সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-১১

0
1164

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১১
#আফিয়া_আফরিন

হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে কেউ ভেতরে ঢুকে পড়ল।অনু পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল মিমি তার দুই হাতে দুইজনের জন্য কফি নিয়ে এসেছে। অনু নিজের চোখের পাওয়ারি চশমাটি খুলে টেবিলে রাখল। তারপর মিমির দিকে ঘুরে বসে পড়ল। মিমি অনুর হাতে কফির মগটা দিয়ে অনুর সামনে বসে পড়ল। অনু কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,

‘কালকে একটা হসপিটালে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম বুঝেছিস?’

‘হুমম, তো কি হলো?’

‘বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় নিয়ে নিয়েছে।’

‘সরকারি না বেসরকারি?’

‘এটা কেমন প্রশ্ন মিমি? অভিয়েসলি বেসরকারি।’

‘ওহ,,ভুলেই গেছিলাম যে তোর সব সার্টিফিকেট তো মেডিকেলে আছে। সরকারি চাকরি কোথা থেকে পাবি!’

‘তোর এই মাথাটা যদি একটু আগে খাটাস তাহলে খুব ভালো হয় বুঝলি?’

মিমির এতক্ষনে অর্ধেক কফি শেষ। আরেকবার কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল,

‘তুই বোঝ,আমার বোঝার দরকার নেই।’

অনু মিমির দিকে সরু সরু চোখে তাকালো। মিটমিট করে কিছুক্ষন হেসে উত্তর দিল,

‘এই জন্যেই আজ পর্যন্ত প্রেম করতে পারলি না।’

মিমি শ্যেন চোখে অনুর দিকে তাকিয়ে আছে। মিমি অনুর থেকে এক বছরের বড়। আজ পর্যন্ত কোনো ছেলের দিকে ঘুরেও তাকায়নি সে। কারন তার ভালোবাসার মানুষকে আজও খুজে বেড়াচ্ছে সে। মিমির ছয় বছর বয়সে লন্ডনে চলে গেছিল সেই ছেলেটি। মিমি তখন ছোট হলেও অগাধ ভালোবাসায় বাধা পড়েছিল সে।

মিমি গলা খাকারি দিয়ে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,

‘সামলাতে পারবি দুইটা হসপিটালের কাজ।’

অনু তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,

‘আমাদের তো শ্বাস নেওয়ারও সময় নেই রে। রোগী দেখতে দেখতেই তো জীবন কাটবে আমাদের।’

অনুর কফি খাওয়া শেষ। মিমি কফির মগ নিয়ে রন্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। অনু, লারা,মিমি আর ইরা এই চারজন মিলে একই বাসায় থাকে। দুই রুম, একটা টয়লেট আর একটা রান্নাঘর নিয়ে বাসাটি গঠিত। অনুর খুব ভালো লাগে এই বাসাটি। সময় পেলেই বাড়িটাকে বিভিন্নভাবে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

__________

চার ঘন্টার জার্নি করে প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রাফাত। মাথায় অসহ্য ব্যাথা করছে তার। মাথার অসহ্য ব্যাথা নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল রাফাত। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে থাকতেই ঘুমের দেশে ঘুমপরী আহ্বান করতে লাগলো তাকে। কিন্তু হঠাৎ কপালে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল রাফাত। রাফাত চোখ খুলতেই ঝাপ্সা দেখতে পেল নিজের চোখে। ভালো করে চোখ মেলে দেখল একটা মেরুন কালারের টপস পড়া মেয়ে বসে আছে তার পাশে। রাফাত ধড়ফড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল।

মেয়েটি রাফাতের এভাবে উঠে বসায় ভ্রু কুচকে তাকালো রাফাতের দিকে। রাফাত বিরক্তিভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাফাত মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘সায়মা তুমি এখানে?’

মেয়েটি চোখ মুখ কুচকে তাকিয়ে রইল রাফাতের দিকে। তারপর মুখ বাকা করে ন্যাকা কন্ঠে বলে উঠল,

‘কেন রাফাত? তুমি আমার আসায় খুশি হওনি?’

রাফাতের রাগে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। সায়মা নামক পেত্নিকে সে একদম সহ্য করতে পারে না। নুন্যতম জ্ঞান এই মেয়েটির মধ্যে নেই। রাফাত আজ পর্যন্ত কখনো নেশাদ্রব্যের দিকে হাত বাড়ায়নি।কিন্তু এই মেয়েটি সকল নেশাদ্রব্য যেমন ড্রাগস, সিগারেট,মদ ইত্যাদি ইত্যাদি সেবন করে। সায়মা তার খালামনির ছোট মেয়ে। ছোট বেলা থেকেই আদরে আদরে বড় হয়ে ওয়ান কাইন্ড অফ জেদী এবং অহংকারী হয়েছে সে। রাফাত দাঁত কিটমিট করতে করতে বলল,

‘না তা হবে কেন?

‘তোকে দেখে আমি কেন বিশ্বের কেউ খুশি হবে না শাকচুন্নি।’

বিরবির করে কথাটা বলল রাফাত। সায়মার দিকে রাফাত তাকিয়ে দেখল সায়মা নেশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাফাত খুব ভালোভাবেই জানে যে সায়মা তাকে পছন্দ করে। কিন্তু রাফাত তাকে একদমই সহ্য করতে পারে না। রাফাত নিজের মাথায় হাত দিয়ে চোখ মুখ কুচকে সায়মাকে বলল,

‘সায়মা আমার না প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে। আমি একটু একা থাকতে চাই।’

‘কি বলছো তুমি রাফাত? তোমার মাথা ব্যাথা করছে আমি টিপে দেব?’

এই কথা বলে বিছানায় বসে থাকা অবস্থায় সায়মা একটু এগিয়ে আসে। রাফাত চমকে উঠে আরো পিছিয়ে যায় সায়মার থেকে। সায়মা রাফাতের মাথায় হাত বুলাতে গেলে রাফাত সায়মার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে ওঠে,

‘সায়মা আমার জন্য একটা কাজ করে দিতে পারবে?’

সায়মা তৃপ্তির হাসি দিল। যেন রাফাত তার হাত ধরায় জীবনের সব সুখ পেয়ে গেছে সে। সায়মা রাফাতের হাতের উপর তার আরেক হাত দিয়ে বলল,

‘হুমম,,বলো না? তোমার একটা কাজ কেন হাজারটা কাজ করে দিতে পারবো আমি।’

রাফাত রহস্যময় হাসি দিয়ে বলল,

‘আমার জন্য একটু ভেজিটেবল সুপ বানাতে পারবে। তোমাকেই বানাতে হনে কিন্তু। অন্য কারোর হাতের কিন্তু আমি খাবো না।’

সায়মার মুখ মুহূর্তেই মলিন হয়ে গেল।কারন খুন্তি কি করে নাড়তে হয় সেইটা পর্যন্ত সে জানে না। আর রাফাত কি না তাকে সুপ বানাতে বলছে। সায়মা মুখে জোড় পূর্বক হাসি দিয়ে সম্মতি জানালো। রাফাত ছট করে সায়মার হাত ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। সায়মা বসে বসে ভাবতে লাগল কি করবে সে। রাফাত সায়মার মনে অবস্থা বুঝতে পেরে বলল,

‘কি হলো সায়মা?তুমি এখনো বসে আছো কেন?তুমি দেখছনা আমি কত কষ্ট পাচ্ছি।যাও তাড়াতাড়ি।’

সায়মা তাড়াতাড়ি করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর বড় বড় পা ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। সায়মা বেরিয়ে যেতেই রাফাত অট্টহাসিতে মেতে উঠল। হাস্যজ্জল চেহারায় রাফাত বলে উঠল,

‘এবার দেখ কেমন লাগে? আজকে তো তুই নিজের হাত পড়াবিই সায়মা রানি। আর আমার থেকে প্রায় এক ঘন্টার জন্য দূরে থাকবি।’

রাফাত আবার অট্টহাসিতে মেতে উঠল। তারপর গায়ে চাঁদর পেচিয়ে শুয়ে পড়ল সে। এবার সে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাতে চায়।’

_________

সকালে সূর্যের তীর্যক রশ্নি সোজা গিয়ে অনুর মুখে পড়ে। দূর থেকে অনুর কানে পাখি দের কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে আসছে। অনু পিটপিট করে নিজের চোখ খুলল। ঘড়ির দিকে তাকাতেই লাফিয়ে উঠল সে। কারন তার হসপিটালে আধাঘন্টার ভেতর পৌছাতে হবে। অনু বিছানা থেকে ধপ করে নেমে পড়ল। দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে রেডি হয়ে নিল সে। অনুর মাথা ঢুকছে না কেউ তাকে আজকে ডেকে কেন দিল না।

মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল বাসায় কেউ নেই।সবাই গেল কোথায়?অনু বাড়ির সবজায়গায় নিজের চোখ বুলিয়ে নিল।কিন্তু কোথাও কাউকে পেল না সে। হঠাৎ পেছন থেকে হৃদয় কাপানোর মতো শব্দ ভেসে আসলো তার কানে। উপর থেকে ছোট ছোট রঙ বেরঙের কাগজের টুকরো উড়ে এসে অনু মাথায় পড়ল। অনু অবাক হয়ে পেছনে তাকাতেই সবাই চিৎকার করে বলে উঠল,

‘Happy birthday.’

অনু বিষ্ফরিত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অনুর মনেই ছিল না আজকে তার জন্মদিন। কিছুক্ষন পর অনু নিজেকে স্বাভাবিক করে হেসে দিল। অনু জানতে পারল রাত বারোটার সময় অনুকে অনেক ডাকা হয়েছিল কিন্তু অনু ওঠেনি তাই তারা উইশটাও করতে পারেনি।কিন্তু অনু এতেই অনেক খুশি হয়ে গেছে। ব্যাস্ততার কারনে তাড়াতাড়ি করে সবাইকে বের হয়ে যেতে হলো। অনুর জন্মদিন ইরা,লারা আর মিমি ভালো কতে সেলিব্রেট করতে পারল না যা তাদের মনটাকে খারাপ করে দিয়েছে।

রাত বারোটা বাজে। অনু যে বেসরকারি হাসপাতালে চাকরী নিয়েছিল সেখানে তাকে নাইট ডিউটি দেওয়া হয়েছে। করিডরের চেয়ারে মন খারাপ করে বসে আছে সে। কারন আজ ইরা, লারা আর মিমি তার জন্য রেস্টুরেন্টে টেবিল বুক করেছিল।কিন্তু রোগীদের চাপে অনু যেতে পারেনি।তাই মন বিষন্ন করে বসে আছে সে।

রাতে হাসপাতালে বেশি কেউ নেই। নিস্তবদ্ধ আর সম্পূর্ণ ফাকা রয়েছে হাসপাতালটি। বেসরকারি হাসপাতাল গুলো সরকারি হাসপাতালের চেয়ে একটু পরিষ্কার হয়। তাই এখানে বেশি একটা নোংরা হয়নি যার কারনে অনু প্রান ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। আচমকা এক নার্স অনুকে ডাকতে ডাকতে তার কাছে চলে আসল। অনু অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নার্সের সামনে। নার্সটি হাপাতে হাপাতে বলল,

‘ম্যাম আপনি এখানে? আর আমি আপনাকে সারা হসপিটালে খুজে বেড়াচ্ছি। তনয় স্যার আপনাকে ডাকছেন। একটা পেশেন্ট এসেছে। খুব গুরুতর অবস্থা তাই তনয় স্যার আপনাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি চলুন।’

অনু মাহিরা নামক নার্সটির কথায় এক মুহূর্তও নিজেকে দাঁড়িয়ে রাখতে পারলো না। দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরল সে। এক কথায় জগিং করছে সে। তাড়াতাড়ি সার্জারির ড্রেস পড়ে ওই করিডরের দিকে পা বাড়ালো সে। কিন্তু করিডরের সামনে যেতেই পা থমকে গেল অনুর। অনুর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা চিন্তিত মানুষগুলোকে দেখে যেন অনু আকাশ থেকে পড়েছে। এই ছোট্ট হাসপাতালে এরা কি করছে সেইটাই ভেবে পাচ্ছে না অনু।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে