#সাত_সমুদ্র_তিমির
পর্বঃ০৪
#সুমাইয়া_আফরিন
ইরা অনুর মুখ থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল।অনু রাগে চিৎকার করে বলল,
‘ওই শয়তান,তুই আমার মুখ চেওএ ধরলি কেন?দেখেছিস কি হাল করেছে আমার?’
‘তুই জানিস, ওই গাড়িতে কে ছিল?’
‘কে ছিল রে?তোর হবু শশুড়?যত্তসব।’
‘তার থেকেও বড় কিছু। ওই গাড়িতে রাফাত চৌধুরি ছিল।মাই ক্রাশ ছিল বুঝেছিস।’
রাফাতের নাম অনুর কানে যেতেই অনু নিশ্চুপ হয়ে যায়।রাফাতের নামটা আর অনু সহ্য করতে পারে না। ভীতরটা দুমরে মুচরে শেষ হয়ে যায় তার। অতীতের ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সহজে ভুলতে পারেনি সে। সেদিন রাফাতের চারটা লাইন অনুর হৃদয়কে ভেঙে চার হাজার টুকরো করে দিয়েছে।অনুর চোখের কোণে সামান্য পানি জমে গেছে। অনু এমন চুপ হয়ে যাওয়ায় সবাই অবাক হয়ে যায়। কারন অনুর যখন রাগ হয়, কোনো কিছুতেই থামানো যায় না তাকে। তাই আজ অনুর চুপ হয়ে যাওয়াটাকে কেউ মেনে নিতে পারলো না।অনুর কাধে মিমি হাত রেখে চোখগুলো ছোট ছোট করে বলল,
‘কি রে, কি হয়েছে তোর?’
‘কিছু না। কি হবে আবার?’
‘না আসলে তোর যখন রাগ হয় তখন তুই তো…..
মিমিকে কথাটা শেষ করতে দিল না অনু। তার আগেই ভাবান্তুক কন্ঠস্বরে বলল,
‘আচ্ছা তোরা ওনাকে এত চিনিস কি করে বলতো? পড়াশোনাই করেছিস নাকি এইসব বিজনেসম্যানদের খুজে বেড়াইছিস।’
‘আরে দোস্তো, খালি তুমিই ওনাকে চেনো না। রাফাত চৌধুরি কয়েকটা গান গেয়েছেন। বলতে গেলে ক্ষুদে সিঙ্গার উনি। আর আমি ওনাকে চিনেছি ওনার ফিজিক্স আর ক্যামিস্ট্রি ক্লাস দেখে। ক্লাস নাইন আর টেনের ফিজিক্স,ক্যামিস্ট্রি ক্লাস নেয় সে। খুব সুন্দর করে পড়ায়। কেন রে তুই ওনার ক্লাস কোনোদিনও করিসনি?’
‘এত ভালো ভালো টিচার থাকতে আমি ওনার ক্লাস করতে যাব কেন রে?আর ক্লাস নাইন টেনে থাকতে আমার হাতে ফোন ছিল না।’
লারা আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনু থামিয়ে দিল তাকে। তারপর চারজনে মিলে ক্ষেতের দিকে পা বাড়ালো। কিছুক্ষন হাঁটার পর অনু তার বাবার ক্ষেতের কাছে পৌছে গেল। বাবার হাতে খাবার দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো তারা।
অনু বাড়িতে ঢুকেই ওয়াশরুমে চলে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো করে হাত পা ধুয়ে নিল সে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল অনু।অতীতের পাতা গুলো অনুর কাছে আজও ভাসমান হয়ে আছে। প্রতিমুহূর্তে সে ভেবে যায় কি করে বাবার কাছে থেকে সেই ভিডিও রিকর্ডিংটা নেবে। এই সাত বছরে অনেক চেষ্টা করেছে রেকর্ডিংটা নেওয়ার কিন্তু কোনো ভাবে নিতে পারেনি সে। রাফাতের বাবাকে যে এত সহজে ছেড়ে দেবে না তা অনু অনেক আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছে।আইন যদি শাস্তি দিতে না পারে তাহলে তাকে প্রাকৃতিকভাবে শাস্তি দেবে অনু।
কথাগুলো চোখ বন্ধ করে ভাবছিল অনু। রিয়ার ডাকে চোখ মিলে তাকায় সে। অনু তাকিয়ে দেখল রিয়া একটা শর্ট টপস আর জিন্সের প্যান্ট পড়ে আছে। রিয়া সবসময় ওয়াস্টার্ন ড্রেস পড়ে। জীবনের অধিকাংশ সময় সুইজারল্যান্ডে কাটানোর জন্য রিয়ার কালচার অনুর কালচারের সাথে ম্যাচ করে না। যার জন্য তাদের মধ্যে আরো বেশি ঝগড়া লাগে। অনু চোখ অর্ধ খুলে রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়া ন্যাকা কন্ঠে বলল,
‘কখন যাব আমরা?’
‘সন্ধ্যায়।’
‘কিহ? সন্ধ্যায়? আমাকে তো পার্লারে যেতে হবে।’
অনু রিয়ার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল। রিয়া অনুর হাসি দেখে রাগে ফুসছে। সে আসলে বুঝতে পারছে না অনু কেন হাসছে। রিয়া অনুর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘What’s the matter Anu? Why are you laughing?’
‘এই গ্রামের মধ্যে এক পাগল পার্লার খুজছে সেইটা দেখে হাসছি।হাহাহা’
‘কিহ? আমি পাগল। How dare you?’
‘তা নয়তো কি? এই গ্রামের মধ্যে পার্লার আছে নাকি যে তুমি পার্লারে যেতে চাইছো?পার্লারে যেতে চাইলে এখান থেকে এক ঘন্টা যাওয়ার পর শহর পাবে সেখানে পার্লার আছে।’
রিয়া অবাক হয়ে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,
‘এক ঘন্টা মানে one hour?’
‘ইয়েস। এখন তুমিই ভাবো, এক ঘন্টা ধরে তুমি যাবে, মেক আপ করে আরো এক ঘন্টা আর ফিরে আসতে আরো এক ঘন্টা। টোটাল তিন ঘন্টা। আর তিন ঘন্টা সময় তো আমরা অপেক্ষা করতে পারবো না। আর একটু পরেই বিক্সলের আযান দিয়ে দেবে।’
রিয়া মন খারাপ করে চলে গেল। অনুর একটু রিয়ার জন্য খারাপই লাগল। কিছুক্ষন পর চারপাশ দিয়ে মুয়াজ্জিনের মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনা গেল। অনু ওয়াশরুমে গিয়ে অযু করে আসলো। তারপর নামাজ পরে মেলায় যাওয়ার জন্য তৈরি হওয়া শুরু করল।
,
,
,
,
,
,
,
সন্ধ্যার একটু পরেই অনু,রিয়া, ইরা, লারা আর মিমি বেরিয়ে পড়ল। আজ অনুকে বেশ সুন্দর লাগছে। ঘেয়া কালারের উপরে পিংক ও সবুজ কালারের কারুকাজ করা একটা থ্রিপিছ পড়েছে সে। ফরসা গায়ের রঙের সাথে কালারটা বেশ মানিয়েছে তাকে। মাথায় মেজেন্টা রঙের স্কার্ফও পড়েছে সে যা তার সৌন্দর্যটাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। মেলাটি অনুর বাড়ির থেকে বেশি দূরে নয়। হেঁটেই চলে যাওয়া যেত কিন্তু রিয়া নাকি হেঁটে যেতে পারবে না তাই দুটো রিক্সায় করে যেতে হলো তাদের।
মেলায় খুব তাড়াতাড়িই পৌছে গেল তারা। রিয়া মেলা দেখেই এক চিৎকার দিয়ে উঠল। খুবই উত্তেজিত লাগছে তাকে। অনু একটা বিরক্তির নিশ্বাস ছেড়ে মেলায় ঢোকার জন্য পা বাড়ালো। হঠাৎ এক পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো তার কানে। অনেকদিন আগে শুনেছে সে এই কন্ঠস্বর। কার কন্ঠস্বর উপলব্ধি করতে না পেরে পেছনে তাকালো সে।
পেছনে তাকাতেই চমকে উঠল অনু। মুহূর্তের মধ্যে চোখ নোনা জলে ভরে উঠল তার। শরীরে এক অজানা শিহরন বয়ে গেল তার। অনু সামনে ব্যাক শার্ট আর ব্যাক ব্যাবার্ডিন প্যান্ট পরিহিত এক সুদর্শন পুরুষ দাড়িয়ে আছে। সেই সুদর্শন পুরুষটি আর কেউ নয় রাফাত চৌধুরি।একটা গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফাতের সামনে আরেকটা ছেলে আর মেয়ে আছে। মেয়েটাকে অনু চেনে, মেয়েটা রাফাতের ছোট বোন। প্রায় ছয় বছরের ছোট রাফাতের থেকে। অনু বজ্রদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। রাফাত অনুর দিকে তাকাতেই অনু মাথা ঘুরিয়ে নিল। ইরা, মিমি, লারা আর রিয়া অনুর থেজে অনেকটা দূরে চলে গেছে। মিমি অনুকে খুজে না পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল অনু মুখ গোমরা করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা চারজন আবার পেছনে এসে অনুকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘কি রে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?যাবি না মেলায়?'(মিমি)
‘হুমম, চল।'(অনু)
অনু তাদের সাথে মেলায় ঢুকে পড়ল। অনুর কেন যেন মনে হচ্ছে রাফাত তার দিকে তাকিয়ে আছে।যখন কোনো মানুষকে কেউ ফলো করে তখন তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দেয়। অনুর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এখন তাই বলছে। অনু রাফাতের ব্যাপারে আর মাথা না ঘামিয়ে মেলায় ঘুরাতে মন দিল। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও মেলায় মন দিতে পারছে না সে। ইরা আর মিমি ফুচকা খেতে চাওয়ায় সবাই ফুচকার দোকানের কাছে চলে গেল। অনু রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল রিয়া সেলফি নিতে ব্যস্ত। অনু একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রিয়ার থেকে নিজের চোখ সরিয়ে নিল।
আচমকা রাফাতের বোন রাফাতের হাত ধরে ফুচকা দোকানের কাছে নিয়ে এলো। লারা ঠিক তখনই ফুচকা ওয়ালার কাছ থেকে ফুচকা নিচ্ছিল। রাফাতকে দেখে ফুচকার প্লেটটা অসাবধানতার জন্য পড়ে গেল তার হাত থেকে। কিন্তু বিপদ হলো অন্য জায়গায়, ফুচকার টক ছিটকে গিয়ে পড়ল রিয়ার গায়ে। কিন্তু রিয়ার কোনো হোলদোল নেই। রাফাতের দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। রাফাত আর রাফাতের বোন দুইজনই এমন কান্ড দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিয়া আর লারার দিকে। অনু রিয়াকে ঝাকিয়ে বলল,
‘Riya look at your dress.’
অনুর কথা শুনে হুশ আসলো রিয়ার। নিজের দিকে তাকাতেই এক চিৎকআর দিয়ে উঠল সে। রাগী কন্ঠে বলল,
চলবে,
(ভুল ত্রুটি মাফ করবেন।)