সাদা ফুল পর্ব-১০

0
3832

পর্ব-১০
#সাদা ফুল
#ফারিয়া_আক্তার_নূপুর
১৪.

“লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে”

বয়স্কদের গাওয়া হলুদের গানে মুখরিত রহমান মিয়ার বাড়ির উঠান। উঠানের একপাশে গায়ে হলুদের স্টেজ আর উঠানের উপর হলুদ কাপড় টানানো। পুরো বাড়ি মরিচবাতির আলোতে আলোকিত। উঠানের এক কোণায় বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়। বয়স্ক মহিলারা পান সুপারির থালা নিয়ে খোশগল্প করছেন। মাঝে মাঝে গলার স্বর মিলিয়ে আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্ন গীতও গাইছেন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতেই শুভ্রতাকে হলুদ শাড়ী পরিয়ে পরিয়ে স্টেজে বসানো হয়। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে হলুদ সামগ্রী নিয়ে এসেছে অনেকে বিকেলে। সবাই এসে শুভ্রতাকে হলুদ লাগিয়ে দেয়। শুভ্রতার চোখ মুখ জুড়ে এক অন‍্যরকম খুশির ঝলক। মেয়ের খুশিতে শুহানা বেগমও বেশ খুশি। গ্রামের প্রায় সকলের কাছেই খবর গিয়েছে চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে বাজারের কসাই রহমান মিয়ার মেয়ের বিয়ে। অনেকে খুশি হলেও আবার অনেকে করেছেন সমলোচনা। রহমান মিয়া সেগুলো কর্ণপাত করেননি। ছেলেমেয়ের খুশিতেই উনি খুশী।

মোবাইলে শুভ্রতার হলুদের ছবিগুলো দেখছিলো তীব্র। অন‍্য দিনের তুলনায় আজ তার সাদা ফুলকে একটু বেশি সুন্দর লাগছে। একদম হলদে পরীর মতো। শুভই ছবিগুলো পাঠিয়েছে। তখনই রুমে ঢোকে অয়ন। তীব্রকে একটা হলুদ পান্জাবী দিয়ে পুনরায় চলে যায়। তীব্র পান্জাবী পরে ছাদে চলে আসে। ছাদেই অনুষ্ঠানের প‍্যান্ডেল করা হয়েছে। একে একে বাড়ির সকলে এসে হলুদ ছোয়ায় তীব্রের গালে। অয়ন পুরো মুখে হলুদ মাখিয়ে দেয়। তীব্র রাগ করার বদলে খিলখিল করে হেসে অয়নের গালেও হলুদ মাখিয়ে দেয়। তিথি রহমান ছেলের হাসিখুশি মুখ দেখে তৃপ্তি পান। তীব্রকে এত হাসতে তিনি হয়ত খুব কমই দেখেছেন। অনুষ্ঠান শেষ করতে করতে রাত ১২টা বেজে যায়। তীব্র মোবাইল চেক করে দেখে শুভ্রতার হাতে মেহেদী পড়ানোর অনেকগুলো ভিডিও পাঠিয়েছে শুভ। তীব্র মুচকি হেসে ভিডিও চালু করে। ঈষৎ হলদে বর্ণের হাতে মেহেদীর গাঢ় লাল রঙ ফুটে উঠেছে। তীব্রের এক হাতের তালুতে দেওয়া মেহেদীগুলোও শুকিয়ে গেছে। মাঝারী সাইজের একটা ফুল আকাঁনো মাঝে শুভ্রতার নাম। তীব্র তাড়াহুড়ো করে হাতের মেহেদী আর গালের হলুদ ধুয়ে রওনা বাইরে বেড়িয়ে পরে।

“এই শুভ্র শুভ্র উঠ।”

শুভর ডাকে শুভ্রতা হুম করে ডান দিকে ফিরে আবারও ঘুমে তলিয়ে যায়। শুভ পুনরায় ফিসফিসিয়ে ডাকে,

” আল্লাহর বান্দা কত ঘুমাস! উঠ এবার তীব্র ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে”

তীব্রের নাম কানে আসতেই থরফরিয়ে উঠে বসে শুভ্রতা। আথিবিথি করে বলে,

“দুপুর হয়ে গেছে? উনারা এসে পড়েছে তীব্র সাহেবও এসে গেছেন?”

বোনের এরুপ কথায় বেশ হাসি পেলো শুভর। কিন্তু কেউ জেগে যাবার ভয়ে হাসলো না। পকেট থেকে ফোনটা বের করে শুভ্রতার সামনে ধরে বলে,

“দেখ ১টা বাজে তবে দুপুর না রাত ১টা।”

শুভ্রতা মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে ভ্রুজোড়া কুচকে ফেলে। বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই শুভ বলে,

“তীব্র ভাই বাড়ির পিছের মেহেগুনি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে গত ৩০ মিনিট ধরে। তোর এত ঘুম যে আমি এই সময় অব্দি তোর ঘুম ভাঙাতে ব‍্যর্থ। এখন উঠে আমায় উদ্ধার কর বোন”

শুভ্রতার চোখ ঘুমে নিভে আসে। সে অবারও বিছানায় শুয়ে পরে বলে,

“আমি পারবো না আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে “।

শুভ কিছু বলার আগেই তার ফোনটি বেজে উঠে। শুভ রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে কন্ঠ আসে তীব্রের। শুভ ফোনটি শুভ্রতার কানের উপর রাখে। ওপর পাশ থেকে তীব্র বলে,

” কয়েক মিনিটের জন‍্য একটু বাইরে আসো সাদা ফুল,প্লিজ। এখানে প্রচুর মশা, প্লিজ আসো”।

তীব্রের কথার পিঠে মানা করতে পারল না শুভ্রতা। ঘুম ঘুম চোখে শুভর সাথে বাইরে বের হলো। উঠানে বাবুর্চিরা রান্নার ব‍্যবস্থা করছে। রহমান মিয়া তদারকি করছেন তার। শুভর সাথে ধীর পায়ে বাড়ির পেছনে থাকা মেহেগুনি গাছের দিকে যেতেই চোখ পরে দাঁড়িয়ে থাকা তীব্রের ওপর। শুভ্রতা এগিয়ে গিয়ে তীব্রের সামনে দাঁড়ায়। কাল তো দেখা হবেই?এত রাতে হঠাৎ এখানে আসার কারনটা বুঝতে পারছে না সে। বাড়ির চারপাশে মরিচবাতির আলোই এখানে আবছা আলো-ছায়া তৈরী করেছে। তীব্র এই আবছা আলোতেই শুভ্রতার ঘুম ঘুম মুখশ্রী খেয়াল করে। ভিতর থেকে অসম্ভব ভালো লাগা ঢেউ খেলে যায়। শুভ্রতার ফোলা চোখ তীব্রকে যেনো চুম্বকের ন‍্যায় আকর্ষণ করছে। তীব্রের ইচ্ছে করছে শুভ্রতার ওই নেত্রপল্লবে টুপ করে তার ওষ্ঠ জোড়া ছুয়ে দিতে। নিজের অদম্য ইচ্ছাকে চোখ মুখ বন্ধ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দমিয়ে দেয় তীব্র। যে শুভ্র ফুলকে পবিত্র রাখতে সে এতদিন অপেক্ষা করেছে তাহলে কয়েক ঘন্টার জন‍্য তা নষ্ট করার ইচ্ছা নেই তার। পেছন থেকে বাম হাতটি শুভ্রতার সামনে তুলে ধরেল। হাতে থাকা ছোট্ট একটি প‍্যাকেট। শুভ্রতা এর মানে না বুঝে তীব্রের দিকে তাকায়। তীব্র বলল,

“নাও”!

শুভ্রতা বাধ‍্য মেয়ের মতো প‍্যাকেটা হাতে নেয়।তারপর বলে,

“কি আছে এটাতে?”

“কাল সকালে দেখে নিয়ো।”

শুভ্রতা প্রতিউত্তরে কিছু বলল না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে শুভ্রতা সামান‍্য উচু স্বরে হেসে উঠলো। তীব্র ভ্রূ কুচকে জিজ্ঞেস করলো হাসির কারন। শুভ্রতা ঠোটে হাসি রেখেই বলল,

“আপনার গালের পাশে হলুদ লাগানো”।

তীব্র মাথা চুলকিয়ে উত্তর দিলো,

“তাড়াহুরা করে ধুয়ে চলে এসেছিলাম তাই হয়ত লেগে আছে। অয়ন পুরো গালে মেখে দিয়েছিলো।”

“আসি তাহলে”

হাসি থামিয়ে অস্ফুট কন্ঠে কথাটি বলে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায় শুভ্রতা। তীব্র দাঁড়িয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। কয়েক কদম গিয়ে পেছন ফিরে থামে শুভ্রতা। তারপর আবারও তীব্রের সামনে এসে দাঁড়ায়। এবার দূরত্ব আগের তুলনায় সামান্য কম। লম্বায় শুভ্রতা তীব্রের বুক অব্দি। পা উচু করা ছাড়া তীব্রের নাগাল পাওয়া কষ্টকর। তীব্র অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শুভ্রতা বলল,

“মাথাটা একটু নিচু করবেন?”

তীব্র মন্ত্রমুগ্ধের ন‍্যায় শুভ্রতার কথা অনুযায়ী মাথা নিচু করে। শুভ্রতা মুচকি হাসে। কাঁপা হাতে গায়ের ওড়নার এক কোণা দিয়ে তীব্রের গালে লেগে থাকা হলুদ সযত্নে মুছে দেয়। শুভ্রতার কম্পনরত শীতল হাতের ছোঁয়া পেতেই তীব্রের পুরো শরীর বিদ‍্যুৎস্পষ্টের ন‍্যায় কেপে উঠে। শুভ্রতা হাত নামিয়ে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। তার নিজের এরকম সাহসিকতায় নিজই বেশ অবাক। তীব্র এখনো আগের ন‍্যায় দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রতার এইটুকু স্পর্শ তার ভেতর অগোছালো করে দিলো।

শুহানা বেগমের ডাকে ঘুম ভাঙে শুভ্রতার। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে। গতরাতে হাতে দেওয়া মেহেদীর দিকে তাকায়। গাঢ় লাল হয়ে আছে। হাতের দিকে তাকাতেই মনে পরে কাল রাতের তীব্রের দেওয়া প‍্যাকেটের কথা। দ্রুত বিছানা থেকে উঠে ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা প‍্যাকেটটি নেয়। খুলে দেখে ভেতরে চার জোড়া খাঁজ কাটা কাচের লাল চুড়ি। শুভ্রতা ভ্রু কুচকে কিছু মনে করার চেষ্টা করে। মুহূর্তেই তার মনে পরে সেদিনের মেলার কথা। মেলায় ঠিক এইরকম চুড়িগুলোই সে হাতে পরেছিলো। চুড়ির সাথে একটা চিরকুটও পেলো শুভ্রতা। চিরকুট খুলে দেখল সেখানে খুব সুন্দর হাতে লেখা “বছর আগের চুড়িগুলো কিনা সাহস পায়নি দিতে। লাল শাড়ীর সাথে হাতে দিয়ো”।
শুভ্রতা হাসলো। দু-মুঠ তার চুড়ির বাক্সে সযত্নে রেখে দিলো। আর বাকি দু-মুঠ টেবিলের উপর। নাশতা নিয়ে জাহানারা বেগম ঘরে ঢুকেন। তারপর নিজ হাতে খাইয়ে দেন নাতিনকে। তার কলিজার টুকরা এই দুজন। আজ অন‍্যের ঘরে চলে যাবে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে তার। দাদির হাতে খাবার খেতেই চোখ ছাপিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরল শুভ্রতার। গলা দিয়ে খাবার নামলো না। মূহুর্ত্তের মধ‍্যে মন জুড়ে ছেয়ে গেলো বিস্বাদ। জাহানারা বেগম শুভ্রতাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে অনবরত চোখের পানি মুছছে শুভ্রতা। দরজার ওপাশ থেকে সবটা দেখলেন রহমান মিয়া। চোখ দিয়ে তারও পানি গড়িয়ে পরল। নিজেকে শান্ত করতে দ্রুত নিজ ঘরের বিছানায় গিয়ে বসে পরলেন। বাবার আদরের মেয়ে যে কিছুক্ষন বাদেই চলে যাবে তাকে ছেড়ে। শুহানা বেগম স্বামীকে খুঁজতে ঘরে চলে আসে। রহমান মিয়া স্ত্রীকে দেখেই চোখ মুছতে উদ‍্যত হন। শুহানা বেগম পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

“আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে মেয়েটা আরও কান্না করবে!”

রহমান মিয়া যেন আরও ভেঙে পড়লেন। অস্ফুটস্বরে কেঁদে উঠলেন। কাঁপা কন্ঠে বললেন,

“মেয়ে বিদায় এত কষ্ট ক‍্যান শুহানা! আমার বুকটা ফাইট্টা যায়তাছে। আমি জানি তীব্র বাবার কাছে আমার মাইয়া সুখে থাকবো। তাও আমার এত কষ্ট হয়তাছে ক‍্যান কইতে পারো? ইচ্ছে করতাছো কি জানো, শুভ্রতা হওয়ার পর আম্মা আমার কোলে দেওয়ার পর প্রথমবার যেমনে বুকের মধ‍্যে আগলায়া রাখছিলাম আজকেও ওমনে বুকের মধ‍্যে আগলাই রাখি।”

শুহানা বেগম প্রতিত্তরে কিচ্ছু বললেন না। এই মূহুর্তে সান্ত্বনা ছাড়া আর কিছুই তার কাছে নেই। প্রতিটা মেয়ের জন‍্যই এই দিনটা কষ্টের বৈকি! প্রিয় মানুষকে পাওয়ার যতই খুশি থাকুক না কেনো মা বাবার ভালোবাসা ছেড়ে যাওয়ার কাছে তখন তা ফিকে মনে হয়।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে