#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৯]
রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধরণীতে ঘটেছে শীতের তাণ্ডব। দুপুরের খানিক পরে গ্ৰাম থেকে রওনা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেছে অনুভাদের। ঘণ্টা খানেক আগেই তারা বাড়ি এসে পৌঁছেছে। যদিও চাচা-চাচীরা কিছুতেই আসতে দিতে চাইছিল না তাদের তবুও সেসব অনুরোধের তোয়াক্কা না করেই মাকে নিয়ে দুই বোন ফিরে এসেছে নিজেদের বর্তমান আবাসস্থলে।
এই শীতের রাতেই ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল সেরে সোফায় এসে বসলো অনুভা। শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লেগেছে খিদে। গতকাল থেকে পেটে তেমন ভারি কিছু পড়েনি।বাবার মৃ’ত্যু শোকে খেতেও পারেনি ঠিকমতো। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। মস্তিষ্ক জানান দিলো ওদিকে মা আর বোনও যে তার মতোই অভুক্ত রয়েছে। তাদেরও নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?
ক্লান্ত দেহখানাকে টেনে নিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করল অনুভা। রঙচটা ফ্রিজটা খুলে ভেতরে কী কী আছে দেখতে লাগলো। বেশি কিছু রান্না করার মতো শক্তি শরীরে আর অবশিষ্ট নেই। ফ্রিজ থেকে ডিম বের করে চুলার ধারে রাখলো। ফেরার পথে সেই যে তাঈম ঘুমিয়েছে এখনো ভাঙেনি তার সেই ঘুম। ঘুম ভাঙলেই খিদের চোটে কান্না শুরু করে দিবে ছেলেটা। তাই গুঁড়ো দুধের প্যাকেটটা সর্বপ্রথম হাতে নিলো অনুভা। আগে দুধ আর সুজি জাল দিবে তারপর বাকি কাজ।
দুধ জাল দিয়ে তা ফিডারে ভরে সুজির পাতিল বসালো চুলায়। তখনি কলিং বেল বাজার শব্দ হলো। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। এত রাতে কে এলো? কোমরে বাঁধা ওড়নাটা দিয়ে ভালো করে মাথা ঢেকে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। লুকিং হোলে চোখ রাখতেই দেখা মিললো অপরিচিত এক যুবকের। বিষ্মিত হলো অনুভা। ছেলেটির মুখশ্রী তার নিকট সম্পূর্ণ অচেনা। তাই দরজা খোলার আর সাহস হলো না। বাড়িতে তিন তিনটে মেয়ে তারা। নেই কোনো পুরুষ মানুষ। দরজা খোলা কিছুতেই যে উচিত হবে না তা বুঝে গেলো অনুভা। দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গলা উঁচিয়ে শুধালো,“কে আপনি? কাকে চাই?”
লোকটি ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিলো,“ম্যাডাম পার্সেল ছিলো একটা।”
“কীসের পার্সেল? কার পার্সেল?”
“অনুভা ম্যাডামের নামে পার্সেল।”
“কী আছে ওতে? আমি তো কোনো কিছু অর্ডার দেইনি। তাহলে কে পাঠিয়েছে?”
“কী আছে তাতো জানি না তবে স্যার আপনাকে দিতে বলেছেন।”
“কোন স্যার?”
যুবকটি প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললো,“ম্যাম আমার তাড়া আছে। পার্সেলটা একটু দ্রুত নিলে ভালো হতো।”
বিরক্ত হলো অনুভা। সাথে ভীষণ ভয়ও হলো।দিনকাল ভালো নয়। দরজা খোলাটা কী ঠিক হবে? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে ভুগতেই অপরপাশ থেকে আবারো ডাক এলো। জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো অনুভা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“দরজার কাছে পার্সেল রেখে আপনি চলে যান। আমি পরে নিয়ে নিবো।”
যুবকটি আর দ্বিমত করল না। তার কথা অনুযায়ী সেখানেই প্যাকেট রেখে বিদায় নিলো। লুকিং হোলে পুরো দৃশ্যটা দেখে নিয়ে মিনিট চারেক অপেক্ষা করে তারপর দরজা খুললো অনুভা। একটা শপিং ব্যাগ দেখে ভারি অবাক হলো সে। চটজলদি ব্যাগ হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকে আটকে দিলো দরজা।
কী আছে ব্যাগে? কেই বা পাঠালো? মনের গহীনে অসংখ্য প্রশ্ন রেখে ব্যাগ খুলতেই মারাত্মক বিষ্ময়ে বসে পড়ল অনুভা। কয়েকটা খাবারের টিফিন বক্স। নিজেকে সামলে নিয়ে খাবার টেবিলের উপর নিয়ে সেগুলো রাখলো। একে একে বক্স খুলতেই দেখতে পেলো গরম গরম রুটি, দু পদের রান্না করা সবজি আর দেশি মুরগি ভুনা। সাথে পেলো একটি চিরকুট। তাতে স্পষ্ট বাক্যে লেখা,“এত রাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রান্না করার কোনো প্রয়োজন নেই নোভা। মায়ের হাতের রান্না। মা খুব যত্ন করে রেঁধেছেন। আপু আর আন্টিকে নিয়ে খাবারগুলো খেয়ে ঘুমাতে যাও।”
খাবারগুলো যে শ্রাবণ পাঠিয়েছে তা বুঝতে আর বেগ পেতে হলো না তাকে। চোখ জোড়া ভিজে উঠলো মুহুর্তেই। ছেলেটাকে যত দেখছে ততোই সে অবাক হচ্ছে। মুগ্ধ তো অনেক আগেই হয়েছিল। আচ্ছা ছেলেটা এমন কেন? এতটা দায়িত্ববান একটা পুরুষ কী করে হতে পারে? দায়িত্বের মতো কোনো সম্পর্ক কী আদৌ তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে? কই এমন কিছু তো গড়ে ওঠেনি। তাহলে? না এগুলো তো দায়িত্ব নয় বরং এগুলো হচ্ছে ভালোবাসা। মোবাইল নিয়ে শ্রাবণের নাম্বারে ডায়াল করল অনুভা। কিন্তু রিসিভ হলো না। বাজতে বাজতে কেটে গেলো কল। পরপর তিনবার কল দেওয়ার পরেও সেই একই অবস্থা। তার মিনিট দুয়েক পর সেই নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এলো,“এমনিতেই ঊনত্রিশ বছর ধরে সিঙ্গেল তার উপর বউ ছাড়া এই কনকনে শীতের রাত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে নোভা। তার সঙ্গে তোমার কল রিসিভ করে বকাঝকা শোনার কোনো ইচ্ছেই আপাতত আমার নেই। চুপচাপ খেয়ে ঘুমাতে যাও।”
ম্যাসেজটা পড়েই লজ্জা রাঙা হয়ে উঠলো অনুভার মুখশ্রী। ছেলেটা এসব কথাও বলতে জানে! ভাবতেই ভীষণ অবাক হলো। এই ছেলেটার জন্য জীবনে তাকে আর কতটা অবাক হতে হবে তার হিসেব যেনো অনুভার ভাবনা বহির্ভূত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার বেড়ে মা আর বোনকে ডাকার জন্য পা বাড়ালো ঘরের দিকে। তখনি আগমন ঘটলো অর্থিকার। ছোটো বোনের উদ্দেশ্যে বললো,“শরীরটা খুব ব্যথা করছিল তাই একটু শুয়েছিলাম। কলিং বেল বাজার শব্দ পেলাম মনে হলো। কে এসেছে এত রাতে?”
“পার্সেল এসেছে।”
“কীসের পার্সেল?”
“কীসের আবার? খাবারের?”
ললাটে ভাঁজ পড়ে অর্থিকার। টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে খাবারগুলো দেখতেই বিষ্ময় খেলে যায় চোখেমুখে। অনুভা যে বাহির থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে আনাবে না তা সে নিশ্চিত। তাহলে কে পাঠালো? এত রাতে বাড়ি পর্যন্ত এতগুলো খাবার পাঠানোর মতো আপন মানুষ বলতে তো কেউ নেই তাদের। তবে? প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কে পাঠিয়েছে এগুলো?”
দম ছাড়লো অনুভা। উত্তর দেওয়ার প্রয়াস চালাতেই সেই উত্তরের অপেক্ষা না করে অর্থিকা বাম ভ্রু উঁচিয়ে ফের শুধালো,“শ্রাবণ পাঠিয়েছে?”
বড়ো বোনের কথায় চমকায় অনুভা। সে জানলো কী করে এ কথা? আর শ্রাবণের নামটাই বা জানলো কী করে? বাবার মৃ’ত্যুর দিন একমাত্র শ্রাবণ এসেই তাদের এত উপকার করেছে। কিন্তু ও-ই যে শ্রাবণ তা তো জানার কথা নয় অর্থিকার। অনুভা তো তেমন কিছুই বলেনি বোনকে। তাহলে? কৌতূহল নিয়েই উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। আশানুরূপ উত্তর পেয়ে মুচকি হাসে অর্থিকা। বলে,“ছেলেটা কিন্তু তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে অনু। এই যুগে এমন ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া বড়োই দুষ্কর ব্যাপার।”
বোনের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। মিনমিনে স্বরে বললো,“যাই মাকে ডেকে আনি। তুই বরং খাওয়া শুরু কর আপু। খাওয়া শেষে ফিডার আর সুজির বাটিটা নিয়ে যাস। তাঈমকে খাইয়ে দিস।”
ছোটো বোনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্থিকা। যাক ছোটো বোনটার জীবনে এবার অন্তত সুখ নামক পাখিটা তো আসতে চলেছে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি যে আবারো নতুন রূপে ফিরে এসেছে তার জীবনে।
_______
সকাল হওয়ার পরেও চারিদিকে নেই কোনো রোদের তাপ। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে সূয্যি মামা। আজ যেনো এক কুয়াশাচ্ছন্ন দিন। অন্যদিনের মতো আজ সকালে নেই সুফিয়ার কোনো চিৎকার চেঁচামেচি। মায়ের দায়িত্ব বোন আর পারভিনার উপর ছেড়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বের হলো অনুভা। গন্তব্য অফিস। মনের ভেতরে তার হাজারো ভয় ডানা ঝাপটাচ্ছে। বিনা ছুটিতে কাউকে না জানিয়েই টানা চারদিন অফিস বন্ধ করেছে। চাকরিটা আদৌ কী আর থাকবে? তানিম যেমন ধাঁচের মানুষ তাতে যে চাকরিটা আর থাকবে না তা অনুভার খুব ভালো করেই জানা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গলি পেরিয়ে মেইন রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। যা হয় তা না হয় পরেই দেখা যাবে। খারাপ কিছু হলেও তা আর মেনে নিবে সে। তানিম তাকে সকলের সামনে অপমান করলে সে আর কোনো কৈফিয়তই দিবে না কাউকে। চুপচাপ চলে আসবে। সব সিদ্ধান্ত নিয়েই এগিয়ে গেলো সম্মুখে।
রাস্তায় জ্যাম না থাকায় অফিসে এসে পৌঁছাতে বেশি একটা সময় লাগলো না অনুভার। উদ্বিগ্ন, সঙ্কিত মন নিয়ে নিজের চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নিলো। তাকে দেখতেই কলিগ নায়রা এগিয়ে এলো। চোখেমুখে তার হাজারটা প্রশ্নের ছাপ। মাথা নুইয়ে ফিসফিস করে শুধালো,“আরে আপা কতদিন পর আপনাকে দেখলাম! তা কোথায় ছিলেন এতদিন? অফিসে আসেননি কেন? ছুটিতে ছিলেন অথচ একবারও জানালেন না?”
একনাগাড়ে মেয়েটির এত প্রশ্নে হকচকিত হলো অনুভা। অফিসে যে এ ব্যাপার নিয়ে তানিম চিৎকার চেঁচামেচি করেনি তা মেয়েটির প্রশ্নেই বেশ ভালো ভাবে টের পেলো সে। এই শীতেও তার কপালে ঘাম জমেছে। বাম হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে ঘাম মুছে নিলো অনুভা। উত্তরে বললো,“আমার বাবা মারা গেছেন তাই আসতে পারিনি।”
কথাটা কর্ণপাত হতেই মুখখানি মলিন হলো নায়রার।
মিনমিনে স্বরে,“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন” পড়ে অনুভাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে গেলো নিজ আসনে।সময় পেরোলো। এতক্ষণ ধরে অফিসে আসার পরেও আজ নাহিয়ানের সঙ্গে দেখা হলো না তার। ক’দিন না আসায় তার ভাগের কাজও জমে থাকার কথা কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কোনো কাজই জমে নেই। পিয়ন আজগর এসে উপস্থিত হলেন টেবিলের সম্মুখে। বললেন,“ম্যাডাম! স্যার আপনেরে যাইতে কইছে।”
চমকায় অনুভা। স্যার মানে তো তানিম! সে আবার কখন এলো?শুধালো,“স্যার কখন এলেন?কোনদিক দিয়ে এলেন? কই দেখলাম না তো?”
“আপনে আসার আগেই আইছে। এহন যান তাড়াতাড়ি।”
মাথা নাড়িয়ে তেড়ে আসা ঝড়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে তানিমের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো অনুভা। অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই মিলিত হলো একে অপরের দৃষ্টি। খানিকটা অপ্রস্তুত হলো অনুভা। সরিয়ে নিলো নিজ দৃষ্টি। তার এহেন কাণ্ডে মনে মনে হাসে তানিম। কিন্তু বাহিরটা গাম্ভীর্যের চাদরে মুড়িয়ে রেখে প্রশ্ন ছুঁড়লো,“অফিসের তো কিছু নিয়ম-কানুন আছে মিস.অনুভা। তা কোনো ধরণের ইনফর্ম না করেই টানা চারদিন ধরে অফিসে আপনি অনুপস্থিত ছিলেন কেন?”
যে ছেলের কণ্ঠে সর্বদা রাগের আভাস পাওয়া যায় আজ সেই ছেলের এত স্বাভাবিক কণ্ঠে কৌতূহলী হয়ে ওঠে অনুভার মন। রয়েসয়ে উত্তর দেয়,“আমার বাবা মারা গেছেন। অমন একটা মুহূর্তে অতকিছু মাথায় আসা সম্ভব নয় স্যার। তাই আগে থেকে কিছু জানাতে পারিনি।”
তানিমের মুখখানা মলিন হলো। যদিও নাহিয়ানের থেকে অনুভার ঠিকানা নিয়ে সেদিনই তার খোঁজ নিয়েছিল তানিম। পুরো ঘটনাটা সম্পর্কে অবগত হতেই মেয়েটির জন্য খুব মায়া হলো। তবে সেসব সম্মুখে আর প্রকাশ করল না। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে শুধালো,“তা কীভাবে মারা গেলেন উনি?”
“বলেছিলাম না স্যার বাবা আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন? শরীরের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছিল আর তারপরেই না ফেরার দেশে চলে গেলেন।”
“ওহ, তা এই শোকের মধ্যে অফিসে আসতে গেলেন কেন? চাইলেই তো অফিসে ফোন করে আরো কয়েকদিনের ছুটি নিতে পারতেন।”
“তার আর প্রয়োজন নেই স্যার। বলার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
মাথা নাড়ায় তানিম। অনুভাও অনুমতি নিয়ে চলে আসে নিজ কেবিনে।
_______
বিয়ে উপলক্ষে অফিস থেকে বেশ কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছে নাহিয়ান। গতকালই পারিবারিক ভাবে তমা আর তার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। দুই পরিবারের আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে বিয়ে করে বউ নিয়ে রাতেই বাড়ি ফিরেছিল নাহিয়ান। তার জোরাজুরিতে তানিমও উপস্থিত ছিলো সেই বিয়েতে।
শুরুতে মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে কুলসুমের মনের ভেতরে খচখচ একটা ভাব থাকলেও ছেলে-মেয়ের বিভিন্ন যুক্তি তর্কের সামনে হার মেনে নিয়ে বিয়েটা অবশেষে মেনে নিয়েছেন তিনি। যে সংসার করবে তারই যদি সমস্যা না থাকে তাহলে উনারই বা আর কী বলার আছে?
সকাল থেকেই রান্নাঘরে ব্যস্ত তমা। শাশুড়িকে রান্নার কাজে হাতে হাতে সাহায্য করছে। এতে বেশ বিরক্ত হচ্ছেন কুলসুম। তিরিক্ষ মেজাজে বললেন,“এমন ঘাড়ত্যাড়া মেয়ে কেন তুমি? তোমাকে বলেছি না ঘরে যাও।”
তমা মিনমিনে স্বরে বললো,“আমি একটু সাহায্য করলে সমস্যা কোথায় মা? আমিও তো এখন থেকে এ বাড়ির একজনই।”
“বিয়ে হতে না হতেই এত সাহায্য করতে বলেছে কে? ঘরে গিয়ে বসে থাকো। দুপুরের দিকে মানুষের আনাগোনায় নড়ার সময়টুকু পাবে না। ঘরে যাও।”
শেষের কথাটা একটু ধমকের সুরেই বলে উঠলেন কুলসুম। শাশুড়িকে আর বেশি রাগানোর সাহস পেলো না তমা। ছোটো ছোটো কদম ফেলে চলে এলো কক্ষে। নাহিয়ান বিছানায় আধ শোয়া। নববধূকে প্রবেশ করতে দেখেই উঠে বসলো সে। মুচকি হেসে শুধালো,“কী হলো চলে এলে যে? নিশ্চয়ই মা তাড়িয়ে দিয়েছে তাই না?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় তমা। গোমড়া মুখখানিতে ফোটে ওঠে মৃদু হাসি। বলে,“শুরুতে শাশুড়ি সম্পর্কে যা ধারণা করেছিলাম তার তো উল্টোটা ঘটছে।আমার শাশুড়ি মা কিন্তু খুব কেয়ারিং।”
“মা এমনই। মনটা খুব নরম উনার। শুরুতে তোমায় হয়তো একটু অপছন্দ হয়েছিল বটে, তবে দেখবে দিন যতো এগিয়ে যাবে ততোই সবার থেকে বেশি আপন তোমায় মা-ই করে নিবে আর ভালো ও বাসবে।”
বাড়িতে পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত শাশুড়িকে নিয়ে তমার মনের মধ্যে বিভিন্ন আজেবাজে ভাবনা থাকলেও সেসব ভাবনার কিছুটা হলেও যেনো অবসান ঘটেছে এবার। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে প্রশান্তির ছাপ। কিছু একটা ভাবনা মস্তিষ্কে আসতেই আবারো পূর্বের ন্যায় চুপসে গেলো তার মুখশ্রী। স্বামীর উদ্দেশ্যে অনুমতি চাইলো, “একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“হুম করো।”
“মায়ের অমত থাকার পরেও কেন আপনি আমায় বিয়ে করলেন বলুন তো? এমন তো নয় যে আমরা পূর্ব পরিচিত। ইনফেক্ট আমরা একে অপরকে সেদিনের আগ পর্যন্ত চিনতামও না। তাহলে?”
“পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রী পছন্দ হয়েছে তাই বিয়ে করে এনেছি। সহজ কথা। কেন তোমার কী আমায় পছন্দ হয়নি?”
“সেসব কিছু না। আপনাকে কেন পছন্দ হবে না? আপনি স্বামী হিসেবে সবদিক দিয়েই উপযুক্ত। কিন্তু আমায় পছন্দ হওয়ার কোনো কারণ তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না।”
“পছন্দ না হওয়ার কোনো কারণও তো খুঁজে পাচ্ছি না।”
“আমি শ্যামলা।”
“শ্যামলা মেয়েরা মায়াবতী। তাই তুমিও একটা মায়াবতী। আর কখনো নিজের গায়ের রঙ নিয়ে মন খারাপ কিংবা আফসোস করবে না বুঝলে?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় তমা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নাহিয়ান। রূপবতীকে না হয় সে পায়নি কিন্তু মায়াবতীকে তো পেয়েছে। একজনকে চিরকাল একতরফাভাবে অতি গোপনে ভালোবেসে সারাজীবনের জন্য একাকিত্বকে সঙ্গী করে বাঁচা হচ্ছে একমাত্র বোকামি। কিন্তু নাহিয়ান তো বোকা নয়। সে আবারো ভালোবাসবে। তবে এবার একতরফা নয়। বরং এই ভালোবাসা হবে পবিত্র এবং দুজনার সম্মতিতে।
চলবে _______
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:২০]
দেখতে দেখতে মাস পেরোলো। এক মাসের মধ্যে স্থান, কাল, মানুষগুলো না বদলালেও বদলেছে বিভিন্ন সম্পর্কের গতিবিধি। চতুর্থবারের মতো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বাড়ি ফিরলো অর্থিকা। ক্লান্ত দেহখানার ভারসাম্য সোফায় ফেলে বসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অনুভা। বসে পড়ল বড়ো বোনের মুখোমুখি। রাগত স্বরে বলে উঠলো,“নিষেধ করার পরেও আবার তুই ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলি আপু? তোর সমস্যাটা ঠিক কোথায় বলবি? আর ঠিক কতবার তোকে বললে এসব চাকরি বাকরি করার ভূত মাথা থেকে নামবে?”
সোজা হয়ে বসলো অর্থিকা। ভ্রু যুগল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তোকে না সকালে অফিসে বের হতে দেখলাম? তাহলে এ সময় বাড়িতে কী করছিস তুই? আমার জানামতে তোর কঞ্জুস বস তো এমনি এমনি ছুটি দেওয়ার লোক নন।”
“শরীরটা ভালো লাগছিল না। যদিও শুরুতে ভেবেছিলাম ছুটিটা হয়তো উনি দিবেন না কিন্তু দিয়ে দিলেন।”
প্রত্যুত্তর করল না অর্থিকা। অনুভা ফের পূর্বের প্রসঙ্গ টেনে এনে বললো,“আজকের পর আর ওসব ইন্টারভিউ দিতে যাবি না তুই। সময়টা ছেলের পেছনে দে। বড়ো হচ্ছে ও। আমি তো এতদিন ধরে চালাচ্ছি সংসারটা তাহলে এখন আবার তোকে চাকরি করতে হবে কেন বল তো? বাবাও এখন আর নেই। বাবার চিকিৎসা ওষুধপত্রের জন্য যেই অর্থটা খরচ হতো সে টাকাটাও তো এখন মাস শেষে রয়ে যায়।”
অর্থিকা দ্বিমত পোষণ করে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো, “অবশ্যই প্রয়োজন আছে। সারাজীবন কী এভাবেই চাকরি করে সংসার চালিয়ে মা-বোনের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার ফন্দি এঁটেছিস নাকি? যদি এসব আজেবাজে ফন্দি এঁটে থাকিস তাহলে সেসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। বড়ো বোন হিসেবে আমার কিছু দায়িত্ব কর্তব্য আছে। এতদিন একটা ট্রমার মধ্যে ডুবে থাকার কারণে কিছু বলতে পারিনি তোকে তবে আমি নিজেকে এখন যথেষ্ট স্বাভাবিক করতে পেরেছি। এবার আমার সব দায়িত্ব পালনের সময় এসে গেছে।”
“কী দায়িত্ব শুনি?”
“আমি তোর বিয়ে দিবো।”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই আশ্চর্য হয় অনুভা। আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বলে,“এসব আজেবাজে চিন্তা কোত্থেকে তোর মাথায় উদয় হলো আপু?”
“আজেবাজে চিন্তা হবে কেন? এটাকে বলে সুচিন্তা। বয়স তো কম হলো না। আরো অপেক্ষা করলে দেখা যাবে ছেলের মায়েরা পুত্রবধূ হিসেবে তোকে পছন্দই করছে না। অসব ঝুঁকি কিন্তু আমি একদম নিতে পারবো না বলে দিলাম।”
মুখখানা মলিন হলো অনুভার। কণ্ঠে জমাট হলো শঙ্কা,ভয়। মিনমিনে স্বরে বললো,“আমি বিয়ে করতে চাই না আপু। চাই না নতুন কোনো সম্পর্কের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে। ভালোবাসতে যে খুব ভয় হয় আমার। কাউকে বেশি ভালোবাসলেই সে হারিয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষ হারানোর বেদনা যে খুবই নিকৃষ্ট আপু।”
ছোটো বোনের কাঁধে হাত রাখলো অর্থিকা।আশ্বস্তের সুরে বললো,“আমার এই অবস্থা দেখে ভালোবাসার প্রতি এত বিদ্বেষ জন্মেছে তোর তাই না? তুই তো আমায় বলেছিলি তন্ময় আমায় ছেড়ে যায়নি। তার হায়াত অতটুকুই ছিলো। তাহলে? তাহলে তোর কেন এত ভয়? ভালোবাসা ছাড়া একাকিত্বকে সঙ্গী করে মানুষ বাঁচতে পারে না অনু। প্রত্যেকেরই সুখ, দুঃখ ভাগ করার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। নিজেকে ভেঙেচুরে উপস্থাপন করার জন্য, জড়িয়ে ধরে সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়ার জন্য একজনকে প্রয়োজন হয়। আর সেই একজন হচ্ছে জীবনসঙ্গী। সেই জীবনসঙ্গী পেতে হলে তো বিয়ে করতে হবে তাই না?”
“তাহলে তোর কী হবে? তুই কার কাছে নিজের সুখ, দুঃখ ভাগ করে নিবি?”
কথাটা শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাসলো অর্থিকা। তার এই অবুঝ ছোট্ট বোনটা যে এত তাড়াতাড়ি বড়ো হয়ে গেছে, বোঝদার হয়ে গেছে ভেবেই ভেতরে ভেতরে প্রশান্তি অনুভব করল। অধরে হাসি রেখেই বললো, “আমি তো আর তোর মতো ভালোবেসেও ভয়ের চোটে তা নিজের ভেতরে গোপন করে রাখিনি অনু। বরং আমি মন প্রাণ উজাড় করে একজনকে ভালোবেসেছি। তার বিনিময়ে এর থেকেও বেশি পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছি। পেয়েছি সুন্দর একটা সংসার, পেয়েছি একজন সাদাসিধে স্বামী। আবার তার মাঝেই পেয়েছি একজন প্রেমিককে। পেয়েছি আমাদের ভালোবাসার জলজ্যান্ত প্রাণ আমাদের ছেলে তাঈমকে। আর কী চাই বল তো? শুরুতে হয়তো তন্ময়ের মৃ’ত্যুটা আমি মেনে নিতে পারিনি কিন্তু এখন আমি সবটাই মেনে নিয়েছি। ওর সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আর তাঈমকে নিয়েই বাকি জীবনটা আমি পরম শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারবো। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পুরুষকে ভালোবেসে যাবো।”
“তোকে অমন পরিস্থিতিতে সামলানোর জন্য না হয় আমরা ছিলাম কিন্তু আমাকেও ওই একই পরিস্থিতিতে পড়তে হলে? আমি যে মেনে নিতে পারবো না রে আপু। বাবা মারা যাওয়াতেও আমার অতটা কষ্ট হয়নি যতটা না কষ্ট হয়েছিল তোকে ওই পরিস্থিতিতে দগ্ধ হয়ে যাওয়া দেখতে। কারণ বাবা তো অনেক আগেই ভেতরে ভেতরে মরে গিয়েছে, দূরে সরে গিয়েছে আমাদের থেকে। শুধু তার দেহটাই অক্ষত ছিলো। কিন্তু!”
বাকি কথাটুকু আর শেষ করতে দিলো না অর্থিকা। বললো,“কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। আর না কেউ এসব চিন্তা মাথায় নিয়ে সুখ খোঁজে। এসব ভেবে কেউ সংসার সাজায় না। দুঃখের পরে যে সুখ আসে এ কথাটা মানিস তো?”
উপর নিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। অর্থিকা পুনরায় বলে,“তেমনি চিরকাল কিন্তু সুখও থাকে না। এই যে দেখ না, আমাদের জন্ম থেকে শুরু করে বেড়ে ওঠা পর্যন্ত সবটাই ছিলো সুখের চাদরে মোড়ানো। কিন্তু কী হলো? দমকা হাওয়ায় সেই সুখ থেকে আমরা ছিটকে পড়লাম দুঃখের সাগরে।দুঃখ পেতে পেতে যে আমরা শক্ত পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেছি। কিন্তু তার মধ্যেও মায়ের দুটো মেয়ে আছে। যাদের আঁকড়ে ধরে সামনের পথগুলো মা নির্ধিদ্বায় অতিক্রম করতে পারবে। তেমনি আমারও আছে। তুই আর মায়ের পাশাপাশি তাঈম আর ওর বাবার স্মৃতি আছে। কিন্তু তোর কী এমন কেউ আছে? নেই তো। তাই তোর উচিত নিজের জীবনকে একটা পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া। জীবনে একজনকে আঁকড়ে ধরা। পরে না হয় যা হওয়ার হলো। সব হারিয়ে গেলেও স্মৃতি কিন্তু হারায় না অনু।”
বোনের প্রতিটি কথাই সঠিক। মরতে তো সকলকেই হয় কিন্তু তাই বলে কী জীবন থেমে থাকে? তবুও উপরে উপরে কিছুতেই যেনো দমতে চাইলো না অনুভা। বিপরীতে বলতে লাগলো,“কিন্তু আপু!”
এবারো তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো অর্থিকা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“মন থেকে একটা সত্যি কথা বল তো। তুই সত্যিই এ জীবনে কাউকে ভালোবাসিসনি? এখনো কী বাসিস না ভালো?”
প্রশ্নগুলো মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই চোখের অদৃষ্টে ভেসে উঠলো পরিচিত একটি মুখ। জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো অনুভা। এই প্রশ্নটা শুনলেই ভেতরে ভেতরে অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। তার এই অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো অর্থিকা। একহাতে বোনকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“ভালোবাসাকে স্বীকার করতে শিখ। অনুভূতিগুলো বুকের ভেতর চেপে রেখে কষ্ট না পেয়ে প্রকাশ করতে শিখ। ভালোবাসার দহনে যে একা একা পুড়তে নেই। যদি পুড়তে হয় তবে ভালোবাসার মানুষটিকে সঙ্গে নিয়ে পুড়ে মর।”
ঘন পল্লব ঝাপটে বড়ো বোনের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো অনুভা। অর্থিকা তাকে রেখেই উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো নিজ কক্ষে। কিছু একটা মনে পড়তেই পথিমধ্যে থেমে গিয়ে পিছু ফিরে বললো,“বুঝলি অনু? চাকরিটা কিন্তু আমার হয়ে গেছে। আর এই চাকরিটা পাওয়ার সকল ক্রেডিট হচ্ছে শ্রাবণের।”
হকচকিয়ে উঠলো অনুভা। বসা থেকে দ্রুতপদে উঠে দাঁড়ালো। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“শ্রাবণের?”
“হুম, প্রথম তিনটে ইন্টারভিউর মধ্যে একটাতে বয়সের জন্য নেয়নি আর বাকি দুটোতে তো নামমাত্র ইন্টারভিউ নিয়েছিল। ভেতরে ভেতরে আগে থেকেই লোক তাদের ঠিক করা ছিলো। তারপর শ্রাবণই আমায় এখানে নিয়ে গেলো। ওর কোনো এক রিলেটিভ নাকি ওখানে চাকরি করে। এই জন্যই ঝামেলাহীন ভাবে ইন্টারভিউ দিয়ে টিকেও গেলাম।”
“তা ও কীভাবে তোর সঙ্গে যোগাযোগ করল?”
“কেন? মোবাইলে।”
“ফোন নাম্বার পেলো কোথায়?”
“তোকে বলবো কেন?”—-প্রশ্নটা করেই আপনমনে হনহনিয়ে প্রস্থান করল অর্থিকা।
অনুভা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো নিজ স্থানে। এখানেও শ্রাবণ! এই ছেলেটা কী কোনোমতেই তাকে আর ছাড়বে না?
________
শ্রাবণদের বাড়িতে আগমন ঘটেছে অতিথিদের।শেখ ম্যানসনের ড্রয়িং রুমে বসে আছে প্রান্তি আর তার বাবা-মাসহ ছোটো ভাই। সৌহার্দ্যও বসা ঠিক তারই মুখোমুখি সোফায়।
দুদিন আগে কাউকে কোনো কিছু না জানিয়েই দেশে ফিরে এসেছে সৌহার্দ্য। কোনো ভণিতা ছাড়াই এবার বাবা-মাকে জানিয়ে দিয়েছে নিজের পছন্দের কথা। বড়ো ছেলের বিয়েটা এখনো পর্যন্ত দিতে না পারায় মন খারাপ থাকলেও ছোটো ছেলে তো অন্তত বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এই ভেবেই মন খারাপ কিছুটা হলেও যেনো হ্রাস পেলো শান্তার। প্রান্তিও এবার আর বিয়ের ব্যাপারে অমত পোষণ করতে পারলো না। মাঝখানে কয়েক দিনের জন্য ছেলেটার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রাণ তার যায় যায় অবস্থা ছিলো। তাই বাবা-মাকে বুঝিয়ে গতকালই এসে পৌঁছেছে দেশে। আর আজ সোজা সৌহার্দ্যের বাড়িতে।
প্রান্তির বাবা পলাশ মাহমুদ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য নিজ দেশ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন ভিন্ন দেশে। লেখাপড়া শেষে সেখানেই চাকরি নিয়ে থেকে যান তিনি। প্রান্তির মা মায়ার সঙ্গে উনার বিয়েটা হয়েছিল সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে। বিয়ের পর স্ত্রী সমেত আবারো তিনি পাড়ি জমান সেই বিদেশের মাটিতে। প্রান্তি এবং তার ভাইয়ের জন্মটাও ওখানেই।
খানিক সময়ের মধ্যেই হানিফ শেখের সঙ্গে পলাশ মাহমুদের বেশ ভাব জমে উঠলো। যতই হোক দুজনের পেশাই শিক্ষকতা কিনা! বেয়াইন হিসেবে মায়াকেও বেশ পছন্দ হয়েছে শান্তার। তাদের জমে ওঠা আলাপচারিতা দেখে সৌহার্দ্য আর প্রান্তি ইশারায় দুজন দুজনাকে আশ্বস্ত করে বললো,“বিয়েটা তো পুরোপুরি পাকা। এবার আর আটকায় কে আমাদের?”
খাওয়া দাওয়ার পাট চুকে যেতেই বিয়ের কথাবার্তাও পাকাপোক্ত হয়ে গেলো।হানিফ শেখ প্রস্তাব রাখলেন,
“আমি চাইছিলাম আপনারা যেহেতু দেশে এসেছেনই তাহলে আপাতত ঘরোয়া ভাবেই ওদের বিয়েটা দিয়ে দেই? ধুমধাম করে অনুষ্ঠান না হয় পরে করবো।”
পলাশ মাহমুদ প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“এখন হলেই সমস্যা কোথায়? আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই।”
শান্তা মন খারাপ করে বললেন,“আর বলবেন না ভাই। আমার বড়ো ছেলেটারই তো এখনো বিয়ে হয়নি। বড়ো ছেলে রেখেই ছোটো ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে আত্মীয় স্বজন পরিচিতরা তো হাজারটা প্রশ্ন ছুঁড়বে। তা তো বুঝেনই?”
পুরো ব্যাপারটাই উনারা বুঝলেন। মায়া বললেন,“তাও অবশ্য ঠিক। এসব দেশীয় আত্মীয় স্বজনদের মুখ আবার লাগামহীন। তা বড়ো ছেলে কোথায়? দেখলাম না তো ওকে।”
হানিফ শেখ উত্তর দিলেন,“ছেলে আমার ভার্সিটির লেকচারার। ভার্সিটিতেই গিয়েছে। তবে ওর ফেরার সময়ও প্রায় হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”
মায়া মৃদু হেসে বললেন,“তা বিয়ে থা করছে না কেন? আমার কাছে কিন্তু ভালো মেয়ের সন্ধান আছে। যেহেতু আত্মীয়তার সম্পর্ক করতেই যাচ্ছি তাই একসঙ্গে দুটোই না হয় করে ফেলি। কী বলেন?”
শান্তার চোখেমুখে উৎসাহিত একটা ভাব চলে এলো। কিন্তু তার মধ্যেই হানিফ শেখ ভদ্রতার সহিত বলে উঠলেন,“এখনকার ছেলে-মেয়েদের কী আর অতো কষ্ট করে পাত্র-পাত্রী খুঁজে বিয়ে দিতে হয়? সৌহার্দ্যের যেমন প্রান্তি মাকে পছন্দ তেমন আমার বড়ো ছেলে শ্রাবণেরও আগে থেকেই মেয়ে পছন্দ আছে।”
পলাশ মাহমুদ জিজ্ঞেস করলেন,“তাহলে বিয়ে দিচ্ছেন না কেন?”
হানিফ শেখের সহজ উত্তর,“ছেলে অনুমতি দেয়নি তাই। তবে এ বছরেই বিয়েটা দিয়ে দিবো ভাবছি। আর তারপরেই না হয় সৌহার্দ্য আর প্রান্তির বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে করবো।”
সকলেই সায় জানালো এই প্রস্তাবে। বিকেলের দিকে বাড়িতে আগমন ঘটলো শ্রাবণের।
__________
বিছানায় অন্যমনস্ক হয়ে শুয়ে আছে অনুভা। তখনি ঘরে প্রবেশ করল অর্থিকা। বিছানায় এসে বসে প্রশ্ন করল,“কী রে কী করছিস?”
বোনের উপস্থিতি টের পেতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো অনুভা। নিচু স্বরে উত্তর দিলো,“কিছু না।”
“আমি না একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি রে অনু।”
“কী সিদ্ধান্ত?”
“ভাবছি এই বাসাটা বদলে ফেলবো। এতদিন তোকে একা একা সব সামলাতে হতো তাই সবদিক কুলাতে না পেরে এই বাসাটা ভাড়া নিতে হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে এখানে সবদিক দিয়েই অসুবিধে। তার উপর মা সারাক্ষণ ঘরে চুপচাপ বসে থাকে। হয়তো বাবার স্মৃতিচারণ করে। এভাবে তো আর চলতে পারে না বল। আমি যেহেতু এক সপ্তাহ পর চাকরিতে জয়েন করবো তাই এই সপ্তাহেই বাসা পাল্টে ফেলতে চাই। দুজনার অফিস থেকে কাছাকাছি দূরত্বেরই একটা খোলামেলা বাসা ভাড়া নিবো না হয়।”
“তোর যা ইচ্ছে।”
“আমার আবার কী ইচ্ছে রে? চল কালই বাসা দেখতে বের হই আমরা।”
“কাল আমার অফিস আছে।”
“তাতে কী? অফিস ছুটি হলে আমায় কল দিবি। তারপর না হয় দুজন একসঙ্গে দেখতে চলে যাবো।”
“ওই রাতের বেলায়?”
“তো কী হয়েছে? রাতের বেলাও বাসা দেখা যায় বুঝলি?”
না বুঝলেও চুপচাপ উপরনিচ মাথা নাড়ায় অনুভা। বোনের কথায় সায় জানায়।
চলবে _________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)