স্যার কী মনে করছেন? ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে চায়ের কাপে চুমুক বসালো অনুভা। সকল ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে মনোযোগ বসালো কাজে।
পুরো বিষয়টি খুব ভালো করেই পর্যবেক্ষণ করল তানিম। মেয়েটির ভাবুক দৃষ্টি দেখতেই মুচকি হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,“আপনি এমন কেন অনুভা? খুব অদ্ভুত এক নারী। নারীদের কী এমন অদ্ভুত আচরণে মানায়?”
পুরো একটা দিন পেরিয়ে রাত হলো। সকল কাজের অবসান ঘটিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ হাতে চেয়ার ছেড়ে টানটান হয়ে দাঁড়ালো অনুভা। বের হলো অফিস থেকে। সবসময়কার মতো একই স্থানে দেখা পেয়ে গেলো বড়ো আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির। হাত ভাঁজ করে গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। মুখশ্রীর ভঙ্গি অত্যন্ত স্বাভাবিক। সহাস্যে তার দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। আজও সপ্তাহ খানেক পর দুজনার দেখা হলো। কোনো ভণিতা ছাড়াই পুরুষটির উদ্দেশ্যে সে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “সবসময়ই সপ্তাহে একদিন আমাদের দেখা হয়। দেখা হওয়ার পর টানা সাতদিন তুমি আমার সামনে আসো না। কিন্তু আমি জানি রোজ তুমি আমায় দেখো, আমার খেয়াল রাখো। এবার প্রশ্নটা হচ্ছে এমন করে কী মজা পাও বলো তো?”
প্রশ্নটি করে থামলো অনুভা। উত্তরের আশায় বিপরীতে দাঁড়ানো পুরুষটির মুখশ্রীতে গাঢ় দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে রইলো। চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। উত্তরে বললো, “তোমাকে আমার অনুপস্থিতি সম্পর্কে ভাবাতে। তোমার মনে আমাকে এক নজর দেখার ব্যাকুলতা সৃষ্টি করতে।”
থামলো শ্রাবণ। সেকেন্ড দুয়েক বিরতি নিয়ে বাম ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা ঝুঁকলো অনুভার দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তা আমার উদ্দেশ্যে কী আমি সফল হতে পারলাম? আমার নোভা রাণী কী আমায় মিস করেছে?”
অপ্রস্তুত হলো অনুভা। আশেপাশে অপ্রয়োজনে তাকালো। প্রসঙ্গ বদলাতে বললো,“আজকে অনেক ঠাণ্ডা পড়েছে তাই না?”
“তা তো অবশ্য পড়েছেই।এমন একটা আবহাওয়াতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় রোজ তোমায় খুব মিস করি। তুমি পাশে থাকলে হয়তো এই ঠাণ্ডার মধ্যে আমাকে কোলবালিশ ধরে শুয়ে থাকতে হতো না।”
ছেলেটার কথাবার্তা দিনদিন লাগাম ছাড়িয়ে যাচ্ছে। রাগ হলো অনুভার। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,“অসভ্য একটা।”
হাসিটা চওড়া হলো শ্রাবণের। বললো,“জানো?আমার ছোটো ভাই না তোমার উপর চরম ক্ষীপ্ত।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই অবাক হলো অনুভা।ছেলেটার যে একটা ভাইও আছে সে বিষয়ে আজ প্রথমই জানলো সে। তার উপর সেই ভাই তার উপর কেন রাগ করবে? আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে শুধালো,“কেন? আমি আবার কী করলাম?”
“অবশ্যই করেছো। তোমার জন্যই তো ও ওর বউকে ঘরে তুলতে পারছে না।”
“আমার জন্য! আমি তো তোমার ভাইকে কখনো দেখলামই না। সেখানে ওর বউ কোত্থেকে এলো?”
“দেখোনি তো কী হয়েছে? ও একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বাবা-মা ওদের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নিয়েছে কিন্তু বিয়েটা আটকে আছে।”
“কেন আটকে আছে?”
“কেন আবার? বিবাহযোগ্য বড়ো ভাই রেখে ছোটো ভাইয়ের বিয়ে? আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী তো রীতিমতো কুটনৈতিক বৈঠক বসিয়ে দিবে।”
“তাহলে এখানে আমার উপর কেন ক্ষীপ্ত হলো? দোষ তো তোমার। তুমি বিয়ে করে নাও তাহলেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।”
এতক্ষণ যেনো এ কথাটা শোনার জন্যই ভেতরে ভেতরে ওৎ পেতে ছিলো শ্রাবণ। চট করে বললো,“অবশ্যই তোমার দোষ। আমি কী চাইছি না বিয়ে করতে? অবশ্যই চাইছি। বউ ছাড়া এত দীর্ঘ রাত কাটাতে আমার কষ্ট হয়। আমি তো সেই কবে থেকেই তোমাকে বলে যাচ্ছি আমায় বিয়ে করো নোভা, আমায় বিয়ে করো। কিন্তু তুমিই তো করছো না। সেক্ষেত্রে সব দোষ তোমার।”
ভেতরে ভেতরে অনুভূতিরা তাণ্ডব চালালেও বাহির থেকে নিজেকে কঠোর রাখলো অনুভা। বললো,
“তুমি এমন অধৈর্যশীলদের মতো কেন করছো বলো তো? আমাদের মধ্যে কিছু হতে পারে না। পরিবার যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে তাকেই বিয়ে করে সুখী হও।”
কথাটা মোটেও গুরুত্ব সহকারে কানে তুললো না শ্রাবণ। ভাবলেশহীন বললো,“আমাদের একে অপরের সুখ যে আমাদের দুজনার মধ্যেই নিহিত নোভা। অন্য কারোর সঙ্গেই যদি নিজেকে বাঁধতে পারতাম তাহলে এতকিছুর পরেও কী আর ফিরে আসতাম? তাছাড়া আমার মতো লয়্যাল ছেলে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে তুমি দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাবে না। বুঝলে?”
আহত দৃষ্টিতে তাকালো অনুভা। এই পুরুষটির জন্য আকাশসম অনুভূতির পাহাড় যে অনেক আগে থেকেই তার ভেতরে রয়েছে। বারবার তাকে ফিরিয়ে দিতেও ভীষণ কষ্ট হয় অনুভার। কিন্তু সব বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকতে হয় তাকে। ভবিষ্যৎ ভেবে ভিতু হয় তার মন। শ্রাবণের বাবা-মা তাদের সম্পর্কে সব জানার পর আদৌও কী তাকে পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নিবেন?
তাকে ভাবনার অন্তর্জালে ডুবে যেতে দেখে গাড়ির দ্বার খুলে দিলো শ্রাবণ। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“উঠে বসো।”
ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার। নিরবে উঠে বসলো গাড়িতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজ গতিতে চলতে শুরু করল গাড়ি। এতক্ষণ ধরে এই কপোত কপোতীকে দূর থেকেই খুব গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে গেলো এক জোড়া চোখ। রোষানলে ফেটে পড়ল তার সমস্ত দেহ। শক্ত কণ্ঠে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে আদেশ ছুঁড়লো,“স্টার্ট দাও।”
মালিকের এমন কণ্ঠস্বরের সঙ্গে পূর্ব পরিচিত মাঝ বয়সী ড্রাইভার। শুকনো ঢোক গিলে দ্রুত হাতে স্টেয়ারিং ঘুরালো।
সবসময়কার মতো দক্ষ হাতে গাড়ি চালাচ্ছে শ্রাবণ। পাশেই বসা অনুভা। কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই ফের প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তুমি আপুকে চাকরির সন্ধান দিয়েছো?”
শ্রাবণের সোজাসাপ্টা জবাব,“হ্যাঁ।”
“এটা করার কী খুব প্রয়োজন ছিলো?”
“অবশ্যই ছিলো।”
“কেন? অতীত থেকে সবে আপু বেরিয়ে এসেছে। মুভ অন করেছে, তার মধ্যেই মাথার মধ্যে চাকরির ভূতটা ঢুকানোর কোনো প্রয়োজন তো আমি দেখছি না। তাছাড়া আমিই তো সবটা সামলাচ্ছিলাম।”
“চাকরির ভূত আমি ঢুকাইনি। উনি নিজেই হয়তো এ বিষয়ে ভেবেছেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমি শুধু হেল্প করেছি ব্যস। তোমার উচিত উনার সিদ্ধান্তকে সম্মান করা। অন্যের উপর বোঝা হয়ে থাকার থেকে নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়া ভালো নয় কী?”
কথাটা মোটেও আশা করেনি অনুভা। আহত হলো তার মন। মিনমিনে স্বরে বললো,“আমার মা বোন এবং বোনের সন্তান আমার কাছে বোঝা নয়। তারা আমার আপনজন। তাদের দেখভাল করা আমার দায়িত্ব।”
“অমন ইঙ্গিতে কথাটা বলিনি নোভা। কষ্ট পেও না। চিরকাল কী কেউ থাকে এই পৃথিবীতে?আরেকজনের উপর নির্ভর হওয়ার থেকে নিজেরই একটা কিছু করা উচিত নয় কী? উনি তো ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তুমি যেভাবে জব করছো সেভাবেই করো। পরিবারের দায়িত্ব পালন করো। পাশাপাশি আপু যা করছেন তা উনাকে করতে দাও। এতে উনার উপকারই হবে।”
কথাটা মন দিয়ে শুনলো অনুভা। অনুধাবন করার চেষ্টা করল। কিছু সময়ের মধ্যে শ্রাবণের কথাটার অর্থ ধরেও ফেললো। তাই আর কথা বাড়ালো না। মেনে নিলো সবটা।
চলবে __________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২২]
কুয়াশার ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ এসে আলোকিত করে তুলেছে ধরণীকে। বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে প্রভাতটা উপভোগ করছে অনুভা। দেখতে দেখতে আরো একটি মাস কেটে গেলো। গতকালই পরিবার নিয়ে নতুন ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে দু বোন। এখনো পুরোপুরি ভাবে গোছগাছ করা হয়নি কিছুই। শুধু মায়ের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরটাই গুছিয়ে উঠতে পেরেছে দুজনে।
আজ শুক্রবার। আজ আর বাজার করতে বের হয়নি অনুভা। অর্থিকা বাজারে যেতে নিষেধ করেছে তাকে। আজ অনেকদিন বাদে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে অনুভার। মাথায় নেই কোনো চিন্তা, দেহে নেই ক্লান্তির ছাপ। এই মুহূর্তে বাবাকে খুব মনে পড়ছে তার। আচ্ছা বাবা কেমন আছে কবরে? প্রশ্নটা মস্তিষ্কে হানা দিতেই মন ভার হয় অনুভার। চায়ের কাপ খালি হয়েছে অনেকক্ষণ হলো। বারান্দা থেকে উঠে ঘরে ফিরে এলো সে। আগের ফ্ল্যাটের তুলনায় নতুন ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ো আর খোলামেলা। ঘরগুলো জুড়েও শুধু আলোর খেলা।
সুফিয়া বিছানায় শুয়ে আছেন। আগের সেই তেজ এখন আর অবশিষ্ট নেই উনার মধ্যে। স্বামীর মৃ’ত্যুর পর প্রাণহীন নির্জীব হয়ে গেছেন ভদ্রমহিলা। কারো সঙ্গে তেমন কথা বলেন না আর।
তাঈম মেঝেতে বসে খেলনা নিয়ে খেলছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুখ দিয়ে আওড়াচ্ছে অস্পষ্ট কিছু শব্দ। অনুভা এসে বসলো তার সম্মুখে। তাকে দেখতেই চঞ্চল হয়ে উঠলো তাঈম। হাতের খেলনা গাড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“মা, মা, খেলু খেলু।”
মুচকি হাসলো অনুভা। খেলনা গাড়ি না নিয়ে নিজ কোলে বসালো তাঈমকে। গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে বললো,“মা না খালামণি বল।”
কথাটা কিছুতেই মনঃপুত হলো না ছোট্ট তাঈমের। গলা জড়িয়ে ধরে বললো,“মা আমা মা।”
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অনুভা। তার হাসির শব্দে ভেতর ঘর থেকে ছুটে এলো অর্থিকা। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে বোন আর ছেলেকে গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,“কী হলো এভাবে হাসছিস কেন অনু?”
বোনের প্রশ্নে যেনো বেশ মজা পেলো অনুভা। অধরে হাসি রেখেই জবাব দিলো,“তোর ছেলে একটু একটু করে হাঁটতে শিখে গেছে কিন্তু এখনো আমাকে মা বলে ডাকা ভুলেনি। আমি বললাম মা না খালামণি বল কিন্তু ও কী বলে জানিস?”
ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয় অর্থিকার। শুধায়,“কী?”
সরাসরি উত্তর দেয় না অনুভা। প্রমাণ দেখাতে হবে। তাই ফের তাঈমের পানে দৃষ্টি ফেলে শুধায়,“আমি তোমার কী হই বাবাটা?”
প্রশ্নের বিপরীতে সঙ্গে সঙ্গে অবুঝ বাচ্চাটির থেকে উত্তর এলো,“মা মা।”
আবারো হেসে উঠলো অনুভা। তাকে জড়িয়ে ধরলো বুকের সঙ্গে। আজ আর রাগলো না অর্থিকা। সেও হেসে দিলো ছোটো বোনের সঙ্গে। হাস্যজ্জ্বল মুখে বললো,“তোর মা হওয়ার তো খুব শখ দেখছি রে অনু! তোর এই শখটা পূরণের জন্যই এবার আমি তোকে বিয়ে দিয়ে দিবো।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই মেঝেতে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠলো। উঁকি দিয়ে স্ক্রীনে ভাসমান ‘শ্রাবণ’ নাম দিয়ে সেভ করা নাম্বারটা দেখে মুচকি হাসলো অর্থিকা। ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,“ওই যে বিয়ের কথা বলতে না বলতেই বাচ্চার ভবিষ্যৎ বাপ কল দিয়ে দিলো। কী টাইমিং রে বাব্বাহ্!”
বড়ো বোনের কথাটা শ্রবণালী ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই লজ্জায় ফর্সা গাল দুটোতে রক্তিম আভা ফোটে উঠলো অনুভার। তাঈমকে খেলনা দিয়ে মেঝেতে বসিয়ে রিসিভ করল কল। সবসময়কার মতো আজও তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বিপরীত পাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠস্বর,
“তোমার তো দিনে দিনে খুব অবনতি হচ্ছে নোভা! রুটিন মাফিক আজ তোমার বাজার করার কথা ছিলো কিন্তু তুমি বাজার করতে এলে না।এটা কী ঠিক করলে? এই এই তুমি কী এখন আমাকে তোমার বাজার করার কেয়ার টেকার বানাতে চাইছো নাকি?”
একসঙ্গে এতগুলো কথা শোনার পর হতভম্ব হয়ে গেলো অনুভা। কিয়ৎ নিরব থেকে তার স্বরেই বললো,“তুমি তো আমার বডি গার্ড। বডি গার্ডের পদ ছেড়ে আবার কেয়ার টেকার হতে চাইছো?”
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। কিন্তু তা প্রকাশ করল না বরং পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠেই বললো,“তুমি আমায় বডি গার্ড বলতে পারলে নোভা?”
“তো কী বলবো? যেভাবে সারাক্ষণ আমার খবরা খবর রাখো তাতে তো আমার এমনটাই মনে হয়।”
“জামাই না হয়েও জামাইয়ের মতো তোমায় আগলে রাখি আর তুমি কিনা আমার সম্পর্কে এমনটা ভাবলে? ছিহ্।”
নিঃশব্দে হাসলো অনুভা। এ যেনো সেই পুরোনো শ্রাবণ। সবকিছু বদলালেও এই ছেলেটার আচার ব্যবহার একটুও বদলায়নি। তার হাসি দেখতেই তাঈমও হেসে উঠলো। আদো আদো বুলি ছুঁড়লো,“মা মা আমা তাতে খেলু।”
পুরো কথাটাই স্পষ্ট শুনতে পেলো শ্রাবণ। প্রশ্ন করল,
“বাচ্চাটা কে? তাঈম?”
“হুম।”
“অর্থি আপু কী তোমার পাশেই?”
“না, আপু তার ঘরে।”
“তাহলে মা বলে কাকে ডাকে?”
“কাকে আবার? আমায় ডাকে।”
ললাটে ভাঁজ পড়ে শ্রাবণের। কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে কিছু একটা ভেবে উঠতেই হেসে ওঠে। বলে,
“বাহ নোভা! বিয়ের আগেই মা ডাক শোনা হয়ে গেছে তোমার? আমি তবে বাদ যাবো কেন? দাঁড়াও আমি বরং আমার ফটো পাঠাচ্ছি।”
ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে যায় অনুভার।শুধায়,“কেন?
তোমার ফটো দিয়ে আমি কী করবো?”
“কেন আবার?তাঈমকে দেখিয়ে বাবা ডাক শেখাবে, পরেরবার দেখা হলেই বাবা ডেকে আমার কোলে চলে আসবে ও।”
“অন্যের বাচ্চার থেকে বাবা ডাক শোনার এত শখ কেন হ্যাঁ? পারলে নিজে একটা পয়দা করে নাও।”
কথাটা মনঃপুত হলো শ্রাবণের। কণ্ঠে খেলে গেলো দুষ্টুমি। বললো,“এই জন্যই বলেছিলাম চলো বিয়ে করে নেই। তারপর না হয় বাচ্চা পয়দা করার কাজকর্ম শুরু করবো।”
ছেলেটার এমন লাগামহীন কথায় থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। বেশ লজ্জাও পেলো। দাঁতে দাঁত চেপে ‘অসভ্য’ বলেই কেটে দিলো কল। এতক্ষণের আটকে রাখা হাসিটা এবার বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পেলো শ্রাবণের। হাসতে হাসতে বিছানায় মোবাইল রেখে ঘর থেকে বের হলো সে।
টেবিলে বসে চপিং বোর্ডে তরকারি কাটছেন শান্তা।মায়ের পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো শ্রাবণ। ছেলেকে দেখতেই মুখ বাঁকালেন শান্তা।আফসোসের সুরে বলতে লাগলেন,“কী কপাল আমার!যেই বয়সে ছেলের বউয়ের হাতের রান্না খাওয়ার কথা সেই বয়সে নিজে রান্না করে খেতে হচ্ছে। কী লাভ হলো দু দুটো ছেলের মা হয়ে? এর থেকে যদি মেয়ে হতো তাহলে অন্তত এতদিনে ডজন ডজন নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খেলতে পারতাম।”
মায়ের কথায় আড়ালে হাসলো শ্রাবণ। তবে সামনাসামনি গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আজ শুক্রবার, তোমরা চাইলে কিন্তু আজ আমার বিয়েটা দিয়ে দিলেই পারতে মা। তাহলে অন্তত তোমার দুঃখ কষ্ট ঘুচতো।”
হাত থেমে গেলো শান্তার। পূর্ণ দৃষ্টিতে পুত্রের পানে তাকালেন। ডান ভ্রু টা উঁচিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে শুধালেন,“মেয়ে রাজি?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। তৎক্ষণাৎ চোখেমুখে উৎসুক একটা ভাব ফোটে উঠলো শান্তার। আহ্লাদী কণ্ঠে পুনরায় শুধালেন,“দেখতে কেমন? সুন্দর?”
“কেন? সুন্দর না হলে বুঝি পুত্রবধূ হিসেবে মানবে না?”
“তা হবে কেন? আমার ছেলের পছন্দের উপর আমার পুরোপুরি ভরসা আছে। সে আমার অপছন্দ হবে এমন মেয়েকে কখনোই পছন্দ করতে পারে না।”
প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো শ্রাবণ। শান্তা বললেন,“তোর বাবাকে গিয়ে বলি তবে?”
“কী?”
“এই যে তুই বিয়ে করবি। তোর কোনো চিন্তা নেই। যা ব্যবস্থা করার আমি আর তোর বাবা মিলে করবো। দরকার পড়লে আজ রাতেই বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবো।”
এবারও চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। মা যে তার বউ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে তা বেশ বুঝতে পারলো। বললো,“বাবাকে বলে দিয়েছি, বিয়ে করলে পরের শুক্রবারই করবো।”
মুখখানি মলিন হলো শান্তার। টেনে টেনে বললেন,
“আরো সাত দিন পর! বাঁচবো এ কদিন?”
“বাঁচবে না কেন? নাতি নাতনি নিয়ে খেলতে হবে না?”
মুচকি হাসলেন শান্তা। বললেন,“তা তো হবেই। যাক এত বছর অপেক্ষা করেছি আর সাতদিন অপেক্ষা করতে পারবো না? অবশ্যই পারবো।”
________
শীতকালে সন্ধ্যাটা খুব দ্রুতই নেমে পড়ে। তবে এখন বিকেল। আসরের নামাজ পড়ে ছাদে এসেছে অর্থিকা। দুপুরে তাঈমের কিছু কাপড় ছাদে দিয়ে গিয়েছিল শুকাতে, এখন সেগুলো নেওয়ার উদ্দেশ্যেই এখানে আসা। কয়েকটা ফ্ল্যাটের মহিলারা একপাশে বসে গল্প করছে। অন্যপাশে চলছে বাচ্চাদের হইচই।
দ্রুত পদে কাপড়গুলো দড়ি থেকে নামিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে যাওয়ার পথেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠলো,“অর্থিকা!”
সিঁড়ির মাঝখানেই থেমে দাঁড়ায় অর্থিকা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হয়। দৃষ্টিগোচর হয় ছাদের দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুরুষকে। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই অর্থিকার মনে হলো এই পুরুষটিকে সে চেনে। তার ভাবনার মধ্যেই এগিয়ে এলো লোকটি। বললো,“অনেকগুলো বছর বাদে দেখা হলো আমাদের তাই না?”
সৌজন্য হাসলো অর্থিকা। বললো,“হুম। তা তুমি এখানে? ছাদে তো চোখে পড়ল না। এখানেই থাকো নাকি?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় ফায়াজ। প্রশ্ন করে,“তোমরাই নতুন ভাড়াটিয়া তাই না?”
“হ্যাঁ।”
কথার প্রসঙ্গেই প্রশ্ন ছুঁড়ে ফায়াজ,“শুনেছিলাম বিয়ে করে নিয়েছিলে? তা ছেলে-মেয়ে কজন?”
“একটাই ছেলে, তা একদিন এসো না। একই বিল্ডিং এ থাকছি তার উপর পরিচিত। এখন তো আবার প্রতিবেশীও হয়ে গেলাম।”
প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো ফায়াজ। অর্থিকা তাড়া দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো,“চায়ের দাওয়াত রইলো কিন্তু।”
“গ্ৰহণ করলাম তোমার দাওয়াত।”
ঘাড় ঘুরিয়ে হেসে নিচে নেমে গেলো অর্থিকা।ফায়াজ এখনো সেদিক পানেই তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে বললো,“গ্ৰহণ করলাম তোমার দাওয়াত। নিয়তি যখন আবারো দুজনকে সম্মুখে দাঁড় করিয়েই দিলো তখন আমারও তো দেখা উচিত কার কপালে স্রষ্টা তোমায় লিখে রেখেছিলেন।”
কাপড় নিয়ে ভেতরে এসে দরজা লাগালো অর্থিকা। সোফার উপর কাপড়গুলো রেখে ডেকে আনলো অনুভাকে। তারপর দুজনে মিলে আবারো শুরু করল ঘর গোছানো। আজকের মধ্যেই সব কমপ্লিট করতে হবে। কাল থেকে যে অফিস শুরু। অর্থিকাও তো চাকরিতে জয়েন করেছে মাস খানেক হবে।
_______
একটি রাত কেটে নতুন আরেকটি দিনের সূচনা ঘটলো। তানিম বাড়িতে নেই। রোজকার রুটিন মাফিক অফিসে সে। পল্লবী ভবনে শোনা যাচ্ছে একজন নারী কণ্ঠস্বরের চেঁচামেচি। রোজিনাকে বিভিন্ন কাজের নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। কাজগুলো মনঃপুত না হওয়ায় খানিক বাদে বাদেই বিরক্ত হয়ে বলছেন,“এটা এভাবে করছিস কেন? এভাবে হবে না, ওভাবে কর।”
রোজিনা মেয়েটা পড়েছে মহা ঝামেলায়। মালকিনের কথামতো বারবার কাজের ধরণ বদলাচ্ছে সে। আজিজুল হক এসে উপস্থিত হলেন স্ত্রীর সম্মুখে। বললেন,“এভাবে না বলে কয়ে হুটহাট মেয়ে দেখতে যাওয়াটা কী ঠিক হবে? উনাদের তো আগে জানানো উচিত তাই না?”
স্বামীর কথাটা পছন্দ হলো না আফসানার। বললেন, “কাকে জানাবে? ছেলে তো বললোই মেয়ের পরিবার সম্পর্কে। আমরা যাবো ওর মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে চলে আসবো।”
মন সায় দিলো না আজিজুল হকের। আমতা আমতা করে বললেন,“কিন্তু।”
“কোনো কিন্তু নয়, ছেলেটা নিজ থেকে এসে বিয়ে করতে চাইছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা দিয়ে দেওয়া উচিত। পরে আবার মত বদলে গেলে?”
স্ত্রীর কথায় সম্মতি জ্ঞাপন করলেন আজিজুল হক।
আজকে তানিমের মেজাজটা খুব ফুরফুরে। এই ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই দু দুটো মিটিং শেষ করে নিজ চেয়ারে এসে বসে আছে সে। সিসি ক্যামেরায় দৃষ্টি স্থির রেখে মুচকি হাসলো। তারপর আবারো সরিয়ে নিলো নিজ দৃষ্টি। টেবিলের উপর রাখা বেলটা বাজাতেই ছুটে এলেন আজগর। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার উদ্দেশ্যে তানিম বলে উঠলো,“মিস.অনুভাকে পাঠিয়ে দিন।”
উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যায় আজগর। অনুভার টেবিলের সামনে এসে আহত স্বরে প্রশ্ন করে,“আইচ্ছা ম্যাডাম আপনে দুইদিন পরপর এতো অন্যায় করেন ক্যান কন তো?”
মনোযোগ সহকারে কাজ করছিল অনুভা।আজগরের কথায় ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে তাকায়। শুধায়,“আমি আবার কী করলাম?”
“তা আমি কী জানি? ঘাড়ের রগ কাটা স্যার আপনেরে আবার ডাকছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে তানিমের কেবিনে পা বাড়ায় অনুভা। ভেতরে প্রবেশ করে অনুমতি নিয়ে। চোখেমুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তানিম প্রশ্ন ছুঁড়ে,“যেই কাজগুলো দিয়েছিলাম তা কমপ্লিট হয়েছে?”
“পুরোপুরি শেষ হয়নি স্যার, আর আধ ঘণ্টা সময় লাগবে।”
“ঠিক আছে, কাজটা শেষ হলে আজগরকে দিয়ে আমায় পাঠিয়ে দিবেন।”
“ওকে স্যার।”
“এরপর তো আপনার আজ আর কোনো কাজ নেই সম্ভবত। তাই চাইলে আপনি চলে যেতে পারেন। আপনার ছুটি।”
চমকায় অনুভা। কথাটা যেনো বিশ্বাস হলো না। তাই ফের শুধায়,“জ্বি স্যার? ছুটি?”
“হ্যাঁ, কেন কোনো আপত্তি আছে?”
“না স্যার। ধন্যবাদ আপনাকে।”
বলেই সেখান থেকে নিজ ডেস্কে চলে এলো অনুভা। তার হাস্যজ্জ্বল মুখখানা দেখতেই তানিমের গম্ভীর মুখখানাতেও ফোটে উঠলো হাসির রেখা।
________
পাশের ফ্ল্যাটের পৌঢ় ভাড়াটিয়ার সঙ্গে কথা বলে নতুন একজন আয়া ঠিক করেছে অর্থিকা। বাড়িতে এখন সুফিয়া, তাঈম এবং সেই নতুন আয়া মাজেদা। কলিং বেল বাজার শব্দ কানে আসতেই ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে দরজা খুলে দিলো মাজেদা। অনুভা অফিসে যাওয়ার আগে কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়ে গেছে,“আমি কিংবা আপু ব্যতীত অন্য কেউ এলে কিন্তু একদম দরজা খুলবে না আর ভেতরেও ঢুকতে দিবে না। ঠিক আছে?”
দরজার সামনে দাঁড়ানো তিনজন অপরিচিত মানুষ দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো মাজেদা। কর্কশ কণ্ঠে বললো,“আপারা বাড়িত নাই। আইতে আইতে রাইত হইবো। কোনো দরকার হইলে তহন আইয়েন।”
আফসানা মৃদু হেসে কোমল গলায় বললেন,“তোমার আপাদের মাও কী বাড়িতে নেই?”
“খালার কথা কইতাছেন?”
না বোঝেও মাথা নাড়ালেন আফসানা। মাজেদার চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ। প্রশ্ন করল,“আমনেরা কী লাগেন চাচীর?”
“কিছু হই না তবে তুমি আমাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিয়ে উনাকে ডেকে দিলে ভালো একটা সম্পর্ক হতে পারে।”
কথাটার অর্থ খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো মাজেদা। হেসে বললো,“আপনেরা ঘটক? ছুডু আপার লাইগ্গা সম্বন্ধ আনছেন?”
মেয়েটা চালাক চতুর যা খুব ভালো করেই টের পেলেন আফসানা। উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। তৎক্ষণাৎ দরজা ছেড়ে ভেতরে হাঁটা ধরলো মাজেদা।ড্রয়িং রুমের সোফা দেখিয়ে বললো,“আপনেরা বসেন আমি খালারে ডাইক্কা আনি।”
আজিজুল হক আর আফসানা বসলেন সোফায়। সাথে আসা ড্রাইভার ছেলেটা মিষ্টির প্যাকেটগুলো সেন্টার টেবিলের উপর রেখে চলে গেলো গাড়ির কাছে।
তাঈমকে নিজের পাশে ঘুম পাড়িয়ে রেখে নিজেও চোখ বন্ধ করে আছেন সুফিয়া। ভেতরে প্রবেশ করল মাজেদা। নিজ স্বরে বললো,“খালা ঘুমাইয়া গেছেন নাকি?”
সুফিয়া চোখ মেলে তাকালেন। বললেন,“না ঘুমাইনি। কিছু বলবে?”
“হ খালা। ছুডু আপার লাইগা সম্বন্ধ আইছে।”
কথাটা শুনতেই টনক নড়ে উঠলো সুফিয়ার। কিছুটা সময় নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলেন। প্রশ্ন করলেন,
“অনুর জন্য সম্বন্ধ এসেছে?”
“হ খালা। তাড়াতাড়ি চলেন। হেরা বসার ঘরে বইসা আছে।”
বড়ো আশ্চর্য হলেন সুফিয়া। এখানকার কাউকেই তো চেনেন না উনারা।সেখানে মেয়ের জন্য সম্বন্ধ কোত্থেকে এলো? কে নিয়ে এলো? এসব ভাবতে ভাবতেই ব্যথাযুক্ত পা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। পরনের শাড়ি ঠিক করে ঘোমটা টেনে বাহিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। মাজেদাকে বলে গেলেন,“তাদের জন্য চা বিস্কিটের ব্যবস্থা করো।”
মাজেদা মাথা নাড়ালো।তার আগে কল দিলো অর্থিকার নাম্বারে। কথাটা তো দু বোনের একজনকে জানাতে হবে নাকি? যার জন্য সম্বন্ধ এসেছে তাকে জানানো উচিত হবে না তাই বড়ো বোনকেই কল বসালো মাজেদা।
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)