সুখেরও সন্ধানে পর্ব-১৭+১৮

0
568

#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৭]

ভোরের আলো কেবল ফোটতে শুরু করেছে। সে সময়ই হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসে সর্বশক্তি দিয়ে ছোটো কন্যার কক্ষের দরজায় কড়া নাড়লেন সুফিয়া। চিৎকার করে ডাকলেন,“অনু! এই অনু! উঠ না তাড়াতাড়ি। দেখ না তোর বাবা ঘুম থেকে উঠছে না। আমি এত করে ডাকলাম কিন্তু কিছুতেই আমার কথা কানে নিলো না। ওই অনু!”

মায়ের আহাজারিতে ঘুম ভাঙলো অনুভার। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানায় শুতেই চোখটা লেগে এসেছিল তার। দুলতে দুলতে দরজা খুলে দিতেই দৃষ্টিগোচর হলো মায়ের আতঙ্কিত মুখশ্রী। শুধালো,“কী হয়েছে? চিৎকার করছো কেন?”

অন্য কোনো সময় হলেও হয়তো এ কথাটায় রেগে যেতেন সুফিয়া, কিন্তু আজ তিনি রাগলেন না। সঙ্কিত কণ্ঠে বললেন,“রোজ ভোরবেলাতেই তোর বাবার ঘুম ভেঙে যায় তবে আজ ভাঙেনি। আমি কতবার করে ডাকলাম কিন্তু উঠলোই না। আমার না খুব ভয় করছে অনু, তোর বাবার শরীরটা একেবারে বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কী হলো বল তো?”

“শীত এসে গেছে,এমন সময় হাত-পা ঠাণ্ডা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক মা। আচ্ছা চলো দেখি।”

বাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। তার পিছু নিলেন সুফিয়াও। এতক্ষণে অর্থিকার ঘুমটাও ভেঙে গেছে। খুব সাবধানে ঘুমন্ত তাঈমের পাশ থেকে উঠে এসে ঘর থেকে বের হলো সে।

ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই শায়িত বাবাকে দৃষ্টিগোচর হলো অনুভার। বিছানার একপাশে বসে আলতো করে বাবার মাথায় হাত রেখে কোমল স্বরে ডাকলো,“বাবা! ও বাবা! সকাল যে হয়ে গেছে এবার তো ঘুম থেকে ওঠো।”

এত ডাকাডাকির পরেও চোখ মেলে তাকালেন না কামরুল হাসান। মুখশ্রী উনার নিষ্প্রাণ ঠেকছে। দেহখানা বরফের মতো ঠাণ্ডা, পাথরের ন্যায় শক্ত। কিছু একটা আঁচ করতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো অনুভার। কাঁপা কাঁপা হাতে ডান হাতের অঙ্গুলি পিতার নাকের কাছে রাখলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠলো সে। কারণ শ্বাসক্রিয়া চলছে না। এবার অতি দ্রুত উনার বুকের উপর মাথা রাখলো। অবাক করা বিষয়, হৃদযন্ত্র ক্রিয়াও বন্ধ।

সুফিয়া মেয়ের পানে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের মুখের আদল বদলে যেতে দেখেই শঙ্কা বৃদ্ধি পেলো উনার। বিচলিত কণ্ঠে শুধালেন,“কী হয়েছে তোর বাবার? উঠছে না কেন? ডাক্তার ডাক না।”

‘ডাক্তার’ শব্দটা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল অনুভার। মায়ের কথায় যেনো সম্বিৎ ফিরে এলো সে। দ্রুত পায়ে হেঁটে নিজের কক্ষে এলো। বিছানার উপর রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে কল দিলো পরিচিত ডাক্তারের নাম্বারে। বিস্তারিত সব জানিয়ে আবারো ফিরে এলো পিতার কক্ষে। হৃদয় প্রাঙ্গন ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে তার। শীতের মধ্যেও শরীর ঘেমেনেয়ে একাকার। কু ডাকছে মন। বিভিন্ন চিন্তায় ভার হয়ে এসেছে মস্তিষ্ক। সেসব কিছুতেই পাত্তা দিলো না অনুভা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় মগ্ন হয়ে পড়ল।

সুফিয়া নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছেন। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন স্বামীর পানে। অর্থিকা মাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে চুপচাপ। তার মনেও শঙ্কা। এক শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আরেক শোক? মনে মনে রবের নিকট আকুল হয়ে প্রার্থনা করছে। স্বামীকে যে হারিয়েছে মেয়েটা পুরোপুরি ভাবে এখনো বছর কাটেনি। তার মধ্যে পিতাকে হারানোর বেদনা যে কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব নয় তার পক্ষে।

ডাক্তার আসতে আসতে ঘণ্টা পেরোলো। ডা. মুস্তফা এর আগেও বেশ কয়েকবার এ বাড়িতে এসেছেন মূলত কামরুল হাসানের জন্যই। তাই বাড়িটা উনার খুব ভালো করেই চেনা। উনাকে নিয়ে ভেতরে এলো অনুভা। চেয়ার টেনে বসতে দিলো কামরুল হাসানের সম্মুখে। চোখে চশমা এঁটে নিষ্প্রাণ দেহখানার দিকে তাকালেন ডাক্তার। কিছু সময় নিয়ে বিভিন্ন ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থামলেন তিনি। মুখশ্রী গম্ভীর। তর্জনী আঙুলের সাহায্যে নিজ কপাল ঘষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলেন,“ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। অনেক আগেই উনি এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেছেন।উনি আর বেঁচে নেই, চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মৃ’ত্যুর সময় অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে।কিছু টের পাননি আপনারা?”

পরিবেশটা মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেলো। তিনজন নারীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। বাকহারা হয়ে গেলো সকলে। শুরুতে অনুভা যেই আশঙ্কাটা করেছিল তাই সত্যি হলো। কিয়ৎক্ষণ থেকে বিদায় নিলেন ডাক্তার।

এতক্ষণে বরফের মতো জমে গেছেন সুফিয়া। পাথরের মূর্তির ন্যায় একস্থানেই বসে আছেন। এক বিছানায় থেকেও কীভাবে স্বামীর মৃ’ত্যু যন্ত্রনা উপলব্ধি করতে পারলেন না তিনি? কেন ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার মতো পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছিলেন?ভেতরে ভেতরে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে লাগলেন সুফিয়া।অর্থিকা পিতার লাশের সম্মুখে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার মনে পড়ে এভাবে সে কেঁদেছিল এইতো মাস এগারো আগে। এই ছোট্ট জীবনে কেন এত দুঃখ? গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো কেন এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় জীবন থেকে?

বাবার আয়ু যে ফুরিয়ে এসেছে তা সেদিন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেই বুঝতে পেরেছিল অনুভা।তবে আজ বাস্তবতা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার।বাবা যতই সমাজের কাছে অপরাধী থাকুক না কেন, মানুষ যতই তার বাবাকে মন্দ বলুক না কেন, নিঃসন্দেহে কামরুল হাসান একজন শ্রেষ্ঠ পিতা এবং শ্রেষ্ঠ স্বামী। বাবার সঙ্গে কাটানো অতীতের স্মৃতিগুলো অকপটে ভেসে ওঠে অনুভার দৃষ্টিতে। এতশত আত্মত্যাগ তো এই বাবা-মায়ের জন্যই ছিলো। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ক্লান্ত দেহখানা ঠেলে বাড়ি ফেরার পর আপন মুখগুলো দেখলেই তো অনুভা ভুলে যেতো সকল দুঃখ কষ্ট। অথচ আজ কিনা তাদের মধ্য থেকে একজন এভাবে বিদায় নিলো পৃথিবী থেকে? বাবা নামক মানুষটি সব ছেড়েছুড়ে চলে গেলো? এতিম হয়ে গেলো সে?

নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না অনুভা। শক্ত খোলসটা বেরিয়ে মুহূর্তেই হয়ে উঠলো পুরোনো অনুভা। চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। কামরুল হাসানের শক্তপোক্ত ডান হাতটা নিজের কপালের সঙ্গে ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগের সুরে বলে উঠলো,“কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলে বাবা? কেন? তুমি কখনোই আমার কাছে বোঝা ছিলে না বাবা। প্লিজ ফিরে এসো। আমি যে তোমায় খুব ভালোবাসি বাবা।”

মেয়েদের কান্নায় সম্বিৎ ফিরে পেলেন সুফিয়া। বসা থেকে অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীর প্রাণহীন দেহের পানে কিয়ৎ নিরব তাকিয়ে রইলেন। চামড়া কুঁচকে যাওয়া কাঁপা কাঁপা হাতে ছুঁয়ে দিলেন স্বামীর প্রাণহীন দেহখানা। এই লোকটার সঙ্গে যখন বিয়ে হয় তখন সুফিয়ার বয়স কেবল পনেরো। তারপর দেখতে দেখতে একসঙ্গে চৌত্রিশটা বসন্ত কেটে গেলো। এই মুহূর্তে এসে তিনি বড়ো মেয়ের দুঃখটা খুব করে অনুভব করতে পারছেন। কষ্টে দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে ভেতরটা। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার চোখ দিয়ে এখন আর উনার পানি ঝরছে না। কিছু সময় এমনভাবেই অতিবাহিত হলো। শরীরের ভারসাম্য ছেড়ে দিলো সুফিয়ার। মাথা টনটন করে ঘুরছে। দৃষ্টির সম্মুখে সব অস্পষ্ট, ঘোলাটে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দাঁড়ানো অবস্থা থেকে মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেলেন। শক্ত টাইলসে পড়ায় মাথার খানিকটা অংশ ফেটে গেলো।

অনুভা দৌড়ে এলো মায়ের কাছে। মায়ের মাথাটা নিজের কোলের উপর রেখে কপোলে হাত রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলতে লাগলো,“মা, ও মা, কী হলো তোমার? বাবা যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে, তুমি অন্তত যেও না। মা গো..”

অর্থিকাও মৃত পিতার নিকট হতে চলে এলো মায়ের কাছে। এমন অবস্থা দেখে দৌড়ে গিয়ে পানি এনে ছিটিয়ে দিলো মায়ের মুখশ্রীতে। কিন্তু জ্ঞান ফিরলো না সুফিয়ার। আজ যেনো দু বোনের কঠিন পরীক্ষার দিন। একদিকে পিতাকে হারানোর শোক অন্যদিকে মায়ের এমন করুন অবস্থা। কোথায় যাবে তারা? কী করবে? এমন একটা কঠিন সময়ে পাশে হয়তো বিশ্বস্ত কারো একজনের থাকা উচিত ছিলো।

বেলা বাড়তে লাগলো। পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাকে ডেকে এনেছে অর্থিকা। উনি এবং অনুভা মিলে সুফিয়ার হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। ক্ষত স্থানে লাগিয়ে দিয়েছে এন্টিসেপটিক। দুজন পুরুষ এসে খাট থেকে কামরুল হাসানের লাশটা মেঝেতে নামিয়ে রেখেছেন। সুফিয়ার জ্ঞান ফিরলো আরো আধ ঘণ্টা পর। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই বিড়বিড় করে প্রলাপ বকতে লাগলেন তিনি। একটু পরপর মৃত স্বামীর লাশের পানে তাকিয়ে বিসর্জন দিতে লাগলেন অশ্রু। তাঈমের ঘুম ভেঙেছে। ঘুম ভাঙার পর থেকে সেও চিৎকার করে কাঁদছে। পারভিনা তাকে সামাল দিচ্ছে।

কী করবে কী করবে না দিক বেদিক ভুলে বসেছে অনুভা। এই শহরে তাদের আপন বলতে কেউই নেই। তবে কামরুল হাসান বেশ কয়েকবার মেয়ের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,“আমি মারা গেলে আমার কবরটা আমার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দিস মা।”

এমন একটা সময় কী থেকে কী করবে কিছুই মাথায় আসছে না অনুভার। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলে গেছে তার। হাঁটু মুড়ে বসে আছে ঘরের এককোণে। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পিতার নিথর দেহের পানে। মনে মনে রবের নিকট অভিযোগ জানাচ্ছে,“এতটা অসহায় কেন করে দিলে আমায়?”

এভাবেই বেলা বাড়ছে,এতক্ষণ পাশে বসা দুয়েকজন যারা ছিলো তারাও চলে গেলো নিজ নিজ কাজে। অনুভার খেয়াল হলো তার মোবাইল অনেকক্ষণ যাবত বাজছে। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরলো মোবাইল। অপরপাশ হতে ভেসে এলো গম্ভীর কণ্ঠস্বর,“কল ধরছিলে না কেন নোভা? আজ কী অফিস বন্ধ তোমার?”

কণ্ঠস্বরের মালিককে চিনতে বেগ পেতে হলো না অনুভার। পারলো না নিজেকে সামাল দিতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো তৎক্ষণাৎ। চমকালো শ্রাবণ। শুধালো,
“তুমি কী কাঁদছো নোভা? কিছু হয়েছে তোমার? কী হয়েছে? বলো আমায়।”

“বাবা আর নেই।”—এতটুকু বলতেই যেনো দম বন্ধ হয়ে এলো অনুভার। বুক ভার হলো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সে। অপরপাশ হতে হয়তো আরো কিছু বলা হলো কিন্তু সেসব অনুভার শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো না। সে নিজের কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। নিজে দুর্বল হয়ে পড়লে যে মা আর বোনও অনেক অসহায় হয়ে পড়বে।

চারিদিকে শোকের ছায়া। সুফিয়া নিজ ভারসাম্য ছেড়ে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছেন। অর্থিকাও সেই পূর্বের ন্যায় মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছুক্ষণ বাদেই হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করল এলোমেলো একজন পুরুষ। পায়ে কেডস, পরনে ট্রাউজার, পাতলা টি-শার্ট তার উপর ডেনিমের একটা জ্যাকেট। চুলগুলোও তার এলোমেলো। বোঝাই যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এসেছে সে। পুরো ঘরে দৃষ্টি ফিরিয়ে এককোণে বসে থাকতে দেখলো অনুভাকে। এই কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কী অবস্থাই না হয়েছে মেয়েটার। গাঢ় স্বরে ডাকলো,“নোভা!”

তার ডাকে অনুভা, অর্থিকা দুজনেই তাকায়। পুরুষালী মুখখানা অচেনা ঠেকে অর্থিকার নিকট। এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে অনুভার সম্মুখে বসে শ্রাবণ। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে শুধায়,“কখন হলো এমনটা?”

“মনে হয় রাতে।”

চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে শ্রাবণের। আজ ভার্সিটিতে তার কোনো ক্লাস নেই। রোজকার মতো আজও অনুভার জন্য অপেক্ষা করছিল রাস্তায় কিন্তু তার কোনো সাক্ষাৎ না পেয়ে চিন্তিত হয় সে। একসময় বাধ্য হয়েই কল করে বসে। তখন অমন কথা শুনতেই একপ্রকার দৌড়ে বাকি পথটা এসে পৌঁছেছে ছেলেটা। কয়েক মিনিট বাদে পুনরায় অনুভার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,“নিজেকে শক্ত করো নোভা। ভেঙে পড়লে চলবে না। উনি তো আগে থেকেই অনেক অসুস্থ ছিলেন। তবুও তোমাদের কষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। বাবা হারানোটা যে অনেক কষ্টের তা আমি বুঝতে পারছি।”

অনুভা নিরুত্তর। এখনো তার পূর্ণ দৃষ্টি পিতার নিথর দেহের পানে নিবদ্ধ। কোমল কণ্ঠে পুনরায় শ্রাবণ বললো,“মৃত দেহ বেশিক্ষণ এভাবে ফেলে রাখা উচিত নয় নোভা। আমি গোসল করানোর ব্যবস্থা করছি। কবর দেওয়ার কথা ভেবেছ? কোথায় কবর দিবে? গোরস্থানে নাকি গ্ৰামের বাড়িতে? গোরস্থানে হলে তার ব্যবস্থাও না হয় আমিই করছি।”

এবার এক ঝলক শ্রাবণের পানে তাকালো নোভা। চোখ জোড়া রক্তিম হয়ে আছে তার। ভেজা ভারি স্বরে বললো,“বাবা বলে গেছেন তাকে যাতে দাদা দাদীর কবরের পাশে কবর দেওয়া হয়।”

“তো আত্মীয় স্বজনদের খবর দিয়েছো? বিশেষ করে তোমার চাচাদের?”

দুদিকে মাথা নাড়ায় অনুভা। শ্রাবণ ফের বলে,“জানাতে হবে তো। নাম্বার আছে?”

অনুভা কিছু বলার আগেই চটজলদি অর্থিকা বলে ওঠে,“কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। ওই বেঈমানদের তো একদম নয়।”

অতি বিনয় নিয়ে শ্রাবণ বলে,“এমন একটা সময় রাগ পুষে রাখা অনুচিত আপু। উনাদের সবটা জানানো উচিত। ভাইয়ের মৃ’ত্যু সংবাদ শুনে অন্তত উনাদের মন গলবে। তাছাড়া জানাজা থেকে শুরু করে কবর পর্যন্ত পরিচিত কাউকে তো লাগবেই তাই না?”

মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনলো অর্থিকা। অপরিচিত ছেলেটার কথায় খুঁজে পেলো যুক্তি। শ্রাবণ এবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,“নাম্বারটা?”

“উনাদের কারো নাম্বার আমাদের কাছে নেই।যেখানে যোগাযোগ নেই সেখানে নাম্বার?”

এবার কী বলবে, কী করা উচিত বুঝতে পারলো না শ্রাবণ। উঠে দাঁড়ালো। আপাতত গোসলের ব্যবস্থাটা করা উচিত। ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই শোনা গেলো সুফিয়ার কণ্ঠস্বর,“অর্থির বাবার মোবাইলে হয়তো আছে ওদের নাম্বার।”

উনার দিকে ফিরে চাইলো শ্রাবণ। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে বেদনার ছাপ। কপালে সুক্ষ্ম ক্ষত যাতে জমাট বেঁধে আছে র’ক্ত। শুকিয়ে গেছে মুখখানা। প্রশ্ন ছুঁড়লো,“উনার মোবাইলটা?”

প্রশ্নটি করে আশেপাশে চোখ বুলাতেই বালিশের কাছে দেখা মিললো একটি বাটন ফোনের। শ্রাবণ এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলো। কল লিস্টে ঢুকে পেয়েও গেলো মেজো ভাই দিয়ে সেভ করা একটি নাম্বার। একবার দুবার বাজতে বাজতে তৃতীয়বারের মাথায় রিসিভ হলো কল। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বিস্তারিত সবকিছু জানিয়ে দিয়ে ফোন কাটলো শ্রাবণ। বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। এবার নিজের পরিচিত কাউকে কল দিলো।
_______

গোসল শেষে মৃত দেহ রাখা হলো লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়িটায়। জানাজা পড়ানো হবে একেবারে গ্ৰামে নিয়ে। ফোন পেয়েই সেজো চাচা আর চাচাতো ভাইয়েরা তখনি রওনা দিয়েছিল নিজ বাড়ি থেকে। তারা আসতে আসতে একেবারে বিকেল হয়ে গেছে। মাকে তৈরি করে নিজেও তৈরি হয়ে নিলো অনুভা। সারাদিন পর তাঈমকে কোলে তুলে নিলো অর্থিকা।

সেই যে এখানে এসেছে শ্রাবণ, তারপর আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। এদিকের সবদিক একাই সামলেছে ছেলেটা। গ্ৰামে ফেরার জন্য গাড়িও ভাড়া করেছে। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। অনুভার সেজো চাচা আতিউর এসে দাঁড়ালেন তার পাশে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধালেন,“তুমি সম্পর্কে হেগো কী লাগো কও তো?”

ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো শ্রাবণের। ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো লোকটির পানে। আসার পর থেকেই লোকটি তার দিকে কেমন একদৃষ্টিতে যেনো বারবার পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিল। আর এখন সরাসরি এমন একটা প্রশ্ন? গভীর দৃষ্টিতে শ্রাবণও লোকটিকে দেখে নিলো। এও বুঝে ফেললো লোকটা যে তেমন সুবিধার নয়। সুবিধার হলে কী আর নিজ ভাইয়ের সঙ্গে এভাবে বেঈমানি করতে পারতো? শ্রাবণ স্বাভাবিক কণ্ঠে উত্তর দিলো,“হঠাৎ এই প্রশ্ন? কেন বলুন তো?”

“আসার পর থাইক্কাই দেখতাছি আগ বাড়াইয়া হেগোরে সাহায্য করতাছো,হুনলাম লাশের গোসলের ব্যবস্থাও নাকি তুমি করছো? ছোডো মাইয়ার লগে কোনো সম্পর্ক টম্পর্ক আছে নাকি?”

“প্রতিবেশী হিসেবে এতটুকু করা আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কাউকে সাহায্য করলেই যে তাদের সঙ্গে গভীর কোনো সম্পর্ক থাকতে হয় এ কথা কোত্থেকে শিখেছেন? ভাই মারা গেছে আপনার। কোথায় শোক পালন করবেন, কষ্ট পাবেন তা না করে কার সঙ্গে কার সম্পর্কে আছে, কে কাকে কেন সাহায্য করছে সেসব বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন কেন বলুন তো? আপনার কী ভাইয়ের মৃ’ত্যুতে কষ্ট লাগছে না?”

নড়েচড়ে উঠলেন আতিকুর। মলিন হয়ে গেলো উনার মুখশ্রী। কথাটা খুব ভালো করেই গায়ে লেগেছে। নিরবে সরে দাঁড়ালেন শ্রাবণের পাশ থেকে।

কয়েক মিনিট বাদে ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে নিচে নেমে এলো অনুভারা। গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে নিচে। শুকনো মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অনুভা। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শ্রাবণ। বললো,“আবারো বলছি নিজেকে শক্ত করো নোভা। জন্মালেই যে মানুষকে মরতে হয়। এটাই ভবিতব্য। ওখানে গিয়ে নিজের খেয়াল রেখো। সাথে মা-বোনের খেয়ালও কিন্তু রেখো।”

“হু।”

“তোমাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না আমার কিন্তু তোমার চাচার নজর ভালো ঠেকলো না। আমি চাই না আমার জন্য তোমাদের কাউকে কথা শুনতে হোক। সমস্যা হলে আমায় জানিও। আর হ্যাঁ একদম মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখবে না। ঠিক আছে?”

“হু।”—-এবারো ছোট্ট করে উত্তর দিলো অনুভা। তাকে আর ঘাঁটালো না শ্রাবণ। একটা দুঃখ ঘুচতে না ঘুচতেই আরেকটা দুঃখ যেনো হুমড়ি দিয়ে জেঁকে ধরে এই পরিবারটাকে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একে একে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। তারপরেই ছেড়ে দিলো গাড়িগুলো। যতক্ষণ পর্যন্ত দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্তই সেই পথে তাকিয়ে রইলো শ্রাবণ। পরিশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষের জীবন কত আশ্চর্য! দুনিয়াতে সুখের সন্ধান করতে করতে কখন যে মৃ’ত্যু হাতছানি দিয়ে ওঠে তাই টের পায় না কেউ।

চলবে ___________

(#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৮]

জানাজা শেষে কামরুল হাসানের মৃত দেহখানা আজীবনের জন্য কবরে রেখে বাড়ি ফিরে এলো সকলে। এতক্ষণ ধরে নিজেকে জোরপূর্বক বাহির থেকে সামলে নিয়ে অযু করে কোরআন পাঠ করল অনুভা। তাদের চাচাতো ভাইয়ের বউ তাঈমকে নিজ ঘরে নিয়ে গোসল করিয়ে একেবারে খাইয়ে দিয়েছে। সুফিয়া একটা বাক্যও আর কারো সঙ্গে বিনিময় করেননি। মূর্তির ন্যায় খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন। দৃষ্টি শূন্যে স্থির, ঠোঁট দুটো তরতর করে কাঁপছে। অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর কথাটা যেনো উনার উপর ফলে গেছে এক লহমায়। অর্থিকাও মাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও নড়ছে না কোথাও। চুপচাপ বসে আছে মায়ের পাশে।

রাত হয়েছে অনেক। গতকাল যেই মানুষটি এই দুনিয়ার সকল সুবিধা ভোগ করেছিল। যে গত রাতটাও নরম বিছানায় শরীর এলিয়ে আরাম করে শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছিল। আজ রাতটা সে আর এই দুনিয়ার বুকে নেই। আজ থেকে তাকে কাটাতে হবে ওই অন্ধকার কবরে। আজ থেকে ওইটাই যে তার ঘর।

বড়ো জা মরিয়ম খাবার হাতে ঘরে এলেন। অর্থিকার উদ্দেশ্যে আদেশের সুরে বললেন,“তোর ভাবী খাওন বাড়ছে। বইনরে লইয়া কিছু মুখে দে। এমনে না খাইয়া থাকলে শরীর কেমনে চলবো? মরা মানুষের লাইগ্গা অতো কানতে নাই।”

বিপরীতে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতেই মরিয়ম চোখ রাঙালেন। তাই আর কিছু বলতে পারলো না অর্থিকা। একবার মায়ের মুখশ্রীতে চোখ বুলিয়ে স্থান ত্যাগ করল। তার প্রস্থানেই মরিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সুফিয়ার পানে তাকালেন পূর্ণ দৃষ্টিতে। দুজনার শেষ দেখা হয়েছিল এইতো বছর তিনেক আগে। তখন সুফিয়া নামক এই নারীটির চেহারা ছিলো উজ্জ্বল, শরীরে ছিলো দামি শাড়ি এবং দামি গহনা। অথচ সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে চেহারায় বসে গেছে বাধক্যের ছাপ। চোখের নিচে কালি জমেছে। পরনের শাড়িটাও কমদামি। কানে ছোট্ট সোনার দুল। উনার এই অবস্থা দেখে নিজেদের বড্ড অপরাধী মনে হতে লাগলো মরিয়মের।

খাবার মাখিয়ে এক লোকমা ছোটো জায়ের মুখের সামনে ধরলেন তিনি। নড়েচড়ে উঠলেন সুফিয়া। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন মরিয়মের পানে। মরিয়মের চোখ জোড়াও ছলছল করছে। ভেজা গলায় বললেন, “পারলে মাফ কইরা দেইস তোর এই বোইনডারে। অমন একটা বিপদের সময় আমি তগো পাশে দাঁড়াইতে পারি নাই। এতগুলা বছর সংসার কইরাও কাছের মানুষরে চিনতে পারি নাই। তোর ভাসুরের লাইগ্গা তগো লগে যোগাযোগ পর্যন্ত করতে পারি নাই। মাফ কইরা দেইস আমারে।”

কথার তালে তালে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুজল। উনার চোখে অশ্রু দেখে শক্ত খোলসে আবৃত হৃদয়টাও যেনো কেঁদে উঠতে চাইলো সুফিয়ার। চোখ ভরে এলো পানিতে। বউ হয়ে প্রথম যখন এ বাড়িতে পা রেখেছিলেন তিনি তখন এই নারীটিই মাতৃ স্নেহে আপন করে নিয়েছিলেন সুফিয়াকে। বড়ো বোনের মতো সবকিছু শিখিয়ে পড়িয়ে গড়ে তুলেছিলেন আদর্শ স্ত্রী রূপে। এই মানুষটি যে নির্দোষ তা সুফিয়া জানেন কিন্তু ভাসুর ননদদের যে কখনোই তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না। তারা ঠকিয়েছে উনার স্বামী আর সন্তানদের। নিজেদের এই অবস্থার জন্য তারাও যে অধিক দায়ী।

তবে চোখের পানি মুছে নিলেন সুফিয়া। স্বামীর জন্য রবের নিকট দোয়া করলেন। তিলে তিলে অনেক গুলো দিন, মাস যে মানুষটা ভোগেছে। রোজ রোজ মেয়ের উপর বোঝা হয়ে থাকার দরুন আফসোস করে দৃষ্টি নত করেছে। সবই তো স্বচোক্ষে দেখেছেন সুফিয়া। তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃ’ত্যু নামক মুক্তি ধের ভালো।

জোরপূর্বক সুফিয়াকে কয়েক লোকমা খাইয়ে কক্ষ ত্যাগ করলেন মরিয়ম। সিদ্ধান্ত নিলেন আজ জায়ের সঙ্গেই রাতটা কাটাবেন তিনি।
______

দিন পেরিয়ে রাত, রাত পেরিয়ে নব্য দিনের সূচনা। অফিসে এসে আজও পরিচিত চেয়ারটা খালি দেখে তানিমের ফুরফুরে মেজাজটা তিরিক্ষ হয়ে উঠলো। নিজের কেবিনে ঢুকেই বসে পড়ল নির্ধারিত আসনে। বাম হাত দিয়ে আলগা করল গলার টাই। মোবাইল হাতে নিয়ে কল বসালো একটি নাম্বারে। তার মিনিট চারেক পর হাজির হলো নাহিয়ান। সালাম জানিয়ে শুধালো,“বলুন স্যার।”

“মিস.অনুভা কোথায়? গতকালও উনার চেয়ার খালি ছিলো এবং আজকেও খালি। অফিসে কোনো ধরণের ইনফর্ম না করেই এভাবে অফিস বন্ধ করা কী উচিত হচ্ছে উনার?”

ঘটনাটা নাহিয়ানও খেয়াল করেছে। মেয়েটা তো সহজে অফিস বন্ধ করে না। তাহলে? হলো কী? কোনো বিপদ ঘটেনি তো? তার এই নিরবতায় বেশ বিরক্ত হলো তানিম। বললো,“এভাবে চুপ করে থাকার জন্য তো তোমায় ডাকিনি নাহিয়ান। আমার এন্সার দাও।”

“আমি কীভাবে জানবো স্যার?”

“তোমার তো পরিচিত। না জানার তো কোনো কারণ দেখছি না আমি।”

“স্যরি স্যার। এ ব্যাপারে তো কিছু জানি না আমি। তাছাড়া ওর সঙ্গে অনেকদিন ধরে তেমন করে আমার কথাও হয়নি।”

আশানুরূপ কোনো উত্তর না পেয়ে মন ভার হলো তানিমের। মেয়েটাকে দুদিন ধরে না দেখে ভেতরটা অস্থিরতায় ছেয়ে যাচ্ছে তার। তার সঙ্গে সমান তালে চিন্তাও হচ্ছে। কোনো বিপদ ঘটলো না তো? মেয়েটা যেই ভুলোমনা আর বেখেয়ালি, তার সঙ্গে বিপদ আপদ ঘটাও তো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ভোরে মাকে নিয়ে বাবার কবরটা দেখে এলো অনুভা। সকালের নাস্তা সেরে বিছানায় বসতেই চাচাদের ডাক পড়ল বসার ঘরে। মাকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হতেই নজরে পড়ল চাচা-চাচী এবং চাচাতো ভাইদের।অর্থিকাও উপস্থিত আছে সেখানে।সোফার এককোণে মাকে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ল অনুভা।

চাচাদের মুখগুলো কেমন থমথমে। নিরবতা ভেঙে বড়ো চাচা নতজানু হয়ে বললেন,“নতুন কইরা কী আর কমু? আশেপাশের মাইনষের কটু কথা হুইন্না আর শয়তানের ফাঁদে পইড়া ভুল একটা কাম কইরাই ফেলাইছি। তুমগো তাড়াইয়া দিছি। তুমগো পরিস্থিতি সম্পর্কে যদি একটাবার জানতাম! কামরুলের অমন অবস্থার কথাও তুমগো জানানো উচিত আছিল আমাগো। তাইলে আমরা অন্তত সাহায্য করতে পারতাম।”

চট করে মেজাজ খারাপ হলো অর্থিকার। রাগত স্বরে বললো,“ভুল নয় বরং আপনারা অন্যায় করেছেন। আমাদের বাবাকে আপনারা ঠকিয়েছেন। কম উপকার তো বাবা আপনাদের করেনি, তারপরেও বেঈমানের মতো সব ভুলে গিয়ে বিপদের সময় আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাবাকে ঠকিয়ে সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিলেন। আর এখন বলছেন ভুল হয়েছে?”

আবারো পরিবেশটা থমথমে হয়ে গেলো। সকলের মুখ চুপসে গেলো। মেজো চাচা বললেন,“তার শাস্তি তো আর কম পাই নাই আমরা। তোমরা যাওয়ার কয়দিন পরেই সেজোর মাইয়া বেলীরে শ্বশুর বাড়িত্তে বাজা উপাধি দিয়া তাড়াইয়া দিলো। আমার পোলা নাজমুলরে বিদেশে যাওনের লাইগ্গা যেই টাকা দিছিলাম, সেই টাকাডা লইয়াও দালালে পলাইয়া গেলো। বড়ো ভাইজানের এক কিডনি নষ্ট। সেজো ভাবীও বছর দুয়েক আগে পানিতে ডুইবা মইরা গেছে। আর কত শাস্তি পামু কও তো? আমরা আমগো ভুল বুঝতে পারছি। এবার তুমগো সম্পত্তি তোমরা বুইঝা লও। আবারো কইতাছি কামরুলের এই অবস্থার কথা জানলে আমরা কিন্তু ঠিক তুমগো পাশে দাঁড়াইতাম।”

সুফিয়া এখনো বেশ স্বাভাবিক হয়ে বসে আছেন। উনার এই স্বাভাবিক ব্যবহারটাই ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিচ্ছে অনুভাকে। সারাক্ষণ যে মা অল্পতেই বাড়ি মাথায় করে রাখেন সেই মা কিনা এত এত ঘটনার মধ্যে নিরব! এ বড়ো আশ্চর্যজনক ব্যাপার। মৌন ব্রত ভেঙে সুফিয়া এবার মুখ খুললেন। ঠাণ্ডা স্বরে বললেন,“আমার স্বামী যা অপরাধ করেছে তার শাস্তি সে দুনিয়াতেই ভোগ করে গেছে। তার সাথে সাথে আমার মেয়েরাও সেই শাস্তি ভোগ করছে। তাই বলে আপনাদের আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। যা বিচার দেওয়ার তা রবের নিকট আমি দিয়ে দিয়েছি। তিনিই আপনাদের বিচার করবেন। একটা কথা জানেন কী? সব ভুলের ক্ষমা হয়না।সেদিন আপনারা যদি অমন করে না ঠকাতেন তাহলে আজ হয়তো আমাদের অবস্থা এতটা খারাপও হতো না। আমার স্বামীকে আফসোস নিয়ে বাঁচতে হতো না। আমার ছোটো মেয়েটাকে নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে গাধার মতো খাটতে হতো না। দোয়া করি আল্লাহ যাতে এর থেকেও খারাপ দিন আপনাদের দেখিয়ে তারপর মৃ’ত্যু দেয়।”

কথাগুলো বলা শেষ করতেই ভেতরটা হালকা হয়ে এলো সুফিয়ার। অনেক বছর ধরে যে ক্ষোভের দহনে পুড়ছিলেন তিনি। সময় নিয়ে তৎক্ষণাৎ স্থান ত্যাগ করলেন। ভাগ্নিদের উদ্দেশ্যে বড়ো চাচা মিনমিনে স্বরে বললেন,“আমগো উপর তোমাগো রাগ করাডা স্বাভাবিক মা। কম পাপ তো আর করি নাই জীবনে। শেষ বারের মতোন একটা সুযোগ দাও মা। নইলে মরার পর রবের সামনে দাঁড়ামু কেমনে কও তো? আর ফিইরা যাওয়ার দরকার নাই ওই অপরিচিত শহরে। এইহানেই তোমরা থাইক্কা যাও। তোমাগো বাবার সব সম্পত্তি আমি নিজ দায়িত্বে তোমাগো বুঝাইয়া দিমু। তোমাগো সব দায়িত্ব তোমাগো ভাইয়েগো।”

অর্থিকার ইচ্ছে হলো কড়া কিছু শুনিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার সেই ইচ্ছেকে পূর্ণতা না দিয়ে অনুভা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“তার কোনো প্রয়োজন নেই চাচা। যখন দায়িত্ব নেওয়ার ছিলো তখন তো আর নিতে পারেননি বরং জীবন নামক গভীর সাগরের মাঝখানে ছেড়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ওই মাঝপথ থেকে অনেক কষ্টে উঠে এসে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছেছি। নিজের দায়িত্ব নেওয়া শিখেছি।আপনাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই এখন। আপনাদের মুখোমুখি হওয়ারও কোনো ইচ্ছে ছিলো না আমার। কিন্তু ওই যে বাবার শেষ ইচ্ছে ছিলো কবরটা যাতে তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে দেওয়া হয়। তাই আসতে হলো। দয়া করে আমাদের নিয়ে আর কোনো চিন্তা করবেন না। আজই আমরা নিজেদের ঠিকানায় রওনা দিবো।”

কথাটা শেষ করে গটগট হেঁটে প্রস্থান করল অনুভা। অর্থিকাও তার পিছু নিলো‌। লোকগুলোর মুখ দেখেই অতীতের জঘন্য স্মৃতিগুলো চক্ষু পটে ভেসে উঠলো দু-বোনের।

বেশ কয়েকবার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটায় কল দিয়ে থামলো শ্রাবণ। বিপরীত পাশ হতে কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে চিন্তিত হলো মন। সেই চিন্তার ছাপ ভাঁজ পড়া ললাটেও উদীয়মান হয়ে উঠলো। ইচ্ছে জাগলো ছুটে চলে যেতে অনুভার কাছে। কিন্তু ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হলো তাকে। হাত-পা যে তার অদৃশ্য এক শিকলে বাঁধা। এই সময়টায় মেয়েটার পাশে ছায়ার মতো থাকতে না পারার কষ্টে ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ছারখার হয়ে যেতে লাগলো।

খানিকক্ষণ বাদে অনুভার কল এলো।কল কেটে দ্রুত ব্যাক করল শ্রাবণ। চিন্তিত, উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তুমি ঠিক আছো তো নোভা? কতগুলো কল দিলাম ধরলে না কেন? আন্টি, অর্থি আপু, তাঈম ওরা ঠিক আছে তো?”

“হুম সবাই ঠিক আছে।আসলে মোবাইলটা সাইলেন্ট অবস্থায় ঘরে রেখে গিয়েছিলাম তো তাই ধরতে পারিনি।”

চিন্তা কিছুটা হলেও এবার হ্রাস পেলো শ্রাবণের। কণ্ঠে নমনীয়তা এনে শুধালো,“খেয়েছো?”

“হুম।”

“ফিরতে কী দেরি হবে?”

“না আজকালের মধ্যেই চলে আসবো।”

“একা একা আসার প্রয়োজন নেই,পুরো লোকেশনটা পাঠিয়ে দিও আমি এসে নিয়ে যাবো তোমাদের।”

“আর কত সাহায্য করবে বলো তো?একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো উপর নির্ভর হতে চাই না আমি। সবাই মাঝপথে ফেলে চলে যায়। একা করে দিয়ে যায় আমাদের। বাকি পথটাও যে একাই চলতে হবে। তাই নতুন করে আর কাউকে প্রয়োজন নেই আমার।”—-
কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠলো অনুভার। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল জলরাশি।

শ্রাবণের মুখশ্রী মলিন হয়। গাঢ় স্বরে বলে,“আমি তো ইহজন্মের জন্যই তোমার একাকিত্ব দূর করে দিতে চাই নোভা। তোমার জীবনের দুঃখ কষ্ট ঘুচিয়ে দিতে চাই। তোমার চলন্ত পথ বদলে দিতে চাই। একবার শুধু বিশ্বাস করে আমার হাতটা ধরো। কথা দিচ্ছি মৃ’ত্যু ব্যতীত তোমার ওই হাত ছাড়বো না আমি।”

আচমকা কেঁদে উঠলো অনুভা। ক্রন্দনরত কণ্ঠে বললো,“এই মৃ’ত্যুটাই তো সব শ্রাবণ। এই মৃ’ত্যুটাই আমাদের একা করে দিয়ে যায়। এই মৃ’ত্যুর কারণে একে একে সবাই হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।”

“প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃ’ত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই বলে তুমি কাউকে ভালোবাসবে না? চিরকাল বুকের ভেতর এক সমুদ্র দুঃখ পুষে রেখে একা থাকার সিদ্ধান্ত নিবে? একবার ভালোবেসে দেখো না নোভা।”

“ভয় করে, শেষে যদি আপুর মতো অবস্থা হয়? যদি ভালোবাসা নামক বিষ গলাধঃকরণ করলে মানসিক অসুখ নামক মৃ’ত্যু হয় আমার? তখন! তখন কী হবে?”

“প্রতিটি জিনিসের মন্দ দিক যেমন থাকে তেমন ভালো দিকও থাকে। এমনও তো হতে পারে তোমার ক্ষেত্রে উল্টো ঘটলো? বিষ নয় বরং ভালোবাসা নামক অমৃত সুধা পান করে তোমার সুখের অসুখ হলো। তখন?”

নিরব হয়ে গেলো অনুভা। কখনো তো এমন করে ভেবে দেখেনি সে। ভালোবাসা কী আদৌ অমৃত হতে পারে? ভালোবাসা কী পারে জীবন বদলে দিতে? এমন প্রমাণ তো কখনো পায়নি সে। তবে? এসব ভাবনাতেই মস্তিষ্ক এলোমেলো হয়ে গেলো অনুভার। বিপরীত পাশ হতে আকুল আবেদনী কণ্ঠে শুধালো,“অনেক তো হলো ভালোবাসাকে ঘৃণা করা। এবার একটু ভালোবেসে ভালোবাসায় গা ভাসিয়ে দেখো না নোভা। তোমার ভালোবাসার তৃষ্ণায় যে একজন প্রেমিক পুরুষ তৃষ্ণার্ত হয়ে ছটফট করছে। একবার শুধু বিশ্বাস করে ভালোবেসে দেখো। কথা দিচ্ছি ঠকবে না। শ্রাবণের হাত ধরলে তুমি ঠকবে না।সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখবো তোমায়।”

কী সুন্দর আবদার! এই আবদারের বিপরীতে কী আদতে ‘না’ শব্দটি উচ্চারণ করা সম্ভব? যায় কী এমন স্নিগ্ধ পুরুষের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা? হয়তো যায় না। অনুভা নামক কঠিন হৃদয়ের মেয়েটি হাজারবার চেয়েও পারলো না তা উপেক্ষা করতে। তবে অজস্র জড়তার কারণে সরাসরি সেই আবদার মঞ্জুরও করতে পারলো না। মৌন রইলো। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো তার।

ছোট্ট একটি শব্দ শোনার আশায় উতলা হয়ে বসে থাকা শ্রাবণ নামক পুরুষটি জিভ দিয়ে নিজের শুকনো ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে শুধালো,“এবারের উত্তরটা কী হ্যাঁ ধরে নিবো নোভা? বাসবে কী ভালো?”

এবারও উত্তর এলো না বিপরীত মুখী হতে। দুদিকে মিনিট দুয়েক নিরবতা চললো পাল্লা দিয়ে। শ্রাবণ আর কিছু বললো না। চাইলো না জোর করতে। সময় দিলো পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার। অনুভা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,“রাখছি।”

চলবে _________

(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে