সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-২৫

0
1140

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২৫
#সুমাইয়া_আফরিন

অনু রাফাতের কথা শুনে দুই পা পিছিয়ে গেল। চোখে হালকা ঝাপসা ঝাপসা দেখতে লাগল সে। বিশ্বাস করতে পারছে না সে রাফাতের কথাগুলো। এই কি সেই রাফাত যে ওই মেসেজগুলো লেখেছিল? এই কি সেই রাফাত যে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল?

অনু নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না। রাফাত আরো কিছু কথা বলছে আলি উদ্দিন চৌধুরির সাথে কিন্তু তার কোনো কথাই কানে যাচ্ছে না অনুর। অনুর চোখ দিয়ে দুই ফোটা অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ল। অনু অশ্রুশিক্ত চোখ নিয়ে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকেই ডুকড়ে কেদে উঠল সে। বারবার রাফাত তাকে অসহনীয় ধোকা দিচ্ছে। আর সহ্য করতে পারছে না সে এই ব্যথা। অনু বিছানায় বসে নিজের চোখের অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। এক বিদঘুটে অন্ধকার বিতাজ করছে রুমটায়। ভয়াবহ ধরনের নিরবতা চলছে আর সেই নিরবতার মাঝেই শোনা যাচ্ছে অনুর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ।

অনু নিজেকে শক্ত করে চোখের পানি মুছে নিল। এখন যে দুর্বল হলে চলবে না। শক্ত হতে হবে তাকে এবং রাফাত আর তার বাবার পরিকল্পনা ব্যার্থ করতে হবে। দুই হাজার মানুষদের ন্যায় দিতে হবে তাকে। রাফাত আর তার বাবাকে চরম শাস্তি দিতে হবে যাতে দ্বিতীয়বার এমন চিন্তা মাথাতেও না আনে।

আনমনে কথাগুলো ভাবছিল অনু। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেতেই চোখ মুখ ভালো করে মুছে নিল সে। রাফাতকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে সে সব জেনে গেছে। অনু বিছানা থেকে উঠে প্রানভরে শ্বাস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই আরেকটি দরজা খোলার শব্দ ভেসে আসলো তার কর্ণকুহরে। অনু পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল রাফাত দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফাতের ঠোটের কোনায় এক অদ্ভুত শয়তানি হাসি বিরাজ করছে। রাফাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। রাফাতের এমন দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পারল না অনু। শরীরের প্রত্যেকটা শীরায় শিরায় এক ঠান্ডা শিহরন বয়ে গেল তার। বুকে এক ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি হলো অনুর।

রাফাত দরজা ছেড়ে দিয়ে পকেট থেকে তার ডান হাত বের করল। ডান হাতের সাথে বেরিয়ে আসল অনুর পরিহিত পায়েলটি। অনু পায়েলটি দেখেই চমকে উঠল। অনুর নুপুর পছন্দ নয় যার কারনে তার মামা রূপার পায়েল বানিয়ে দিয়েছিল তার জন্য। কিন্তু আজকে হঠাৎ পায়েলটি খুলে পড়ে গেল কোথায় আর রাফাতই বা এটা পেল কোথায় সেটাই বুঝতে পারছে না অনু। অনু বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। রাফাত ঠোটের কোণায় ক্রুর হাসি ঝুলিয়ে পায়েলটি আঙুলের মাঝে ঘুরাতে ঘুরাতে ধীর পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল অনুর দিকে। অনু ওয়াশরুমের দরজা থেকে একটু দূরে চলে এসেছে। শুকনো ঢক গিলে রাফাতের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে মারে সে,

‘পায়েলটি কোথায় পেলেন রাফাত?’

রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিল। যে এত হাসির আর আজব কথা কখনো শোনেনি সে। অনুর দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সে। অনুর বেশ অবাক লাগল বিষয়টি। অনু রাফাতের কাছে আসতে না চাওয়ায় এক পা দুই পা করে পিছাতে লাগল সে। পিছাতে পিছাতে এক সময় বিছানার কাছের ছোট টেবিলের সাথে ধাক্কা খেল সে। ধাক্কা খাওয়ায় একটি নোট বুক নিচে পড়ে গেল। রাফাত অনুর অনেকটা কাছে চলে এসেছে। রাফাতের রহস্যময়ী হাসি প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে অনুর ভয়কে। অনু কম্পিত চক্ষুতে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। রাফাত অনুর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে আঙুলের মাঝে পায়েল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,

‘কোথায় পেলাম পায়েলটা?এটাই জিজ্ঞাসা করলে না তুমি?’

অনু একটু অবাক হলো রাফাতের প্রশ্নে। রাফাতের কথা বলার ভঙ্গিটা কেমন যেন পালটে গেছে। এক ভয়ঙ্কর মানুষের মতো লাগছে তাকে। অনু রাফাতের কথায় ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,

‘হুম।’

রাফাত মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

‘যেখানে দাঁড়িয়ে তুমি আমার আর বাবার কথা শুনছিলে সেখানে পেয়েছি।’

অনু রাফাতের কথায় চোখগুলো বড় বড় করে ফেলে। রাফাত যে বুঝতে পেরে গেছে যে সে সবটা জানে এটা ভাবতেই অনুর বুকটা ছ্যাত করে উঠল। গলা প্রতিনিয়ত শুকিয়ে আসতে লাগল তার। রাফাত মুখ শক্ত করে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনুর রাফাতের রক্তিম চোখগুলোর দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে যে কি করতে হয় সেটাও ভুলে যাচ্ছে সে। অনু দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করেছে।

অনু রাফাতের দিকে তাকিয়ে দেখল রাফাত তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হঠাৎ রাফাত এক দড়ি দিয়ে অনুর গলা চেপে ধরল। নিমিষেই গলায় অস্বাভাবিক চাপ অনুভর করতে পারল সে। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল তার। অনু হাত পা ছোটাছুটি করতে লাগল। অনুর এক হাত গলায় বিচরন করছে। হাজারো চেষ্টা করছে দড়িটি নিজের গলা থেকে সরানোর কিন্তু কোনোভাবেই রাফাতের সাথে পেরে উঠছে না সে। গোঙানো শুরু করে দিয়েছে অনু। অনু কখনো ভাবতেও পারেনি রাফাত তাকে মারার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। রাফাত যে এত নিচেও নামতে পারে এটা জানা ছিল না অনুর। রাফাতকে থামানোর অনর্থক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অনু। আর কিছুক্ষন সময় অতিক্রম হলেই হয়তো অনু এ-ই পৃথিবীটাকে বিদায় জানাবে।

অনুর চোখ দিয়ে অঝস্র ধারায় অশ্রুজল বয়ে যাচ্ছে। অনু নিশ্বাস নিতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখনই রাফাত ছেড়ে দিল অনুর গলা। ধাক্কা দিয়ে অনুকে বিছানায় ফেলে দিল সে। অনু নির্বিকারভাবে কাশতে লাগল। রাফাতের চোখে মুখে এক ভয়াবহ কাঠন্যতা বাস করছে। যেন এক মায়াদয়াহীন মানুষ সে। অনু কাশতে কাশতে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে থাকল। গলায় এখনো চিনচিন ব্যাথা করছে অনুর। আচমকা মাথায় ব্যাথা অনুভব করল সে। রাফাত অনুর চুলের মুঠি ধরে শোয়া থেকে দাড় করিয়ে দিয়ে বলল,

‘এবার বুঝতে পেরেছিস, আমার আর আমার বাবার কথা শোনার ফল কি হতে পারে?’

অনু ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। হঠাৎ এক রাশ ঘৃনা ভর করল তার চোখেমুখে। দাঁত খিচিয়ে অনু বলে উঠল,

‘তুই আমার সাথে যাই করিস না কেন তোর মতো শয়তানকে শাস্তি দিয়েই ছাড়বো আমি।’

‘ওহ প্লিজ, তোর কতটুকু ক্ষমতা তা আমার জানা আছে বুঝেছিস?’

অনু রাফাতের কথায় থুতু ফেলে বলল,

‘চুপ কর তুই।তোর মুখ দিয়ে একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। তোর সাথে এক বিছানায় ঘুমিয়েছি আমি এটা ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে আমার। হাজার পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করলেও এই ঘৃনা দূর হবে না।’

রাফাত অনুর কথার অসম্ভব পরিমান রেগে যায়। অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। নিজেকে কোনোরকমে সামলিয়ে অনুর হাত পা দড়ি দিয়ে বাধতে শুরু করল সে। অনু অনেকটা অবাক হয়ে গেল রাফাতের হাত পা বাধা দেখে। অনু কোনোকিছু না ভেবে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। কিন্তু রাফাতের মতো শক্তিশালী পুরুষের সাথে তার ক্লান্ত শরীর পেরে উঠছে না। রাফাত খুব সহজেই এবং তাড়াতাড়ি অনুর হাত পা বেধে ফেলল। একটা শক্ত কাপড় দিয়ে অনুর মুখ বেধে দিল যাতে চিৎকার না করতে পারে। অনুকে পাজা কোলে তুলে সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে চিনে নেমে গেল রাফাত। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় অনু সিড়ির দিকদ নিজের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল আলি চৌধুরি নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এক প্রকার কাঠন্য বাস করছে তার চোখে মুখে। নিমিষেই বিষিয়ে উঠল অনুর মনটা।

রাফাত অনুকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে লাগল। অনু কোনো উপায় না পেয়ে গাড়ির কাঁচে নিয়মিত আঘাত করতে লাগল। কাঁচটা ভেঙে ফেলার অনর্থক চেষ্টা করতে লাগল সে। রাফাত অনুর ছটফটানি দেখে বিরক্ত হয়ে উঠল। অনুকে বাধা দিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,

‘কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো প্রিয়তমা? গাড়ির জানালার কাঁচ এত সহজে ভাঙবে না। আর গাড়ির ভেতর থেকে তোমাকে কেউ দেখতেও পাবে না। সো, চুপচাপ বসে থাকো।’

অনু রাফাতের কথায় চুপ হয়ে গেল। কারন রাফাতের কথায় সত্যতা বসবাস করছে। জানালার কাঁচ কখনোই ভাঙা সম্ভব নয়। অনুর চোখ দিয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। অপেক্ষা করতে লাগল কখন গাড়িটা এক নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছাবে।

অনুর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে রাফাত এক বড় বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো। বাড়িটা আহের বাড়ির থেকে সামান্য ছোট। কিন্তু এ-ই বাড়িও অনুর কাছে প্রাসাদের মতো লাগতে থাকল। অনুকে আবার পাজাকোলে তুলে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল রাফাত। অনুর মনে অজানা আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাফাতের পরিকল্পনার ছিটেফোটাও বুঝতে পারছে না সে।

রাফাত অনুকে এক অন্ধকার ঘরে নিয়ে গেল। পুরো বাড়িটাও অন্ধকার দিয়ে ঢাকা ছিল কিন্তু এ-ই ঘরটা একটু বেশিই অন্ধকার। অন্ধকারে অনুর চোখ ব্যাথা করে উঠল। রাফাত আস্তে করে অনুকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। ঘরের প্রত্যেকটা অবস্থান যে রাফাতের জানা আছে তা বুঝতে অনুর দেরি হলো না। কারন এত অন্ধকারে কেউ এত ভাবলেশহীনভাবে হাঁটতে পারে না। রাফাত অনুকে চেয়ারে বসিয়ে লাইট অন করে দিল। নিমিষেই চোখ মুখ কুচকে গেল অনুর। ঝাঝিয়ে উঠছে চোখটা। অনু পিটপিট করে রাফাতের দিকে তাকালো। অনু চারিপাশে তাকিয়ে দেখল ঘরটা সম্পূর্ণ ফাকা। কোনো আসবাবপত্রই লক্ষ করা যাচ্ছে না ঘরটায়।

রাফাত অনুর মুখের থেকে বাধন খুলে ফেলল। অনু ঘৃনাভরা দৃষ্টিতে তাকালো রাফাতের দিকে। রাফাত এক নেশাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করছে তার মাঝে। কিন্তু রাফাতের এমন দৃষ্টি অনুর ঘৃনাকে যেন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাফাতের প্রত্যেকটা স্পর্শ মৃত্যুর চেয়েও খারাপ লাগছে তার। অনু রাফাতের থেকে চোখ সরিয়ে নিচের দিকে তাকালো। হঠাৎ রাফাত অনুর মুখে রুমাল চেপে ধরল। অনু গুঙিয়ে উঠল কিন্তু রাফাতের যেন কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। অনু বুঝতে পারল রুমালে ক্লোরোফ্রম মাখানো আছে। তাই রাফাতের চোখ ধুলো দিতে অজ্ঞান হওয়ার নাটক করল সে। কিন্তু অনুর থেকে রাফাত যেন দুই পা এগিয়ে আছে। অনু নিখুত অভিনয় করার পরেও রাফাত অনেক্ষন নাকের কাছে ক্লোরোফ্রম ধরে রাখল। অনু বেশিক্ষন নিশ্বাস বন্ধ রাখতে না পেরে শ্বাস ছেড়ে দেয়। সাথে সাথেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।

মাঝরাতে হঠাৎ মআথায় চিনচিনে ব্যাথা করে ওঠে অনুর। ভয়াবহ ধরনের ভারী হয়ে আছে মাথাটা। ঘরটায় জানালা দরজা বন্ধ থাকায় গরম হাওয়া বিরাজ করছে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই অনু বুঝতে পারল বিছানায় হাত পায়ের বাধন ছাড়া শুয়ে আছে সে। বিষয়টিতে অনেকটা অবাক হলেও পরবর্তীতে আরো অবাক হয়ে গেল সে। নিজের পাশে তাকাতেই রাফাতের ঘুমন্ত চেহারা ভেসে উঠল তার চোখে। বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরল অনু। বুক ফেটে কান্না আসছে তার। এ-ই লোকটা তার শেষ সম্বলটুকুও রাখল না।

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে