#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১২]
আজ অফিস থেকে সকল কর্মচারীকে স্যালারি দেওয়া হয়েছে। স্যালারির পুরো টাকাটাই একাউন্টে প্রবেশের ম্যাসেজ দেখে থ হয়ে গেলো অনুভা। স্যার না বলেছিলেন বেতন থেকে তিন হাজার টাকা কেটে রাখবেন? তাহলে পুরো টাকাটা কেন দিলেন? ইচ্ছেকৃত নাকি ভুলবশত? অফিসের সঙ্গে জড়িত এমন কিছুতে তো তানিমের কোনো ভুল হওয়ার কথা নয়। প্রতিটি কর্মচারীর কাছ থেকে কড়ায় গন্ডায় হিসাব নেয় সে। পরক্ষণেই অনুভার মনে পড়ল, হয়তো নাহিয়ান পরিস্থিতিটা সামলে নিয়েছে। মনে মনে নাহিয়ানের উপর আবারো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল অনুভা। এই লোকটি কত সাহায্যই না করছে তাকে।
অফিস থেকে বের হয়ে নিচে নামতেই দেখা মিললো তানিমের। নিজ গাড়ির সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। আজ অফিস থেকে একটু আগেই নাহিয়ান বেরিয়ে গেছে। তানিমকে পাশ কাটিয়ে স্থান পরিত্যাগ করার জন্য সামনে পা বাড়ালো অনুভা। তৎক্ষণাৎ তানিম বলে ওঠলো,“কী ব্যাপার মিস. অনুভা? দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছেন যে?”
পথিমধ্যে অনুভার পা থামে। ভদ্রলোকের কণ্ঠের কঠোরত্ব টের পায়। পিছু ফিরে সৌজন্য হাসে। কিন্তু কী বলবে বুঝতে পারে না। গাড়ির পেছনের দ্বার খুলে দেয় তানিম। অনুভার পানে চেয়ে বলে,“নিন উঠুন। বাড়ি পর্যন্ত আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“তার প্রয়োজন নেই স্যার। আমি যেতে পারবো।”
“আপনার মতামত তো জানতে চাইনি মিস.অনুভা। আপনি যে যেতেন পারবেন তা আমি জানি। রোজ তো জানই আজ না হয় আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“আসলে স্যার…”
বাক্যাংশ শেষ হতে না দিয়েই হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় তানিম। কঠোর গলায় বলে,“না শুনতে আমি অভ্যস্ত নই অনুভা। উঠুন।”
ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলো অনুভা। বস হয় বলে কিছু বলতেও পারে না লোকটাকে। কিন্তু হুট করে এনার আচরণের পরিবর্তন দেখে বেশ চমকিত অনুভা। আর কথা না বাড়িয়ে নিরবে উঠে পড়ল গাড়িতে। তানিমও উঠে তার পাশের আসনে বসলো। চালকের আসনে বসে আছে তানিমের ব্যক্তিগত ড্রাইভার নয়ন। ছুটে চললো গাড়ি। কেমন এক ইতস্ততবোধ জেঁকে ধরলো অনুভাকে। কখনো কী সে কল্পনা করতে পেরেছিল যে এই রগচটা বসের গাড়ি করে তাকে বাড়ি ফিরতে হবে? ভেতরে শুরু হলো পিনপতন নিরবতা।
নিরবতা ভেঙে তানিম প্রশ্ন ছুঁড়লো,“তা মিস.অনুভা কে কে আছে আপনার পরিবারে?”
তানিমের দিকে না ফিরেই অনুভা উত্তর দিলো, “বাবা-মা, বড়ো বোন আর তার নয় মাসের একটা বাচ্চা।”
“ওহ, তা বোনের হাজব্যান্ড কোথায়?”
“মারা গেছেন।”
মন ভার হলো তানিমের। কণ্ঠস্বর নরম হয়ে এলো। পুনরায় শুধালো,“কীভাবে মারা গেছেন উনি?”
“বাস দুর্ঘটনায়।”
“ওহ, তা আপনার বাবা কিছু করেন না?”
“বাবা প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় শায়িত তার সাথে ক্যান্সারের রোগী।”
“তার মানে আপনিই আপনার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি?”
“হ্যাঁ।”—অনুভার সহজ উত্তর। তাতে নেই কোনো কষ্টের ছাপ।
মেয়েটির কথা শুনে হুট করেই তানিম অনুভব করল তার কষ্ট হচ্ছে। মানব জীবন বড়োই অদ্ভুত। কারো জীবনে সুখ আর সুখ আবার কারো জীবনে শুধুই দুঃখ কষ্টতে ভরপুর। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই গাড়ি থামাতে বললো অনুভা। তার নির্দেশে দ্রুত গাড়ি থামালো চালক। তানিমের পানে তাকাতেই দৃষ্টিগোচর হলো তার প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি। সৌজন্য হাসলো অনুভা। তার উদ্দেশ্যে বললো,“এখান থেকে আমার বাড়ি যেতে তিন-চার মিনিটের পথ। বাকি পথটুকু আমি একাই যেতে পারবো স্যার। পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।”
প্রত্যুত্তরে শুধুই মাথা নাড়ালো তানিম। অনুভা প্রস্থান করল। তার যাওয়ার পথে তাকিয়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য নয়নকে তাড়া দিলো তানিম।
বালিশের উপর উবু হয়ে শুয়ে কারো সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছে সৌহার্দ্য। চোখেমুখে ফোটে উঠেছে তার অসহায়ত্ব। স্ক্রীনে ভাসছে একটি মেয়েলী মুখ। মেয়েটির চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি তার প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে ঝগড়া করছে। কিন্তু অপরপাশ হতে মনঃপুত উত্তর না পেয়ে রাগটা তার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিনা কারণে প্রেমিকার এমন ঝগড়ায় এবার চরম বিরক্ত হলো সৌহার্দ্য। বাজখাঁই গলায় বললো,
“এবার একটু চুপ করবে প্রান্তি? জাস্ট অসহ্য লাগছে।”
তার এতটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো প্রান্তি নামক মেয়েটির রাগ নামক আগুনের লেলিহান শিখা বৃদ্ধি করার। শক্ত কণ্ঠে বললো,“অসহ্য লাগছে! আমায়? বিডিতে গিয়ে তো তোমার ভালোই উন্নতি হয়েছে দেখছি।”
“তোমার সমস্যা কী বলবে? সারাদিন পর একবার কল ধরার সময় পাও অথচ এই সময়টাও ঝগড়া করে কাটাতে হবে? কী এমন বললাম যে এত চটতে হবে তোমাকে?”
“আমার আবার কীসের সমস্যা? আমার তো কোনো সমস্যা নেই। সব সমস্যা তোমার। তুমি রীতিমতো আমাকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছো।”
“চাপ কোথায় দিলাম? আমি কী বলেছি এখনি বিয়ে করো? আমি শুধু বলেছি আমার মা তোমায় দেখতে চাইছে।”
“কেন দেখতে চাইবে? আমি কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবো না। আর না আমি এখন বিডিতে যাবো।”
“আহা বিডিতে আসতে কে বলেছে? এখন আমরা যেভাবে কথা বলি সেভাবেই মায়ের সঙ্গে কথা বলবে। দিনের বেলায় না হয় তোমায় ভিডিও কল দিবো।”
প্রান্তির চোখেমুখে ফোটে উঠলো বিরক্তির ছাপ। বললো,“বাঙালি ছেলের সঙ্গে রিলেশনে জড়ানোটাই আমার সবচেয়ে বড়ো ভুল হয়েছে। তোমরা সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকো কেন বলো তো? কই আমার মা তো তোমায় দেখতে চায়নি কখনো।তাহলে তোমার মা কেন দেখতে চাইবেন? থার্ড ক্লাস যত্তসব। রিলেশন হতে না হতেই বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায় এরা।”
প্রান্তির কথায় হতবাক হয়ে গেলো সৌহার্দ্য। তার মাকে নিয়ে মেয়েটার মনে এত বাজে বাজে চিন্তা উদয় হয়েছে?কই সম্পর্কের শুরুতে তো এমন ছিলো না প্রান্তি, তাহলে? আর না কখনো মেয়েটিকে এই সম্পর্কে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল সৌহার্দ্য। সে তো নিজ থেকেই এসেছিল তার কাছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সৌহার্দ্য। স্ক্রীনে গাঢ় দৃষ্টি ফেলে শুধায়,“বাঙালি তো তুমিও। তাহলে বাঙালিদের নিয়ে এতো হীন চিন্তা কেন এলো তোমার মাথায়?”
প্রান্তি নিশ্চুপ। বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় মগ্ন সে। সৌহার্দ্যের চোয়াল শক্ত হলো তার নিরবতায়। বললো,“রিলেশনটা নিয়ে তুমি আর খুশি নও তাই তো? আমাকে আর ভালো লাগে না তোমার? অথচ আমি তোমায় নিয়ে বাকিটা পথ, বাকিটা জীবন অতিক্রম করতে চেয়েছিলাম। ব্রেকআপ করতে চাও সেটা সরাসরি বলে দিলেই হতো।আমার মাকে থার্ড ক্লাস বলে হীন মানসিকতার প্রমাণ দিয়ে নিজেকে ছোটো করার কোনো প্রয়োজনই ছিলো না।”
চমকে গেলো প্রান্তি। অফিসের কিছু কাজে ইদানিং সে প্রচন্ড ডিস্টার্ভ। রাগের মাথায় কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজেই জানে না। তার এই নিরবতা দেখে সৌহার্দ্যের রাগও বৃদ্ধি পেলো। যদিও ছেলেটা সহজে রাগে না। নিজেকে ঠান্ডা, শান্ত রাখার অধিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা তার আছে কিন্তু মায়ের অপমান কিছুতেই মেনে নেওয়ার ছেলে সে নয়। ফের কঠিন স্বরে বললো,“যাও ব্রেকআপ তোমার সঙ্গে। আর কখনো তোমায় বিরক্ত করা তো দূরে থাক আজকের পর থেকে তোমায় আমি চিনি না।”
কথাটা শেষ করেই কল কেটে মেয়েটিকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে দিলো সৌহার্দ্য। এই মুহূর্তে সবকিছু তার নিকট অসহ্য লাগছে। হুট করে প্রিয় মানুষের বদলে যাওয়াটা মেনে নেওয়াটা যেনো দুষ্কর। হাতের মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেললো মেঝেতে। কানাডায় পড়তে গিয়ে প্রান্তি নামক মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয় সৌহার্দ্যের। একই ক্লাস একই ডিপার্টমেন্ট হওয়ায় রোজই দেখা হতো দুজনার। বাঙালি হওয়ায় আগ বাড়িয়েই সৌহার্দ্য বেশ কয়েকবার কথা বলেছিল তার সঙ্গে। তবে কথা বলার প্রধান কারণই ছিলো নোটস। সৌহার্দ্যের মনে পড়ে না লেখাপড়ার বাহিরে কবে সে কথা বলেছিল এই মেয়েটির সঙ্গে। শান্তা রোজ রোজ ছেলেকে কল করে বারবার মনে করিয়ে দিতেন,“শোন সহু, ওইসব বিদেশিনী মেয়ের প্রেমে কিন্তু একদম পড়বি না। বিদেশি মেয়েরা ভালো হয় না। আমি তোর জন্য একটা ধার্মিক মেয়ে খুঁজে এনে দিবো। ইহকালও শান্তি, পরকালও শান্তি।”
পরিচয়, বন্ধুত্বের বছর তিনেক পার হতেই সৌহার্দ্যের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে প্রান্তি। একসময় বন্ধু-বান্ধব সকলের সামনে নিজের মনের কথা সৌহার্দ্যকে জানিয়েও দেয়। দেয় রিলেশনশিপে যাওয়ার প্রস্তাব। সঙ্গে সঙ্গে তার সেই প্রস্তাব নাকোচও করে দিয়েছিল সৌহার্দ্য কিন্তু একটা সময় সে হার মেনে নেয়। কথায় কথায় পুত্রবধূ হিসেবে মায়ের কেমন মেয়ে পছন্দ, অপছন্দ তাও জানিয়ে দিয়েছিল তাকে। তা শুনে প্রান্তি বলেছিল,“শাশুড়ি মায়ের ছেলেকে পাওয়ার জন্য না হয় নিজেকে একটু পরিবর্তনই করে নিলাম।শাশুড়ি মায়ের মনের মতো বউমা হয়ে উঠলাম। এ আর কী এমন কঠিন কাজ?”
সেদিনের সেই মেয়েটির মধ্যে আজ কত বদল!আবারো প্রমাণিত হলো মানুষ বদলায়, মানুষের মন বদলায়।
________
রাত যত গভীর হচ্ছে ততোই চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে শিউলি ফুলের সুবাস। এত রাতেও ঘুম নেই শ্রাবণের চোখে। বিশাল ছাদটায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা শিউলি গাছটাতে শুভ্র রঙা ফুল ফোটেছে। নরম বিছানা ছেড়ে অনেকক্ষণ ধরে ছাদে এসে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সদ্য ফুটন্ত ফুলের পানে। গত শরতে যে গাছটি তার সবুজ পাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সেই গাছটিতেই এই শরতে ফুলে ফুলে ভরা। কিছু একটা মস্তিষ্কে উঁকি দিতেই ঠোঁটের কার্নিশে চওড়া হাসি ফোটে উঠলো শ্রাবণের।
গাছ থেকে অজস্র ফুল পেড়ে বোঝাই করল পরিধেয় ট্রাউজারের পকেটে। তারপর নিঃশব্দে নেমে গেলো ছাদ থেকে। শব্দহীন কদম ফেলে ঘর থেকে গাড়ির চাবিটা এনে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
সারাদিন কাজে ডুবে থাকায় বাড়ি ফিরতে হয় ক্লান্ত শরীর নিয়ে। ক্লান্ত শরীর বিছানায় ফেলতেই রাজ্যের ঘুম এসে আবেষ্টিত করে নেয় অনুভাকে। জীবনে এত অপূর্ণতা, দুঃখ, চিন্তা থাকার পরেও ঘুমের সঙ্গে যেনো মেয়েটার গোপন কোনো সন্ধি রয়েছে। বরাবরের মতো আজও সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাঈমকে এখন নিজের কাছেই রাখে অর্থিকা। যত্ন করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়,খাওয়ায় বাদ বাকি কাজও করে। দিন যত পার হচ্ছে ততোই মেয়েটা আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তাই এখন অনুভার কাজটা একটু লাঘব হয়েছে।
কিন্তু অনুভার ঘুমটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। কারো নিকট হয়তো তার এই শান্তির ঘুমটা পছন্দ হলো না।মোবাইল বেজে উঠলো ঝংকার তুলে। পরপর কয়েকবার। চোখ আধ বোজা করে মেলে কল রিসিভ করল অনুভা। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শুধালো,“হ্যালো কে?”
“আমি।”
“আমি? আমি কে?”
“শ্রাবণ।”
মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো অনুভার। ঘুমের নেশা কেটে গেলো মুহূর্তেই। কণ্ঠের সেই ঘুমঘুম ভাবটাও আর নেই। তার নিরবতায় অপরপাশ থেকে ভেসে এলো আকুল আবেদন,“আমি নিচে দাঁড়িয়ে আছি। আসবে একবার? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তোমায়।”
অবাক হলো অনুভা। ঘড়িতে ২টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। এত রাতে এই ছেলে নিচে দাঁড়িয়ে? দ্রুত কল কেটে মাথায় ভালো মতো ওড়না জড়িয়ে নিয়ে গায়ে জড়ালো একটা চাদর। রাতে বাড়ির মেইন গেইটে তালা দেওয়া থাকে কিন্তু প্রত্যেক ফ্ল্যাটেই একটা করে চাবি দিয়ে রেখেছে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। ফ্ল্যাটের দরজা বাহির থেকে লক করে নিচে নামলো অনুভা। গেইটের তালা খুলে বের হতেই হলুদ লাইটের টিমটিম আলোয় স্পষ্ট ফোটে উঠলো পরিচিত, আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির মুখশ্রী।
হাত ভাঁজ করে সামনের বিল্ডিং এর দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রাবণ। অনুভাকে দেখতে পেয়েই বহুল প্রতীক্ষিত হাসিটা বিস্তর লাভ করল তার অধরে। চমকিত মুখশ্রী দেখেই ভেতরে ভেতরে তৃপ্ত হলো। এগিয়ে এসে ছেলেটির সম্মুখে দাঁড়ালো অনুভা। কিন্তু তাকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়েই শ্রাবণ বলে উঠলো,“চলো।”
“কোথায়? তার আগে বলো তুমি এত রাতে এখানে কেন?”
“আসা বারণ?”
“জানি না।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো শ্রাবণ। উপায়ন্তর না পেয়ে অনুভাও দূরত্ব রেখে তার পিছুপিছু হাঁটতে লাগলো। গলি পার হয়ে উঠে এলো মেইন রাস্তায়। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। হাঁটতে হাঁটতেই অনুভা প্রশ্ন করল,“যাচ্ছি কোথায় আমরা? এত রাতে ঘর বাড়ি ছেড়ে এখানে কী করছো?”
“কোথায় যাচ্ছি জানি না তবে তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই চলে এসেছি।”
“এতদিন পর হুটহাট কেন দেখতে ইচ্ছে করবে? মাঝখানে তিন বছরের মতো সময় যে একেবারে না দেখেই কাটিয়ে দিয়েছো, তখন কেন এসব দেখা দেখির শখ জাগেনি? হুট করে আবার কোত্থেকে না কোত্থেকে উদয় হয়ে ঢং দেখানো হচ্ছে?”—কণ্ঠে অনুভার ক্ষোভ ঝরে পড়ল।
কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই পথিমধ্যে থেমে গেলো শ্রাবণ। অনুভার মুখশ্রীতে দৃষ্টি স্থির রেখে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।তার এহেন দৃষ্টিতে ঘাবড়ে গেলো অনুভা। মনের গহীনে ঘিরে ধরলো অনুশোচনায়। রাগের মাথায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে কথাগুলো। শ্রাবণের মুখশ্রীতে পূর্বের হাসিটা এখনো বিদ্যমান। বাম ভ্রু উঁচিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,“কোত্থেকে না কোত্থেকে উদয় হয়েছি মানে? আমার অনুভূতি তোমার নিকট ঢং মনে হয় নোভা? স্বাভাবিক এবং ভালো আচরণ করছি বলে নিজের মনঃপুত যা ইচ্ছে ভেবে নিচ্ছো?”
“তুমি যা ভাবছো আমি আসলে….”
কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিলো শ্রাবণ। বললো,“বাহিরে যাওয়ার কথা তোমায় আমি আগেই জানিয়েছিলাম। এমনকি চিঠিতেও সবকিছু লিখেই গিয়েছিলাম। যোগাযোগ করার জন্য নাম্বারটা পর্যন্ত দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি কোনো রেসপন্ড করোনি।। এখন আবার এটা বলো না চিঠিটা তুমি পাওনি। আমি জানি চিঠিটা তুমি পেয়েছিলে এবং পুরো চিঠিটাই মনোযোগ সহকারে পড়েছ। কতগুলো দিন তোমার একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছি তা কী তুমি জানো? জানলে নিশ্চয়ই এমনটা করতে পারতে না। অপেক্ষা করাটা যে কতটা কষ্টের তা শুধু তারাই জানে যারা অপেক্ষা করে। এতে অবশ্য তোমার উপর আমার চরম রাগ হওয়ার কথা ছিলো। রাগ হয়েছিলও বটে। খুব রাগ হয়েছিল তোমার প্রতি। ইচ্ছে করছিল ওখান থেকে এসেই তোমার নরম ফর্সা গাল দুটো একেবারে গরম করে দিতে।”
হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অনুভা। দম ছাড়লো শ্রাবণ। ফের বললো,“যখন তোমার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারলাম তখন সেই পুষে রাখা রাগ গুলো এক নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। যার জীবনটাই এত এলোমেলো হয়ে গেলো তার উপর রাগ পুষে রেখেই বা কী লাভ?”
নরম হলো অনুভার মন। এই মুহূর্তে নিজেকে বড্ড অসহায় ঠেকছে নিজের কাছে। কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বললো,“সব যখন জানতেই তাহলে আবার কেন এলে আমার জীবনে? তুমি বুদ্ধিমান পুরুষ। বুদ্ধিমান পুরুষদের এমন বড়ো বড়ো ভুল করা মানায় না শ্রাবণ। আমার সামনে আসা যে তোমার মোটেও উচিত হয়নি।”
মুচকি হাসলো শ্রাবণ। পূর্বের ন্যায় আবারো হাঁটতে লাগলো সামনের পথ ধরে। বললো,“তোমারও উচিত হয়নি তোমার বসের গাড়িতে করে বাড়ি পর্যন্ত ফেরা। চাকরি করলেই যে অফিসের বসের গাড়িতে করে বাড়ি ফিরতে হবে এমন কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম তো নেই নোভা।”
পূর্বের ন্যায় হতবাক, হতভম্ব হলো অনুভা। শ্রাবণ কী করে জানলো এ কথা? থামলো শ্রাবণ। পেছনের দিকে এগিয়ে এলো। মেয়েটির প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টি অবজ্ঞা করে পকেট থেকে বের করল সঙ্গে করে নিয়ে আসা ফুলগুলো। বাড়িয়ে দিলো অনুভার দিকে। অনুভা হাত দুটো উঁচু করে ধরলো তার সম্মুখে। গ্ৰহণ করল সেই ফুল। নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে পরম আবেশে শুঁকে নিলো সেই সুমিষ্ট ঘ্রান।
প্রেয়শীর মুখশ্রীতে তৃপ্তির রেখা দেখতেই চমৎকার হাসলো শ্রাবণ। নেশাতুর কণ্ঠে বললো,“তুমি স্নিগ্ধ ঠিক এই শুভ্র শিউলির মতো। তুমি সুন্দর এই শরৎ এর মতো। তুমি চঞ্চল বর্ষার মেঘমালা। তুমি শ্রাবণের প্রিয়তমা নোভা।”
পুরো দেহখানা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠলো অনুভার। লোম কূপ জাগ্ৰত হলো। সতেজ হয়ে উঠলো ভগ্ন হৃদয়। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো শ্রাবণ। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,“আ’ম জেলাস নোভা। আই গেট জেলাস হয়েনএভার আই সি ইউ উইথ সামওয়ান এলস্।”
চলবে _________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১৩]
বাকি রাতটা অনুভা নির্ঘুমে কাটালো। শ্রাবণ চলে যেতেই বাড়িতে ফিরে এসেছে সে। বালিশের উপর শ্রাবণের দেওয়া শিউলি ফুলগুলো রেখে অযু করে এসে ফজরের নামাজটা পড়ে নিলো। তারপর কোরআন তেলাওয়াত করে পা বাড়ালো রান্নাঘরে। অধিকাংশ সময় মা-বোনের সঙ্গে কাটাতে কাটাতে রান্নাটা খুব ভালো ভাবেই আয়ত্বে এনেছে অনুভা। সকালের নাস্তাটা তৈরি করে ফের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল সে।
বেলা বাড়লো।সাড়ে সাতটায় বাড়িতে প্রবেশ করতেই বাবা-মায়ের মুখোমুখি হতে হলো শ্রাবণকে। পুত্রকে দেখতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন শান্তা। মুখশ্রীতে উনার চিন্তার ছাপ। এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে পুত্রের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,“এত ভোরবেলা কোথায় গিয়েছিলি? ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠে দেখি তুই ঘরে নেই। কোথায় ছিলি এতক্ষণ?”
“ঘুম আসছিল না মা তাই ছাদে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আজান দিয়ে দিলো তখনি ওখান থেকে একেবারে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ে মর্নিং ওয়াক করে ফিরলাম।”
পুত্রের কথা বিশ্বাস করে নিলেন শান্তা। চিন্তিত মুখখানা থেকে কেটে গেলো চিন্তার রেশ। বললেন,
“আচ্ছা ঘরে গিয়ে তবে ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা দিচ্ছি।”
মায়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায় শ্রাবণ। মাকে সে মিথ্যে বলেনি। প্রতিটি কথাই সত্য শুধু অনুভার সঙ্গে দেখা করার কথাটাই ছিলো গোপনীয়।
ছোটো ছোটো কদম ফেলে সোফায় এসে বসলো সৌহার্দ্য। বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়েছে। সকালের নাস্তা সেরে সময় মতো নিজ কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে শ্রাবণ।
গতকাল মেঝেতে মোবাইল ছুঁড়ে মারায় মোবাইলের স্ক্রীনের অবস্থা নাজেহাল। ভাঙা স্ক্রীনের পানে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্য। দূর থেকে ছেলেকে নিবিড়ভাবে বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন হানিফ শেখ। মুখোমুখি হয়ে সোফায় বসে পড়লেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“রাগ করা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। কিন্তু হাতের সামনে যা পাবো তাই ছোড়াছুড়ি করবো এমন রাগ ভালো না। এমন ধরণের রাগে ক্ষণিকের জন্য আনন্দ পাওয়া গেলেও রাগ কমার পর আফসোস করতে হয়। নিজের পকেটের টাকা নষ্ট হয়। তাই আমি কখনোই রাগ করে জিনিসপত্র ছোড়াছুড়ি করি না। সেখানে আমার ছেলে হয়ে তুই কী করে এমনটা করতে পারলি? কাজটা করা তোর মোটেও ঠিক হয়নি। অনুচিত কাজের জন্য তোর কঠিন শাস্তি পাওয়া উচিত। তোর এই ভাঙাচোরা মোবাইল মেরামতের জন্য একটি পয়সাও আমি দিবো না। আর এটাই হচ্ছে তোর শাস্তি।”
দৃষ্টি নড়েচড়ে পিতার মুখশ্রীতে গিয়ে স্থির হলো সৌহার্দ্যের। ভাঙা মোবাইল আড়াল করল পেছনে। আমতা আমতা করে বললো,“রাগ করে কিংবা ইচ্ছে করে ফেলিনি বাবা। হাত থেকে ফসকে মেঝেতে পড়ে ভেঙে গেছে।”
“তুই কী ভেবেছিস? মিথ্যে বললেই সুরসুর করে আমি তোকে টাকা বের করে দিবো? জিন্দিগিতেও না।”
“আমায় বিশ্বাস করলে না বাবা?”
“এই বয়স তো আমিও পার করে এসেছি। বিশ্বাস করি কী করে বল তো বাবা?”
ভ্রু বাঁকালো সৌহার্দ্য। চোখেমুখে তার সন্দেহ। প্রশ্ন করল,“তুমিও কী ভাঙচুর করতে নাকি?”
উপর নিচ মাথা নাড়ালেন হানিফ শেখ। পিতার থেকে আশানুরূপ উত্তর পেয়ে অতি উৎসাহিত হয়ে উঠলো সৌহার্দ্যের মুখখানা। তার এই অতি উৎসাহিত ভাব দেখে বুক ফোলালেন হানিফ শেখ। পুত্রের কাছে উপস্থাপন করতে লাগলেন নিজের অতীতের রাগের বশে করা ভাঙাচোরার গল্প। পিতার কাহিনী শুনে মুহূর্তেই মনটা ভালো হয়ে গেলো সৌহার্দ্যের।
পেশায় হানিফ শেখ কলেজের একজন অধ্যক্ষ। এই তো বছর দেড়েক আগে রিটায়ার্ড করেছেন। অবসর সময়টা পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গেই কেটে যায় উনার। কলেজে উনি সিংহ হলেও বাড়িতে যেনো একেবারে ভেজা বেড়াল।স্ত্রীর মতো ছেলেদের সঙ্গে অতোটা বন্ধুসুলভ মেলামেশা না থাকলেও খুব সহজেই যেনো ছেলেদের মন পড়ে ফেলতে পারেন ভদ্রলোক। কথার একপর্যায়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। বললেন,“বাবার ছায়াতলে যতদিন ছিলাম ততদিনই এই রাগ ক্ষোভ, ভাঙাচোরার বদ অভ্যাসগুলো ছিলো। বাবাও চলে গেলেন, নিজে উপার্জন করতে শিখলাম তখন আর রাগ হলেই ভাঙচুর করতে পারতাম না। রাগের মাথায় যাই করি না কেন খেসারত তো নিজেকেই দিতে হবে। ভাঙচুর আমি করলে টাকা তো আমারই যাবে।”
আফসোস করে কথাটা বলে পুত্রের পানে তাকালেন হানিফ শেখ। মুহূর্তেই আঁতকে উঠলেন। সৌহার্দ্যের অধরে দুষ্টু হাসির ছাপ। কণ্ঠে দুষ্টুমি এঁটে বললো,
“আমার তো বাবাও আছে বাবার টাকাও আছে। যাই তাহলে, নতুন একটা মোবাইল কিনে নিয়ে আসি।”
কথাটা বলতে বলতেই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সৌহার্দ্য। হাঁটা ধরলো পিতার কক্ষের দিকে। পেছন থেকে অসহায় কণ্ঠে হানিফ শেখ বলে উঠলেন,”ওই তো পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পাই। সেই টাকাটায়ও তোর ভাগ বসাতে হবে বেয়াদব?”
সৌহার্দ্যের শ্রবণালী পর্যন্ত কথাটা পৌঁছেছে বলে মনে হলো না। ততক্ষণে সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এক লহমায় মুখের ভাবধারা পরিবর্তন হলো হানিফ শেখের। শব্দহীন হেসে উঠলেন। মনে মনে বললেন,
“এসব মন খারাপের বয়স কবেই পার করে এসেছি। চুলে তো আর এমনি এমনি পাক ধরেনি।”
__________
সামিরা মেয়েটার হাবভাব ইদানিং খুব বিরক্ত ঠেকছে শ্রাবণের নিকট। সাথে এও সে বেশ বুঝতে পেরেছে যে সদ্য যৌবনে পা রাখা মেয়েটি তার উপর আবেগে মজেছে। শুরুর দিন থেকেই ক্লাসে সারাক্ষণ হা করে নিষ্পল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মাঝে একদিন পড়ার ফাঁকে একটা টপিক থেকে মেয়েটিকে প্রশ্নও করে বসেছিল শ্রাবণ। কিন্তু সেই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তরই দিতে পারেনি সামিরা।
শ্রাবণের ব্যক্তিগত ফেসবুক একাউন্টেও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছে সে। যা দেখেও শ্রাবণ এমন একটা ভান ধরে আছে যেনো এই প্রসঙ্গে কিছুই সে জানে না। তবে ব্যাপারটা এখন খুব ভাবাচ্ছে তাকে। এই বয়সী ছেলে-মেয়েরা খুব আবেগ প্রবণ হয়ে থাকে। আবেগের বশে ভুল কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।তাই মেয়েটাকে বেশি দূর এগোতে দেওয়া উচিত হবে না।
তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে এলো শ্রাবণ। একটু এগোতেই কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সামিরাকে। এভাবে রোজরোজ যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা যেনো সামিরার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আজ আর তাকে এড়িয়ে গেলো না শ্রাবণ। এগিয়ে গেলো তার দিকে। মৃদু হেসে শুধালো,
“কেমন আছো?”
এই প্রথম শ্রাবণের থেকে তুমি সম্বোধন শুনে অবাক হলো সামিরা। চোখেমুখে ফোটে উঠলো খুশি খুশি একটা আমেজ। শুরু থেকেই লোকটার থেকে আপনি সম্বোধনই শুনে এসেছে সে। তবে একটা ব্যাপার খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে সামিরা।বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকরাই শিক্ষার্থীদের আপনি আপনি করে সম্বোধন করে। ভাবনা বাদ দিয়ে প্রত্যুত্তর করল,“ভালো স্যার। আপনি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তা এখানে কী করছো? কারো জন্য অপেক্ষা করছিলে?”
যদিও অপেক্ষাটা শ্রাবণের জন্যই ছিলো তবুও তৎক্ষণাৎ সত্যটা বলতে পারলো না মেয়েটা। হুটহাট করে এমনটা বলাও তো সম্ভব নয়। যখন বিপরীত থেকে পাল্টা প্রশ্ন আসবে, কেন অপেক্ষা করছিলে? কী প্রয়োজন? তখন কী উত্তর দিবে সে? তাই চট করে মিথ্যে বললো,“ফ্রেন্ডের সঙ্গে এসেছিলাম স্যার। ও ওর বোনের সঙ্গে দেখা করতে গেছে তাই আমি আরকি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি।”
“ওহ, একা দাঁড়িয়ে থেকে আর কী করবে? চলো হাঁটতে থাকি। এমনিতেও দাঁড়িয়ে কথা বলাটা ভালো দেখায় না।”
দ্বিমত করল না সামিরা। এমন সুযোগ তো আর বারবার আসে না। হাঁটতে লাগলো শ্রাবণের সাথে সাথে। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কোনো ভণিতা ছাড়াই সরাসরি শ্রাবণ প্রশ্ন করল,
“তুমি কী আমায় পছন্দ করো সামিরা? স্টুডেন্ট হিসেবে প্রত্যেকেরই একজন পছন্দের টিচার থাকে কিন্তু তোমার চাল চলন দেখে কেন জানি আমার তা মনে হচ্ছে না। তোমার আচরণ বলছে তুমি মোটেও আমায় একজন টিচার হিসেবে পছন্দ করো না।”
কথাগুলো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছাতেই ভড়কে গেলো সামিরা। সাথে সর্বাঙ্গে ঘিরে ধরলো লজ্জায়। এ কথা তো সে স্যারকে সরাসরি কখনো বলেনি, তাহলে? তাহলে স্যার জানলো কী করে? লজ্জায় দৃষ্টি নত হলো। পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিরবতায় সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রাবণ। মনে মনে কিছু কথা গুছিয়ে নিয়ে বললো,“ভার্সিটি লাইফ পার করে আসায় এসব অনুভূতি, চাহনি, দেখা করার অজুহাত সম্পর্কে খুব ভালো করেই অবগত আমি।ডিপার্টমেন্টে এমন কতশত ছেলে-মেয়ে দেখলাম যারা কিনা টিচারের উপর ক্রাসড। কেউ কেউ তো প্রেমে একেবারে হাবুডুবু পর্যন্ত খেয়েছে। তোমার চালচলন শুরু থেকেই আমার নজরে পড়েছে। আমরা টিচাররা ক্লাসের যে স্থানে গিয়ে দাঁড়িয়ে লেকচার দেই, সেখান থেকে কিন্তু ক্লাসের সব স্টুডেন্টকে খুব ভালো করেই দেখা যায়, বুঝলে?”
“কাউকে ভালোলাগা, ভালোবাসা কী অপরাধ স্যার?”
“অপরাধ হবে কেন? তবে একটা কথা জানো কী? ভালোবাসা কখনো হুটহাট করে হয় না। হুটহাট করে হয় ভালোলাগা। মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালো লাগতেই পারে তবে সেই মানুষ সম্পর্কে পুরোপুরি না জেনে তাকে ভালোবাসাটা অপরাধ। তার পাশাপাশি মারাত্মক অন্যায়ও বটে।”
“আমি আপনার সম্পর্কে জানি স্যার। ভাইয়ার সঙ্গে তার ফেয়ারওয়েল সিরিমনিতে এসেছিলাম আমি। সেখানেই আপনাকে প্রথম দেখা। ভাইয়ার থেকে আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মূল কারণও আপনি।”
“এখন আমি তোমার শিক্ষক সামিরা। পিতা-মাতার পর শিক্ষকের স্থান, জানো তো নাকি? শিক্ষককে নিয়ে অতিরিক্ত কিছু ভাবা অন্যায় কাজ।”
“শিক্ষক ছাত্রীর কী বিয়ে হয় না স্যার? কতই তো হচ্ছে।”
মেয়েটাকে যে বিভিন্ন যুক্তি দিয়েও বোঝানো সম্ভব নয় তা খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো শ্রাবণ। তাই সময় নষ্ট করার চিন্তাভাবনা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলে মৃদু হেসে বললো,“তা অবশ্য ঠিক। বর্তমানে এসব ঘটনা অহরহ হচ্ছে। তবে তোমার এদিকে আর না এগোনোই ভালো। তোমার ম্যাম যে খুব হিংসুটে। এসব ব্যাপারে জানলে খুব রেগে যাবে আমার উপরে।”
চমকালো সামিরা। শুধালো,“ম্যাম?”
উপরনিচ মাথা নাড়ায় শ্রাবণ। পুনরায় সামিরা প্রশ্ন করে,“ম্যাম কোত্থেকে এলো স্যার? আপনি তো অবিবাহিত।”
“তাতে কী? সবসময় কী আর অবিবাহিত থাকবো নাকি? খুব শীঘ্রই বিবাহিত’র তকমা লেগে যাবে আমার গায়ে। অলরেডি আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। আশা করি বুঝতে পারছো তুমি? তাই আমাদের মধ্যে একটাই সম্পর্ক তা হচ্ছে তুমি আমার ছাত্রী আর আমি তোমার শিক্ষক।”
কথাটা শেষ করে প্রস্থান করল শ্রাবণ। সেখানেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো সামিরা। প্রতিটি কথা বিঁধে আছে কানে। ভেতরের কোথাও তৈরি হচ্ছে সুক্ষ্ম ক্ষত। সদ্য হৃদয় ভাঙার যন্ত্রনায় জ্বলে যাচ্ছে সর্বাঙ্গ।
________
দুপুর হলেই তাঈম ঘুমিয়ে পড়ে। এটাই যেনো পরিণত হয়েছে তার অভ্যাসে। আজ টানা তিন মাস পর বাবার ঘরে পা রাখলো অর্থিকা। চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে আছেন কামরুল হাসান। ঘুমিয়েছেন কিনা এই মুহূর্তে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না। সুফিয়া কিছুক্ষণ আগেই নিজ হাতে স্বামীকে খাবার আর নির্ধারিত ওষুধ খাইয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
বিছানার একপাশে বসে একদৃষ্টে পিতার মুখশ্রীতে তাকিয়ে আছে অর্থিকা। এককালে এই ভদ্রলোক কী স্বাস্থ্যবানই না ছিলেন। দেহখানা ছিলো বলিষ্ঠ।চোখেমুখে ছিলো তীক্ষ্ণ ব্যক্তিত্বের ছাপ। আর আজ তার কী অবস্থা! অতীতের মতো সেই দেহখানা আর নেই। হাড়গুলো ভেসে আছে মাংসপিণ্ডের উপর দিয়ে। কঙ্কালসার দেহ। মুখশ্রীতে অসহায় একটা ভাব। মাথায় টাক পড়েছে। অবশিষ্ট যা চুল আছে তাও আধপাকা। চেহারায় মলিনতার ছাপ। বাবার এই অবস্থা দেখলেই খুব কষ্ট হয় অর্থিকার। আজও তার ব্যতীক্রম হলো না। চোখের কোণে অশ্রু জমেছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ভারি দীর্ঘশ্বাস।
বিড়বিড় করে বললো,“ছোটো থেকে আমাদের যেই নীতিমালা শিখিয়েছিলে সেই একই নীতি যদি তুমিও মেনে চলতে, লোভ না করতে তাহলে হয়তো আজ আমাদের পরিবারটার এমন অবস্থা হতো না বাবা। আর না অনুকেও নিজের জীবনকে অবজ্ঞা করে, নিজের ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিয়ে এত কষ্ট করতে হতো।”
ধীর পায়ে পিতার কক্ষ ত্যাগ করে নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ালো অর্থিকা। মেয়েকে দেখেই সুফিয়া বলে উঠলেন,“বেলা চলে যাচ্ছে, খাবি কখন?”
হাঁটা থামালো না অর্থিকা। যেতে যেতে উত্তর দিলো,
“সময় হলে খেয়ে নিবো।”
“তোর বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে?”
“না, বাবা ঘুমাচ্ছে।”
“যখন উঠবে তখন কথা বলে নিস তবে।”
“কী বলবো? বলার মতো তো কিছু নেই।”
নিশ্চুপ হয়ে গেলেন সুফিয়া। ততক্ষণে অর্থিকা ঘরে প্রবেশ করেছে।
রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সূর্যের তাপে জনজীবন বিপর্যস্ত। মাথার উপর ফ্যান ঘুরার পরেও গরমের চোটে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। উদাস দৃষ্টি মেলে বারান্দার গ্ৰিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অর্থিকা। একসময় প্রকৃতি ছিলো তার অত্যন্ত প্রিয়। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে ভালোবাসতো মেয়েটি। দুঃখ হলে, অভিমান হলে তা ভুলতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতো বারান্দায়। কখনো সখনো দুয়েকজন বন্ধু নিয়ে চলে যেতো ঘুরে বেড়াতে। অথচ এখন সে প্রকৃতি থেকে লুকিয়ে থাকে। পড়ে থাকে ঘরের এক কোনায়। তিন বছরে যে তন্ময় নামক প্রেমিক পুরুষটির সঙ্গে অজস্র স্মৃতি জমে আছে তার।
অর্থিকার মনে পড়ে, রোজ অফিস থেকে ফেরার পথে তার জন্য শুভ্র রঙের ফুল নিয়ে আসতো তন্ময়। শুভ্র রঙ শান্তির প্রতীক এই জন্যই হয়তো অর্থিকার প্রিয়’র তালিকায় ছিলো এই রঙ এবং এই রঙের ফুল। তন্ময় ছিলো ভুলোমনা একজন পুরুষ। মাঝেমধ্যে ফুল ছাড়াই ফিরে আসতো বাড়িতে। আবার কখনো বা শুভ্র বাদ দিয়ে নিয়ে আসতো র’ক্তবর্ণের গোলাপ কিংবা জবা। তখন অর্থিকার সেকি রাগ! সেকি রাগ!
তন্ময়ের মতে,নারী হচ্ছে ফুলের মতো পবিত্র। তাদের মনও ফুলের মতো কোমল। ফুলের পানে তাকালে যেমন সকল মন খারাপ এবং অভিমান ভালো হয়ে যায় ঠিক তেমনি স্ত্রীর ওই কোমল, নিষ্পাপ মুখখানায় তাকালে সকল ক্লান্তি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়।
তখন রেগেমেগে অর্থিকা গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো বারান্দায়। আর রইলো তন্ময়, সেও চলে আসতো বউয়ের পিছুপিছু। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বউয়ের রাগ ভাঙানোর জন্য কত কিছুই না বলে হাসাতো।এই মানুষটির উপর চাইলেও বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারতো না অর্থিকা।
পুরোনো স্মৃতিচারণ বাদ দিয়ে বিছানায় এসে বসলো সে। ঘুমন্ত ছেলের পানে মাতৃ স্নেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিষ্পলক। চুমু খেলো কপালে। বিড়বিড় করে বললো,“বাবা নেই তো কী হয়েছে? তোর মা তো আছে। আমি বাঁচবো, প্রাণ খুলে হাসবো শুধুই আমার ছেলের জন্য। আমার তন্ময়ের রেখে যাওয়া স্মৃতি আর ওর এই অংশটুকুর জন্য হলেও আমি বাঁচবো।”
মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো অকৃত্রিম হাসি কিন্তু চোখ দিয়ে যেনো গড়িয়ে পড়লো দু ফোঁটা অশ্রুজল।
চলবে ________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)