#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১০]
বিয়ের আমেজ শেষ হতেই পরিবারসহ নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে আসে অনুভা। কিন্তু তারপরেই তাদের জীবনে এক কালবৈশাখী ঝড় এসে লণ্ডভণ্ড করে দেয় সবকিছু। ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়ায় মাস খানেক আগেই নাকি চাকরি চলে গেছে কামরুল হাসানের। এতদিন মেয়েদের থেকে পুরোপুরি ভাবেই ঘটনাটা গোপন করেছেন তিনি। অনুভার যেনো কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না তার বাবা এমন একটি অন্যায় কাজ করতে পারে। তবে এটা ঠিক বুঝতে পারছিল যে এই জন্যই তাড়াহুড়ো করে বড়ো বোনের বিয়েটা দেওয়া হয়েছিল।
চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে ঘটনাটা। খবরের কাগজেও ছাপা হয়েছে তা। সব প্রমাণ কামরুল হাসানের বিরুদ্ধে। ঘটনাটা ঘটেছে অনেকদিন আগেই। তখন উনাকে সাময়িকভাবে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। বারবার নিজেকে নির্দোষ দাবি করার পরেও কোনো প্রমাণ ছিলো না হাতে। হুট করেই একটা ফুটেজ চলে যায় সাংবাদিকদের হাতে। তারা নিউজটিকে জনসমক্ষে আরো গভীরভাবে উপস্থাপনের জন্যই হয়তো এতদিন সময় নিয়েছিল। ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে একজন লোক কয়েকটা টাকার বান্ডেল টেবিলের উপর রেখেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কামরুল হাসান এক এক করে টাকার বান্ডেলগুলো ঢুকালেন নিজ টেবিলের ড্রয়ারে।
লোকটাকে ধরা হলো। সে নিজ মুখে স্বীকার করল তার ছেলে খুনের মামলায় জেলবন্দি। মামলা কোর্টে উঠবে দুয়েক দিনের মধ্যেই। কামরুল হাসান বলেছিলেন টাকা দিলে নাকি তিনি চেষ্টা করবেন কেসটাকে ধামাচাপা দেওয়ার। তদন্ত করে জানা গেলো ঘুষ নেওয়ার মতো অপরাধ নাকি উনি এর আগেও বেশ কয়েকবার করেছেন। সব প্রমাণ উনার বিরুদ্ধে যাওয়ায় ডিপার্টমেন্ট থেকে ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি হয়ে পড়ল। আজীবনের জন্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হলো উনাকে। মামলাও হলো। কয়েকদিনের মধ্যেই কামরুল হাসানের ঠাঁয় হলো কারাগারে। যাদের নিকট এতদিন সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন মুহূর্তেই তাদের নিকট পরিণত হলেন অসম্মানীয় একজন ব্যক্তি হিসেবে। গ্ৰাম থেকে ছুটে এলেন চাচারা। ভালো একজন উকিল ঠিক করা হলো। এসব কেসে উকিলের ফি অনেক। চাচারা নিজ ভান্ডার থেকে সেসব ফি দিয়ে ভাইকে ছাড়াতে নারাজ। এত এত ঝামেলার মধ্যে ভার্সিটির কথা ভুলেই গেলো অনুভা।
এত বছর ধরে একটু একটু করে টাকা সঞ্চয় করে আসা নিজের ফান্ডটা ভেঙে ফেললেন সুফিয়া। সব টাকা তুলে দিলেন মেজো ভাসুরের হাতে। সেই টাকা দিয়ে উকিল ঠিক করলেন উনি। তবে উকিল দিয়ে কেস লড়ানোর জন্য এই টাকাটা পর্যাপ্ত ছিলো না। জমানো যা টাকা আছে সব কামরুল হাসানের একাউন্টে। কিন্তু তিনি তো এখন জেলবন্দি। তখন ভাসুরদের নিকট ধার চাইলেন সুফিয়া,“আমার কাছে যা ছিলো সবই তো দিয়ে দিয়েছি। এখন বাকি টাকা কোথায় পাবো? আপনাদের ভাই হয় ও, আপনারা যদি বাকি টাকাটা দিয়ে সাহায্য করতেন? আমি কথা দিচ্ছি ও ছাড়া পেলেই সব টাকা আপনাদের পরিশোধ করে দিবো।”
বড়ো চাচা অপারগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,“আমার কাছে অতো টাকা পয়সা নাই। অতো টাকা পয়সা পামু কই?”
বাকি চাচারাও বড়ো চাচার সাথে সহমত পোষণ করলেন।অনুভা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখলো সবটা। অথচ এই বড়ো চাচার ছোটো কন্যার বিয়ের অর্ধেক খরচই বাবা দিয়েছিলেন। সেজো চাচা যখন বাইক এক্সিডেন্ট করল তখন বাবাই ভাই ভাই করে জান দেওয়ার অবস্থা। সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সব খরচ তিনিই বহন করেছিলেন। দুই ফুফুকেও কম সাহায্য করেনি। অথচ সেই ফুফুরা একবারের জন্যও দেখতে এলো না নিজের ভাইকে। বরং ফোনে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন, ভাইয়ের কুকর্মের জন্য নাকি তারা শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখাতে পারছেন না।
সুফিয়ার বাপের বাড়ির অবস্থা যথার্থ উন্নত ছিলো। এক ভাই প্রবাসী, আরেক ভাই ব্যবসায়ী। তাদের থেকে সাহায্য চাইলেন তিনি। তারাও সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। সাথে কটু কথাও কম বলেননি উনাকে। সবাই ত্যাগ করতে পারলেও সুফিয়া কিছুতেই কামরুল হাসানকে ত্যাগ করতে পারলেন না। যতই হোক স্বামী তো! ঘরকুনো স্বভাবের এই নারীটিই একা একা বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া ওয়ারিশের দলিল বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। এতে ভাইরা ক্ষীপ্ত হয় একমাত্র বোনের উপর। নিরবেই ছিন্ন করে সকল সম্পর্ক।
তারমধ্যেই ভার্সিটি থেকে সেমিষ্টার পরীক্ষার নোটিশ আসে। বন্ধুদের থেকে নোট সংগ্ৰহ করে পারিবারিক এমন দুরাবস্থাতেই পরীক্ষায় বসে অনুভা। মা স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন,“যত যাই হয়ে যাক লেখাপড়া থেকে দূরে সরিস না মা। এটাই তোর সম্বল। বাবা এখন বাড়িতে নেই তো কী হয়েছে? মা আছে। তোর মা সব সামলে নিবে।”
এমন একটা পরিস্থিতিতেও মায়ের থেকে এতটা আত্মবিশ্বাস পেয়ে অনুভা আবারো মনোযোগী হলো লেখাপড়ায়। গুরুত্ব সহকারে পরীক্ষা শেষ করার পরপরই দেখা হলো এক বান্ধবীর সঙ্গে। খামে ভরা একটা চিঠি এগিয়ে দিলো তার দিকে। বললো,“শ্রাবণ ভাই চিঠিটা দিয়েছে তোকে।”
“কবে দিলো?”
“তুই গ্ৰামে যাওয়ার চার পাঁচদিন পর। কিন্তু তোর সঙ্গে তো আমার দেখাই হচ্ছিল না তাই দিতেও পারিনি।”
চিঠিটা নিলো অনুভা। তাড়া দেখিয়ে বললো,
“ধন্যবাদ তোকে। বাড়ি ফিরতে হবে এখন। পরে কথা হবে।”
বিদায় নিয়ে চলে এলো অনুভা। বাড়ি ফিরে নিজ কক্ষে গিয়ে চিঠিটা পড়েই জানতে পারলো শ্রাবণ দেশে নেই। উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য চলে গেছে বাহিরের দেশে। চিঠির শেষ অংশে বড়ো বড়ো সংখ্যায় তার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটাও দেওয়া। সেদিকে গভীর দৃষ্টি রেখেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কথায় কথায় অনেক আগেই শ্রাবণের নিকট থেকে অনুভা জানতে পেরেছিল উচ্চশিক্ষার জন্য সে দেশের বাহিরে যেতে চায়। কাগজপত্র নাকি এতদিনে বাবা জমাও দিয়ে দিয়েছে। গ্ৰাজুয়েশনের সমাপ্তি আর ভিসা পাওয়ার অপেক্ষা শুধু। তাহলে সেদিন যখন দেখা হলো তখন কেন কিছু জানালো না শ্রাবণ? অনুভা কষ্ট পাবে বলে? হয়তো।
মোবাইল হাতে নিয়েও তা রেখে দিলো অনুভা। খুব করে ইচ্ছে জাগলো ছেলেটার সঙ্গে কথা বলে নিজের কষ্টটা লাঘব করার কিন্তু নিজের ইচ্ছেটাকে গুরুত্ব দিলো না সে। নিজেদের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবতেই লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেলো। এই মুহূর্তে স্বাভাবিক নেই অনুভা। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। বাবাকে যে বড্ড ভালোবাসে মেয়েটা। অন্যদের মতো শ্রাবণও যদি জেনে যায় তার বাবা ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা খেয়েছে, জেলবন্দী হয়েছে তখন কী হবে? অনুভাকে কেমন দৃষ্টিতে দেখবে সে? এসব ভাবতে ভাবতেই চিঠিটা অযত্নে ড্রয়ার বন্দী করল।
বাবার অপকর্ম ধরা পড়ায় শ্বশুর বাড়িতে অর্থিকার অবস্থাও নাজেহাল। উঠতে বসতে শুধু খোঁটা আর খোঁচা মারা কথা।তন্ময় মা মরা ছেলে। এক স্ত্রী মরতে না মরতেই বাবা আরেক বিয়ে করে সংসার পাতেন। ছোটো থেকেই বড়ো বোনেদের আদর যত্নে বড়ো হয়েছে তন্ময়। ছেলে-মেয়েরা দ্বিতীয় বিয়ে মানতে না পারায় নতুন বউ নিয়ে অন্যত্র গিয়ে নতুন করে সংসার পাতেন তন্ময়ের পিতা।তাই সংসারে একচ্ছত্র আধিপত্য তখন বোনেদের। যদিও তারা ছিলো বিবাহিত কিন্তু বাপের বাড়ির অধিকার যেনো কিছুতেই তারা ছাড়বে না। সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় বাড়ির খবর কিছুই জানতো না তন্ময়। অর্থিকাও ভয়ে কিছু বলতো না তাকে।যদি বোনেদের নিয়ে বলা কথা বিশ্বাস না করে সে? যদি তাড়িয়ে দেয় তাকে? ততদিনে তন্ময়কে খুব ভালোবেসে ফেলেছে অর্থিকা। আট মাস ননদদের অত্যাচার সহ্য করে শ্বশুর বাড়িতে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে ছিলো মেয়েটা। একবারই শুধু দেখতে আসতে পেরেছিল বাবা-মা, বোনকে। তাতেও অনেক কথা শোনায় ননদরা। স্পষ্ট করে বলে দেয়,“তোমার ওই জেল খাটা বাবা আর তার পরিবারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে পারবে না তুমি। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হলে এ বাড়ি তোমাকে ছাড়তে হবে।”
এতকিছুর পরেও তারা দমেনি। একসময় তাদের দু চোখের বিষ হয়ে ওঠে অর্থিকা। পাশাপাশি আরেকটা বিয়ে করানোর জন্য চাপ দেওয়া শুরু করে তন্ময়কে। বোনেদের অবদান তন্ময়ের জীবনে অনেক। তাদের মুখের উপর কথা বলা তার স্বভাব বহির্ভূত। তাদেরকে যেমন বাড়িতে আসতে নিষেধ করতে পারবে না ঠিক তেমনি নিজের স্ত্রীকেও সে ছেড়ে দিতে পারবে না। মেয়েটাকে যে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো তন্ময়। মনটাও দিয়ে দিয়েছিল অতি গোপনে। একসময় সকল লাজ লজ্জা ভুলে সরাসরি নিজে গিয়েই কামরুল হাসানের নিকট বিয়ের প্রস্তাবটাও দিয়ে দিয়েছিল।
ছেলেটির আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হন কামরুল হাসান। লোক লাগিয়ে খোঁজ নেন ছেলেটির সম্পর্কে। তারপরই পাকাপোক্ত হয় বিয়ের কথাবার্তা। কিন্তু অমন এক পরিস্থিতিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হন তিনি। তাই অতিদ্রুত মেয়েকে পাত্রস্থ করেন।
বাধ্য হয়েই স্ত্রীকে নিয়ে অফিসের কাছাকাছি ভাড়া বাড়িতে ওঠে তন্ময়। অর্থিকার দুঃখের দিন ঘুচে। আবারো যোগাযোগ শুরু হয় পরিবারের সাথে। এমন একটা ঘটনার জন্যই তো তন্ময়ের প্রতি অর্থিকার ভালোবাসাটা আকাশচুম্বী। একটা নারী ঠিক কতটা ভাগ্যবতী হলে এমন স্বামী পায়? অথচ মেয়েটার কপালে বেশিদিন সেই সুখ সইলো না। সইলো না স্বামী সোহাগ।
ছয় মাস জেল খেটে জামিনে ছাড়া পান কামরুল হাসান। সকলের অগোচরে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করে স্ত্রীর সম্পত্তিটুকু ছাড়িয়ে আনেন। দলিল ফিরিয়ে দিলেন শ্যালকদের। সুফিয়া খুব চটে গেলেন স্বামীর উপর। স্ত্রীর রাগান্বিত মুখশ্রী দেখে অমন অবস্থাতেও তিনি হেসে জানালেন,“দুনিয়ার মানুষগুলো খুব স্বার্থপর আর লোভী। এই যে দেখো না লোভ করতে গিয়ে আজ আমার কী অবস্থা? লোকের সামনে মুখ দেখানোর উপায়টুকু নেই। আত্মীয় স্বজন কেউ কারো নয়। এমনিতেই তো আমি সবার কাছে লোভী প্রমাণিত হলাম এখন আর তোমার ওই সম্পত্তিটুকুর জন্য তোমার ভাইদের চোখে আর খারাপ হতে চাই না। ওদের সঙ্গে অন্তত তোমার সম্পর্কটা ভালো থাকুক।”
স্বামীর বিপরীতে আর কথা বললেন না সুফিয়া। দিন যেতে লাগলো সাথে জীবনটাও ক্রমশ নরকে পরিণত হতে লাগলো। বাহিরে বের হওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ল। কামরুল হাসান নিজেকে গৃহবন্দী করলেন। সুফিয়া বাহিরে তো দূরে থাক, প্রতিবেশীদের কটু কথায় ছাদেও যেতে পারেন না। অনিয়মিত ক্লাস করায় ভার্সিটিতে অপরিচিত মুখ হয়ে উঠলো অনুভা। ওদিকে অতটা হেয় প্রতিপন্ন না হলেও এলাকায় বের হওয়া, প্রবেশ করা ছিলো তার জন্য একপ্রকার যুদ্ধ। সব বয়সীরাই তাকে দেখলে পথ আটকে আজেবাজে প্রশ্ন করতো। এসবের সঙ্গে অপরিচিত সে। মাকে জড়িয়ে যে কত কান্নাকাটি করেছে তার কোনো হিসেব নেই। কখনো কামরুল হাসান কান পেতে শুনেছেন মেয়ের কান্না। বারবার নিজেকে নিজের কাছেই ছোটো মনে হয়েছে উনার।
এভাবেই কয়েক মাস চললো। প্রতিবেশীদের কথা নামক বিষাক্ত ফলায় চূর্ণ বিচূর্ণ হতে লাগলো একটা পরিবার। সব শেষে কামরুল হাসান সিদ্ধান্ত নিলেন ফিরে যাবেন গ্ৰামে। তন্ময়ও সাহায্য করল এতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরেই পরিচিত কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ‘হলে’ উঠলো অনুভা।
কামরুল হাসানের পৈতৃক নিবাস ছিলো সিরাজগঞ্জ। গ্ৰামে বাপ-দাদার জমি জমার কোনো অভাব নেই। দাদার আমলের বিশাল বাড়ি।একমাত্র ছেলে হওয়ার দরুন যা উনার বাবা একাই পেয়েছিলেন সব। নিজেদের খেতের ধান,খেতের শাক-সবজি, পুকুরের মাছ সবদিক দিয়েই উচ্চবিত্ত পরিবার। উনারা ভাই- বোন ছিলেন ছয় জন। চার ভাই দুই বোন। কামরুল হাসান ছিলেন বাবা-মায়ের ষষ্ঠ সন্তান। ভাই- বোনদের সবার ছোটো। উনার যখন জন্ম হয় তখন বাবা আর সেই জোয়ান পুরুষটি নেই। অর্থাৎ শেষ বয়সের সন্তান তিনি। লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছিলেন কামরুল হাসান। লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস দেন। প্রথম চান্সে উত্তীর্ণ হয়ে একেবারে হয়ে যান পুলিশের এসপি। কয়েক মাস পর বদলি হয়ে যান খুলনায়। সরকারি চাকরি হওয়ায় এক জায়গায় এক বছরের বেশি সময় ধরে মনে হয় না টিকতে পেরেছেন তিনি। একসময় বাবা-মায়ের পছন্দে বিয়ে করে ঘরে তুলেন সুফিয়াকে।
সুফিয়া ছিলেন একজন সংসারী নারী। উনার চাওয়া পাওয়া ছিলো সীমিত। শক্ত হাতে সংসারটাকে সাজিয়ে নেন মন মতো। বছর ঘুরতেই তাদের কোল আলো করে আসে অর্থিকা। তার বছর পাঁচেক পর হয় অনুভা। দুই মেয়ে নিয়ে কামরুল হাসানের ছোটো সংসার। নেই কোনো অভাব অনটন। দুই বোন ছোটো থেকেই বড়ো হয়েছে অনেক আদরে। যখন যা আবদার করেছে তাই কামরুল হাসান মেয়েদের সামনে এনে হাজির করেছেন।
গ্ৰামে যাওয়াতে ভাই, ভাই বউরা তেমন খুশি হলো না। মাস খানেক থাকার পর সেখানেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন উনারা। এলাকার লোকেরা বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে যেতো কথা। একদিন সকল ভাইয়েরা একত্র হলো। হয়তো আগেই তারা নিজেদের মধ্যে শলা পরামর্শ করে রেখেছিল। কামরুল হাসানের উদ্দেশ্যে সরাসরি বড়ো ভাই বলে ওঠেন,“তুই লোভে পইড়া খারাপ একটা কাম কইরা ফেলাইছোস। তোর লাইগ্গা তোর বউ পোলাপাইন ভুগতাছে। যতদিন বাঁচবো ততদিন এমনেই ভুগবো। বড়ো মাইয়ার কপাল ভালা তাই তার জামাই অহনও তারে তালাক দেয় নাই। ছোডো মাইয়াডারে কেডায়ই বা বিয়া করবো? আর যাই হোক ভালা বংশে ওরে বিয়া দেওয়া সম্ভব না। এহন কথা হইলো তোর লাইগ্গা তো আর আমরা ভুগতে পারমু না। গেরামে এমনিতেই মান সম্মান কিচ্ছু নাই। তার উপর তোরা এনে আসার পর আরো কথা শুনতে হইতাছে।আমগোও তো বউ পোলাপাইন আছে। মাইয়ারা শ্বশুর বাড়ি। ওগো যে কথা শুনতে হইবো না তার কোনো গ্যারান্টি আছে?”
এমন এক বিপর্যয়ে ভাইয়ের থেকে এমন কথা মোটেও প্রত্যাশা করেননি কামরুল হাসান। যদিও শুরুতে শুনেছিলেন স্ত্রীর নিকট থেকে সবটা। শুধালেন,“এখন কী করতে বলো তোমরা?”
মেজো ভাই বললেন,“এতদিন যেনে ছিলি হেনেই তোরা ফিরা যা।”
“বললেই তো আর ফিরে যাওয়া যায় না ভাইজান। তাছাড়া এমন কথা কী করে বলো তোমরা? এ বাড়িতে আমারও তো একটা ভাগ আছে। বাবার ছেলে হিসেবে আমিও তো সম্পত্তির ভাগীদার।”
মুহূর্তেই সকলের মুখের আদল বদলে গেলো। এক কথা দু কথা হতে হতে অবস্থা বদলে গেলো। ভাইদের চোখেমুখে ক্ষীপ্ততা। সেজো ভাই চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,“কীসের ভাগীদার? তোর কোনো ভাগ নাই এইহানে। আব্বায় সব সম্পত্তি আমগো তিন ভাইয়ের নামে দিয়া গেছে। বোন গো তো বিয়ার সময় কম যৌতুক দেয় নাই। তাগো আর কোনো ভাগ নাই। তোরও নাই।”
বজ্রাসনের ন্যায় চমকালেন কামরুল হাসান। ভাইদের স্বরূপ দেখতে পেলেন নিজ চক্ষে। কথাটা যখন উনার বিশ্বাস হচ্ছিল না তখন ভাইরা উনাকে দলিল দেখায়। যাতে স্পষ্ট পিতার টিপসই দেওয়া। হয়তো অসুস্থ, অক্ষর জ্ঞানহীন পিতাকে তারাই ভুলিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিল। বোনদের থেকেও কোনো সাহায্য পাননি তখন। অথচ সবার ছোটো হওয়ার পরেও এই ভাই-বোনদের জন্য কত কিছুই না করেছেন তিনি। বিপদে এগিয়ে এসেছেন। তারাও তখন উনাকে এবং উনার পরিবারকে মাথায় তুলে রেখেছিল। তাহলে আজ কী হলো? বিপদের সময় কী সত্যিই কেউ পাশে থাকে না? থাকে নাই তো। যার প্রমাণ নিজের অসময়ে পেয়েছেন কামরুল হাসান। ‘লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু’ প্রবাদ বাক্যটা বাস্তব জীবনে যে ফলে গেছে ধের বুঝতে পারলেন তিনি। ফিরে এলেন আবারো নিজেদের ফ্ল্যাটে।
অর্থিকা স্বামীকে বাবা-মায়ের পরিস্থিতির কথা জানাতেই তন্ময় তাদের জন্য নতুন ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিলো। পুরোনো ফ্ল্যাটটা রয়ে গেলো তালা বন্ধ। নিজেকে পরিপূর্ণ ঘর বন্দী করে নিলেন কামরুল হাসান। স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে উনার লজ্জা লাগে। একাকিত্বকে সঙ্গী করে ডিপ্রেশন নামক অসুখে ডুবে গেলেন। শেষে কিনা বেছে নিলেন আত্মহ’ত্যার পথ। ভাগ্য ভালো থাকায় সুফিয়া সময় মতো দেখে ফেলেছিলেন স্বামীর অমন কান্ড। প্রতিবেশীদের সাহায্যে নিয়ে উনাকে নিয়ে গেলেন হাসপাতালে। সেবারের মতো বেঁচে ফিরলেন তিনি তবে চিন্তায় চিন্তায় বড়ো ধরণের স্ট্রোক করে বসলেন। ডাক্তার নিষেধ করল চিন্তা করতে কিন্তু কেউ নিষেধ করলেই কী আর চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা যায়?
অনেকবার চেষ্টা করেছেন আত্মহ’ত্যার কিন্তু সকল চেষ্টাই বৃথা যাওয়ার পর হাল ছেড়ে দিলেন। বাবাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো অনুভা। ভারি কণ্ঠে বললো,“যা হওয়ার হয়ে গেছে বাবা। সব ভুলে যাও। তুমি যদি চলে যাও তাহলে আমার আর মায়ের কী হবে বলো তো? আমাদের জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।”
মেয়ের কথায় সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন লোকটা। তারপর আর অমন জঘন্য কাজে পা বাড়াননি। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু সবার জীবনে সুখ কী আর বেশিদিন থাকে? হাতে যে কটা টাকা ছিলো তা শেষ হয়ে গেলো। এভাবে ঘরে বসে থাকলে তো আর চলবে না। ভালো চাকরি যে পাবেন না তা তিনি নিশ্চিত। ছোটো খাটো যাই পান না কেন সংসারটা তো চলবে। তাই বেরিয়ে পড়েন চাকরির সন্ধানে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চাকরি তো পেলেনই না বরঞ্চ ফেরার পথে চলন্ত গাড়ির নিচে পড়ে ঘটিয়ে ফেললেন দুর্ঘটনা। তৎক্ষণাৎ পথচারীরা উনাকে নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালো। সঙ্গে পাওয়া মোবাইল দিয়ে বাড়িতে ফোন করে জানালো সকল ঘটনা।
আল্লাহর অশেষ রহমতে এবারও বেঁচে ফিরলেন কামরুল হাসান। তবে আজীবনের জন্য শরীরের অর্ধেকটা হয়ে গেলো প্যারালাইসড। অতঃপর স্বামীর চিকিৎসার জন্য শেষ সম্বল ফ্ল্যাটটাই বিক্রি করে দিলেন সুফিয়া। তন্ময় সাহায্য করতে চাইলেও নিলেন না তার কোনো সাহায্য। একপর্যায়ে দুলাভাইয়ের সাহায্যে একটা এনজিওর চাকরিতে জয়েন হয়ে পরিবারের খরচা এবং বাকি লেখাপড়াটাও চালিয়ে গেলো অনুভা।
চলবে ________
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই
[পর্ব:১১]
এনজিও থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে সবদিক সামলিয়ে সংসার পরিচালনা করা অতোটাও সহজ ছিলো না। কিন্তু তারপরেও যে মা কীভাবে সংসারটা চালিয়েছে তা শুরুতে অনুভার অজানা থাকলেও একসময় জানতে পারে যে মা তার কিছু গহনা বিক্রি করে দিয়েছে। সে টাকা দিয়েই এতদিন ধরে সবটা সামলিয়ে আসছে। চাকরির পাশাপাশি মাস্টার্সে সবে ভর্তি হয়েছে অনুভা। দুদিন মাত্র ক্লাস করতে না করতেই তন্ময়ের মৃ’ত্যুর সংবাদ এলো। আবারো বিধ্বস্ত হয়ে গেলো সকলের মন। একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে চললো। দুঃখ যেনো তাদের আর ছাড়তেই চাইলো না। তন্ময় অনুভাকে ছোটো বোনের মতো স্নেহ করতো। অনুভারও ছিলো দুলাভাইয়ের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাবোধ এবং ভাই সমতুল্য ভালোবাসা। এমন একজন মানুষকে হারিয়ে সেও ভেঙে পড়ল মারাত্মকভাবে।
একদিকে বাবা-মা আরেকদিকে বোন আর তার সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ছোট্ট শিশু। মৃ’ত্যুর দিন চারেক পার হতে না হতেই ননদেরা কিছুতেই শ্বশুরের ভিটেতে থাকতে দিলো না অর্থিকাকে। যারপনায় তার ঠাঁই হলো বাপের বাড়িতে। সেসময়ে মারাত্মকভাবে পরিবারে দেখা দিলো আর্থিক অনটন। ওখানেই ইতি ঘটলো অনুভার লেখাপড়ার।
সেবার হঠাৎ ঝড় শুরু হলো। সুফিয়া ছুটে গেলেন ছাদ থেকে কাপড় আনতে। কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার সময়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন সিঁড়ি থেকে। পা মচকে গেলো উনার। কপালটাও বেশি খানিকটা ফেটে গেলো। চাকরির বিজ্ঞাপন দেখে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল অনুভা। বাড়ির নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে ইন্টারভিউ না দিয়েই ছুটে এসে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যায় মেয়েটা। এক্সরে করে জানা যায় পায়ের হাড় ভেঙে গেছে সুফিয়ার। সেই চিকিৎসা করতে গিয়েই তো অবশিষ্ট অর্থটাও শেষ হয়ে গেলো। সাথে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আরো বিভিন্ন অসুখ বিসুখ তো ধরা পড়লোই। চাকরিটা তখন ভীষণ প্রয়োজন হয়ে পড়ল অনুভার। তখনি চাকরির সন্ধান নিয়ে হাজির হলো নাহিয়ান। যার জন্য আজীবন লোকটার কাছে সে কৃতজ্ঞ থাকবে।
খরচ দিন দিন বেড়েই চলছিল। বাড়ি ওয়ালা তার মধ্যেই ভাড়া দু হাজার বাড়িয়ে দিলো। বাজারে দিনদিন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়ে চলেছে। তাই সুফিয়াই তৎক্ষণাৎ বাড়ি বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মেয়েকে বলে কয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়িটা বদলেও ফেলেন।
অতীতের কথা মনে পড়লেই যেমন আনন্দ ঘিরে ধরে তেমনি কিছু কিছু সময়কার ঘটনা অক্ষিপটে ভেসে উঠলেই চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। আজও ব্যতীক্রম হলো না অনুভার সঙ্গে। জীবনটা হয়তো এতটা কঠিন না হলেও পারতো। সুখ হারিয়ে দুঃখ না এলেও হয়তো হতো।
রাতের আঁধারে ভারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের পানি মুছে নিলো অনুভা। বারান্দা থেকে ফিরে এলো ঘরে। সিদ্ধান্ত নিলো আর অতীত নিয়ে সে ভাববে না। মেনে নিবে বর্তমানকে। যা ভাগ্যে আছে তাই না হয় হতে থাক।তাকে যে আরো কঠিন হতে হবে। চোখের পানি আর সুখ যে তার জন্য নয়। তবুও সে খুশি। রবের উপর বিশ্বাসী। আল্লাহ্ যা করেন মঙ্গলের জন্যই তো করেন।
বিছানায় শরীর এলিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো অনুভা। কাল আবারো রুটিন মাফিক অফিসে ছুটতে হবে তাকে। উঠতে হবে ভোরে। নরম বালিশে মাথা রাখতেই সকল গ্লানি ভুলে গিয়ে ডুবে গেলো তন্দ্রার অতল গহ্বরে।
________
ফজরের নামাজ শেষে হানিফ শেখ দুই পুত্রকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়েছেন। এই নিয়ে পরপর দুবার ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে চক্কর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সৌহার্দ্য। একটা বেঞ্চ দেখেই হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল তাতে। হানিফ শেখ আর শ্রাবণের অবস্থাও একই কিন্তু বাপ-ছেলে কেউ কারো সামনে নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে যেনো নারাজ।
বুক টানটান করে মুখে দাম্ভিকতা ফুটিয়ে ছোটো পুত্রের পাশে গিয়ে বসে পড়লেন হানিফ শেখ। কণ্ঠে অহমিকা এঁটে বললেন,“মাত্র এতটুকুতেই হাঁপিয়ে গেলি? তোর বয়সে আমি থাকতে পুরো গ্ৰাম তিন- চারবার করে চষে বেড়াতাম। অবশ্য তোরা শহরের ছেলেপুলে তো আবার একটুতেই দুর্বল হয়ে যাস।”
“তা দাদু বেঁচে থাকলেই জানা যেতো। উনার ছেলের দৌড় কতটুকু ছিলো তা তো আর দাদার থেকে ভালো কেউ জানবে না।”—-বিদ্রুপ করে কথাটা বলে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো শ্রাবণ।
ভাইয়ের কথা কর্ণপাত হতেই শব্দ করে হেসে উঠলো সৌহার্দ্য। থতমত খেয়ে গেলেন হানিফ শেখ। বিড়বিড় করে বললেন,“ছেলে দুটো উচ্ছন্নে গেলো। বাবার প্রতি কোনো ভয় ডর নেই?”
খানিকক্ষণ বাদে দু হাতে করে দু কাপ চা নিয়ে উপস্থিত হলো শ্রাবণ। কাপ দুটো ভাই আর পিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“বাড়ি যাচ্ছি আমি। খুব ক্লান্ত লাগছে।”
হানিফ শেখ এবং সৌহার্দ্য চায়ের কাপ দুটো গ্ৰহণ করতেই হনহনিয়ে প্রস্থান করল শ্রাবণ। চায়ের কাপে চুমুক বসালেন হানিফ শেখ। চোখা দৃষ্টিতে তাকালেন ছোটো পুত্রের পানে। পিতার এহেন চাহনিতে চুপসে গেলো সৌহার্দ্য। শুধালো,“কী দেখছো?”
“জীবনে তো আর বাবা-মাকে কম মিথ্যে কথা বলিসনি। জানিস তো বাবা-মাকে মিথ্যে বললে যে পাপ হয়? দুনিয়ার জীবনে পাপ করলে পরকালের জীবনে কিন্তু শান্তি পাওয়া যায় না। নিজের পাপের ভাগটা কমানোর জন্য চটপট করে এখন একটা সত্যি কথা বলে ফেলতো।”
“কী সত্যি?”
“তোর ভাই কার সঙ্গে প্রেম করে? মেয়েটা কে? বাড়ি কোথায়? বাবা কী করে?”
বিস্ফোরিত নেত্রে পিতার মুখশ্রীতে তাকিয়ে রয় সৌহার্দ্য। পুত্রের এমন চাহনিতে বিরক্তবোধ করলেন হানিফ শেখ। বললেন,“গরুর মতো তাকিয়ে আছিস কেন? নির্দ্বিধায় বন্ধু মনে করে আমায় সব বলতে পারিস। আমি হচ্ছি ডিজিটাল বাবা। কিচ্ছু বলবো না।”
“তোমায় বন্ধু মনে করবো! তোমায়? কাবি নেহি। ইম্পসিবল।”
“কেন? বন্ধু ভাবতে সমস্যা কোথায়?”
“মনে আছে ছোটো বেলায় বাড়ির পাশের বালুর মাঠে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ছক্কা মারলাম? এমন ছক্কাই মারলাম যে একেবারে মোতালেব চাচার জানালাটা ভেঙে গেলো? তখন তুমি কী বলেছিলে?বলেছিলে, বাবা তুই কী জানালাটা ভেঙেছিস? যদি ভেঙে থাকিস তাহলে সত্যিটা বলে ফেল। আমি কিছু বলবো না তোকে। তারপর কী করলে?”
“কী করেছি? সত্যিই তো কিছু করিনি।”
“মিথ্যে বলবে না বাবা।তুমি বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে সবটা বলে দিয়েছিলে আর তারপর মা আমার পিঠে কাঠের দু দুটো স্কেল ভেঙেছিল।”
হাস্যজ্জ্বল মুখখানা মলিন হয়ে গেলো হানিফ শেখের। আমতা আমতা করে উঠে দাঁড়ালেন বসা থেকে। সামনের পথে যেতে যেতে বললেন,“তোর মা যে তোকে মারবে আমি কী জানতাম নাকি? পুরোনো কথা মনে রাখতে নেই। বাড়ি চল।”
সৌহার্দ্যও বসা থেকে উঠে বাবার পিছুপিছু হাঁটতে লাগলো। অভিযোগের সুরে বললো,“কিন্তু তুমি তো মায়ের মারের হাত থেকেও রক্ষা করোনি।”
“আইসক্রিম খাবি?”
“সেদিন মাইর খেয়ে যখন আমি কাঁদছিলাম তখনও তুমি এ কথাটাই বলেছিলে।”
“আহা! পুরোনো কথা মনে রাখতে নেই। মায়ের হাতে মাইর খেয়েছিস বলেই তো আর কখনো অমন অঘটন ঘটাসনি। আর আমারও কাউকে জরিমানা দিতে হয়নি।”
বাপ-ছেলে কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললো বাড়ির পথে। বাহির থেকে এসেই সোজা নিজ কক্ষে প্রবেশ করেছে শ্রাবণ। ক্লান্ত দেহখানা নিয়ে ঢুকে পড়েছে বাথরুমে, গোসল করার উদ্দেশ্যে।
বেলা বাড়লো। ডাইনিং টেবিলে নাস্তা দিয়েছেন শান্তা। ভার্সিটির জন্য একেবারে তৈরি হয়ে টেবিলে এসে বসেছে শ্রাবণ। শান্তা ইতস্তত করতে করতে ছেলের উদ্দেশ্যে বলেই ফেললেন,“কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিলে হতো না মেহু?”
“এসব মেয়েদের নামে ডাকবে না তো। আর ছুটিই বা কেন নিবো?”
“ওই যে তোর রুবি খালার ননদের মেয়ের কথা বললাম না? তুই তো বিয়ে করবি না বলে নিষেধ করে দিলি তাই সৌহার্দ্যের জন্য ওকে দেখতে যাবো। ভাবছি বিয়ের কথাবার্তাও একেবারে পাকা করে আসবো।”
“এতো তাড়াহুড়ো করছো কেন?”
“তাড়াহুড়ো করবো না? বিয়ের বয়সী মেয়ে তার উপর সুন্দরী। এসব মেয়ের বাবা-মায়ের পেছনে সারাক্ষণ ঘটক পড়ে থাকে। যদি অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে যায়? আমি তো এ হতে দিবো না।”
“শোনো মা, এসব ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এখনকার যুগে ছেলে-মেয়েরা বাবা-মায়ের ভরসায় বসে থাকে না। কলেজ, ভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে নিজেরাই নিজেদের লাইফ পার্টনার ঠিক করে নেয়। তাছাড়া সৌহার্দ্য অলরেডি একজনকে পছন্দ করে। তোমরা অন্তত ওর উপর চাপ ক্রিয়েট করো না।”
হতভম্ব, হতবাক হয়ে গেলেন শান্তা। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,“কিহ! সহু প্রেম করে?”
মায়ের চিৎকারে দম ছাড়ে শ্রাবণ। বিরক্ত হওয়ার ভঙিতে বলে,“সিনক্রিয়েট করো না মা। আমার জানামতে বাবার সঙ্গেও তোমার প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। ওদিকে নানা বাবাকে পছন্দ করতেন না তাই তুমি বাবার হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলে।পরে অবশ্য মান সম্মানের ভয়ে নানা আবারো তোমাদের বিয়েটা নতুন করে দিয়ে দেয়। তবে মন থেকে কিন্তু মেনে নেয়নি। ঘটনাটা আরো বত্রিশ বছর আগের। সেই তুমিই বত্রিশ বছর পরে কীভাবে ছেলেদের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চাইছো?”
ছেলের কথায় মিইয়ে গেলেন শান্তা। কিছু সময় অতিক্রম হতেই ফের প্রশ্ন করলেন,“মেহু সত্যি করে বল তো তুইও কী প্রেম করিস?”
কোনো ভণিতা ছাড়াই খেতে খেতে শ্রাবণ উত্তর দিলো,“উহু প্রেম করি না। ওইসব প্রেমট্রেম আমার সঙ্গে যায় না। তবে মেয়ে পছন্দ আছে।”
“মেয়েটা কী জানে তুই ওকে পছন্দ করিস? আচ্ছা ওই মেয়েও কী তোকে পছন্দ করে?”
“মা হয়ে ছেলেকে এসব প্রশ্ন করা উচিত নয়।”
কথাটা শেষ করে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো শ্রাবণ। মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে।
শ্রাবণ যেতে না যেতেই টেবিলে একে একে উপস্থিত হয় হানিফ শেখ এবং সৌহার্দ্য। মাকে গোমড়া মুখ করে বসে থাকতে দেখে সৌহার্দ্য শুধায়,“তোমার আবার কী হয়েছে মা? মুখ ভার কেন?”
“মেহুরও বিয়ের জন্য মেয়ে পছন্দ আছে। শেষে কিনা মেহুও প্রেম করে!”
স্ত্রীর কথা শেষ হতেই হানিফ শেখ সবজান্তার মতো ভাব নিয়ে বললেন,“এ আর নতুন কী? খবরটা অতিব পুরোনো। মেয়েটার নাম, ঠিকানা যদি জানতে পারো তাহলে সেটাই হবে নতুন এবং টাটকা খবর।”
চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো শান্তার। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে স্বামীর পানে তাকালেন। শুধালেন,“তুমি জানতে ও প্রেম করে? কীভাবে জানলে? কবে জানলে?”
“ভার্সিটিতে পড়াকালীন মাস শেষে যখন ড্রাইভারকে দিয়ে আমার হাতে গাড়ির পেট্রোল খরচের বিশাল বড়ো একটা লিস্ট ধরিয়ে দিতো তখনি কিছু একটা আন্দাজ করেছিলাম। পরে ড্রাইভার ব্যাটাকে ধরে আরো কিছু তথ্য উদঘাটন করি। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত আমার পেট্রোল খরচা করে ওই মেয়ের সঙ্গেই ও দেখা করতে যেতো।”
“তাহলে তো অনেক বছর ধরে সম্পর্ক চলছে!”
“হুম তা তো চলছেই।”
বড়ো ভাইয়ের পেছনে বাবা-মায়ের গোয়েন্দাগিরি চালানোটা মোটেও পছন্দ হলো না সৌহার্দ্যের। বিরক্তির সহিত বললো,“আহা তোমরা থামো তো। অযথা ভাইয়ার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করে সময় নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন আছে? সময় হলে ভাইয়া নিজেই ভাবীকে নিয়ে এসে তোমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিবে। এখন শুধু রিলেক্স করো।”
সরু দৃষ্টিতে এবার ছোটো পুত্রের পানে তাকালেন শান্তা। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“তোর ভাইয়ের না হয় নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে বাবা-মায়ের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি। কিন্তু তোর তো সময় না হওয়ার কিছু দেখছি না। কার সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছিস?কে মেয়েটা? তাকে নিয়ে বাড়িতে আসিস তো দেখবো। আর হ্যাঁ বিদেশি কোনো মেয়েকে কিন্তু আমি পুত্রবধূ হিসেবে মানবো না বলে দিলাম। তারপরেও আমাকে যদি জোর করিস তাহলে তোর বাবাকে দিয়ে তোকে ত্যাজ্য পুত্র করে দিবো।”
কথা শেষ করে হনহনিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন শান্তা। অসহায় মুখ করে মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে সৌহার্দ্য। হানিফ শেখ উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন,“তোদের দুই ভাইকে নিয়ে আমি গর্বিত। বাবা যে পথে হেঁটেছে তোরাও দেখছি সেই পথেই হাঁটছিস! ক্যারি অন। আমার বাবা আমার পাশে না থাকলে কী হবে? আমি আছি তোদের পাশে।”
_________
অন্যান দিনের থেকে আজকে কাজের চাপটা একটু বেশিই। কলিগ নায়রার সঙ্গে ক্যান্টিনে এসে সবে বসেছে অনুভা। মেয়েটি অফিসে নতুন সাথে অনেক মিশুকও বটে। দুদিনেই নিজ দায়িত্বে ভাব করে নিয়েছে অনুভার সঙ্গে। আগের তুলনায় অতো কথা বলার অভ্যাস আর নেই অনুভার। নিরবে শুনে যাচ্ছে অপরপাশে বসা ব্যক্তির একনাগাড়ে বলা কথা গুলো। মাঝেমধ্যে সৌজন্য স্বরূপ হাসছে। খাওয়ার ইতি উতি ঘটিয়ে দুজনেই বের হতে নিলো ক্যান্টিন থেকে। তৎক্ষণাৎ তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ালো নাহিয়ান। চোখেমুখে তার বিষণ্ণতা। আগের সেই চমকপ্রদ হাসিটা আর নেই। একদিনের ব্যবধানে মুখশ্রী হয়ে উঠেছে অনুজ্জ্বল।
অনুভা সৌজন্য হাসলো। শুধালো,“কেমন আছেন ভাইয়া?”
প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলো নাহিয়ান। পাল্টা প্রশ্ন করল,
“ফ্রি আছো তুমি? দু মিনিট সময় হবে?”
সরাসরি না করতে পারলো না অনুভা। নায়রার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,“আপনি এগোন আপা, আমি উনার সঙ্গে কথা বলেই আসছি।”
নায়রা সায় দিলো তাতে। প্রস্থান করল কয়েক সেকেন্ডেই। ক্যান্টিনের ভেতরে ফাঁকা টেবিলে এসে বসলো নাহিয়ান। তার মুখোমুখি বসলো অনুভা। জিজ্ঞেস করল,“কী যেনো বলবেন ভাইয়া? এবার বলুন।”
হুট করে তো ডেকে নিয়ে এলো কথা বলার জন্য কিন্তু এবার কী বলবে? মস্তিষ্কে ঘুর্ণিপাক খাওয়া প্রশ্নগুলো সরাসরি জিজ্ঞেস করলে যদি রেগে যায় অনুভা? যদি ভুল বোঝে? বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতেই কয়েক মিনিট অতিক্রম হলো। অনুভা পুনরায় বললো,“কী হলো ভাইয়া? কী ভাবছেন? যা বলার নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।”
কিছুটা হলেও সাহস সঞ্চয় হলো নাহিয়ানের। সরাসরি প্রশ্ন করল,“ওই ছেলেটা কে অনু? তোমাদের মধ্যে কী কোনো সম্পর্ক আছে?”
ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত হলো অনুভার। শুধালো,“কে? শ্রাবণ?”
“ওহ, ছেলেটার নাম তবে শ্রাবণ? তা কী সম্পর্ক তোমাদের মধ্যে? কতদিনের পরিচয়?”
“পরিচয় অনেক আগের। ধরুন পাঁচ-ছয় বছর তো হবে।”
শুকনো ঢোক গিললো নাহিয়ান। ভেতরে অস্থিরতা বিরাজ করছে। উপরে উপরে নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে। কথাটা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে বারংবার। পাঁচ-ছয় বছর! সেখানে সে অনুভাকে চেনে মাত্র বছর দেড়েক হবে। তাও আবার কয়েক মাস কম ব্যস আছে তার মধ্যে। সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ও তোমায় ভালোবাসে তাই না?”
”জানি না।”
ললাটে ভাঁজ পড়ে নাহিয়ানের। ফের প্রশ্ন করে,“তুমি বাসো? এবারও অন্তত জানি না বলো না।”
কী উত্তর দিবে ভেবে পেলো না অনুভা। তবে হ্যাঁ একসময় শ্রাবণ নামক পুরুষটি তার জীবনের অর্ধেকটা জায়গা দখল করে ছিলো। এই পুরুষটিকে নিয়ে সে ভাবতো। তার দেখা পাওয়ার জন্য ছটফট করতো মন। একসময় নিশ্চিতও হতে পেরেছিল যে পুরুষটির প্রেমে পড়েছে সে। ভালোও হয়তো বেসেছিল কিন্তু সে সময়টায় জীবনে এক ঝড় বয়ে যায়। ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের সুন্দর সাজানো পরিবারটা তছনছ হয়ে যায়। দরিদ্রতার কড়াল গ্ৰাসে ভেঙে পড়ে। সব দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে অনুভার। তখন সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কাউকে একটা প্রয়োজন ছিলো পাশে কিন্তু কাউকেই পায়নি মেয়েটি।
দায়িত্বের ভারে একসময় তার মন, মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যায় শ্রাবণ। তবে এমনি এমনি বের হয়নি বরং জোর করে শ্রাবণ নামক পুরুষটিকে নিজের সকল ভাবনা থেকে বের করে দিয়েছিল অনুভা। বারবার তার মুখশ্রী স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলেও তাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তবে এই মুহূর্তে নাহিয়ানের কথার বিপরীতে চট করে না বলতে পারলো না অনুভা। ভেতরে কোথাও শ্রাবণের জন্য এখনো কিছু একটা অনুভব করে সে।
তার নিরবতায় মলিন হাসলো নাহিয়ান। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। বললো,“বেশি সময় নিয়ে ফেললাম তোমার। নিজের টেবিলে যাও। স্যারের চোখে পড়লে আবার বকা খেতে হবে।”
বলেই চলে গেলো নাহিয়ান। অনুভাও উঠে দাঁড়ালো। এ বিষয়ে আর বেশি একটা ভাবলো না। চলে গেলো নিজ টেবিলে।
চলবে _________
(কপি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।)