সিঁদুর রাঙা মেঘ পর্ব-২৮+২৯+৩০

0
1529

#সিঁদুর_রাঙা_মেঘ
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব-২৮,২৯,৩০
চিত্রা আবাক হলো। বাসাটি বৃষ্টি বিলাস বাসাটির মতোই তৈরি করা।সে বলল,,
–” বোন পুরাই বৃষ্টি বিলাস।”
মোহোনা বুঝলো না। ভ্রু কুচকে বলল,,
—” কি বৃষ্টি বিলাস? ”
চিত্রা নিজের মাথায় চাপের বলল,,
—” বাংলাদেশে আমরা যে বাসাটি থাকি সেই বাসাটির মতোই এ বাসাটি!”
মোহোনা ছোট একটি “ওহো” শব্দ উচ্চারণ করলো।
চিত্রা এগিয়ে গেল৷ দারোয়ানকে ইংরেজীতে বলল,,
—” চাচা আমি এ বাড়ির মালিকের সাথে দেখা করতে চাই?”
চাচা সুন্দর একটি হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন,,
—“ওহ ডিয়ার তারা বেড়াতে গিয়েছেন। দুই-তিন দিনের মাঝে এসে যাবেন।”
চিত্রা মুখে ঘন কালো মেঘ জমা হয়ে গেল। এত অপেক্ষার পর যখন ভাবলো অপেক্ষার অবসান ঘটেছে এবার! কিন্তু হলো না। ও আল্লাহ আর কত অপেক্ষা করাবে?

চিত্রা এই দুটো দিন দু বছরের মতো কাটচ্ছে। চিত্রাকে এমন অস্থির দেখে মোহোনা বলল,,
—” অস্থির হোশ না। কালতো যাবোই আবার! চল আজ শপিং করে আসি। পরের মাসে বিয়ে আমার। সময় একদমই নেই।”
চিত্রা ভাবলো সময়তো কাঁটবেই।তাই হে বলে দিলো।

প্যারিসের নামি-দামি শপিংমলে শপিং করছে মোহোনা আর চিত্রা৷ এর মাঝেই মোহোনার বাগদত্তা রিক এসে হাজির। এ শহরে স্থানীয় হলেও তার মা বাঙ্গালী ছিল বলে সে নিজেকে বাঙালি বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অনেক মিশুক মানুষ। চিত্রাদের সাথে অনেকটুকু সময় ব্যয় করলো সে। চিত্রা মনেই হয়নি মানুষটি তাদের থেকে ভিন্না। রিক চলে যাওয়ার পর মোহোনা বলল,,
—” কিরে জিজুকে কেমন লাগলো?”
চিত্রা হাত উঁচু করে বললো,,
—” জোস। সবচেয়ে বেশী পছন্দ হয়েছে আধো আধো বলা বাংলা কথা।”
মোহোনা হাসলো। বলল,,
—” হে সে বাংলাদেশকে অনেক ভালোবাসে।”
—” তা বুঝতেই পেরেছি তার কথা শোনে!”
দুজনে শপিংমলের নিচে নেমে এলো। কথা বলতে বলতে। তখনি রিক কল করে। মোহোনা হেসে বলে,,
—“উনার কল!”
—“কথা বল!”
চিত্রা এক পাশে দাঁড়ালো প্যাকটে হাত দিতেই মনে পড়লো চিত্রা তার ফোন ভুলে রেস্টুরেন্ট এসেছে। সে মোহোনাকে বলে দ্রুত ফোন আনতে গেল। যে টেবিলে বসেছিল সেখানেই পেয়ে গেছে। মনে মনে ১০০ ধন্যবাদ দিচ্ছে আল্লাহকে। রেস্টুরেন্ট থেকে নেমে বাহিরে আসতেই কারো সাথে থাক্কা খায় চিত্রা। তার হাতে শপিং ব্যাগ কিছু নিচে পড়ে যায়। চিত্রা দ্রুত তুলতে নিবে তখনি পাশের সেই ব্যক্তিটি “সরি ” বলতেই চিত্রার কানে ঝংকার তুললো যেন। এত সুন্দর আর চমৎকার কন্ঠের অধিকারীকে দেখার জন্য মাথা তুলতেই চমকে উঠে চিত্রা। মুখ দিয়েই আনমোনে বের হয়ে যায়..”ইউসুফ ” নামটি।

সামনের ছেলেটি ব্যাগ গুলো তুলে চিত্রাকে দিতেই। চিত্রা আবার বলল,,
—“ইউসুফ? ”
ছেলেটি বুঝতে না পেরে বলল,,
—” সরি! বুঝতে পারিনি! ”
চিত্রা এবার চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,
—“আপনি ইউজারসিফ? ”
ছেলেটি অবাক হয়ে বলল,,
—” ইয়েস মেম? আমি কি আপনাকে চিনি?”
চিত্রা ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বলল,,
—না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি!”
ইউজারসিফ হাসলো বলল,,
—“আমাকে তো সবাই চিনে!”
—” তেমন কিছু না। আমি বলছি আপনাকে? বাংলাদেশে আপনাদের যে বাসাটা আছে বৃষ্টি বিলাস নামে সেটায় ভাড়া থাকি। আমি মুলত আপনাদের সাথে দেখা করার জন্যই প্যারিসে আসি। মালিকাকা আপনাদের ঠিকানা দেন আমায়। সে বাসাতেই আপনার ছবিটি দেখি সেই সুবাদে চেনা। ”
এক দমে কথাটুকু শেষ করে তারপর থামলো চিত্রা। ইউজারসিফ অবাক হয়ে বলল,,
—” কিন্তু আপনি আমাদের খুঁজছেন কেন?”
চিত্রা দম নিলো বলল,,
—“বলছি। আসুন একটু বসি। আমার হত পা কাঁপছে।”
ইউজারসিফ খেয়াল করলো মেয়ে সত্যি কাঁপছে।

কফি শপে বসে আছে তারা। নিরবতা ভেঙ্গে চিত্রা আবার বলল,,
—” আমি ভাবিনি কাকতালীয় ভাবে এখানে দেখা হবে। ”
ইউজারসিফ চিত্রার দিক এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,,
—” শান্ত হোন আমি শোনবো। পানি পানিটুকু খেয়ে ধীরে ধীরে বলেন।”
চিত্রা তাই করলো। পানি খেয়ে একটু জিরুয়ে গর গর করে সব বলতে লাগলো। ইউজারসিফ অবাক হয়ে শুনছে সব। তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। একটি ডায়েরির শেষে কি ছিল তা জানার জন্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে এসেছে মেয়েটি। পাগল নয় তো?মনে মনে হাসলো সে।

চিত্রা সব বলে যখন থামে তখন ইউজারসিফ হেসে বলে,,
—” সাজিদ ইউসুফ আমার দাদু। তাদের ঘটনা লাষ্টে কি হয়েছিল তা না হয় তার মুখ থেকেই শুনবেন। সময় থাকলে চলুন আমার সাথে যদি বিশ্বাস করেন আমায়।”
ইউজারসিফের কথায় আকাশের চাঁদ যেন হাতে পায় চিত্রা। লাফাতে লাফাতে রাজি হয়। তখন ইউজারসিফ ভাবলো,
—” মেয়েটি আসলেই পাগল। নয়ত অপরিচিত একজনের সাথে যাওয়ার ধেই ধেই করে যেতে রাজি হলো! ওহো আল্লাহ্।”

পর্ব-২৯
ইউজারসিফ চিত্রাকে তার বাসায় নিয়ে এলো। বাড়ির প্রতিটি কারুকার্য তাদের সেই ময়মনসিংহের বৃষ্টি বিলাস বাড়িটির মতোই সাজানো। চিত্রার মনে এবার কৌতূহল আরো বাড়লো। দুটি বাড়ি একি রকম কারণ কি? কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে জিগ্যেস করে বসে চিত্রা,,
—” আপনাদের দুটো বাড়িই একি রকম? কেন?”
ইউজারসিফ হাসে। বলে,,
—” বাংলাদেশের সেই বাড়িটি আমি সেই ছোট বেলায় দেখেছি। তারপর আর যাওয়া হয়নি আমার। এত ছোট ছিলাম যে দেশের স্মৃতি গুলো ঝাপসা অনেক।”
চিত্রার একটু মন খারাপ হলো। এখন পর্যন্ত সঠিক উত্তর সে পাচ্ছে না। কষ্টে বুক ফাটছে।

তখনি ইউজারসিফ বলল,,
—” আসুন আমার সাথে।”
এগিয়ে গেল একটি রুমের দিক ইউজারসিফ। চিত্রার তখন টনক নরে। অপরিচিত ছেলেকে বিশ্বাস করে এতো দূর তো চলে এসেছে সে। এখন যদি উল্টো পাল্টা কিছু করে? চিত্রা নিজের ব্যাগ টেনে নিলো। ব্যাগের ভিতর মরিচের গুঁড়ো আছে। তাই ভেবেই সাহস পেয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো সে। ইউজারসিফ রুমটির আগে গিয়ে থেমে যায়। বাঁকা হেসে বলে,,
—” এতোটা পথ বিশ্বাস করে এসেছেন এখন অবিশ্বাস কেন হচ্ছে আপনার?”
চিত্রা চকিতে তাকালো। লোকটি বুঝে গেল কিভাবে? চিত্রা ভাল করে তাকালো ইউজারসিফের দিক। বাঁকা ঠোঁটে মিটিমিটি হাসচ্ছে। তারো গালে টোল পড়ছে। চিত্রা অবাক হলো। তখনকার মতো দাম্ভিকতা ছেয়ে নেই ইউজারসিফের মুখে। তার বদলে এখন চোখে-মুখে চঞ্চলতার আভা। ইউজারসিফ তুরি বাজালো চিত্রার মুখের সামনে। চিত্রা ধ্যান ভাঙ্গলো। ইউজারসিফ বলল,,
—” মেম কোথায় হারালেন? বাই দ্যা ওয়ে আপনার নামটা জানা হলো না।”
চিত্রা হাসার চেষ্টা করে বলল,,
—“চি.. চিত্রা! ”
—“ওহো নাইস নেইম! আসুন ভিতরে! ”
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো একটি বৃদ্ধ লোক খাটের মাঝে শুয়ে আছে। ইউজারসিফ বলল,
—“দাদু দেখ কাকে নিয়ে এসেছি?”
বৃদ্ধটি ধীরে ধীরে উঠে বসে বলল,,
—” কে এসেছে দাদু ভাই?”
চিত্রা অবাক হয়ে তাকালো খাটে শায়িত বৃদ্ধর দিক। লোকটি হুবুহু ইউজারসিফের মতো।জোয়ান কালে তিনি যে কত সুন্দর ছিলেন তার এই বয়সেও ধরা যায়। শরীর ভেঙ্গেছে। কিন্তু গায়ের সেই সুন্দর্য্য ছিটে ফোটাও কমেনি। বরং সাদা দাড়ি, সাদা চুল আর সাদা পাঞ্জাবিতে আরো এবয়সেও অনেক সুন্দর লাগচ্ছে।চিত্রা ঠোঁট নাড়িয়ে আলত করে বলল,,
—” ইউসুফ? ”
ইউজারসিফ মাথা নাড়ায়। চিত্রার চোখে ঠিক সেই মুহূর্তে ছলছল করে উঠে। অবাক হয়ে ভাবতে লাগে মানুষ কতই না পরিবর্তন হয়। সেই সুন্দর ইউসুফ আজ বৃদ্ধ অসুস্থ খাটে শায়িত। চিত্রা নিজেরও একদিন এমন পরিস্থিতি দিয়ে যাবে মৃত্যুর কাছে? বুক চিড়ে শ্বাস বেড়িয়ে এলো চিত্রার। তখন ইউসুফ বলল,,
—” কে তুমি দাদু ভাই?”
চিত্রা কাছে এগিয়ে এলো ইউসুফের হাতের উপর তার হাত রেখে বলল,,
—” আমাকে চিনবে না তুমি দাদু ভাই। কিন্তু আমি তোমাকে খুব করে চিনি। বলতে পারো আমার ক্রাশ তুমি।”
ইউসুফ হো হো করে হাসলো। বলল,,
—” এ বুড়ো বয়সে কারো ক্রাশ হবো। ভাবতেই পারিনি। ”
চিত্রাও হাসলো। ইউজারসিফ বললো,
—” দাদুভাই ও কিন্তু আমাদের দেশী মানুষ। শুনলে অবাক হবে সে আমাদের ময়মসিংহের সেই বাড়িটিতে থাকে।আর আমাদের সাথে দেখা করবে বলে এতদূর আসে।”
ইউসুফ সত্যি অবাক হলো। চিত্রাকে তার পাশে বসতে বলল ইশারায়। তারপর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,,
—” বাড়িটির কথা মনে পড়লে এখনো বুকটা কেমন করে জানিস দাদু ভাই? তা দাদু ভাই তুমি কেন দেখা করতে চাইছিলে?”
চিত্রা আসার সময় সেই ডায়েরি গুলো নিয়ে এসেছিল।তা বের করে ইউসুফের সামনে রাখলো। বলল,,
—” দাদু ভাই আপনাদের বাসায় শিফট হওয়ার কিছুদিন পর লাইব্রেরী ঘরে এই ডায়েরি গুলো পাই। আর মাফ চাইছি এই ডায়েরি গুলো আমি পড়ি। কিন্তু লাষ্ট পর্যায় কি হলো তা আর জানতে পাড়লাম না। একটি এক্সিডেন্টে ডায়েরি বাকি পেইজের লিখা মুছে যায়। এখন জানতে পাড়ছি না কি হয়েছিল সেদিন?”
—” কোন দিনের কথা বলছো দাদুভাই?”
চিত্রা সব টুকু খুলে বলল। ইউসুফের চোখে পানি চলে এলো। পুরানো দিনের প্রতিটি মুহূর্ত ভেসে উঠলো ইউসুফের চোখের সামনে।ইউসুফ চোখ থেকে মোটা পাওয়ারী চশমা খুলে নিয়ে ছোট শ্বাস ফেলে ডায়েরি গুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,,
—” এ ডায়েরি গুলো কুহুর ছোট বোন মিহু লিখেছিল। সে একজন রাইটার। বই বের করতে চাইছিল আমাদের নিয়ে। কিন্তু কোনো কারণবশত তা চাপা পরে যায় সেই লাইব্রেরি ঘরেই।”
ইউজারসিফ বলল তখন,,
–“দাদু ভাই সেদিন কি হয়েছিল ? ”
ইউসুফ এবার বাহিরের জানালার দিকে তাকালো। পরন্ত বিকেলের গোধূলি লগ্ন এখন। সূর্যের লাল আভা ঘরে জানালা ভেদ করে রুমে প্রবেশ করছে। এখনো ভাসচ্ছে চোখের সামনে সেই দিনটি।ইউসুফ বলল,,
—“সেদিন আমি বিয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে আমার বাবুইপাখিকে ডিভোর্স পেপার দিয়ে মার ঘরে যাই।মা তখন রুমে ছিল না। কিন্তু তার আলমিরা খোলা ছিল। গহনার বক্স সব নামানো ছিল। সে সময় বাসা থেকে মোটামুটি সবাই চলে গেছে। মার এমন কেয়ারলেসের কাজ দেখে আমি নিজেই তুলে রাখি। তখনি আলমিরার এক সাইডে কুহুর ডাক্তারি রিপোর্ট চোখে পড়ে গাইনী বিভাগের। সেটা হাতে নিতেই উপর দুনিয়া উল্টে যায় আমার। কুহুর দেয়ার ধোকার কারণও ক্লিয়ার হয় সেদিন।”
এটুকু বলে থামলো ইউসুফ। ইউজারসিফ বলল,,
—“দাদু কি ছিল ওই রিপোর্টে?”
ইউসুফের বুক চিড়ে একটি শ্বাস বের হলো। অনেক কষ্টে বলল,,
,—“লিখাছিল সে আর কখনো মা হতে পারবে না।”
চিত্রা মোটেও অবাক হলো না। কিন্তু ইউজারসিফের মুখে বিস্ময় মেখে গেল। ইউসুফ আবার বলল,,
—“সেদিন বিয়ে বাড়িতে আমি উপস্থিত হয়ে…

সেদিন ইউসুফের অনেক রাগ হয় কুহুর উপর। তার মা এ কথা কিভাবে লুকালো? ভাবতে পারছো না ইউমুফ।কুহুকে ছাড়া৷ অসহায় ইউসুফ তার মা জানতো কুহুকে তটা ভালোবাসতো তাহলে? সব প্রশ্নের উত্তর শুধু কুহু আর তার মা দিতে পারবে। তার আগে বিয়ে আটকাতে হবে। ইউসুফ সেদিন বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে গেলেও বিয়ে বাড়িতে আর যায় নি। অদিকে সবাই ইউসুফের চিন্তায় অস্থির। তখনি জায়েদ ফোন করে বলে ইউসুফের এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাইশা তা শুনতেই বিলাপ শুরু করে। কুহু যেখানে বিষ খাওয়ার জন্য রেডি হয়েছিল, মাইশার কান্নার আওয়াজে দৌঁড়ে বাহিরে আসে।তখন জানতে পারে ইউসুফের এক্সিডেন্টের খবর।সঙ্গে সঙ্গে রওনা করে তারা হাসপাতালে। হুর তার বিয়ের সাজ সজ্জা নিয়েই উপস্থিত হয় তার বাবা-মায়ের সাথে। ওটির সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় জায়েদ দাঁড়িয়ে মাথায় তার ব্যন্ডেজ । তার কাছে গিয়ে বলে মাইশা,,
—” এসব কিভাবে হলো?”
জায়েদ বলল,
—আন্টি আমরা কিছুই জানি না ঠিক। আমরা মোর ক্রস করতেই একটি ট্রাক লাগামহীন ভাবে এসে ধাক্কা দেয়। আমি আর সাবিত সাইডে থাকায় ছিকে পড়ি।ইউসুফ বের হতে পারেনি। আর এখন..!”
চোখের জল ছেড়ে দিল মাইশা। কুহু যেন পাথর হয়ে গেছে ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মিশু এসে কুহুকে ধরতেই কুহু হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠে।

ঘন্টা খানেক বাদে ডাক্তার বের হয়ে আসেন।ডাক্তারকে দেখে সবাই এগিয়ে যায়। মহসিন ছেলের কথা জানতে চাইলে ডাক্তার বলে,,
—“রোগীর হাত আর একটি পা ভেঙ্গেছে। শরীরে ক্ষতও অনেক মাথার আঘাতটাও গভীর। আমরাতো আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম রোগী বাচঁবে। সব আল্লাহর কেরামতি। ”
তুহিন বলল,,
—” আমরা দেখা করতে পারবো? ”
—“হে ঘন্টাখানিক পরে। ”

ইউসুফের কেবিনে সকলেই দাঁড়িয়ে আছে।ইউসুফের দৃষ্টি তখন কাউকে খুঁজতে লাগলো। মিশু বুঝতে পেরে ইউসুফের কানে ফিসফিস করে বলল,,
—“যাকে খুঁজে যাচ্ছো সে বাহিরে।”
ইউসুফ চোখের ইশরায় কিছু একটা বুঝাতেই সে চলে গেল বাহিরে।তখন মাইশা বলল,,
—“বিয়েটা আমরা কিছুদিন পিছিয়ে…”
মাইশার কথা কেটে হুরের বাবা বলল,,
—“মাফ করবেন ভাবি। এ বিয়ে আর হচ্ছে না।”
সবাই অবাক হলো। মহসিন বলল,,
—” কিন্তু কেন?”
—“ইউসুফের অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে ও সুস্থ হলেও আমাদের মতো হবে না। এক কথায় প্রতিবন্দী বলা যায়। এমন ছেলের সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে লাইফ শেষ করতে চাইনা।”
মাইশা রেগে গেল তার ছেলেকে প্রতিবন্দি বলায়। তিনি চেঁচিয়ে বললেন,,
—“আমার ছেলে প্রতিবন্দি হয়নি। হাত ভেঙেছে জোরা লাগবে না তা কোথায় লেখা। কোন এঙ্গেলে এসব বলেন?”
হুরের বাবা তার কথায় অটুট থেকে বললেন,,
—“যা ইচ্ছে বলেন এ বিয়ে হবে না!”
মাইশা সে কথা পাত্তা না দিয়ে হুরকে বলে,,
—” মা তুই কি চাস? আমার ছেলেটাকে না তুই ভালবাসিস? ”
মাইশা হুরের দুটি হাত ধরে ছিল। হুর হাত ছাড়িয়ে বলল,,
—” মাফ করবেন আন্টি আমি বাবার বিপক্ষে যেতে পাড়বো না।”
—” এ সব কি বলছো? এমনটা যদি তোমাদের বিয়ের পর হতো তখনও কি ওকে ছেড়ে দিতে?”
মাইশা উত্তরের আশায় চেয়ে রইলো। হুর নির্বিকার ভাবে বলল,
—” আন্টি আমি অবশ্যি ওর জন্য নিজের লাইফ নষ্ট করতাম না।”
মাইশা চমকে গেল এ কাকে ইউসুফের সাথে বাঁধতে যাচ্ছিল তারা? তিনি ছোট শ্বাস ছাড়েরন। শক্ত মুখে বলেন,,
—“গেট আউট।”
তারা চলে গেলেন। মাইশা ছেলের পাশে বসেই কাঁদতে লাগলেন। ইউসুফ তখন ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,,
—” মা কেঁদো না।”
মাইশা ছেলের মাথা হাত বুলিয়ে বলেন,,
—” চিন্তা করিস না বাবা। তুই ঠিক হো এর থেকে সুন্দর বউ তোর জন্য খুঁজে আনবো।”
ইউসুফ তখন হাসলো। বলল,,
—” মা আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর কত করবো?”
মাইশা অবাক হয়ে বলেন,,
—” কি বলছিস? ”
তখনি মিশু কুহুকে নিয়ে ঢুকে রুমে। মিশু বলে,
—” হে মা ভাইয়া কুহুকে বিয়ে করেছে।”
মাইশার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পরে। বলল,,
—” কি যাতা বলছিস?”
ইউসুফ বলল,,
—” ঠিক বলেছে মিশু।”
মাইশা রাগে দুঃখে কুহুর দিক তেরে গিয়ে বলল,,
—” কিভাবে করলি তুই এসব? তোকে বলেছিলাম না। বল বলেছিলাম না?”
নিরবে চোখের জল ফেললো কুহু। পাশ থেকে সুমি বলল,,
—“, এসব কি সত্যি কুহু?”
কুহু চুপ রইলো। তখন ইউসুফ বলল,,
—“ওকে কেন বকছো? ওর কোনো দোষ নেই। পরিস্থিতিই এমন ছিল।”
মাইশা রেগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেল।কুহু অসহায় ভাবে ইউসুফের দিকে তাকালো। ইউসুফ চোখের ইশারায় কুহুকে বুঝালো,,
—” ভয় পাশ না আমি আছি।”

পর্ব-৩০
সেদিনের পর থেকে কুহু ইউসুফের সেবা করে ৬ মাসের মাথায় সুস্থ করে তোলে। ছয়মাস পর মাইশা কুহুর হাতে ডিভোর্স পেপার ধরিয়ে দিতেই ইউসুফ তা কেরে নেয় চেচিয়ে বলে,,
—” একবার তো কেঁড়ে নিয়েইছিলে এবার আর তা হচ্ছে না মা। কুহু আমার স্ত্রী। আমার অর্ধাঙ্গীনি।”
—” এমন সম্পর্ক দু দিন পর এমনি টিকে না যখন বাচ্চা না হয়।”
—” মা সমস্যা যদি আমার থাকতো? তখন কি করতে? ”
—” আজেবাজে বকিস না ইউসুফ। বংশের একমাত্র ছেলে তুই। আমাদের কি আসা থাকতে পারেনা? নাতি-নাতনীদের মুখ দেখার?
—“মা এখন বাচ্চা নেয়ার অনেক পদ্ধতি আছে। আর ডাক্তার বলেছে কুহুর বাচ্চা জম্ম দেয়ার ক্ষমতা ৪০% চান্স আছে।, আল্লাহ চাইলে হবেন।”
মাইশা ইউসুফের কথা উপেক্ষা করে বললেন,,
—“, আমি কিছু জানি না। হয় তুই কুহু ডিভোর্স করবি, নয়তো ডিভোর্স ছাড়াই আরেকটা বিয়ে করবি। এটাই আমার শেষ কথা।”
কুহুর মাথায় সেদিন আকাশ ভেঙ্গে পরে। নিজের এই কমতির জন্য নামাজে বসে কাঁদতে লাগে। একটি মেয়ে আর যাই হোক নিজের স্বামীকে অন্যকারো হতে দেখতে পারে না।

মাইশার অত্যচার বাড়তে লাগলো তখন। কুহু মুখ বুঁজে সব সইতে লাগলো। মাইশার এক কথাই ছিল,,
—” আমার ছেলেকে তুই কালা জাদু করেছিস। তোর কখনো ভাল হবে না।”
কুহু নিরবে চোখের জল ফেলতো। একদিন ইউসুফের কাছে এসব ধরা পরে। ইউসুফ রেগে কুহুকে নিয়ে প্যারিসে চলে আসে। এখানেই তাদের ছোট নীড় তৈরি করে। কুহু কাছে বৃষ্টি বিলাস বাড়িটি এত ভাললাগতো যে ইউসুফ ভালবাসার তাজমহল হিসেবে এ বাড়িটি প্যারিসে বানিয়ে গিফট করে। তাদের দিন সুখেই কাটছিল তখন। একদিন জানতে পারে কুহু প্রেগনেন্ট। খুশি যেন দুগুণ হয়ে গেছিল তখন মাইশা তখন খুব খুশি। কিন্তু ডাক্তার জানালো কুহুর জানের রিক্স আছে এতে। কুহু তা সবার কাছ থেকে লুকিয়ে ফললো। ডেলিভারির সময় কুহু একটি ছেলে সন্তান জম্ম দেয়। তার অবস্থা তখন ক্রিটিক্যাল ছিল খুব। তখন কুহু মাইশাকে বলেছিল,,
—” বড় মামনী আমি তোমার নাতির মুখ দেখাতে পাড়লাম। খুশিতো?আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো!”
মাইশা সেদিন কুহুর কথা ধরতে পারেনি। ইউসুফ যখন তার কাছে এলো। তখন সে তার হাতটি ধরে বললেছিল,,
—” আমার সময় ফুড়িয়ে গেছে। আপনি আমার সন্তানকে দেখবেন! আর হে আরেকটি বিয়ে করে সুখের সংসার করবেন। আপনি সুখে থাকলে আমিও পরকালে সুখে থাকবো। ”
ইউসুফ প্রতি উত্তর সেদিন কিছু বলেনি। শুধু শক্ত গলায় বলেছিল,,
—” আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না। আই হেইট ইউ। ”
ফুপিয়ে উঠে ইউসুফ।কুহুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। কুহুও কাঁদে কিন্তু ঠোঁটে তার হাসি ছিল। সেদিন ইউসুফের বুকেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে কুহু। ইউসুফ কিছুদিন পাগলের মতো করলেও নিজের ছেলের জন্য আবার বাঁচাতে শিখে৷ স্বপ্ন দেখতে শিখে। তার ছেলে সম্রাট বড় হতে থাকে তার হাত ধরেই। এর মাঝে মাইশা তাকে বিয়ের জন্য অনেক বুঝিয়ে ছিল। তখন ইউসুফ বলেছিল,,
—“, যে বুকে আমার বাবুইপাখি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছে সে বুকে অন্য কোনো মেয়েকে টেনে নেই কিভাবে?”
ইউসুফের কথায় হারতে হয় প্রতিবার মাইশার। এক সময় সে এসব বলাই বন্ধ করে দেন।

এভাবে দিন, মাস, বছর গড়িয়ে সম্রাট বড় হয়। ভাল ডাক্তার হয় সে। ইউসুফের ইচ্ছায় ডাক্তারী পরে সে। এবং তার ক্লাসমেটকে বিয়েও করে ভালবেসে। তাদের ঘর আলোকিত করে আসে একটি ছেলে। যে দেখতে হুবুহু ইউসুফের মতো শুধু চোখ জোড়াই তার ডীপ ব্লু কালার। তাই তার নাম করণ করা হয় ইউসুফের মিশরীয় নাম ইউজারসিফ।

ইউসুফ চোখ মুছলো এবার। তার অর্ধাঙ্গীনি, তার বাবুইপাখি মনে হলো তার পাশে এসে বসেছে। সে তার দিক তাকিয়ে যেন মুচকি মুচকি হাসচ্ছে। ইউসুফ বলল,,

—” তোর বয়স বাড়ে নারে বাবুইপাখি ?”
—“আমার বয়স সেদিনে থেমে গেছে ইউসুফ ভাই।”
—” আর দেখ আমি কত বৃদ্ধ হয়ে গেছি। তাও কেন ছুটে আসিস আমার কাছে? ”
কুহু হেসে ফেললো। তার হাসিতে যেন মুক্ত দানা ঝড়ছে। ইউসুফ তার ছল ছল নয়নে দেখছে। বলল,,
—“তোকে খুব মিস করি বাবুইপাখি। কবে তোর কাছে যাবো তার দিন গুনছি।নিয়ে যা না তোর সাথে আমায়।”
কুহুর মুখখানি গম্ভীর হয়ে উঠে। সে উঠে দাঁড়ালো। ইউসুফ আবার বলল,,
—“চলে যাচ্ছিস যে?
কুহু আর পিছনে ফিরলো না। যেতে যেতে বলল,,
–” আপনার এখনো গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ বাকি। তার আগে আর আমাদের দেখা হবে না। ”
ইউসুফ অবাক হয়ে গেল। ধরে আসা গলায় বলল,,
—“আমার উপর রাগ করে চলে যাচ্ছিস?”
কুহু থেমে গেলো। হালকা কাঁধ কাত করে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। বলল,,
—” তোমার আমার দেখা হবে ওই পাড়ে। ”
মিলিয়ে গেল কুহু। ইউসুফ এদিক ওদিক তাকিয়ে আর পেল না তার বাবুইপাখিকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ইউসুফ৷ উপর ওয়ালা কেন তার মুখের দিকে চায় না। কেন তাদের মিলনে এত সময় অতিবাহিত হচ্ছে? এ জীবন যে তার আর ভাল লাগে না। বসে বসে সময় গনে যাচ্ছে কবে সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে