সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-১২

0
1125

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১২
#সুমাইয়া_আফরিন

অনু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মানুষগুলোর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই ছোট্ট হাসপাতালে এরা কি করছে এটাই ভেবে পাচ্ছে না অনু।হঠাৎ অপারেশন থিয়েটারের দরজা ফাক করে আরেকজন নার্স অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ম্যাম প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন।’

অনু নিজেকে আর এক মিনিটও দাঁড়িয়ে রাখতে পারল না। দ্রুত গতিতে অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢুকে গেল। অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢোকার আগে অনু একবার কাকলি সরকারের মুখটা খেয়াল করল। ভদ্র মহিলার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে একেবারে আকাশ থেকে ধপ করে পড়েছেন। বিষ্ফোরিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছেন অনুর দিকে।

অনু অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে দেখল তনয় স্যার সার্জারি করা শুরু করে দিয়েছে।অনু পেশেন্টের দিকে তাকিয়ে চমকে গেল। এবার অনু বুঝতে পারল কার জন্য এবং কেন এসেছে তারা এক হসপিটালে।

বিছানায় শুয়ে আছে একজন ২৩ বছরের মেয়ে। পেটের ব্যাথায় প্রতিনিয়ত চিৎকার করছে সে। অনু মেয়েটাকে দেখে বুঝতে পারল এই মুহুর্তেই বাচ্চা ডেলিভারী করতে হবে। এই যন্ত্রনায় কাতর মেয়েটি আর কেউ নয় রাফাতের মেজো বোন। অনু আর তনয় নামক ডক্টর নিজেদের কাজ শুরু করে দিল।

রাফাতের বোনের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। দুর্বল হয়ে পড়েছে সে যা বেবির উপর আঘাত হানতে পারে। অনু অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল কারন প্রেশেন্টের অবস্থা বেগতিক খারাপ। কিন্তু শত জড়তা পেরিয়ে খুব সাবধানে বেবিকে সুস্থ অবস্থায় ডেলিভারী করল অনু ও তনয় স্যার এবং তাদের সাথে থাকা নার্সরা।

দরজার ভেতরে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না রাফাতের পরিবার। কাকলি সরকার চিন্তায় কান্না করে দিয়েছেন। তারপরে আবার অনু এখানে কি করে এলো এটাও বুঝতে পারছে না সে। হাজারো টেনশান নিয়ে পায়চারি করছে সবাই। হঠাৎ দরজার ভেতর থেকে এক নবজাতক শিশুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। কাকলি সরকার ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। চেয়ার থেকে উঠে এক পানে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন এই আশায় যে কোন সময় বেবিকে নিয়ে আসবে।

দরজা ঠেস দিয়ে একজন নার্স কোলে সাদা কাপড়ে রাখা এক নবজাতক শিশুকে নিয়ে বাইরে এলো। তারপর কাকলি সরকারের হাতে বেবি দিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেলেন। কাকলি সরকার বেবিটাকে দেখে তৃপ্তির হাসি দিলেন। তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। বুকের ভেতরের সব খুশি যেন এই চোখের পানির মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে।

প্রায় পনেরো মিনিট পর অনু আর তনয় স্যার বাইরে বেরিয়ে এলেন। অনু নিজের পরোনের মাস্ক খুলে প্রানভরে শ্বাস নিল। এই সার্জিকাল ড্রেস পড়ে প্রচন্ড গরম লাগছে তার। কাকলি সরকার অনুকে দেখে নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে আছেন। তনয় স্যার বের হতেই রাফাত তার দিকে এগিয়ে গেলেন। তনয় স্যার রাফাতের দিকে ক্লান্ত চক্ষুতে তাকালেন। রাফাত চিন্তিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন তনয় স্যারের দিকে।

‘আমার বোন কেমন আছে?’

তনয় স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। রাফাত আর তার পরিবারের সবাই একবার তনয় স্যারের দিকে তাকাচ্ছে একবার অনুর দিকে। রাফাত জিজ্ঞাসু চক্ষুতে তাকিয়ে আছে তনয়ের দিকে। তনয় স্যার শান্ত গলায় বললেন,

‘আপনার বোনের অবস্থা বেশি একটা ভালো নয়। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। রক্তশুন্যতা ও পুষ্টির অভাব দেখা দিয়েছে শরীরে। মায়ের এমন অবস্থা বাচ্চার জন্য একদম ঠিক না। মায়ের এমন অবস্থার জন্য শিশুরও সঠিক বিকাশ হয়নি। মায়ের অনেক খেয়াল রাখতে হবে আপনাদের। প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে।’

সবাই অনেকটা চিন্তিত হয়ে পড়ল।তনয় স্যার অনুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘অনু, আমার ওয়াইফের শরীরটা ভীষন খারাপ। তুমি কি একটু ওনাদের প্রেসক্রিপশনটা দিয়ে দিতে পারবে?’

অনুর একবার রাফাতের দিকে নজর বুলালো। রাফাত নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনি একটা গলা খাকারি দিয়ে বলল,

‘অবশ্যই পারবো স্যার।’

তনয় স্যার তৃপ্তির হাসি দিলেন অনুর দিকে। তনয় স্যার ও অনু একই সাথে মেডিকেলে ও এই হাসপাতালে চাকরী করে। তনয় স্যারই অনুকে এই হাসপাতালের ঠিকানা দিয়েছিল। তনয় স্যার মধ্যবয়ষ্কের একজন মানুষ। আজকে তার স্ত্রীর অনেক জ্বর এসেছে যার জন্য তাকে আনফরচুনেটলি বাড়িতে যেতে হবে। যার জন্য তিনি অনুকে কাজটি করতে বললেন। কিন্তু এই বিষয়ের ঘোর আপত্তি করলেন কাকলি সরকার। রাগী কন্ঠে তিনি বলে উঠলেন,

‘মোটেই না।এই মেয়েটা হান্ড্রেড পার্সেন জাল সার্টিফিকেট দিয়ে ডক্টর পাশ করেছে। আমি চাই না আমার মেয়ের প্রেসক্রাইব এই মেয়েটা করুক।’

রাফাত ভ্রু কুচকে তার মায়ের দিকে তাকালো। তনয় স্যার বিষ্ফরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন কাকলি সরকারের দিকে। অনু বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রয়েছে কাকলি সরকারের দিকে। কারন অনু আগে থেকেই জানতো যে কাকলি সরকার এমন কিছু একটাই বলবে। তনয় স্যার রাগী ভঙ্গিতে বললেন,

‘আপনার মাথা ঠিক আছে? অনু একজন বিসিএস ক্যাডার ডক্তর। ঢাকা মেডেকেলে চাকরী করে ও। আর এখানে পার্ট টাইম জব নিয়েছে। আপনি কি করে জানলেন যে নকল ডক্টর? এতই যেহেতু আপনাদের সমস্যা তাহলে এই হাসপাতালে কেন এসেছেন? আমরা আপনার টাকায় কাজ করি না যে আপনার কথা মতো চলবো। এমন তো ভাব দেখাচ্ছেন যেন আপনি একজন ডক্টরের থেকে বেডি জেনে গেছেন। আমরা আপনাদের ট্রিটমেন্ট করি৷ আপনারা আমাদের না বুঝতে পেরেছেন।’

কথাগুলো এক নিশ্বাসে বললেন তনয় স্যার। বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে লাগলেন তিনি। কাকলি বেগম রাগে গজগজ করতে লাগলেন। অনু তনয় স্যারের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছেন। এই প্রথম তার জন্য কেউ এভাবে স্ট্যান্ড নিয়েছে। তনয় স্যার একদিন বলেছিলেন যে তাকে তার বড় ভাই ভাবতে। আজ বড় ভাইয়ের মতোই কাজ করলেন তিনি।

কথাগুলোতে কাকলি সরকারের ইগো হার্ট হয়েছে তা বুঝতে রাফাতের দেরি হলো না। তাই কাকলি সরকার কিছু বলতে যাবে তার আগেই রাফাত কাকলি সরকারকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলল,

‘মম প্লিজ, এখন আর ঝগড়া বাড়িও না।সবাইকে নিজের হাজবেন্টের মতো কেন মনে করো তুমি? সবাই তোমার হাজবেন্টের মতো নকল উদারতা দেখিয়ে বেড়ায় না।’

কাকলি সরকার নিজের ছেলের কথায় চুপ হয়ে গেলেন। রাফাতের কথাগুলো কাকলি সরকারের কাছে নতুন লাগছে না। যেদিন থেকে রাফাত জানতে পেরেছে তার বাবার কু কর্মের সম্মন্দ্ধে সেদিন থেকে প্রতিনিয়ত সে এইসব বলে যায়।

তনয় স্যার মাথা গরম করে বেরিয়ে গেলেন হসপিটাল থেকে। তিনি এইসব বড়লোকিয়ানা একদম পছন্দ করেন না। যার জন্য অনুর সাথে এমন ব্যাবহার করায় রুখে দাড়ান তিনি। অনু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমার কেবিনে কেউ আসুন।’

কথাটা বলেই অনু নিজের কেবিনের দিকে হাঁটা ধরল। নিজের কেবিনে ঢুকে রাফাতের ফ্যামিলির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল সে। অনু খেয়াল করল তাদের আসতে একটু দেরি হচ্ছে তাই অনু রাফাতের বোন স্নেহার প্রেসক্রিপশন লিখতে ব্যাস্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর দরজা ঠেস দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়ল। অনু তাকিয়ে দেখল রাফাত ও একটা অচেনা ছেলে ঢুকেছে। অনু ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইল তাদের দিকে।

চলবে,

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে