সুখময় বৃষ্টি পর্ব : ৫
#লেখা : রায়না মনি
ধারা সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইল অনেক ক্ষণ। পা ফেলে নিচে নামতে ভুলে গেছে । একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো, ওর মা যেভাবে মানুষটার সাথে কথা বলছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা দুজন পরিচিত।
রুবিনা সেই কখন থেকেই দেখছে ধারা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে তাদের দিকে তাকাচ্ছে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে।
“কিরে ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? এদিকে আয়।”
মায়ের কথা কানে যেতেই ধারা খুব তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি থেকে নিচে নামলো। তারপর একে বারে মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর উচ্ছ্বাসের সাথে বললো,
“আপনি সেই না ?”
ধারার কথা শুনে অঝোর একটু অবাকই হলো। ধারা ওকে চিনে নাকি?
রুবিনা ও অবাক হলো, ধারার তো অঝোরকে চেনার কথা না। ধারা কাকে ভাবছে কে জানে।
“স্যরি! তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি সেই মানে?”
অঝোরের কথা শুনে ধারার হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে। কী থেকে কী বলবে ভেবেই পাচ্ছে না। এত দিনের কাঙ্ক্ষিত মানুষটা ওর সামনে বসে ওর সাথে কথা বলছে, ও ভাবতেই পারছে না। রাস্তার দিকে কতো তাকিয়ে রয়েছে এই মানুষ টাকে একটুখানি দেখার জন্য। আর আজ সেই মানুষটা এতটাই কাছে যে, হাত বাড়ালে ছুঁয়েও দেখা যায়। মানুষটার মাথার চুল গুলো আজকেও কপালের উপর পড়ে আছে। চুল গুলোই ধারার নজর কাড়লো বেশি। মানুষটা দেখতে মাশাআল্লাহ খুবই কিউট।
খুশিতে ধারার মাথা আউলা জাউলা লাগছে। ধারা বললো,
“আসলে আমি বলতে চাচ্ছি আপনি কিছুদিন আগে, বৃষ্টির মধ্যে সালাম আঙ্কেলের গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন না ?”
“হ্যাঁ, একদিন দুপুর বেলায় বৃষ্টির জন্য তোমাদের বাসার কাছাকাছিই একটা বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সালাম আঙ্কেলের গ্যারেজ কিনা তা তো আমি জানি না । আমি এখানকার তেমন কিছুই চিনি না ।”
ধারা বেশ আনন্দের সাথেই বললো,
“আপনাকে আমাদের বাসায় দেখবো, আমি তা ভাবতেই পারিনি। আমার মাকে চিনেন আপনি ?
অঝোর কিছু বলার আগেই রুবিনা বললো,
“ধারা ও হচ্ছে অঝোর। সম্পর্কে তোর খালাতো ভাই হয়। ও ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ে। ওর মা বাবা ও আগে ঢাকা থাকতো। ওর বাবা চাকরি করে, ঢাকা থেকে বদলি হয়ে খুলনা আসছে এক মাসের মতো হয়েছে। ওর পরিবার এখন থেকে এখানেই থাকবে ।
আজ মার্কেটে বসে অঝোরের সাথে দেখা হলো, ওর কাছ থেকেই সব জানলাম ।”
ধারা ওর মায়ের পাশে বসলো। ভাবতে লাগলো, ওর কোনো আপন খালামনি নাই। তবে ওর মায়ের কয়েক জন কাজিনকে চিনে। তাদের ছেলে মেয়েকেও ধারা চিনে। একে তো কখনো দেখেনি।
“মা সে আমার কোন খালামনির ছেলে? আমি কি সেই খালামণিকে চিনি?”
“ছোট বেলায় একবার দেখেছিস শিউলি আপাকে, তাই তুই চিনবি না। তোর নানা, আর অঝোরের নানা আপন চাচাতো ভাই ।
তোর জে এস সি পরীক্ষার সময় আমার এক চাচা মারা গেল না? ওই চাচাই ছিল অঝোরের নানা।
চাচাকে দেখতে যে বাড়িতে গেলাম, তখন অঝোরের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।”
কথা গুলো বলে রুবিনা ইফতারি রেডি করতে চলে গেল।
ধারা অঝোরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি আমাকে চিনেন ? কখনো দেখেছেন?”
“তোমাকে আগে চিনতাম না, এখন তো চিনি। আর তোমার সম্পর্কে আন্টির কাছ থেকে সব কিছু শুনেছিও।
আর তোমাকে দু দিন আগে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম বোধ হয়।”
অঝোরের কথা শুনে ধারা অবাক! যাকে দেখার জন্য কতো রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বার বার নিরাশ হয়েছে, তার দেখা মেলেনি একটু । অথচ সেই মানুষটাই নাকি ধারাকে দেখে গেল। আর ও তাকে দেখতে পারলো না।
“আমি তো ভেবেছিলাম সেদিনের পর থেকে আপনি আর বাসা থেকে বেরই হন নি। মানুষ এভাবে নিখোঁজ হয়ে যেতে পারে?”
কথা গুলো বলার পরেই ধারার খেয়াল হলো ও কী বলে ফেলেছে। ইশ এখন এই মানুষটা কী মনে করে কে জানে।
“কেন তুমি আমাকে খুঁজছিলে নাকি ?”
ইশ কি লজ্জার কথা! ধারা মাথাটা লজ্জায় নিচু করে মিনমিন করে বললো,
” না মানে… আসলে সেদিনের পর থেকে আর কখনো আপনাকে দেখিনি তো তাই বললাম।”
“ও আচ্ছা। আমি এখানে তেমন কিছু চিনি নাতো, তাই খুব একটা বাসা থেকে বের হইনা। তুমি যেদিন আমাকে দেখেছো তার আগের দিনই আমি ঢাকা থেকে এখানে আসছি।”
“আপনি কী আবার ঢাকা চলে যাবেন?”
“হ্যাঁ ঈদের পরেই যাবো।”
“ওহ !”
আরো কিছুক্ষণ কথা বার্তা হলো ওদের মাঝে।
অঝোর হাতের ঘড়ি টার দিকে তাকিয়ে দেখলো ইফতারীর সময় হয়ে আসছে। তাই উঠে দাঁড়ালো।
“আন্টিকে একটু ডেকে আনো, আমি বাসায় যাবো।”
“এখন বাসায় যাবেন মানে ? ইফতারী করে তারপরেই বাসায় যাবেন, তার আগে আপনাকে ছাড়ছি না।”
“আরে না না আমি বাসায় যেয়েই ইফতারী করবো।”
ধারা আর ওর মা হাজার বলেও অঝোরকে রাখতে পারলো না। তবে অঝোর কথা দিলো, অন্য আরেক দিন এসে ইফতার করবে।
অঝোরের সাথে ধারা গেট পর্যন্ত আসলো। অঝোর যখন গেটের বাইরে পা রাখলো, তখন ধারা বললো,
“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগলো। আবার আসবেন কিন্তু ।”
অঝোর একটু হেসে বললো,
“হ্যাঁ আসবো।
…
ধারা ব্যালকনিতে বসে আছে ফুর ফুরা মেজাজ নিয়ে। অঝোরকে আজকে দেখার পর থেকেই ভীষণ ভালো লাগছে । অঝোরকে দেখার আশা করেও বার বার নিরাশ হয়েছিল। তাই ভেবেই নিয়েছিল, অঝোরকে হয়তো আর কখনো দেখতে পাবে না। আর আজ সেই অঝোরকেই কিনা এতোটা কাছ থেকে দেখতে পেল।
ধারার কেন জানি মনে হচ্ছে ও বিশেষ কিছু পেয়ে গেছে জীবনে ।
আচ্ছা অঝোর তো ওর খালাতো ভাই হয়, বয়সেও বড় তাহলে অঝোরকে ও কি বলে ডাকবে, ভাইয়া? অসম্ভব অঝোরকে কিছুতেই ও ভাইয়া ডাকতে পারবে না।
আজ যখন ও অঝোরের সাথে কথা বলছিল, তখন ভাইয়া বলতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাইয়া ডাক মুখ থেকে বেরই হয়নি।
যে ভাই হয় তাকে ভাইয়া ডাকতে কেন এমন হচ্ছে, তা ধারা বুঝতে পারছে না ।
ও যে কেন এত অঝোরকে নিয়ে ভাবছে তাও বুঝতে পারছে না। ও তো ভেবেছিল আর একবার অঝোরকে দেখতে পারলে, অঝোরের ভূত মাথা থেকে নামবে। কিন্তু না, এখন উল্টা অঝোরের ভূত আরো মাথায় চেপে বসেছে।
অঝোর রাতে ডিনার করতে বসে ওর আম্মুর সাথে সব কিছু বললো। ওর আম্মু বললো,
“রুবিনার মেয়েটা কতো বড় হয়েছে রে? মেয়েটার যখন দু বছর বয়স তখন একবার দেখেছিলাম। বড় হওয়ার পরে আর দেখি নাই ।”
“আম্মু ধারা তো এখন বড় হয়ে গেছে। এসএসসি পরীক্ষা দিবে এবার।”
“রুবিনাকে আসতে বলিস আমাদের বাসায় । কতো দিন হয়ে গেছে কারো সাথে দেখা হয়না। বিয়ের পরে সবাই সবার নিজের মতো করেই আছে, সংসার সামলাচ্ছে। একেকজন একেক জায়গায় থাকছে। দেখা হচ্ছে না কারো সাথে খুব একটা, কারো সাথে কারো যোগাযোগটা পর্যন্ত ও নেই !”
“রুবিনা আন্টিরা আমাদের বাসার প্রায় কাছেই থাকে। তাদের নিজেদেরই বাড়ি। যে কোনো সময়ই এখন তোমরা দেখা করতে পারবে ।”
…
ধারা লেখা পড়া নিয়েই ব্যস্ত আছে। অনেক দিনই হয়ে গেল অঝোরকে দেখেনা। সেদিন যাওয়ার পরে আর আসেনি। ধারা এখনও মাঝে মাঝে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে অঝোরের জন্য। যখন কোচিং, প্রাইভেট পড়তে যায় তখন আশে পাশে সব জায়গায়ই নজর রাখে, কিন্তু তাকে দেখা যায় না। ধারার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে অঝোর দের বাসা থেকে ঘুরে আসতে। কিন্তু কিসের একটা জড়তা কাজ করে তাই আর যাওয় হয়না ।
একদিন বিকালে ধারা ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বাসার এক আন্টির সাথে কথা বলছিল। এর মাঝেই দেখতে পেল অঝোরকে, ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। অঝোর যখন গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকবে, তখন ধারা আর ছাদে দাঁড়ালো না, এক ছুটে নিচে চলে গেল।
চলবে…