#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ০৯
#সুমাইয়া_আফরিন
রাসেল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘আপু তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছো কেন?’
অনুর দিক থেকে কোনো প্রতিউত্তর পাওয়া গেল না। অনু দাঁত শক্ত করে ব্যাগ গোছাতে লাগল। ইরা অনুর পক্ষ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞাসা করল,
‘কি রে?কিছু জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে তোকে?’
অনু চুপ করে রইল। অনু একবার আলমারিতে যাচ্ছে আর নিজের জামা কাপড় বের করে আনছে। কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর অনু নিজের মুখ খুলল।
‘শুধু আমি না, তোরাও গোছানো শুরু কর। আমি আর এক মুহূর্তও বাড়িতে থাকতে চাই না।’
‘কিন্তু কেন? যেইটা ঘটল ওখানে সেইটার সাথে থাকা না থাকার কি সম্পর্ক?(মিমি)
অনু বজ্রচোখে মিমির জিজ্ঞাসু মুখস্রির দিকে তাকালো। দাঁত কিটমিট করে বলল,
‘একটুপর মা আসবে। তারপর বাবা আসবে।এসেই আমাকে কথা শোনানো শুরু করবে। আমার এখন ইচ্ছা করছে না মা বাবার ওই টিপিকাল কথাগুলো শুনতে। তাদের কাছে শুধু আমিই ভুল। তারা যে আমার সাথে এতকিছু করল সেইটা কিছু না!’
অনুর বেদনা মাখা কথাগুলো শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। অনু অনেক শক্ত একটা মেয়ে। কিছু খারাপ কিছু হলে নিজেকে অনেক শান্ত রাখতে জানে সে। কিন্তু আজকে সেই শান্ত মেয়েটি এত রেগে যাওয়ায় সবাই চমকে গেছে।
ঘরটায় এক বিদঘুটে নিরবতা বিরাজ করল কিছুক্ষন। অনুর ব্যাগ গোছানো প্রায় শেষ। মাত্র দশ দিনের ছুটি পাওয়ায় বেশি জামা কাপড় আনেনি সে। এলোমেলো করে গোছানো জামাকাপড়সহ ব্যাগের চেইন বন্ধ করে ফেলল অনু। ব্যাগ গোছানো শেষে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনু। একটি থ্রিপিছ বের করে রেখেছিল যাওয়ার জন্য। সেই জামাটি নিয়ে অনু ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। অনু ওয়াশরুমে ঢোকার আগেই লারা শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
‘অনু আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিবি?’
অনু ভ্রু কুচকে পেছনে ঘুরে তাকালো। লারার দিকে জিজ্ঞাসু চোক্ষুতে তাকিয়ে রইল সে। শুকনো ঢক গিলে অনু লারাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কি প্রশ্ন?’
‘রাফাতের দোষটা কোথায়? তুমি ওকে মেনে কেন নিচ্ছিস না?’
‘এই প্রশ্ন তুই করছিস লারা? একটা ছেলে যার বাবা আমার সাথে এতকিছু হওয়ার পরেও চুপ করে আছে তুই তার পক্ষ নিচ্ছিস? যার বউ থাকা সত্ত্বেও একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করে বেড়ায় তুই তাকে সাপোর্ট করছিস?’
‘রাফাত তার বাবার অন্যায় দেখে চুপ করে আছে, তুই কি চুপ করে নেই? তুইও তো চুপ করে আছিস। আর তুইও তো অতীতের সবকিছু ভুলে রাফাতের সাথে সংসার করতে চেয়েছিলি।আর তুই কখনো দেখেছিস রাফাতের গার্লফ্রেন্ডকে? আর তুই কোথা থেকে জানলি ওর গার্লফ্রেন্ড আছে?’
অনু লারার কথা শুনে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ লারার প্রত্যেকটা কথা অনুর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসব কি বলছে লারা?অনু ইরা আর মিমির দিকে তাকিয়ে দেখল তারাও তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অনু হতাশার নিশ্বাস ফেলে থ্রি পিছটি বিছানায় রাখল। তারপর অনু চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বলল,
‘আমি কি চেষ্টা করছি না লারা? বাবাকে তো আমি বলছি রেকর্ডিংটা দিতে। কিন্তু বাবা তো দিচ্ছে না। আর দেড় বছর আগে রাফাতের বোন আমার মাকে ফোন করে বলেছিল যে রাফাত অন্য কাউকে ভালোবাসে। ও সংসার করতে চায় না আমার সাথে।’
‘তুই যদি এতই চেষ্টা করতি তাহলে এতদিনে পুলিশে কম্পপ্লেইন করার কথা ছিল। পুলিশে কামপ্লেইন করলে তোর বাবা একদিন না একদিন দিয়েই দেবে রেকর্ডিংটা। আর রইল রাফাতের কথা, তুই তো এখন অর সাথে সংসার করতেই চাচ্ছিস না তাহলে?
‘তুই কি বলছিস লারা? যেই ছেলে অন্য কাউকে দুই বছর ধরে ভালোবাসে তার সাথে আমি কি করে সংসার করবো?’
‘ঠিক আছে। দরকার নেই তোর সংসার করার। বাট তুই তো ওকে ওর বাবার পাপের ভাগিদার ভাবছিস। কেন অনু? কেন?যখন ঘটনাটি ঘটে, তখন তোর মতোই রাফাত অনেক ছোট ছিল। প্রমান তোর এত কাছে থেকেও তুই পারছিস না আর ও এত দূরে থেকে পারবে? তুই কি একবারও রাফাতকে বলেছিস যে, রাফাত আমি তোমার বাবাকে শাস্তি দিতে চাই। আই নিড ইয়র হেল্প।’
‘আমি কেন চাইবো?আমার দরকার নেই ওর হেল্প।আমি পারবো ওর বাবাকে শাস্তি দিতে লারা।’
‘দেখ অনু, আমি কথা বাড়াতে চাই না। তোকে একটু খুলে বোঝাচ্ছি আমি। তুই এখন প্রচুর টেন্সড হয়ে আছিস।’
অনু ছলছল চোখে লারার দিকে তাকিয়ে আছে। অনুর মাথা রিতিমতো ঘোরা শুরু করে দিয়েছে। হ্যাং হয়ে যাচ্ছে তার মস্তিষ্ক।লারা অনুর হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল। তারপর অনুর পাশে বসে বলল,
‘লিসেন অনু, সাত বছর হয়ে গেছে তোদের বিয়ের। সাত বছর আগে তুই ফোন করেছিলি রাফাতকে৷ তখন রাফাত তোকে অনেক কথা শুনিয়েছে। আর তুই ওর সাথে আর কখনো যোগাযোগ করিসনি। এমনকি ওর নাম্বার ব্লক লিস্টে রেখে দিয়েছিস।অ্যাম আই রাইট?’
অনু বিষ্মিত চোখে উত্তর দিল,
‘হুমম।’
‘তুই দেড় বছর আগে জেনেছিস যে রাফাত দুই বছর ধরে কাউকে ভালোবাসে। তারমানে রাফাত গত দেড় বছর আগে নিজের লাইফে কাউকে জায়গা দেয়নি।’
‘ঠিক বলেছিস,কাউকে জায়গা দেয়নি ও।আমাকেউ দেয়নি।’
লারা কিছু বলবে তার আগেই মিমি বলল,
‘তুই আগে রাফাতের সাথে কথা বল। যদি রাফাত তার বাবাকে শাস্তি দিতে না চায় তাহলে তার সাথে ডিভোর্স নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ নে। কারন তোর বাবা একটা পেপারে সাইন করেছে যেখানে স্পস্ট লেখা আছে যে, রাফাত আর তোর বিয়ের বিনিময়ে রাফাতের বাবাকে তার অপরাধের কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না।’
অনু এবার বুঝতে পারল তাকে কি করতে হবে। অনু ডিভোর্স না নিয়ে কিছুই করতে পারবে না ওই চুক্তির কাগজটা জন্য। অনু সিদ্ধান্ত নিল সে রাফাতের সাথে কথা বলবে। কিন্তু রাফাত যে তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করবে তা অনু বেশ বুঝতে পারছে। রাফাত কখনোই তার বাবাকে শাস্তি দিতে চাইবে না। নিজের বাবার কষ্ট কখনো কোনো ছেলেই সহ্য করতে পারবে না।
অনু বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। অনু সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে সবাই। আজকে আমি এখান থেকে যাবোই। আমার ভালো লাগছে না এখানে।’
ইরা, লারা আর মিমি খুব ভালোই বুঝতে পারছে যে অনু এখানে আর এক মিনিটও থাকতে চায় না। তাই অনুর কথা মতো সবাই রেডি হয়ে যায়। কিছুক্ষন পর অনুর মা চলে আসেন। অনুকে চলে যেতে দেখে তিনি অনেক কষ্ট পেলেন কিন্তু প্রকাশ করলেন না। অনুর বাবা আর ভাই রাসেল অনু আর অনুর বন্ধুদের বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসলো।কিছুক্ষনের মধ্যেই বাস এসে যাওয়ায় অনু আর তার বান্ধবীরা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
___________
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে রাফাত। হৃদয়ে জমে থাকা কষ্টগুলো সিগারেটের ধোয়ার সাথে উড়িয়ে দিতে চাইছে সে। রাফাতের চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে। চিৎকার করে কাঁদতে চাইছে সে। বুকের ভেতরে বসবাসরত বেদনাগুলো চাপা পড়ে গেছে হৃদয়ের গহিনে।
পনেরো বছর ধরে রাফাত কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেনি৷ কারন তার বাবা তাকে বলেছিল কোনো মেয়ের সাথে কথা না বলতে। বাবাকে প্রচন্ড ভালোবাসার কারনে রাফাত মেনে নেয় বাবার আদেশ। রাফাত কখনোই বুঝতে পারেনি তার বাবা কেন এমন আদেশ দিল তাকে। আর তার মা কেন এভাবে সবার কাছে থেকে এত দূরে পাঠিয়ে দিল তাকে। মনের ভেতর একই প্রশ্ন ঘুরপাক খেত তার।
আমেরিকায় কোনো মেয়ে ফ্রেন্ডবিহীন জীবন কাটতে থাকে তার। বিদেশে ১০ বছর কাটানোর পর রাফাত নিজের বাড়িতে সাময়িক সময়ের জন্য সবার সাথে দেখা করতে আসে। এই দশ বছরের মধ্যে একবারও রাফাতকে বাড়ি ফিরতে দেয়নি কাকলি সরকার ও আলি উদ্দিন চৌধুরি। রাফাত বাড়িতে দুইদিন থাকার পর জীবনের সব থেকে বড় ধাক্কাটা পায়।
হঠাৎ কাকলি সরকার ও আলি উদ্দিন চৌধুরি রাফাতের সামনে কয়েকটা পেপারস দিয়ে বলে সেখানে সাইন করে দিতে। রাফাত পেপারসগুলো হাতে নিয়ে পড়তে থাকে। পেপারসে লেখাগুলো পড়তেই রাফাত চমকে যায়। রাফাতের মাথায় যেন বাজ পড়ল। রাফাত বজ্র চোখে তাকিয়ে ছিল তার বাবা মায়ের দিকে। পেপারসগুলো ছিল অনু আর রাফাতের বিয়ের রেজিস্টার পেপার।
রাফাত পেপারগুলো ছুড়ে মেরে তার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করল,
‘What is this mom? আমার মত না নিয়ে তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করলে কীভাবে?আর কার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে?’
কাকলি সরকার অস্রুমাখা চোখে তাকিয়ে ছিলেন রাফাতের দিকে। আলি উদ্দিন চৌধুরি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেইদিন।কাকলি সরকার কয়েকটা শুকনো ঢক গিলে রাফাতকে বললেন,
‘সাইন করে দে বাবা। নয়তো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে তোর বাবার। দয়া কর আমাদের উপর।’
রাফাত হতভম্ব হয়ে যায় তার মায়ের কথায়। তার মা কি বলছে তার কিছুই বুঝতে পারছে না রাফাত। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। মায়ের অধিক অনুরোধে রাফাত বাধ্য হয় সাইন করতে। রাফাতের মা রাফাতকে অনুর একটা ছবি দেয়। অনু দেখতে বেশি একটা সুন্দর ছিল না। কিন্তু রাফাত বিশ্বাস করে গুন বড় রুপ নয়। কিন্তু রাফাতের মা রাফাত কে বলেন অনুর রুপ গুন দুটোর মধ্যে একটাও নেই। রাফাত তার পরেও অনুকে নিজের বাবার জন্য মেনে নিতে রাজি ছিল। কিন্তু নিজের মায়ের অনুর বিষয়ে বিষাদময় কথা শুনে অনুকে ঘৃনা করতে থাকে সে।
তাই অনু একদিন ফোন করায় প্রচন্ড রেগে যায় সে। তাই নিজের অজান্তেই অনেক ক্রুদ্ধ ভাশায় অনুকে বকা দেয় সে। কিন্তু পরে এই বিষয়ে রাফাতের প্রচন্ড খারাপ লাগে। সে এতোটা রুড ভাবে না বললেও পারতো। প্রত্যেকটা মেয়ের সপ্ন থাকে বিয়ে করে সংসার করা। এই সপ্ন নিয়েই অনু তাকে ফোন করেছিল। সে কাজটি করে ভালো করেনি তাই অনুকে ফোন দিয়ে সরি বলতে চেয়েছিল সে।
কিন্তু তার আগে রাফাত জানতে চেয়েছিল অনুর সাথে কেন তার বিয়ে হয়েছে। নিজের মা বাবাকে অনেকবার জিজ্ঞাসা করার পরেও যখন সে জানতে পারলো না তখন অন্য বুদ্ধি বের করল সে। রহিম মিয়া নামে এক কর্মচারী প্রায় ত্রিশ বছর ধরে কাজ করছে তাদের বাড়িতে। অত্যন্ত অনুগত এবং সৎ মানুষ তিনি। তাই রাফাত নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে রহিম মিয়ার কাছ থেকে সবকিছু জানতে পারে।
সত্য ঘটনা জানার পর রাফাত নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ছাদে। তার সামনে রহিম মিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাফাত যেন কথা বলতে ভুলে গেছিল সেইদিন। ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিল রহিম মিয়ার দিকে। তার কাছে পুরো পৃথিবীটাই যেন অন্ধকার হয়ে গেছিল।
এত জঘন্য একটা অপরাধ করে তার বাবা বেঁচএ আছে কি করে সেইটাই বুঝতে পারছিল না রাফাত। নিজের বাবার প্রতি অকৃত্রিম ঘৃনা কাজ করছিল তার মধ্যে। হাতের মুঠো শক্ত করে ছাদ থেকে হনহম করে নেমে সোজা তার বাবার কাছে গেল সে।
নিজের বাবাকে সত্যি ঘটনা জিজ্ঞাসা করতেই আলি উদ্দিন চৌধুরির মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। রাফাতের আর বুঝতে বাকি রইল না সে যা শুনেছে সব সত্য। রাফাত তার বাবাকে চিৎকার করে বলল,
চলবে,