সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-১+২

0
1890

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
সূচনা পর্ব
#সুমাইয়া_আফরিন

‘যেই মেয়ে বিয়ের সাত বছর পরেও শশুর বাড়িতে পা রাখেনি সেই মেয়ের চরিত্র কেমন তা আমার জানা আছে।’

‘একদম তাই। তুই কি রে অনু, বিয়ের সাত বছর হয়ে গেল একটা বাচ্চাও তো জন্ম দিতে পারলি না।’

আরেকজন বলে উঠল,

‘তোর অন্য কোথাও আবার কিছুটিছু আছে নাকি রে?’

মানুষজনের এমন কথা শুনে অনু মাথা নিচু করে নিজের রুমে চলে গেল।চোখ থেকে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল তার। তার জন্য তার বাবা মাকে প্রতি মুহূর্তে অপমানিত হতে হচ্ছে। আজ যদি সে তার শশুর বাড়িতে থাকতো তাকে আর তার বাবা মাকে হয়তো এতো অপমানিত হতে হতো না। কিন্তু কি করে যাবে সে ওই বাড়িতে, যেই বাড়িতে অনুকে কেউ সহ্যই করতে পারে না। যেখানে প্রতি মুহূর্তে তাকে অত্যাচারিত হতে হবে। যেখানে তার স্বামী তাকে তার আশে পাশেও দেখতে চায় না। কোন স্বামীর সাথে সংসার করবে সে, যেই স্বামী অন্য মেয়ে ভালোবাসে।

বিছানার চাদর শক্ত করে চেপে ধরে বসে আছে অনু। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে তার মা ঘরে ঢুকে পড়লেন। অগ্নিদৃষ্টি অনুর দিকে নিক্ষেপ করে বললেন,

‘তোর জন্য আর কতো অপমান সহ্য করতে হবে বলতে পারিস অনু। আমি আর পারছি না রে। সাত বছর হয়ে গেছে আর কতোদিন অনু আর কতোদিন।’

অনু কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলল,

‘মা আমি ওই বাড়িতে কিছুতেই যাব না। আমি একজন ডক্টর, নিজের খেয়াল রাখতে পারি। আর আমি ওকে কিছুদিনের মধ্যেই ডিভোর্স দিতে দেব।’

‘এই কাজ করলে তুই আমার মরা মুখ দেখবি।’

এই কথা বলে আমেনা বেগম ঘর থেকে চলে গেলেন। অনু ছলছল চোখে তার মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। অনু এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক হাত দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। আজ তাদের বাড়িতে তার ফুফাতো বোনের ছেলের সুন্নাতে খতনা ছিল। অনুর ফুফাতো বোন সুইজারল্যন্ডে থাকে। অনুর ফুফাতো বোন মানে আরশির শাশুড়ির অনেক ইচ্ছা ছিল তার নাতির মুসলমানি তার নিজের দেশে হবে। যার জন্যই তারা এসেছে অনুদের বাড়িতে।

অনুর ভালো নাম মাহিয়া জান্নাত অনু। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল দেশের টপ বিজনেস ম্যান আতীব চৌধুরির একমাত্র ছেলে রাফাত চৌধুরির সাথে। তখন মাত্র কয়েকদিনের জন্য রাফাত দেশে এসেছিল আর তার মধ্যেই বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায় অনু আর রাফাত। রাফাত অনুকে কখনো বিয়ে করতে চায়নি কিন্তু নিজের বাবার অপকর্মের ফল তাকে ভোগ করতে হয়েছিল। অনু আর রাফাতের বিয়েটা ধুমধাম করে হয়নি। অনুর বাড়িতে রেজিস্টার পেপার পাঠিয়ে দিয়েছিল চৌধুরি ফ্যামিলি যেখানে রাফাতের সাইন করা ছিল। রাফাত এই বিয়ে কিছুতেই মানে নিতে পারেনি যার কারনে সে আবার লন্ডনে ফিরে যায়।

নিজের ঘরের সবকিছু গোছাচ্ছিল অনু। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে অনুর তিন বান্ধবী তড়িঘড়ি করে ঢুকে পড়ল। অনু কিছু বলবে তার আগেই ইরা অনুর হাত চেপে ধরে বলল,

‘অনু এইসব কি শুনছি? তোর বিয়ে হয়েছে তাও আবার সাত বছর আগে?’

আরেকজন জিজ্ঞাসা করল,

‘তোর বয়স তো এখন পচিশ বছর তাহলে তোর বিয়ে হয়েছে আঠারো বছর বয়সে?তুই তো আমাদের এই বিষয়ে কিছুই বলিসনি রে।’

অনুর তিন বান্ধবী অনুর দিকে তাকিয়ে অনুর উত্তরের অপেক্ষা করছে। অনু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয়েছে তার বন্ধবীদের জিজ্ঞাসু চেহারার দিকে। অনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বিছানা গোছাতে শুরু করল। অনুর আরেক বান্ধবী মিমি অনুকে ঝাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,

‘কি রে কিছু বলছিস না কেন?আমরা কি তোর এতই পর যে আমাদের বলা যাবে না?’

অনু এবার নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। ডুকড়ে কেঁদে দিল সে। নিজের হৃদয়ের সব কষ্ট যেন এখন এই কান্নার মাধ্যমে বের হয়ে আসছে। অনুর এই অবস্থা দেখে তার বান্ধবীরা চুপ হয়ে গেল। অনু কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। মিমি, ইরা আর লারা অনুর পাশে বসে পড়ল।লারা অনুর কাধে হাত রেখে বলল,

‘অনু কাঁদিস না প্লিজ। কি হয়েছে আমাদের বল।দেখি আমরা কিছু করতে পারি কি না।’

‘কি বলবো তোদের? যা শুনেছিস তাই সত্যি।’

‘কি করে বিয়েটা হলো সেইটা তো বল।’

‘সব পরে বলবো তোদের। এখন না প্লিজ।’

সবাই চুপ হয়ে গেল। অনু চোখ মুছে ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল। ইরা, মিমি, লারা আর অনু এরা সবাই ডিএমসি র ডক্টর। মাত্র দুই বছর আগে অনু ডক্টর পাস করেছে। অনুর যখন আট বছর তখন তার মামা তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে গেছিল। সেখানেই তার মামা তার পড়াশোনার ব্যাবস্থা করে দেন। অনু টেন পাস করার পরপরই তার পড়াশোনার খরচ তার মামাকে বেশি একটা বহন করতে হয়নি। অনুর পরিবারের অবস্থা বেশি একটা ভালো নয় যার কারনে তাদের পক্ষে অনুর পড়াশোনার খরচ ওঠানো সম্ভব হয়নি। কিন্তু বর্তমানে তাদের পরিবারের অবস্থা খুব সচ্ছল।

__________

রাতে অনু আর তার বান্ধবীরা ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। হঠাৎ অনুর ফুফাতো বোনের ননদ এসে হুমরী খেয়ে পড়ল ছাদের উপর। অনুর ফুফাতো বোনের ননদ রিয়া অনুকে বেশি একটা পছন্দ করে না। ইভেন তার থেকে বেশি স্মার্ট কোনো মেয়েকেই সে পছন্দ করে না। অনু দৌড়ে গিয়ে রিয়াকে উঠতে সাহায্য করল। রিয়া উঠে দাড়াতেই অনুর হাত থেকে নিজের হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। অনু একটা বাকা হাসি দিয়ে বলল,

‘রিয়া সারাদিন এভাবে ফোনের মধ্যে নিজের চোখ কেন গুজে রাখো বলো তো। দেখলে তো আমার সামনে কীভাবে পড়ে গেলে তুমি।’

‘লিসেন অনু, আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছি বুঝেছো। তাই তোমার সাথে কথা বলে আমি আমার মুড নষ্ট করতে চাই না।’

‘মি টু।’

অনু কথাটা বলেই আবার বসে পড়ল তাদের সাথে। রিয়া অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনুর দিকে। কিন্তু অনুর এই নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সে তো তার ফ্রেন্ডদের সাথে আড্ডা দিতে ব্যস্ত।

প্রায় আধাঘন্টা পর আচমকা রিয়া চিৎকার দিয়ে উঠল। কিন্তু এই চিৎকার ভয়ের নয়, উল্লাসের। অনু আর তার ফ্রেন্ডরা রিয়ার দিকে ঘুরে তাকালো। রিয়া আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। মিমি বিরক্ত হয়ে বলল,

‘এই তুমি কি পাগল নাকি। এভাবে লাফাচ্ছো কেন? তোমার স্কার্টটা এমনিতেই অবেক ছোট যার কারনে তোমার পা সম্পুর্ন দেখা যাচ্ছে। লাফালাফি করে আরো দেখানোর কি দরকার?’

রিয়া ক্রুদ্ধ চোখে মিমির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মিমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্য দিকে নিজের চোখ আবদ্ধ করে নিল। রিয়ার চিৎকার শুনে নীচ থেকে রিয়ার মা চলে এলেন।

চলবে,

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ০২
#সুমাইয়া_আফরিন

অনুরা দুই বোন এক ভাই। অনুর বাবা আর রাফাতের বাবা ছোটবেলার বন্ধু ছিল। রাফাতের বাবা বিরাট বড়লোক হলেও তাদের মধ্যে ঘনিষ্ট বন্ধুত্ব ছিল। রাফাতের বাবা জমিদার বংশের ছেলে। যার কারনে গ্রামে তাদের নাম ডাক বেশি। রাফাতের বাবা আলি উদ্দীন চৌধুরি মাঝে মধ্যেই অনু বাবা ইসাক আহমেদকে তার ক্ষেতের কাজে সাহায্য করতো। একদিন হঠাৎ একটা সামান্য ক্ষেতে পানি দেওয়াতে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়ে যায়। ঝগড়াটা প্রথমে ছোট রুপ ধারন করলেও পরবর্তীতে বড় রুপ ধারন করে। তাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। অনুর মা আর রাফাতের মা বিষয়টা থামানোর অনেক চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। ঝগড়াটি এমন পর্যায় চলে যায় যে আলি উদ্দীন চৌধুরি প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে থাকে। কারন ইসাক আহমেদ গ্রামের সবার সামনে তাকে অনেক অপমান করেছেন। কিন্তু আলি উদ্দীন চৌধুরিও কম অপমান করেনি ইসাক আহমেদকে। তখন অনুর বয়স মাত্র আট বছর। আর রাফাতের বয়স ১১ বছর। আলি উদ্দীন চৌধুরি প্রতিশোধের তাড়নায় অনুর ক্ষতি করার চেষ্টা করে। একদিন অনু মাঠে মেয়েদের সাথে বৌছি খেলছিল। খেলয়ে খেলতে প্রায় সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। অনু তাড়াতাড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু কিছুদুর যেতেই অনু লক্ষ্য করল তালে কয়েকটা বখাটে ছেলে পিছু করছে। প্রতেকটা ছেলের বয়স ২০–২৩ এর মধ্যে হবে। অনু ছেলেগুলোকে দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। তাই অনু দৌড়াতে শুরু করে। অনু পেছনে তাকিয়ে দেখল ছেলেগুলোও দৌড়াতে শুরু করেছে তার পেছন পেছন। অনু আরো জোড়ে দৌড়াতে শুরু করল কিন্তু বেশি দূর আর আগাতে পারল না। আচমকা পেছন থেকে একটা ছেলে অনুর হাত চেপে ধরল। অনু আপ্রান চেষ্টা করতে থাকলো নিজের হাত ছাড়ানোর কিন্তু কোনোভাবেই সফল হচ্ছে না সে। কারন অনুর শক্তির থেকে চারজন ছেলের শক্তি দশগুন বেশি।অনু ভয় পেয়ে কেঁদে দিল। অনেক আকুতি মিনতি করতে থাকলো তাদের কাছেকিন্তু ছেলেগুলো অনুকে টানতে টানতে একটা ঘরে নিয়ে গেল। রাস্তায় এমন কেউ ছিল না যে অনুকে একটু সাহায্য করবে। অনুকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখলো ছেলেগুলো। অনুর হাত পা মুখ সব বেধে রেখেছে ছেলেগুলো। অনুর কাদতে কাদতে হেচকি উঠে গেছে। কিন্তু বখাটে ছেলেগুলো নির্দয় মনের মানুষ। টাকার লোভে তারা অন্ধ। হঠাৎ দরজা ঠেস দিয়ে আলি উদ্দিন চৌধুরি ভেতরে ঢুকলো। অনু তাকে দেখ্রি চেচাতে থাকলো এই আশায় যে আলি উদ্দিন চৌধুরি তাকে বাঁচাবে। ছোট বেলা থেকেই অনুকে অগাধ ভালোবাসা দিয়ে এসেছেন আলি উদ্দিন চৌধুরি। অনু ছোট বেলা থেকেই জানতো তার দুইটা বাবা। একজন ইসাক আহমেদ আরেকজন আলি উদ্দিন চৌধুরি। কিন্তু আজ এই বাবাই তার জীবনটা কলঙ্কে ভরিয়ে দিতে চাইছেন। জীবনের সব সুখ শান্তি কেড়ে নিতে চাইছেন। অনু মুখ বাধা অবস্থায় কন্ঠনালি দিয়ে শব্দ করে যাচ্ছে কিন্তু অনুর এই বেদনার চিৎকার আলি উদ্দিন চৌধুরির কানে পৌছাচ্ছে না। তার কানে শুধু তো একটাই শব্দ ভাসছে ‘প্রতিশোধ’। আলি উদ্দীন চৌধুরি অনুর সব চিৎকার উপেক্ষা করে বখাটে ছেলেগুলোর লিডারের কানে কিছু একটা ফিসফিস করে চলে গেলেন। আলিফ উদ্দীন চলে যাওয়ার সময় অনু চিৎকার যেন আরো বেড়ে গেল। বখাটে ছেলেগুলোর লিডার অনুর গোঙানির শব্দ আর সহ্য করতে না পেরে অনুকে একটা ধমক দেয়। অনু ধমক খ্র‍্যে সর্বশান্ত হয়ে যায়। অনু এটাও জানে না তার সাথে কি হতে চলেছে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছে যা হবে খুব কষ্টকর হবে। বখাটে ছেল্রগুলোর লিডার অনুর হাত পায়ের বাধন খুলে হুমড়ে পড়ল তার উপর। রাক্ষসের মতো কুড়ে কুড়ে খেতে লাগল অনুকে। অনু ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠছে কিন্তু সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই ছেলেগুলোর। অনুর কানে ছেলেগুলোর বিদঘুটে অট্টহাসি ভেসে উঠছে। অনু ব্যথায় কাতড়ে উঠছে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায় জ্ঞান হারায় সে।

অনুর বাবা, মা আর গ্রামবাসি এতক্ষনে প্নুকে খুজতে বের হয়ে গেছে। অনুর মায়ের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। হঠাত অনুর বাবার চোখ পড়ে এক বাড়ির দিকে। বাড়িটি পরিত্যাক্ত, অনেক বছর হয়ে গেছে ওই বাড়িতে কেউ থাকে না। কিন্তু আজ সেই বাড়িতে লাইট জ্বলছে। অনুর বাবাসহ সবার খটকা লাগে বিষয়টিতে। গ্রামবাসি সবাই মিলে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেলে। দরজা ভাঙতেই নির্বিকারভাবে তাকিয়ে থাকে বখাটে ছেলেগুলোর দিলে। আনুর মা অনুকে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিয়ে অনুর কাছে দৌড়ে চলে যায় সে। অনুর অনেক জায়গায় কেটে গেছে যার কারনে রক্ত বের হচ্ছে। অনুর বাবা আর গ্রামবাসি বখাটে ছেলেগুলোকে মারতে শুরু করে। বখাটে ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসা করতেই ছেলেগুলো ভয়তে আলি উদ্দীন চৌধুরির নাম বলে দেয়। আলি উদ্দিন চৌধুরির নাম শুনতেই ইসাক আহমেদ অবাকে চুড়ান্ত সীমায় পৌছে যায়। সে কখনো ভাবতেই পারেনি যে প্রতিশোধের বসে এমন কাজ করে বসবেন তিনি। বখাটে ছেলেগুলোর কথা এক ক্যামেরাতে রেকর্ড করে রাখা হয়। ইসাক আহমেদ বেশি একটা শিক্ষিত মানুষ নন তাই আগে পুলিশের কাছে না গিয়ে গ্রামের মাতব্বারের কাছে যান। এক কালে গামের জমিদার আলি উদ্দীন চৌধুরির বংশ থাকার কারনে গ্রামের মাতব্বার ছিলেন আলি উদ্দিনের বাবা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ একজন মানুষ। তাই ইসাক আহমেদ বিশ্বাস করে তার কাছেই গেলেন। কিন্তু ছেলের কাছে সব বাবাই ব্যহায়া হয়ে যায়। আলি উদ্দিনের বাবা সব কিছু শুনে থম মেরে বসে থাকলেন। আলি উদ্দিন তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন মাথা নিচু করে এখন তার মাথায় বুদ্ধি এসেছে যে সে কি অপরাধ করে ফেলেছেন।আলি উদ্দিন ইসাক আহমেদের পা জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলেন। নিজের মেয়ের সাথে কি করে এমনটা সে করতে পারল এটাই তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। নিজের ছেলেকে জেলের মধ্যে দেখতে পারবেন না হাফিস চৌধুরি(আলি উদ্দীন চৌধুরির বাবা)।তাই এক প্রস্তাব দিয়ে বসলেন ইসাক আহমেদকে।হাফিস চৌধুরি ইসাক আহমেদকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘আমার ছেলে তোমার মেয়ের সাথে যা করেছে তা ক্ষমার যগ্য নয়। কিন্তু তোমার মেয়ে যখন বড় হবে তখন তাকে কে বিয়ে করবে এটা কি ভেবে দেখেছো? আমার ছেলে জেলে চলে গেলেও তোমার মেয়ের মুখে যে কলঙ্ক লেগে গেছে তা তো সরানো যাবে না তাই না।’

ইসাক আহমেদ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হাফিস চৌধুরির দিকে। কারন তার কাছে কথাটি ভাবার মতো। ইসাক আহমেদ অনেকক্ষন চুপ থাকার পর মুখ খুললেন,

‘তাহলে এখন কি করনীয়?’

‘যদি রাফাতের সাথে অনুর বিয়ে দেওয়া যায় তাহলে?’

‘আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।’

‘অনুর আঠারো বছর হওয়ার সাথে সাথে রাফাতের সাথে অনুর বিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু যদি রাফাতের সাথে অনুর বিয়ে দিতে চাও তাহলে আমার ছেলেকে জেলে পাঠানো যাবে না।’

ইসাক আহমেদ কিছুক্ষন ভেবে রাজি হয়ে গেলেন বিশয়টায়। কিন্তু রাজি হতে পারল না রাফাতের মা কাকলি সরকার আর রাফাত।ঘোর বিপত্তি করলো এই সিদ্ধান্তে। কারন রাফাতের মায়ের ইচ্ছা এক সুন্দরী ও এজুকেটেড মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে দিবেন। অনুকে দেখতে বেশি সুন্দর না। শ্যামলা আর অনেকটা টেপার মতো দেখতে। রাফাতও অনুকে বেশি একটা পছন্দ করে না৷ কিন্তু সব শেষে মেনে নিলেন এই সিদ্ধান্ত। রাফাতকে তার মা তার পরেরদিনই বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। আর অনুকে তার মামা এখান থেকে তাকে নিয়ে গেলেন। কারন এখানে থাকলে অনুকে অনেক অপমান সহ্য করতে হবে। অনু ঢাকায় গিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিল। অনুর বাবার কাছে আজও সেই রেকর্ড রয়েছে যার কারনে অনুর আঠারো বছর বয়স হতেই রাফাত আর অনুর বিয়ে হয়ে গেল। আঠারো বছর বয়সেও অনু চেহারা এত সুন্দর হয়নি। রাফাতের কাছে অনুর ছবি দিতেই রাফাত টুকরো টুকরো করে ছিড়ে উড়িয়ে দিল। রাফাতের গায়ের রঙ আর চেহারা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু রাফাত একজন এজুকেটেড মেয়ে চায়। রাফাত জানে অনু একটা অশিক্ষিত মেয়ে। অনুর কোনো যগ্যতা নেই রাফাতেরপাশে দাড়ানোর। রাফাতের মাও অনুর বিষয়ে এইসব জানে। কাকলি সরকার প্রতিনিয়ত অনুর বাবা মাকে অপমান করে। এই বলে যে অনু অশিক্ষিত আর গাইয়া মেয়ে। অনুর বাবা মা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে অনু অশিক্ষিত নয়। কিন্তু তারা এই কথা মিথ্যা হিসেবে ধরে নিয়েছেন। অনেক বোঝানোর পরেও তারা কিছুই বুঝতে চাননি। এক পর্যায়ে অনুর বাবা মাকে মিত্থুক উপাধি দেন তারা।

আর এই দিকে বিয়ে হওয়ার পর থেকে সংসারকরার নতুন স্পন দেখে যাচ্ছিল অনু। রাফাতের ছবি নিজের ঘরের দেয়ালে আটকে রেখেছে সে। প্রতি রাতে রাফাতের ছবি দেখে সে ঘুমিয়ে পড়ে। অপেক্ষায় রয়েছে কবে রাফাত তাকে নিতে আসবে। যেদিন থেকে ভালোবাসা বুঝতে পেরেছে অনু সেদিন থেকে রাফাতই তার জীবন। তাই রাফাতের নাম্বার জোগাড় করে ফোন দেয় রাফাতকে।কয়েকবার রিং হওয়ার পিরে অপর পাশ থেকে কেউ রিসিভ করে। ভেসে আসে রাফাতের কন্ঠস্বর। রাফাতের গলা শুনেই অনুর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়। রাফাত কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে জিজ্ঞাসা করে,

‘হ্যালো কে? আরে ভাই কথা বলার ইচ্ছা যদি নাই থাকে তাহলে ফোন কেন দিয়েছেন?’

অনু তোতলাতে তোতলাতে বলল,

‘আআমি অনু।’

‘কেহ অনু?হাউ ডেয়ার ইউ? আমাকে ফোন করার সাহস কোত্থেকে পেলি তুই?তোর মতো মেয়েকে স্মি বউ হিসেবে মানি না বুঝলি।আর দ্বিতীয়বার আমাকে ফোন করবি না।’

অনু এই কথাগুলোর জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অঝস্র পানির ফোটা। মুহূর্তেই নিজের মন থেকে মুছে ফেলে সে রাফাতকে। নিজের চোখ মুছে নিজেকে প্রমিস করে সে যে আজ থেকে বই হবে তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তার ক্যারিয়ারের থেকে বড় আর কিচ্ছু নয়।

______________

ঘরের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে অনু। মায়ের ডাকে অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সে। অনুর মা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে বলল,

‘অনু শুনেছিস আজকে রাফাত ঢাকা থেকে আসছে।’

‘হুমম।’

অনুর মা খুব ভালো করেই বুঝে গেলেন যে রাফাতের আস্তে অনুর বিন্দু মাত্র উল্লাস নেই। অনু বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। রাফাত যে আজকে আসবে তা অনু কালকে রাতেই জেনে গেছে। কালকে রাতে রিয়া রাফাতের আসা নিয়েই এত উত্তেজিত ছিল। কারন রাফাত রিয়ার ক্রাশ। রিয়া রাফাতের প্রেমে মশগুল হয়ে আছে। রাফাত দেশে ফিরেছে আরো দুই বছর আগে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার সাথে অনুর দেখা হয়নি। দুইজন একই জেলায় থাকলেও তাদের দেখা হয়নি। রাফাতের প্রেমে শুধু রিয়া নয় তার ফ্রেন্ডরাও পাগল।বিশেষ করে ইরা আর লারা। রাফাতের বিষয় কিছু বললেই তারা রেগে যায়। রিয়ার মতো ইরা আর লারাও খুব উত্তেজিত যে তারা রাফাতের সাথে দেখা করবে।

আচমকা ঘরে কেউ প্রবেশ করতেই অনু চমকে উঠল। পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখল ইরা, লারা আর মিমি এসেছে। অনু একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলল। ইরা,লারা আর মিমি অনুর পাশে বসে তার বিয়ের ঘটনা জানতে চাইল। অনুর এই তিনজন বান্দবীই তার অনেক কাছের। তাই অনু বিনা দ্বীধায় সব কথা খুলে বলল তাদের। কিন্তু অনু এটা বলল না যে রাফাত তার হাজবেন্ট।শুধু এইটুকু বলেছে যে তার হাজবেন্ট অনেক রিচ। অনু খেয়াল করল সবার চোখে পানি রয়েছে। অনু একটা হাসি দিয়ে বলল,

‘আরেহ বাদ দে তোহ এইসব কথা।’

‘তোর হাজবেন্টের পিক আছে।'(মিমি)

‘না।'(অনু)

‘এমন মানুষের সাথে তোর সংসার করার দরকার নেই ‘(ইরা)

‘আমিও তো সেইটাই চাইছি। শুনেছি ও নাকি কাওকে ভালোবাসে।'(অনু)

‘অনু তোর এখনো পুরো জীবন পড়ে আছে। তুই ছেড়ে দেহ ওই ছেলেকে। আর জেলে ঢুকিয়ে দেহ ওর বাবাকে।তোর সাথে যা করেছে তা ক্ষমার অযগ্য।'(লারা)

‘তাই ভাবছি।'(অনু)

ঘরে বসে বোরিং লাগায় অনু আর তার বন্ধুর ছাদে চলে যায়।ছাদে গিয়ে দেখে,

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে