পর্ব-১১( অন্তিম পর্ব)
#সাদা ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর
“বর এসেছে! বর এসেছে!” এইটুকু বাক্য কানে আসতেই শুভ্রতা ফ্রিজ হয়ে যায়। অদ্ভূত রকম অনূভুতি ঢেউ খেলে যায় পুরো দেহে। আলতা লাল রঙের শাড়ীতে অপরূপা লাগছে শুভ্রতাকে। মেহেদী রাঙা দু-হাতে তীব্রের দেওয়া লাল রেশমি চুড়ি। ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক। মুখে নেই কোনো কৃত্রিম মেকআপ। চুলগুলো খুব সুন্দরকরে খোপা করে মাথায় দোপাট্টা পরিয়ে দেয় লায়লা। রহমান মিয়া ব্যস্ত হয়ে শুভকে বিয়ের গেইটের কাছে পাঠিয়ে দেন। লায়লাসহ আরও অনেকে গেইট ধরে দাঁড়ায়। তীব্র মেরুন রঙের শেরওয়ানি পরেছে। শুভ্র দেহে রঙটা বেশ মানিয়েছে তাকে। বিয়ে বাড়ির আশেপাশের কিছু মেয়ে শুভ্রতার ওপর ঈর্ষান্বিত হলো সাথে ঢেপঢেপ চোখে তীব্রের দিকে তাকিয়ে থাকল। গেইটে প্রায় দশ হাজার টাকা মিটিয়ে ভিতরে ঢোকে বরযাত্রীর সকলে। স্টেজে তীব্রকে বসানো হয়। বাকিদের খাবারের পর্ব শেষ করার জন্য অনুরোধ করেন রহমান মিয়া। বিয়ে পরানের পরপরই বর আর কনেকে খাওয়ানো হবে।বেশ কিছুক্ষণ পর কাজী বিয়ে পড়াতে আসেন।সর্বপ্রথম যেহুতু মেয়ের সম্মতি নেওয়া হয় তাই তিনি কাবিননামা লিখতে বসেন স্টেজে তীব্রের পাশে। কাবিনের পরিমাণ জিজ্ঞেস করতেই তালহা রহমান বলেন আট লাখ দিতে। তীব্র তাৎক্ষনাৎ অসম্মতি জানিয়ে বলে,
“না কাবিন আট লাখ নয় বরং এক লাখ চল্লিশ হাজার লিখুন কাজী সাহেব।”
উপস্থিত সবাই অবাক হয় তীব্রের কথায়। তালহা রহমান অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকায়। চেয়ারম্যান বাড়ির একমাত্র ছেলের কাবিন হবে কিনা মাত্র এক লাখ টাকা। ছেলেকে কিছু বলার আগেই তীব্র রহমান মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
” স্ত্রী হিসেবে কাবিনের সম্পূর্ণ শুভ্রতার হক। ইসলামের দৃষ্টিতে ততটুকুই কাবিননামা করো যতটুকু তোমার সামর্থ্য হয়।”
একটু থেমে সেরোয়ানির পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করল তীব্র। পুনরায় বলতে শুরু করল,
“এখানে এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা আছে যার সবটুকু আমার হালাল রোজগারের। আমি ঢাকায় যাওয়ার পর থেকেই টিউশন করিয়ে টাকাগুলো জমিয়েছি এতদিন। আট লাখ টাকার সবটুকু আমার আব্বা দিতেন আমি জানি কারণ এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। তবে এভাবে সম্পর্ক হালাল হতো না। আমার স্ত্রীর হক পূরণে আমাকেই দিতে হবে।”
তীব্রের কথায় রহমান মিয়া ছাড়াও সবাই বেশ সন্তুষ্ট হয়। তীব্র আবারও বলল,
“চাচাজান আপনি শুভ্রতার কাছে গিয়ে সব বলুন আর জিজ্ঞেস করুন এই সামান্য পরিমাণের কাবিনে ও রাজি কিনা।”
রহমান মিয়া দ্রুত ঘরে যান। শুভ্রতা ঘর থেকেই প্রায় সব কথায় শুনে। রহমান মিয়া মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তীব্র বাবা কাবিন এক লাখ চল্লিশ হাজার দিবার চায়। তুমি কি রাজি আম্মা?”
“হুম রাজী অব্বা”,মাথা নিচু করে জবাব দেয় শুভ্রতা।
কাবিন এক লাখ চল্লিশ হাজার লেখা হয়। তারপর কাজী শুভ্রতার কাছে বিছানায় বসে কাবিননামা পড়েন তারপর শুভ্রতাকে কেন্দ্র করে কবুল বলতে বললেন। শুভ্রতা শাড়ীর আঁচলের এক কোণা হাত দিয়ে ঘনঘন প্যাচাতে থাকে। তিন শব্দের বাক্যগুলো উচ্চারণ করতেই তার গলার স্বর আটকে যাচ্ছে। শুহানা বেগম মেয়ের পাশে বসে হাতে হাত রাখেন। শুভ্রতা মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকায়। ভিন্নরকম এক ভরসার রেশ পায়। কাজী আবারও বলতেই এক নাগাড়ে “আলহামদুলিল্লাহ্ কবুল” তিনবার উচ্চারণ করে। ঘরে থাকা সবাই আলহামদুলিল্লাহ্ বলে উঠে। তারপর কাবিননামাই নিজের নামের সাক্ষর দেয়। শুভ্রতার পরপরই তীব্রের সম্মতি নিতেই তীব্র সময় না নিয়েই অতিদ্রুত “কবুল! কবুল! কবুল!” বলে। উপস্থিত সবাই হেসে উঠে তীব্রের তারাহুরাই কবুল বলা শুনে। বিয়ের পর্ব শেষ হতেই তীব্রের পাশে শুভ্রতাকে বসানো হয়। তীব্র একবার তাকাতেই অবাক হয়ে যায়। সামান্য সাজে কোনো মেয়েকে এতটাও সুন্দর লাগে তার বোধহয় জানা ছিলো না। পলকহীন নয়নে শুভ্রতার পানে তাকিয়ে থাকে সে। এ যেনো হাজার বছর এক পথিকের তৃষ্ণার স্বাদ। হৃৎস্পন্দন দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। অল্পের জন্য তার ভয় হয় না জানি শুভ্রতার এই মনোমোহিনী দর্শনে তার মিনি হার্ট আট্যাক হয়। তীব্রের মূহুর্ত্তেই হাসি পেলো। নিশ্চয়ই খবর ছাপিয়ে যাবে এরূপ যে বিয়ে করতে এসে কনের অপরূপ সৌন্দর্য দেখে হার্ট আট্যাক করল বর! কি বিশ্রি হবে ব্যাপারখানা!
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক কার্যরীতি শেষ করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। রহমান মিয়া মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। শুহানা বেগম বেশ শব্দ করেই কাঁদছেন। শুভ্রতা হুহু করে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। এই মানুষটা তার সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করেছে সবসময়। শুভ একটু দূরে তীব্রের সাথে দাঁড়িয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে। চোখ ছলছল করছে তার। বাবার বুকে মাথা রেখেই নজর যায় ভাইয়ের উপর। তারপর মাথা উঠিয়ে ধীর পায়ে শুভর সামনে দাঁড়ায়। হেঁচকি তুলে কাঁদছে শুভ্রতা। শুভ মুখে হাসির রেখা এনে বলল,
“আজ থেকে তোর সব ভাগ আমার। তোকে কিন্তু একদম পেত্নির মতো লাগছে শুভ্র।”
শুভ্রতা আচমকা ভাইকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে উঠে। শুভ আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারল না। হুহু করে নিজেও কেঁদে উঠে বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তীব্র কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না। ভাই বোনের সম্পর্কগুলো সত্যি বড় অদ্ভুত। ঝগড়া মান অভিমানের মাঝে অসীম ভালোবাসাগুলো চাপা পরে যায়। দূরত্ব আসলেই তা সুপ্ত হয়ে জেগে উঠে। তালহা রহমান এগিয়ে যান রহমান মিয়ার কাছে। কাধে হাত রেখে শান্তনার সূরে বললেন,
“ভাই ভেঙে পরবেন না। আমার মেয়ে নেই। শুভ্রতা মা সর্বপ্রথম আমার মেয়ের স্থান পাবে তারপর ছেলের বউ। কথা দিচ্ছি কখনো এইটুকু কষ্ট পেতে দিবো না। শুভ্রতা মা যখনি আপনাদের দেখতে চাইবে নির্দ্বিধায় এসে যতদিন ইচ্ছা থাকতে পারবে। আর এইটুকু বিশ্বাস রাখুন আমার ছেলে কখনো ফুলের টোকাও লাগতে দিবে না শুভ্রতার গায়ে।”
রহমান মিয়া একটু শান্ত হোন। তারপর শুভ্রতাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে দিতে এগোলেন। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তীব্রের হাতের উপর শুভ্রতার হাত রেখে বললেন,
“আম মাইয়ারে তোমার হাতে তুইল্লা দিলাম বাবা দেইখ্খা রাইখো। কখনো কষ্ট দিয়ো না। আমার ঘরের লক্ষ্মী আমার মাইয়া।”
শুভ্রতা হেচকি তুলে কাঁদে।এক হাতে শুভ্রতাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখে সাবলীল কন্ঠে তীব্র বলল,
” আমার পক্ষ থেকে কখনো নিরাশ হবেন না আব্বা। ভরসা রাখুন। সবসময় সর্বোচ্চ দিয়ে আপনার আর আমার ঘরের লক্ষ্মীকে ভালো রাখবো ইনশাআল্লাহ।”
গাড়িতে উঠার আগে শুহানা বেগম তড়িৎ গতিতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। শুভ্রতার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। ভেতর থেকে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পরেন শুহানা বেগম। কত ধমকিয়েছেন মেয়েকে। কিছু আবদার করলে বকেছেন। ছোট্ট তার মেয়েটি তাকে ছেড়ে এত তাড়াতাড়ি অন্যের ঘরে যাবে ভাবতেই পারেননি উনি। রহমান মিয়া জোর করে স্ত্রীকে ছাড়িয়ে নেন। আর শুভ শুভ্রতাকে গাড়িতে তীব্রের পাশে বসিয়ে দরজা লক করে দেয়। তীব্র শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে শুভ্রতাকে। গাড়ি চলতে থাকে তার নতুন গন্তব্যে। শুভ্রতা জানালার বাইরে তাকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। অসহনীয় ব্যাথা করছে তার বুকে। মা বাবা ভাইকে ছেড়ে যাওয়ার ব্যাথা। প্রতিটা মেয়ের জীবনের এই মূহুর্তটা কত কষ্টের। চিরচেনা মানুষদের ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় অবিদিত গন্তব্যস্থলে। কখনো কখনো সেই গন্তব্যস্থল হয় অনামিশ সুখের নয়তো একরাশ হতাশ আর বেদনায় ঘেরা।
১৫.
তীব্র ঘরে ঢুকে শুভ্রতাকে বিছানার উপর বসে থাকতে দেখে। কোলের ওপর তার ক্যামেলিয়া আরামে ঘুমাচ্ছে। ওয়ারড্রব থেকে তোয়ালে আর কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। শুভ্রতা মাথা নত করেই বসে থাকে। চারিদিকে কাচা ফুলের মিষ্টি গন্ধ। কানে ভেসে আসে বাথরুম থেকে পানি পরার শব্দ। একটু পর তীব্র বের হয়ে আসে। মাথার চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি ফ্লোরে পরছে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বিছানার ওপর বসল। তারপর শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলল,
“শাড়িটা নিশ্চয়ই প্রচুর ভারী। অস্বস্তি হচ্ছে না তোমার?”
শুভ্রতা মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো। তীব্র মুচকি হেসে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফ্লোরের এক কোণে রাখা ল্যাগিজের থেকে খুঁজে,একটা মশ্রিন জর্জেটের একরঙা মেরুন রঙের স্বর্ণালি চিকন পাড়ের শাড়ি হাতে নেই। তারপর আবারও শুভ্রতার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“চেঞ্জ করে নাও সাথে ফ্রেশ হয়ে নাও। সারাদিনে প্রচুর জার্নি হয়েছে আজ।”
শুভ্রতা এইবার মুখ তুলে তাকায়। তীব্রের বক্ষস্থল ধক করে উঠে। কান্না করার কারনে চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। ওষ্ঠ জোড়া তরতর করে কাপছে। তীব্রের ভেতর খারাপ লাগা কাজ করল। শুভ্রতার পাশে বসে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চোখে লেপ্টে থাকা পানি সযত্নে মুছে দিলো। শুভ্রতা চুপ করে মাথা নত করে ফেলে। তীব্রের ছোয়ায় তার পুরো শরীর কেঁপে উঠে। তীব্র বুঝতে পারে প্রেয়সীর অনূভুতি। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে আবারও বলে,
“আজকেই আপনার শেষ কান্না যত ইচ্ছা কান্না করতে পারেন। তবে এখন একটু বিরতি নিতে হবে বিবিসাহেবা। ফ্রেশ হয়ে এসে আবারও কাঁদবেন সমস্যা নেই। আমি সারা রাত বসে দেখবো”।
শুভ্রতা তীব্রের মুখে বিবিসাহেবা শুনে লজ্জা পায়। দু’গাল তার গরম হয়ে উঠে। তীব্র আথিবিথি করে শুভ্রতার দুহাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দাঁড় করায়। তারপর হাতে তোয়ালে আর শাড়ি ধরিয়ে দেয়। শুভ্রতা তীব্রের কথা অনুযায়ী ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয়। বেশক্ষানিক সময় পর শাড়ী পরে বের হয়ে সামান্য অবাক হয়ে যায় । তীব্র ড্রেসিং টেবিলে লাকিজ থেকে এক এক জিনিস নিয়ে গুছিয়ে রাখছে। শুভ্রতার বের হওয়ার শব্দ শুনে পেছন তাকিয়ে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে তীব্র। তার মতে মেরুন রঙের শাড়ীতে অপ্সরা থেকে কম মনে হচ্ছে না শুভ্রতাকে। তীব্রের পলকহীন তাকিয়ে থাকা দেখে পুনরায় লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি এদিক সেদিক নেয় শুভ্রতা। তীব্র দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে আবারও পেছন ফিরে। তারপর বলে,
“ভারী ভারী জিনিসগুলো খুলে রাখো। এগুলো পরে থাকতে হবে না।”
শুভ্রতা তীব্রের কথার ন্যায় বিছানার উপর বিয়ের শাড়ী আর দোপাট্টা রেখে টেবিলের সামনে বসে। শরীরের সব অলংকার খুলে রাখলেও হাতের লাল চুড়িগুলো আর গলার চিকন চেইনটা খুলে না। তীব্র বিছানার উপর রাখা শাড়ী আর দোপাট্টা যত্ন সহকারে গুছিয়ে ওয়ারড্রবের ডয়ারে রাখে। শুভ্রতা মুচকি হাসে তার অগোচরে যা তীব্রের চোখ থেকে এড়ায় না। তীব্র আলমারির থেকে একটা প্যাকেট বের করে। তারপর শুভ্রতার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
“নাও”।
শুভ্রতা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। তীব্র হাসে। আর একটু দূরত্ব ঘুচে শুভ্রতার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বলে,
“এইটা কাবিনের টাকা। এতদিন আমার আমানত ছিলো। আজ আমার দায়িত্ব শেষ। তোমার হক তুমি রাখো। এই সামান্য পরিমানের সবটুকু টাকাই তোমার। আমি কোনোদিন জানতেও চাইবো না এই টাকার কথা।”
“এতগুলো টাকা দিয়ে আমি কি করবো?” মিনমিনিয়ে বলল শুভ্রতা।
“তোমার যা ইচ্ছা করতে পারো। না হয় রেখে দিতে পারে। এখন আপাতত নিজ হাতে সুরক্ষিত জায়গায় রাখো।”
শুভ্রতা চুপ করে থাকে। তার হাত কাপছে টাকাগুলো নিতে। তীব্র খিলখিল করে হেসে উঠলো আচমকা। শুভ্রতা মুখ তুলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষের হাসি। একদমে তার মনে হলো পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর পুরুষটিই তার স্বামী। তীব্রের হাসির শব্দে ক্যামেলিয়াও নিভু নিভু চোখে ম্যাও ম্যাও করে উঠে। শুভ্রতাও ক্যামেলিয়ার ডাকে হেসে দেয়। খুব সুন্দর একটা মূহুর্ত তৈরী হয় নিমিষেই। তীব্র হাসি থামিয়ে টাকাগুলো আলমারিতে শাড়ীগুলোর পাশে রেখে বলল,
“তুমি আমাকে ভয় পাচ্ছো কেনো? আমি কি বাঘ যে তোমাকে খেয়ে ফেলবো।”
শুভ্রতা মাথা নিচু করে রাখে। একটুপর নিজেকে শুন্যে অনুভব করতেই চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে যায়। তীব্র শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে হাটা ধরে। শুভ্রতাকে নামার জন্য নড়াচড়া করতেই তীব্র আরও শক্ত করে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। তারপর বলে,
“এত নড়াচড়া করলে একদম ফেলে দিবো সাদা ফুল। তারপর কোমর ভেঙে বিছানায় বসে থাকতে হবে।তার থেকে বরং চুপটি করে থাকো।”
তীব্র শুভ্রতাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে চলে আসে। ছাদের মধ্যিখানে এসে শুভ্রতাকে কোল থেকে নামায়। তারপর হাত ধরে ছাদের রেলিয়ের পাশে দাঁড়ায়। তীব্র রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তার পাশেই দাঁড়ানো তার অতি অপেক্ষাকৃত নারী। তার সাদা ফুল। তীব্রের ভেতর থেকে ভীষন ভালোলাগা কাজ করছে। আচমকা তীব্র শুভ্রতার দু-হাত ধরে। শুভ্রতা কেঁপে উঠে তাৎক্ষনাৎ তীব্রের দিকে মুখ তুলে তাকায়। তীব্রের নিজও কাঁপছে তবুও সাহস জুগিয়ে শুভ্রতার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। মাথা সামান্য নিচু করে শুভ্রতার দিকে তাকায়। নেশাক্ত তার আখির দৃষ্টি। তীব্র অপলক তাকিয়ে থাকে শুভ্রতার দিকে। তারপর টুপ করে শুভ্রতার কপালে ছোট্ট করে চুম্বন একেঁ দিয়ে বলে,
“আমার জয়ী করা সাদা ফুল”।
শুভ্রতা তীব্রের টিশার্টের এক কোণে শক্ত করে খামচে ধরে। নখের তীক্ষ্ণ আচড় সামান্য বোধগম্য হয় তীব্রের। কিন্তু প্রতিত্তরে কিছু বলল না। শুধুমাত্র ঠোঁটের কোণে লেপ্টে রাখে এক টুকরো মিষ্টি হাসি। শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রতার মাথা ঠেকে তীব্রের বুকে। এক হাত তীব্রের বুকের উপর রেখে আরেক হাত দিয়ে নিজেও জড়িয়ে তীব্রকে। তীব্র একহাতে শুভ্রতাকে আগলে আরেক হাত চুলের মাঝে ডুবিয়ে বিলি কাটতে থাকে। জোছনার আলোকিত আকাশের নিচে এক জোড়া ছোট্ট ভালোবাসার পাখি। সময় পার হয়। দুজনের মধ্যেই নিরবতা কাজ করে। একসময় বুকে মাথা রেখেই শুভ্রতা বলে,
“ভালোবাসি শব্দটা কখনো বলেননি কেনো তীব্র সাহেব?”
“যে অনূভুতি বুঝে তাকে বর্ণনা করে কিছু বলতে হয় আদৌ?”
শুভ্রতা নিশ্চুপ থাকে। তীব্র শুভ্রতার কপালে পুনরায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। তারপর আবারও বলে,
” বছর আগেই যদি প্রকাশ করতাম স্পর্শ করার অদম্য ইচ্ছাকেও দমন করতে পারতাম না। তখন সম্পর্ক শুভ্র থাকত কিভাবে?”
শুভ্রতা মুখ তুলে তীব্রের দিকে তাকায়। পৃথিবীতে এমনও পুরুষ আছে কি? নিজের ভালোবাসাকে শুদ্ধ রাখতে এতটা ধৈর্য ধরে থাকে। অথচ আজকাল ভালোবাসার নাম করে কত কিছু করে ছেলেমেয়েরা। শুভ্রতার মনে অনায়াসেই তীব্রকে নিয়ে গর্ব জমে সাথে একরাশ মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়েই বেশ জোর উচ্ছসিত কন্ঠে বলে,
“বাবার পরে আমার চোখে দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ আপনি তীব্র সাহেব!
তীব্র উচ্চ শব্দে হাসে। চোখ মুখ জুড়ে জয়ী জয়ী ভাব রেখে বলে,
“আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ হতে পেরে আমি ধন্য মহারানি। শুধুমাত্র ইহকালে নয় পরকালেও আপনার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ হয়ে থাকার আবেদন করছি। মঞ্জুর করে বাধিত করবেন অবশ্যই।”
” আবেদন মঞ্জুর করা হলো সাহেব”।
ভালোবাসাগুলোর পূর্ণতার উৎসবে মেতে উঠে চারপাশ। এক সুন্দর প্রহরের সাক্ষী হয় প্রকৃতি। ঝংকার তুলে সমুদ্রপৃষ্ঠের অতলে তলিয়ে যাবার ন্যায় দু’জনের মাঝে ঢুবে যায় ওরা। ভালোবাসা সত্যি সুন্দর,শুভ্র এক অনূভুতি। যার পরশে সবকিছু সাদা ফুলের মতো শুভ্র হয়। স্বচ্ছ, পবিত্র!
–
সমাপ্ত