সুখেরও সন্ধানে পর্ব-০১

0
951

#সূচনা_পর্ব
#সুখেরও_সন্ধানে
লেখনীতে: #মাশফিত্রা_মিমুই

বিপরীত মুখী থেকে আগত বাইকের সংঘর্ষে পিচ ঢালা রাস্তার উপর উল্টে গেলো চলন্ত রিক্সাটি। সঙ্গে সঙ্গেই রিক্সা থেকে ছিটকে পড়ল অনুভা। বাম হাতের কব্জি ছিঁলে ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগলো তরল তাজা র’ক্ত। মারাত্মক ব্যথায় অক্ষি যুগল থেকে বর্ষনের ন্যায় নিঃসৃত হচ্ছে অশ্রুজল। রিক্সা চালকের অবস্থাও মর্মান্তিক। আশেপাশের পথচারীরা দৌড়ে এলো ঘটনাস্থলে। শুরু হলো শোরগোল। আধ বোজা চোখে চাইলো অনুভা। ঘাড় উঁচিয়ে আবছা দৃষ্টিতে চারিদিকে একবার পর্যবেক্ষণ করে পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করে নিলো নিজ অক্ষি যুগল।হঠাৎ করেই শোনা গেলো আকুতি ভরা এক পুরুষালী কণ্ঠস্বর,“আপু উনাকে ধরে একটু সিএনজিতে উঠিয়ে দিন না। অনেক র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।”

যেই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলা হলো সেই মেয়েটি এগোলো না সামনে। ভয়ে নিজ স্থানে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। তার নড়চড় না দেখে নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসতে লাগলো দুজন পুরুষ লোক। তাদের মধ্যকার একজন বলে উঠলো,“আমরা সাহায্য করছি। এই ধরুন তো উনাকে।”

পুরুষটি বাঁধ সাধলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে লোক দুটোর উদ্দেশ্যে বললো,“আপনারা পুরুষ মানুষ। পুরুষ হয়ে অপরিচিত এক নারীকে ধরা কী আদৌ উচিত হবে? যেখানে আছেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকুন।”

থেমে গেলো লোক দুজন। পুরুষটির কথা শুনতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী। হাঁটু গেঁড়ে বসলেন অনুভার সম্মুখে। বিচলিত কণ্ঠে বললেন,“আহারে কতটা কেটে গেছে! আমার হাত ধরে সাবধানে উঠুন দেখি।”

মহিলাটির সাহায্যে উঠে দাঁড়ালো অনুভা। ছিটকে পড়ায় হাঁটুতেও অনেকটা লেগেছে। হাঁটুর অংশের সালোয়ারটায় খানিকটা ছিঁড়ে গেছে। পরনের হলুদ জামা এবং হিজাবের সামনের অংশেও র’ক্তে মাখামাখি। তাকে নিয়ে মহিলাটি সিএনজির দিকে এগোতে নিলেই সেই পুরুষটি উনার হাতে ধরিয়ে দিলো একটি রুমাল। বললো,“রুমালটা উনার ক্ষত স্থানে চেপে ধরে রাখতে বলুন।”

কণ্ঠস্বরের মালিকের কথাটা এবারো শ্রবণালী পর্যন্ত পৌঁছালো অনুভার। মনে হলো কণ্ঠস্বরটির সঙ্গে সে পূর্ব পরিচিত। তবে মস্তিষ্ক চট করে কণ্ঠস্বরের মালিক কে হতে পারে তা ধরতে পারলো না। ঘোলাটে দৃষ্টিতে পুরুষটিকে দেখতে চেয়েও দেখতে পারলো না।ততক্ষণে তাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো সিএনজিতে। মহিলাটিও কি মনে করে যেনো তার সঙ্গেই উঠে পড়ল। নিজ দায়িত্বে ক্ষত স্থানে চেপে ধরলো রুমালটি। শক্ত করে আরেক হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলো বাহু।

নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছাতেই দুজন নার্স ধরাধরি করে একটি কেবিনে নিয়ে বসালো অনুভাকে। একজন ডাক্তার এসে ক্ষত স্থান পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। পূর্বের ব্যথাটা কিছুটা হলেও এবার যেনো লাঘব হলো অনুভার। তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন ডাক্তার। ততক্ষণে সেই অপরিচিত ভদ্রমহিলাও বিদায় নিয়েছে। কিছু সময় অতিবাহিত হলো। হুট করে কিছু একটা মনে পড়তেই মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠলো অনুভার। অশান্ত দৃষ্টিতে আশপাশটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। তার এহেন ছটফটানি লক্ষ্য করে এগিয়ে এলেন একজন নার্স। প্রশ্ন করলেন,“কিছু খুঁজছেন আপনি?”

“আমার ভ্যানিটি ব্যাগ সাথে দুটো ফাইলও ছিলো।”

কেবিনের টেবিলের উপর থেকে একটা ব্যাগ এবং ফাইল দুটো এনে অনুভার হাতে তুলে দিলেন নার্সটি। বললেন “এই নিন। ব্যাগের ভেতরে সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে নিন।”

চটজলদি ব্যাগের ভেতরটা চেক করল অনুভা। সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে পেলো মুঠোফোন। ফোনটা অন করতেই স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করা ভাসমান নাম্বার গুলোতে দৃষ্টি আটকালো তার। মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো অন্তরাত্মা। অফিস থেকে প্রায় এগারোটা কল এসেছে। সাথে এসেছে বসের তিক্ত কিছু ম্যাসেজ।

ফাইলের পানে তাকাতেই অনুভা আঁতকে উঠলো। উপরের মোটা কাগজটার অবস্থা নাজেহাল। সাথে মনে পড়ল আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং ছিলো অফিসে। ফরেনার এক ক্লাইন্ট আসবেন। এই ফাইল দুটোর মধ্যকার একটাতেই তো ছিলো সেই মিটিংয়ের সকল বিষয় বস্তু। ললাট বেয়ে কপোলে এসে পড়ল সরু ঘাম। চাকরি হারানোর চিন্তায় মাথা ব্যথা হওয়ার উপক্রম। অশান্ত চোখ জোড়া দিয়ে বেখেয়ালি ভাবে আশেপাশে তাকাচ্ছে সে। তৎক্ষণাৎ কেউ একজন উপস্থিত হলো কেবিনে। তার সামনে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,“এই নিন আপু, আপনার ওষুধ।”

ধ্যান ভঙ্গ হলো অনুভার।মাথা তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া একজন যুবককে। ভ্রু দ্বয় কুঞ্চিত করে শুধালো,
“আপনি? কে আপনি?”

ছেলেটি কাঁচুমাচু মুখ করে উত্তর দিলো,“যেই বাইকের জন্য আপনার এই অবস্থা হলো সেই বাইকেরই চালক আমি। গতকালই বাবা নতুন বাইক কিনে দিয়েছে। অতশত চিন্তা না করে ফুল স্পীডে অন্য রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় টার্ন করতেই আপনাদের রিক্সার সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায়। স্যরি আপু। আমি বুঝতে পারিনি এত বড়ো একটা দুর্ঘটনা যে ঘটে যাবে।”

অনুভা খেয়াল করল তার থেকেও ছেলেটার অবস্থা খারাপ। কপালে ব্যান্ডেজ সাথে ডান হাতটাও গলায় ঝুলছে। অনুভা কিছুটা ইতস্তত করে বললো,“স্যরি বলার প্রয়োজন নেই। কেউ তো আর ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটায় না। আপনার অবস্থা তো আমার থেকেও করুণ। তা এই ওষুধের আবার কী দরকার ছিলো? আমি নিজেই তো কিনে নিতাম।”

“আমি কিনিনি আপু। একটা ভাইয়া এসে প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে বললেন আপনার হাত পর্যন্ত পৌঁছে দিতে।”

“ভাইয়া? কোন ভাইয়া?”

“নাম তো জানা হয়নি। তবে দুর্ঘটনা স্থলে উনি ছিলেন। আমাকে তো উনিই হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।”

বিপরীতে আর কোনো প্রশ্ন করল না অনুভা। চুপচাপ প্যাকেটটা গ্ৰহণ করল। ছেলেটি তার থেকে বিদায় নিয়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে স্থান ত্যাগ করল। আর বিলম্ব না করে হাসপাতালের পাট চুকিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অনুভা।এখন অফিসে যাওয়ার মতো অবস্থায় সে নেই। কাল যা হবে তা না হয় কালই দেখা যাবে।
______

চতুর্থ ফ্লোরের একটি ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে বাচ্চার গগন বিধারক চিৎকার। একজন পৌঢ় মহিলা দোলনার সম্মুখে বসে বাচ্চাটির কান্না থামাতে ব্যস্ত। ফিডারে করে দুধ এনে মুখের সামনে ধরার পরেও বাচ্চাটির কান্না যেনো কিছুতেই থামছে না। মহিলার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। কীভাবে একে থামাবেন বুঝতে পারছেন না। ভেতর ঘর থেকে ভেসে আসছে অধৈর্য বয়স্ক পুরুষ কণ্ঠ,“কী হলো? নানাভাই কাঁদছে কেন? ওকে এ ঘরে নিয়ে এসো।”

মহিলা নিজ স্থান থেকেই উত্তর দিলেন,“ওর কান্না আমি থামাচ্ছি। তুমি ঘুমাও, এমনিতেই যে পাওয়ারের ওষুধ খেয়েছো।”

পূর্বের ন্যায় নিরবে বিছানায় শুয়ে রইলেন কামরুল হাসান। চোখেমুখে উনার স্পষ্ট ফোটে উঠেছে অক্ষমতা। তৎক্ষণাৎ বেজে উঠলো কলিং বেল। কলিং বেলের শব্দে সুফিয়ার মনে দেখা দিলো আশার আলো। ইচ্ছে করল এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিতে কিন্তু পায়ের ব্যথাটার কারণে পারলেন না ছুটে যেতে। বাচ্চাটিকে রেখেই ছোটো ছোটো কদমে কিছুটা সময় নিয়ে দরজা খুলে দিলেন। দরজার অপরপাশের ব্যক্তিটিকে দেখতেই উনার মুখের আদল বদলে গেলো। কুঞ্চিত হলো ভ্রু দ্বয়। কালক্ষেপণ না করেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,“একি! এই অসময়ে তুই? এত তাড়াতাড়ি অফিস ছুটি?”

ক্লান্ত এবং অসুস্থ দেহখানা নিয়ে সুফিয়াকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেতেই থমকে দাঁড়ালো। শুধালো,“তাঈম কাঁদছে না? ওর আবার কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের পানে একবার তাকিয়ে তারপর দ্রুত পায়ে চলে গেলো দোলনার কাছে। দ্রুত তাঈম নামক বাচ্চাটিকে তুলে নিলো নিজ কোলে। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আহ্লাদী সুরে বললো,
“কাঁদে না, কাঁদে না, কাঁদে না বাবা আমার।”

পরিচিত কণ্ঠস্বর এবং স্পর্শ পেতেই কান্নার গতি হ্রাস পেলো শিশুটির। তাকে এবার পাঁজা কোলে নিলো অনুভা। কপালে, গালে, চোখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। কাদু কাদু মুখ করে বললো,“কাঁদে কেন আমার বাবাটা? কী হয়েছে? নানু বকেছে?”

পুরোপুরি ভাবে কান্না থেমে গেলো ছোট্ট বাচ্চার। ড্যাবড্যাব দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলো অনুভার পানে। আদো আদো কণ্ঠে উচ্চারণ করতে লাগলো,“মা, মা, মা।”

অনুভার অশান্ত, চিন্তিত মুখশ্রীতে ফোটে উঠলো এক চিলতে হাসি। সুফিয়া এগিয়ে এলেন। কোমরে হাত চেপে বসে পড়লেন সোফায়। দম ছেড়ে বললেন,
“অবশেষে থামলো উনার কান্না। কতক্ষণ ধরে যে কান্না করছিল! আমি কত চেষ্টা করলাম কিন্তু কিছুতেই থামলো না।”

“এতো চেষ্টা করতে বলেছে কে? একটু কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করলেই তো কান্না থেমে যেতো।”

“তুই জানিস না আমার কোমরে আর পায়ে যে ব্যথা? নিজেই কত কষ্ট করে যা একটু হাঁটা চলা করি তার উপর ওকে কোলে নিয়ে নেচে নেচে কান্না থামানোর জো আছে?”

কথা বাড়ালো না অনুভা। বললো,“গোসলটাও তো করিয়েছ বলে মনে হয় না। যাই হোক পারলে ওর ফিডার আর সুজিটা দিয়ে যেও। খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিবো।”

কথাটা বলা শেষ করে নিজ ঘরের দিকে পা বাড়ালো অনুভা। তখনি পেছন থেকে ডেকে ওঠেন সুফিয়া। এতক্ষণে মেয়ের অবস্থা উনার দৃষ্টিগোচর হলো। শুধালেন,“তোর হাতে ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে? এই জন্যই অফিস থেকে চলে এসেছিস?”

“তেমন কিছু না।পথে ছোটো খাটো একটা এক্সিডেন্ট ঘটেছে। চিন্তা করো না ডাক্তার দেখিয়েছি, ওষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ বাবার কান পর্যন্ত যাতে কথাটা না পৌঁছায়।”

কথাটা শেষ হতে হতে ঘরে পৌঁছে গেলো অনুভা। দরজা ভিড়িয়ে বালিশ ঠিক করে বিছানায় শুইয়ে দিলো তাঈমকে। খানিকক্ষণ বাদে একহাতে দুধ ভর্তি ফিডার আরেক হাতে সুজির বাটি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন সুফিয়া। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,“তুই গিয়ে জামা-কাপড় বদলে আয়। আমি ওকে খাওয়াচ্ছি।”

মায়ের হাত থেকে সুজির বাটিটা নিজ হাতে নিয়ে নিলো অনুভা। যত্ন সহকারে তাঈমকে খাওয়াতে খাওয়াতে বললো,“তার প্রয়োজন নেই। আমি আছি, বাকি সময়টা আমিই বুঝে নিবো কী করতে হবে আর কী করতে হবে না। তুমি বরং ঘরে যাও।”

কথাটা গায়ে লাগলো সুফিয়ার। যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, “একেই বলে মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। এমন ভাব যেনো আমি ওর কিছুই হই না।”

সম্পূর্ণ কথাটা কর্ণগোচর হতেও বিপরীতে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করল না অনুভা। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তাঈমকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তারপর চলে গেলো নিজের পোশাক বদলাতে। যত যাই হোক না কেন, ছেলেটা ওর ছোঁয়া পেলেই একেবারে শান্ত হয়ে যায়।

স্ত্রীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখেই কামরুল হাসান উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন,“কে এসেছে? অর্থি? নানাভাইয়ের কান্না থেমেছে?”

“অনু এসেছে। ওই থামিয়েছে তাঈমের কান্না।”

“ও না অফিসে গেলো? যাওয়ার আগে বলেও তো গেলো কী নাকি একটা মিটিং ফিটিং আছে।”

“জানি না। বড়ো হয়েছে, এখন কী আর বাবা-মায়ের কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে? যা ইচ্ছে করুক গিয়ে।”

“তুমি সবসময়ই ভুল বোঝো মেয়েটাকে।”

“হ্যাঁ ও তো আমার সৎ মেয়ে যে ওকে ভুল বুঝবো সারাক্ষণ। মাঝেমধ্যে এমন করে কথা বলো যেনো আমি নই বরং তুমিই ওদের পেটে ধরেছো।”

বলেই মুখ বাঁকিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে বসে রইলেন সুফিয়া। কামরুল হাসান নিরব রইলেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর খিটখিটে স্বভাবটাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।ভালো কথাকেও প্যাঁচিয়ে প্যাঁচিয়ে অসহ্য করে তুলেন এই ভদ্রমহিলা। মাঝে মাঝে কামরুল হাসানের ইচ্ছে করে মেয়েকে বলতে,“তোর মাকে দয়া করে ভালো একটা ডাক্তার দেখা। এর ব্যবহার আমি আর নিতে পারছি না। আমার অসহ্য লাগছে সবকিছু।” কিন্তু বাধ্য হয়েই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে হয়। এই একটা মেয়ের উপর আর কতই বা সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া যায়? তাছাড়া স্ত্রীর এই অবস্থার মূল কারণও যে তিনি।

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অনুভা। শরীরটা তার অবশ লাগছে। উত্তাপ ছড়িয়ে গেছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মনে হচ্ছে জ্বর আসবে। হাতের ব্যথাটা আবারো চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। খাবারের পর একটা ওষুধ আছে। কিন্তু পেটে ক্ষুধা থাকলেও খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই তার মধ্যে নেই। মাথায় অন্য চিন্তা,
“কাল অফিসে যাবো কী করে? স্যার যদি সবার সামনে আবারো অপমান করেন? চাকরি থেকে বের করে দিলে? কী হবে তখন?”

বিভিন্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে মাথাটা ভার হয়ে এলো অনুভার। মনে হয় জ্বর আসবে। ছোটো থেকেই তার এই একটা সমস্যা। শরীরে তীব্রতর কোনো আঘাত লাগলেই গা পুড়িয়ে জ্বর আসবে। নিজের শরীর নিয়ে আর হেলাফেলা না করে খাবার খেয়ে ওষুধ সেবনের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো। নিজের জন্য তো নিজেকেই ভাবতে হবে।
_______

একটি কালো দিন পেরিয়ে নব্য দিনের সূচনা হলো। ভয়ার্ত মন নিয়ে অফিসের ভেতরে প্রবেশ করল অনুভা। চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে সবাইকে পরখ করে নিলো। কেউই তার পানে একবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। নিজ টেবিলে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগটা রাখতেই সামনে উপস্থিত হলেন বসের পিয়ন আজগর। পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে লম্বা একটা সালাম দিলেন। বললেন,“স্যার আপনারে যাইতে কইছে ম্যাডাম।”

সালামের জবাব নিলো অনুভা। বড়ো একটা ঝড় যে তার উপর আসতে চলেছে তা খুব ভালো করেই টের পেলো। সবার সামনে যদি স্যার চিৎকার চেঁচামেচি করে তখন কী হবে? লজ্জায় সকলকে মুখ দেখাবে কী করে অনুভা?চিন্তায় চিন্তায় ললাটে ঘাম জমেছে। আজগর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে বলে উঠলেন,“ম্যাডাম কী ভয় পাইতাছেন? ভয় পাইয়া আর কী করবেন? যা হওয়ার হইয়া গেছে। চলেন এইবার। দেরি কইরা গেলে স্যারে আরো রাইগা যাইবো।”

“আচ্ছা চলুন।”

“আপনে যান। আমার অন্য কাম আছে।”

বলেই পিঠ বাঁচিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন আজগর। শুকনো ঢোক গিলে বসের কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনুভা। দরজায় নক করার পূর্বেই ভেতর থেকে ভেসে এলো এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর,“আসুন।”

অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চেয়ারের উপর ফর্মাল পোশাকে বসে আছে একজন সুদর্শন পুরুষ। চোয়াল তার শক্ত। মুখশ্রীতে রাগ বিদ্যমান। লোকটির দিকে একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তারপর সেই দৃষ্টি সরিয়ে মেঝেতে স্থির করল অনুভা। ভয় পেলে চলবে না। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কিছু বলার জন্য ঠোঁট নাড়াতেই তাকে থামিয়ে দিলো তানিম। কণ্ঠে গাম্ভীর্য এঁটে বললো,“নো এক্সপ্লেইন।”

থতমত খেয়ে গেলো অনুভা। আপাতত চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো তানিম। বললো,“মিটিংটা কত গুরুত্বপূর্ণ ছিলো জানতেন না আপনি? এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তাও কী জানতেন না আপনি? তাহলে এমন একটি জঘন্য কাজ করলেন কীভাবে? এমন অনভিজ্ঞ, অকাজের মানুষজনকে কী দেখে যে কাজে রাখা হলো তাই তো বুঝতে পারছি না।”

ধমকে নড়েচড়ে উঠলো অনুভা। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। তানিম এবার একাধিক প্রশ্ন ছুঁড়লো,“সত্যি করে বলুন তো, আমাদের বিরুদ্ধে কে আপনাকে হায়ার করেছে? আমাদের কোনো প্রতিযোগী কোম্পানি? নাম কী সেই কোম্পানির? কত টাকার বিনিময়ে তাদের হয়ে কাজ করছেন?”

বিস্ফোরিত নেত্রে সম্মুখে বসা লোকটির দিকে ফের তাকালো অনুভা। কম্পিত হলো হৃদয়। তার থেকে আশানুরূপ উত্তর না পেয়ে আবারো চোখমুখ কঠিন হয়ে এলো তানিমের। দৃশ্যমান হলো ললাটের রগটা। শাসিয়ে বলে উঠলো,“ভালোয় ভালোয় সত্যটা বলবেন নাকি আমি পুলিশ ডাকবো?”

ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও বাহির থেকে নিজেকে যথেষ্ট সামলে নিলো অনুভা। বললো,“কেউ আমায় হায়ার করেনি স্যার। আমি তো সঠিক সময়েই অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু মাঝপথে আসতেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ি। যেই রিক্সাটিতে উঠেছিলাম সেই রিক্সাটা এক্সিডেন্ট করে। এই দেখুন আমার হাতে এখনো ব্যান্ডেজ।”

হাতের ব্যান্ডেজ করা স্থানটা তুলে ধরলো অনুভা। তানিম সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। অনুভা ফের বললো,“আমার কাছে প্রেসক্রিপশনও আছে স্যার। আপনি বললে ব্যাগ থেকে গিয়ে নিয়ে আসি? আমি ইচ্ছে করে এমনটা করিনি। এই মিটিং নষ্ট করে আমার কী লাভ?”

“নিয়ে আসুন।”

“কী?”

“প্রেসক্রিপশন।”

অনুভা মাথা নেড়ে দ্রুত পায়ে নিজের টেবিলের দিকে অগ্ৰসর হলো। এমন কিছু হওয়ার আন্দাজ আগেই করেছিল সে, বিদায় সঙ্গে করে প্রেসক্রিপশনটাও নিয়ে এসেছে। ব্যাগ থেকে কাগজটা বের করে পিছু ফিরতেই দেখতে পেলো দাঁড়িয়ে আছে তানিম। তার হাত থেকে একটানে নিয়ে নিলো প্রেসক্রিপশনটা। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অনুভার। তার দৃষ্টি চারিদিকে ঘুরছে। ভয়টা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবার সামনেই যদি কড়া কিছু বলে অপমান করে বসে তানিম? আর যাই হোক লজ্জায় যে কারো সামনে উঁচু শিরে দাঁড়ানো যাবে না তা অনুভা পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিত। এর আগেও বস নামক লোকটির থেকে অনেক কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তবে এবারের ব্যাপারটা আগেরগুলোর তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত অন্যায় কাজ।

তানিম কড়া গলায় বলে উঠলো,“এসব অভিনয় তানিম এহসানের সামনে চলবে না। এবারের মতো মাফ করে দিলাম। এরপর এমন ভুল হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে চাকরি থেকে বের করে দিবো।”

তারপর নিজ এসিস্ট্যান্টের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললো,“নাহিয়ান! উনার এই মাসের বেতন থেকে তিন হাজার টাকা কেটে রাখবে।”

কথাটা বলেই হনহনিয়ে স্থান ত্যাগ করল তানিম। অসহায় দৃষ্টিতে একবার অনুভার পানে তাকিয়ে নাহিয়ানও ছুটলো স্যারের পিছু। লজ্জায় মাথা নিচু করে চেয়ার টেনে বসে পড়ল অনুভা। তাকে এমন ভাবে অপদস্থ হতে দেখে সামনের টেবিলগুলোতে বসা কয়েকজন মুচকি মুচকি হাসছে। মেয়েটাকে বকা খেতে দেখে তাদের যেনো খুব আনন্দ হয়।

কিন্তু সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অনুভার। তার মনে বাসা বেঁধেছে চিন্তারা। তিন হাজার টাকা আদৌতেও কী কম কিছু? তাদের মতো মধ্যবিত্তদের কাছে তো এই তিন হাজার টাকাই লাখ টাকার সমান। পুরো বেতন দিয়ে সংসারসহ এতগুলো মানুষের আলাদা আলাদা খরচ চালাতে গিয়েই তো হিমশিম খেয়ে যায় অনুভা। মাস শেষে হাতে একটা টাকাও অবশিষ্ট থাকে না। চলতে হয় ধার দেনা করে। সেখানে এবার আরো তিন হাজার টাকা কম?

চলবে_______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে