#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৬
#সুমাইয়া_আফরিন
চোখের কার্ণিশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল দুই ফোটা নোনা জল। অনু রাফাত যে এমন ঘৃনীয় কাজ করবে তা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি অনু। অনুর গায়ে একটা কাপড়ও নেই। কাফনের মতো চাদর দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছে তার শরীর।
অনু নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে চাদর শক্ত করে নিজের শরীরে পেচিয়ে বিছানা থেকে উঠে গেল। রাফাতের দিকে তাকাতেই খেয়াল করল রাফাত নীল ব্লেজারটা পড়েই শুয়ে পড়েছে। পায়ে মোজা পড়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
অনু রাফাতের দিক থেকে ঘৃনায় মুখ সরিয়ে নিল। রাফাত তার সাথে কিছু করেছে কি না তা বুঝতে পারছে না অনু। অনু সবকিছু ভাবা বন্ধ করে নিজের জামাকাপড় খুজতে লাগল। ঘরটা হালকা অন্ধকার যার কারনে খুজতে সমস্যা হচ্ছে না অনুর। পুরো ঘরটায় তন্নতন্ন করে খুজেও নিজের জামাকাপড় খুজে পেল না অনু।
হঠাৎ অনু চোখ গেল আলমারির দিকে। আলমারি আস্তে করে খুলতেই এক রাশ অন্ধকার আকড়ে ধরল তাকে। অনু আলমারির ভেতর হাত দিতেই বুঝতে পারল আলমারিতে ধুলো পর্যন্ত নেই। অনু কোনো উপায় না পেয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। বাড়িটায় অনেকগুলো ঘর আছে, অনু একটা ঘরের দরজায় চাপ দিতেই অবাক হয়ে গেল। দরজাটি বন্ধ করা। অনু একে একে সবগুলো ঘরের দরজা চেক করে দেখল বাড়ির সবগুলো দরজাই বন্ধ করা।
অনু সিড়ি দিয়ে নিচে নামতেই মেইন দরজার দিকে লক্ষ্য করে দেখল দরজায় সামান্য ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করা। মুহূর্তেই অনুর উল্লাসে লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলতেই থেমে গেল সে। কি করে বাইরে বের হবে অনু?এ-ই অবস্থায় বাইরে বের হলে তো তার যেটুকু সম্মান আছে তাও চলে যাবে।
অনু হতাশ মনে পুনরায় সেই রুমে চলে গেল। রুমের ভেতরে তাকাতেই দেখল রাফাত মোবাইলে কিছু একটা করছে। অনুর মনটা বিষন্ন রাগে ভরে উঠল। যদি রাফাতকে সে কেটে টুকরো টুকরোও করে দেয় তবুও হয়তো তার শান্তি হবে না। অনু হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোবাইলে আলোকিত হওয়া রাফাতের মুখের দিকে।
রাফাত মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে অনুর দিকে তাকিয়ে দেখল অনু মূর্তির ন্যায় হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাফাত ঘুম মিশ্রিত হাই তুলে বলল,
‘কোথায় গেছিলে তুমি? এত ছটফট কেন করো সবসময়?’
অনু দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
‘আমার কাপড় কোথায়?’
রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
‘ওহ আচ্ছা, জামা খুজতে গেছিলে তুমি। সরি গো, আজকে জামাটা পাবে না তুমি।’
‘আমার জামাটা দিয়ে দিন রাফাত নয়তো…..
‘নয়তো কি? কিছুই করতে পারবে না তুমি আমার।’
রাফাতের কথায় অনুর রাগ দ্বীগুন বেড়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে রাগের আগ্নিয়গিরি ফুটছে তার। হাতের মুষ্ঠি বারবার শক্ত হয়ে আসছে তার। কিন্তু এখন রেগে যাওয়ার সময় না যার কারনে অনু শান্ত হয়ে গেল। ক্ষীন স্বরে রাফাতকে বলল,
‘একটা মেয়ের সম্মান এভাবে ছিনিয়ে নিলেন আপনি? কি শান্তি পেলেন এমন কাজ করে?’
রাফাতের ঠোটের কোণা থেকে যেন হাসি সরছেই না। রাফাত মুচকি হাসি নিয়ে অনুকে বলল,
‘তোমার সম্মান আমি কখন ছিনিয়ে নিলাম একটু বলবে প্লিজ? তুমি কি ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার হাজবেন্ট। আর তাছাড়া তোমার ভালোর জন্যই খুলেছি।’
‘আমার ভালোর জন্য? সেটা কীভাবে?’
‘উফফফ এ-ই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার বাবাকে শাস্তি দেবে?এই, তোমাদের মেয়েদের মাথায় বুদ্ধি এত কম থাকে কেন?’
রাফাত অনুর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। রাফাতের এমন জিজ্ঞাসু চাউনি খুবই বিরক্ত লাগছে অনুর। অস্ফুট বিরক্তিভরা কপ্নঠে অনু বলল,
‘যেটা প্রশ্ন করেছি সেটার উত্তর দিন।কেন খুলেছেন?’
‘পাগলি মেয়ে, তোমাকে যদি হাত পা বেধে চেয়ারে বসিয়ে রাখতাম তাহলে কি তুমি খুব শান্তিতে ঘুমাতে পারতে? আর তাছাড়া ব্যাথাও পেতে তুমি। আসলে আমার সুন্দরী একটা বউকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করল না তাই জামা কাপড় খুলে ফেললাম। যার ফলে তুমি এখন পালাতে পারছো না কারন এ-ই অবস্থাতে তুমি বাইরে বের হতে পারবে না। যদি তোমাকে হাত পা খুলে ঘুমাতে দিতাম তাহলে তো তুমি এতক্ষনে পালিয়ে বৃন্দাবন চলে যেতে।’
অনু মুচকি হাসি দিয়ে রাফাতকে বলল,
‘চিন্তা করবেন না রাফাত। আমি বৃন্দাবন যাচ্ছি না।যতক্ষন না আপনাকে আর আপনার বাবাকে শাস্তি দিতে পারছি ততক্ষন আমি যাবো না এখান থেকে।’
‘ওহ তাই নাকি? ভালো কথা। আমিও হারাতে চাই না তোমাকে প্রিয়তমা। আমার বুকটাকে যে ছিন্নবিন্ন করে দিয়েছো তুমি, কি করে যাই তোমাকে ছেড়ে!’
রাফাতের কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝল না অনু। যেন সব কথা মাথার এক হাত উপর দিয়ে চলে গেল। একটা মানুষের কতগুলো যে রুপ থাকতে পারে তা রাফাতকে দেখলে বোঝা এবং জানা যায়।
অনু দরজায় বিরক্তিতে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাফাত বিছানা থেকে উঠে হনহন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অনু এ-ই অন্ধকার বাড়িতে একা বসে রইল রুমটায়। বিছানার পাশের ল্যাম্প চালাতেই পুরো রুমটা আলোকিত হয়ে গেল। একা থাকতে অনুর বেশি একটা সমস্যা হচ্ছে না, ডাক্তার হওয়ায় তার মধ্যে ভূতের ভয়টাও নেই। অনু জানালার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সকাল হওয়ার।
_____________
এক মাস পর অনু খোলা আকাশ দেখছে। রাফাত অনুর হাত শক্ত করে ধরে আছে গাড়ির সামনে। এই এক মাস রাফাতের হাতে এক অন্ধকার ঘরে বন্দি ছিল সে। এ-ই এক মাসে রাফাত তাকে শারীরিকভাবে কোনো কষ্টই দেয়নি যা প্রতিনিয়ত অনুকে অবাক করে দিয়েছে। অনুর জন্য প্রতি বেলায় রাফাত খাবার নিতে এসেছে, অনু খেতে না চাইলে জোড় করে খাইয়েছে সে। অনুর যাবতীয় সমস্ত কাজ রাফাত করতে দিয়েছে এ-ই বাড়িতে। কিন্তু রাত হলেই অনুকে এক ঘরে বন্দি করে রেখেছে সে। অনু হাজারো চেষ্টা করেছে এ-ই বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিন্তু কোনোভাবেই সে সফল হতে পারেনি। বাড়ি থেকে বের হতে পারলেও রাফাতের বডিগার্ড আর সিকিউরিটি ধরে ফেলেছে তাকে। হাউমাউ করে ভিক্ষা চেয়েছে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য কিন্তু অনুর কান্না যেন তাদের কানেই পৌছায়নি।
রাফাত অনুকে জোড় করে গাড়িতে ঢোকাতে চাইলে অনু রাফাতকে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার অনুরোধ করে। এতদিন পর সকালের এই নম্র রোদ গায়ে পড়তেই এক ভালোলাগা কাজ করছে অনুর। অনু কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকল সেখানে। বাড়িটার পার্কের কাছে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারা। রাফাত অনুর রোদ্রবিলাশ দেখে বিরক্ত হয়ে হাতে হ্যাচকা টান মেরে গাড়ির ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। অনু রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাফাতের দিকে। হঠাৎ বিষন্নতায় ভরে উঠল তার মন। এতদিন হয়ে গেল অথচ সেই গরিব মানুষদের জন্য কোনো কাজই বাস্তবায়ন করতে পারল না সে। ন্যায় বিচার দিতে পারল না সেই মানুষগুলোকে। চোখের কোণায় পানি জমে গেল অনুর।
রাফাত দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে থাকল। রাফাতের এত স্পিডে গাড়ি চালানোতে হালকা ভয় পেয়ে গেল অনু। অনুনয়ের সুরে রাফাতকে বলল,
‘গাড়িটা একটু আস্তে চালালে হয় না?’
মুহূর্তেই গাড়ির স্পিড কমিয়ে দিল রাফাত। অনু সস্তির নিশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। রাফাত হাড়ি চালাচ্ছে তো চালাচ্ছেই। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেওয়ায় গাড়ির জানালা খুলে দিল রাফাত। অনু অবাক হয়ে রাফাতের দিকে তাকিয়ে রইল। রাফাতের কোনো ভয় কেন করছে না? সে চিৎকার করে রাফাতকে ফাসাতেও পারে?
অনু সবকিছু বিবেচনা করে আর চিৎকার করল না। কারন হয়তো রাফাতের কোনো পরিকল্পনা আছে যার কারনে জানালা খুলে দিয়েছে সে। অনু চুপ করে বাইরের মনোরম দৃশ্য দেখতে লাগল। বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে তা বুঝতেও পারল না অনু। হঠাৎ রাফাতের ডাকে হুশ ফিরল তার। চোখ মুখ কুচকে তাকিতে রইল রাফাতের দিকে। কিন্তু সাইকেলের হর্ণের শব্দ শুনতেই চমকে উঠল সে। গাড়ি থেকে বের হতেই হতভম্বিত হয়ে গেল সে। রাফাত আর কোথাও না তার গ্রামে তাকে নিয়ে এসেছে। অনু গ্রামের অপরুপ দৃশ্য দেখেই খিলখিল করে হেসে দিল। রাফাত অনুর হাত শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকল আর বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
‘এত হাসি কোথা থেকে আসে বুঝি না। বাচ্চাদের মতো হাসছে, পাজি মেয়ে। এতদিন সব কাজ একা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছি সেটা তো আর মাথায় নেই। সে তো পড়ে ছিল আমার বাগানবাড়িতে কি করে মাথায় থাকবে তার!’
অনুর হাত টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রাফাত। অনু বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই থমকে গেল। চোখগুলো রসগোল্লার ন্যায় ধারন করেছে তার। বাড়িতে সবাই আছে, অনুর বাবা,মা, ভাই বোন, আর রাফাতের বাড়ির সবাই। কাকলি সরকার সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। এক প্রকার মলিনতা কাজ করছে তার মধ্যে। অনু খেয়াল করল কাকলি সরকারের চোখের কোণায় পানি জমে আছে। কাকলি সরকারের ঠিক পাশেই ইনারা আক্তার বসে আছেন। কাকলি সরকারের জন্য হৃদয়ভাঙা কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।
অনুর পরিবার এক প্রকার স্তব্ধ হয়ে আছে। বাড়িতে যেন কোনো প্রান নেই। অনু মুখ বাকা করে তাকিয়ে আছে সবার দিকে। রাফাত অনুর হাত ছেড়ে দিয়ে হনহন করে সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। অনু।কিছুই বুঝতে পারছে না বাড়িতে হচ্ছে টা কি? অনুর মা অনুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
‘কেমন আছিস মা? এতদিন ও-ই বাড়িতে আটকা পড়েছিলি,এখন কেমন লাগছে?’
অনু হতভম্বিত হয়ে তাকালো তার মায়ের দিকে।হাফসা বেগমের কথা শুনে মনে হচ্ছে সবকিছুই জানতেন তিনি। অনু বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে হাফসা বেগমের কথায়। অনুর পুরো পৃথিবীটা যখন পুরো অন্ধকার হয়ে আসছিল তখন কাকলি সরকার কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,
চলবে,