#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ১৮
#সুমাইয়া_আফরিন
‘তুমি আমাকে না বলে এখানে কেন এসেছো রাফাত। তুমি জানো না, তোমাকে এক মুহূর্ত না দেখলে আমার কি অবস্থা হয়।’
রফাতকে জড়িয়ে ধরে ন্যাকা সুরে কথাগুলো বলল সায়মা। রাফাত রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে সায়মার দিকে। তার ইচ্ছা করছে এক থাপ্পরে সায়মার সবগুলো দাঁত ফেলে দিতে। রাফাত অনুর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখল অনু ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। এক রাশ ঘৃনা ছড়িয়ে পড়েছে তার সর্বত্র মুখে। রাফাত এক ধাক্কা দিয়ে সায়মাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিল। সায়মা রাফাতের এমন কান্ডে অনেকটা অবাক হয়ে যায়। পর মুহূর্তেই অনুর দিকে নজর যায় তার। শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
অনু ঠোট কামড় দিয়ে কোনোরকমে নিজের কান্নাকে থামিয়ে দেয়। রাফাতের জন্য এক অদ্ভুত অনুভুতি অনুভব করছে সে যা সাত বছর আগেও করেছিল। অনু কান্নামিশ্রিত চোখে রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আমার মনে হয়, এখানে আমার আর থাকা উচিত নয়। আমার চলে যাওয়া উচিত।’
অনুর কথাকে পশ্রয় দিয়ে সায়মা কর্কশ গলায় বলে উঠল,
‘ঠিক বলেছো তুমি। আমাদের মধ্যে কাবা…….
সায়মা তার কথাটি শেষ করতে পারল না। সায়মার কথা অগ্রাহ্য করে রাফাত অনুকে উদ্দেশ্য করে উচু স্বরে বলে উঠল,
‘অনু, ও হচ্ছে সায়মা। আমার খালাতো বোন এক কথায়… তোমার খালাতো ননদ।’
মুখে এক ফালি হাসি নিয়ে কথাগুলো বলল রাফাত। আনন্দের আভা ছড়িয়ে আছে তার চোখে মুখে। রাফাত ঠোটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আর সায়মা ও হচ্ছে আমার বিউটিফুল ওয়াইফ অনু। অনু একজন ডক্টর। প্রায় মেয়েরাই তো বাবার টাকায় বসে বসে খায় কিন্তু ওর বাবার টাকায় বসে বসে খাওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় না।’
শেষের কথাটি যে সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে রাফাত তা সায়মার বুঝতে বেশি কষ্ট হলো না। সায়মাকে তার বাবা মা বিদেশে পাঠিয়েছিল পড়াশোনা করাতে কিন্তু পরপর দুইবার ফেল করায় নিজের পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি সায়মা। সায়মা রাফাতের কথায় যে অনেক পরিমান কষ্ট পেয়েছে তা সায়মার মুখে ভাসমান। সায়মা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে।
রাফাত এখনো খিলখিল করে হাসছে। যেন সায়মাকে কথাটা বলতে পেরে অনেক খুশি হয়েছে সে। অনু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে রাফাতের হাস্যজ্জল মুখস্রির দিকে। রাফাত যে এমন কিছু বলবে তা অনু কল্পনাতেও ভাবেনি। রাফাত অনুর হাতটা শক্ত করে ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো। রাফাত অনুকে এতটা কাছে নিয়ে আসায় অসস্থিতে পড়ে গেল অনু। অনু রাফাতের থেকে দূরে যেতে চাইলেও যেতে পারছে না। কারন রাফাত শক্ত হাতে ধরে রেখেছে তাকে।
রাফাত একটি শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে সায়মাকে বলল,
‘সায়মা, আমরা একটু ওই দিকে ঘুরতে যাচ্ছি। তো তুমি এখানে একা একা কিই বা করবে! তুমি বরং বাড়ি চলে যাও।’
এই কথা বলেই রাফাত অনুর হাত ধরে সামনে হাঁটে শুরু কতে দিল। অনু রাফাতের দিকে অবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে। রাফাত এত জোড়ে হাঁটছে যে আর কিছুক্ষন পর অনুর হয়তো দৌড়াতে হবে। অনু রাফাতের গৌন্তব্যবিমুখ মুখস্রির দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রাফাত প্লিজ স্টপ।’
রাফাত চোখ যেন সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনুর কথার ভ্রুক্ষেপ করছে না সে। অনু কোনোরকমে পেছনে তাকিয়ে দেখল সায়মার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে পড়ছে। আর একটু পর হয়তো ভ্যা ভ্যা করে কেদেই দেবে মেয়েটা। অনুর সায়মার জন্য একটু খারাপ লাগতে শুরু করল।
প্রায় অনেকটা দূরে এসে রাফাত যেন তার পা থামালো। অনু একটা সস্তির নিশ্বাস নিল। অনুর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়েছে। অনুর বুক ধুকপুক করছে, এত জোড়ে করছে যেন তার মনে হচ্ছে রাফাতও শুনতে পাচ্ছে তার ধুকপুকানি। অনু জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে বিব্রত গলায় বলল,
‘এত জোড়ে আসার কি মানে? আর এভাবে টানতে টানতে নিয়ে এলেন কেন আমায়?’
‘ওই রাক্ষসীর থেকে পিছু হটানোর জন্য।’
‘বেচারা কেঁদেই দিয়েছে। ও তো আপনার গার্লফ্রেন্ড তাহলে ওকে রাক্ষসী বলছেন কেন?’
রাফাত চোখ বড় বড় করে তাকালো অনুর দিকে। যেন এমন আজব কথা রাফাত আর কোনো দিন শোনেনি। তাফাত দাঁত কিটমিট করতে করতে বলল,
‘তুমি এক কল্পনার জগতে বাস করো অনু। সেই কল্পনার জগতে আমার গার্লফ্রেন্ড হচ্ছে সায়মা। কিন্তু এটা কল্পনা নয়,এটা বাস্তব। কাম ব্যাক টু রিয়েলিটি অনু। এই রিয়েলিটিতে আমি হেট সায়মা। যেই মেয়েকে আমি এক সেকেন্ডের জন্য সহ্য করতে পারি না তুমি তাকে আমার গার্লফ্রেন্ড বানিয়ে দিয়েছো? লাইক সিরিয়াসলি?’
কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে প্রানভরে শ্বাস নিল রাফাত। অনু অবাক চক্ষুতে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। সায়মাও যদি রাফাতের গার্লফ্রেন্ড না হয় তাহলে তার গার্লফ্রেন্ড কে?
অনু আনমনে ভাবছিল কথাগুলো। ঠিক সেই সময় রাফাত অনুর হাত ধরে নিয়ে গাড়ির কাছে চলে গেল। খুব দ্রুত অনুকে তার বাড়ি পৌছে দিয়ে গেল রাফাত। অনু কিছু বুঝে ওঠার আগেই চলে গেল সে। অনু হাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইল। রাফাত কেন এত তাড়াতাড়ি তাকে পৌছে দিল বাড়িতে? কিছুই অনুর মাথায় ঢুকছে না।
___________
সন্ধ্যায় অনু টেবিলে বসে কিছু ঔষধের নাম লিখছে। হঠাৎ শব্দ করে তার ফোন বেজে উঠল। অনু তার চোখের পাওয়ারি চশমাটি ঠিক করে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল এক আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। নির্দ্বিধায় কল রিসিভ করল সে। ফোন কানে ধরতেই এক কান্না মিশ্রিত মেয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে আসল তার কর্ণকুহরে। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘অনু তুমি রাফাতের ফাদে পড়ছো। ও তোমার সাথে ভালোবাসার নাটক করছে। তুমি যখনই ওকে বিশ্বাস করা শুরু করবে তখনই ও তোমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তোমার থেকে ওই রেকর্ডিংটা নিয়ে নেবে। তারপর ও তোমাকে ছুড়ে ফেলে দেবে অনু। তুমি ওর ফাদে পরো না। জীবনটা শেষ হয়ে যাবে তোমার।’
কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিল মেয়েটা। অনু এমন কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না যার কারনে এক প্রকার থমকে গেছে সে। পুরো পৃথিবীটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছে তার কাছে। ভয়াবহ ধরনের নিরবতা বিরাজ করতে লাগল ঘরটায়। নিজের অজান্তেই এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল তার চোখ দিয়ে। অনু মূর্তির ন্যায় বসে থাকল চেয়ারটায়।
ফোন রেখেই পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়ল সায়মা আর কাকলি সরকার। চোখে সুস্পষ্ট আনন্দ বিরাজ করছে তাদের। অনু যে এবার তাদের কথার প্ররোচনায় পড়ে রাফাতের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবে না এতে তা নিশ্চিত হয়ে গেছে। এসব কথা শোনার পর কেই বা বিশ্বাস করবে একজন মানুষকে!
চলবে,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)