#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ০৮
#সুমাইয়া_আফরিন
রাফাত সর্বপ্রথম সেখানে উপিস্থিত হলো এবং প্রচন্ড হতাশ হলো সে। ঠিক যেই জিনিসটার ভয় পাচ্ছিল সেটাই হয়েছে। অনু কিছুক্ষন পর পৌছে গেল সেখানে। বাইরে যা ঘটছে এসবকিছু দেখে অনু ভীষন অবাক হয়ে গেল। সে কখনো আশা করেনি যে আজকের দিনে এমন কিছু একটা ঘটবে।
অনুর সামনে রাফাতের মা কাকলি সরকার মুখে যা আসছে তাই বললে অপমান করছেন অনুর মা হাফসা বেগমকে। হাফসা বেগম কিছু বলতে চাচ্ছেন কিন্তু কাকলি সরকার তা বলতে দিচ্ছেন। অনু কিছু বলতে যাবে হাফসা বেগম ইশারায় থামিয়ে দিল তাকে। অনুর বাবা ইসাক আহমেদও নেই সেখানে। তিনি এক কাজে অনেক আগেই চলে গেছেন এখান থেকে। অনুর পেছনে আরশি, রিয়া, লারা,ইরা আর মিমি হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে৷ এখানে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না তারা।
রাফাত নিজের মাকে চুপ করানোর অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছে না সে। রাফাত কিছু বলতে গেলেই তার ছোট বোন আর দাদি চুপ করিয়ে দিচ্ছে। কারন তারাও চায় অনুর পরিবারকে একটু অপমান করতে।রাফাতের মা অগ্নিদৃষ্টিতে হাফসা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি আছে টা কি তোমার মেয়ের হাফসা? একটা অশিক্ষিত গাইয়া মেয়ে তোমার। আমার ছেলের নখেরও যোগ্যতা নেই তোমার মেয়ের। জানো আমার ছেলে আজকে যে পাঞ্জাবী পড়েছে তার প্রাইস কতো? শুনলে হয়তো তুমি পাগল হয়ে যাবে। শুনেছি তোমার মেয়ে নাকি জব করে? কিসের জব করে শুনি? গার্মেন্টসে? নাকি হোটেলের প্লেট ধোয়ার কাজ করে?আমার ছেলের স্ট্যান্ডার্টে……..
আর কিছু বলতে পারলেন না কাকলি সরকার। অনুর রাগের বাধ ভেঙে গেছে। নিজের চোখের সামনে নিজের পরিবারের অপমান সহ্য করতে পারছে না সে। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করতে না পেরে কাকলি সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এক্সকিউজ মি আন্টি, আপনাদের ব্যাবহার প্রতিনিয়ত আমাকে অবাক করে দিচ্ছে। আপনার সো কল্ড হাজবেন্ট আমার সাথে যেটা করেছে সেই টার পরে আপনি কীভাবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমি শুধু সেইটাই ভাবছি। আপনার তো আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখার কথা। নিজের স্বামীর তো চরিত্র ঠিক নেই, তো এখানেই বোঝা যায় আপনার ছেলের চরিত্র কেমন হবে।আপনার ছেলের সাথে যদি আমার সংসার করার ইচ্ছা থাকতো তাহলে এতদিনে আমি আপনার বাড়িতে থাকতাম। আপনার ছেলের মতো মানুষের সাথে আমার সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই। আপনাদের মতো মানুষদের আমি ডিজার্ভ করি না। আর হ্যা,ডিভোর্স পেপার আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।’
অনু কথাগুলো বলে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে থাকল। রাগে তার চোখ রক্তবর্ণ ধারন করেছে। হাতের মুঠো বারবার শক্ত হয়ে আসছে তার। মাথার রগগুলো ফুলে উঠেছে অনুর। কাকলি সরকার বজ্র চোক্ষুতে অনুর দিকে তাকিয়ে আছেন। অনুর এমনভাবে প্রতিবাদ করবে তা কাকলি সরকার কখনো ভাবতেও পারেনি। মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে তার।কারন অনুর বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। তার স্বামী অনু সাথে যা করেছে তা ক্ষমার অযগ্য।
হাফসা বেগম অনুর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তার কাছে অনুর এভাবে কথা বলাটা ঠিক হয়নি। তার মতে তারা অনুর বিষয়ে কিছুই জানে না তাই এমন করছে। তাই তাদের সাথে শান্ত ভাবে কথা বলা উচিত। তাদের ভালোভাবেই বোঝানো প্রয়োজন।
অনু আর এক মুহূর্তও দাড়ালো না সেখানে। বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে বের হতে গেল সে। কিন্তু দরজার কাছে গিয়েই থেমে গেল তার পা। পেছন ফিরে তাকিয়ে রাফাতকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘খুব শিঘ্রই আমি আপনার হাজবেন্টকে জেলে পাঠাবো। মিস্টার আলি উদ্দীন চৌধুরিকে যদি আমি জেলের ভাত না খাইয়ে ছেড়েছি তাহলে আমার নামও হুমাশা রহমান অনু নয়।’
এবার রাফাত নিজেকে আর শান্ত রাখতে পারল না। নিজের পরিবারকে যদি কেউ অপমান করে তাহলে কেউ নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না। অনু তার বাবাকে অপমান না করে তার মা আর তাকে কেন অপমান করছে তা রাফাতের বোধগম্য নয়। কিছু না ভেবেই রাফাত অনুর দিকে তার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে রাগী কন্ঠে বলল,
‘শাট আপ অনু। আমার বাবা তোমার সাথে যা করেছে অনেক অন্যায় করেছে আই আগ্রি ইট। বাট আমার মা কিছু করেনি যে আচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখবে। আর আমার সম্পর্কে কি জানো তুমি? যদি তুমি আমার সম্পর্কে কিছু জানতে তাহলে আমাকে চরিত্রহীন বলতে না। সো, আগে নিজের বিহেভিয়ার ঠিক করো দেন কথা বলতে এসো।’
‘রিয়েলি? আপনার মা আমার মায়ের সাথে যে ব্যবহারটা করলো সেটা কি খুব ভালো একটা কাজ ছিল? আমার মাকে যা নয় তাই বলে ইনসাল্ট করেছেন তিনি। আর এরপরেও আপনি বলছেন আমি চুপ থাকবো?লিসেন মিস্টার রাফাত চৌধুরি, আপনি যেমন আপনার মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে চুপ থাকতে পারেননি, আমিও পারিনি।আর রইল আপনার কেরেক্টার, আপনি যদি এতই ভালো মানুষ হতেন তাহলে অন্য কোনো মেয়েকে ভালোবেসে তাকে নিজের স্ত্রী করার সপ্ন দেখতেন না।
রাফাত কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু অনু হাত উচু করে থামিয়ে দিল তাকে। কারন অনু আর কিচ্ছু শুনতে চায় না রাফাতের মুখে। রাফাতের প্রত্যেকটা কথা অনুর হৃদয়ে তীরের মতো গিয়ে আঘাত করে। অনুর নিষ্পাপ চোখ দিয়ে অনবরত নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে। অনু আর সহ্য করতে পারছে না এসবকিছু।
অনু বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অনুর এভাবে বের হওয়া দেখে ইরা, লারা আর মিমি প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। নিজেদের সামলাতে না পেরে অনুকে ডাকতে ডাকতে তারাও অনুর পেছন পেছন চলে গেল।
রাফাত ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে অনুর যাওয়ার পানে। নিজের অজান্তেই রাফাতের চোখে নোনা অশ্রু জল হানা দিয়েছে। রাফাত কখনো সপ্নেও ভাবতে পারেনি সাত বছর আগে বিয়ে করা মেয়েটিই তার ভালোবাসার সেই মেয়েটি। রাফাত নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলেছে অনুকে। রাফাত আর কিচ্ছু ভাবতে পারছে না। একটা শুকনো ঢক গিলে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সে।
বাড়িতে এখন বেশি কেউ নেই। শুধু মাত্র আরশি ও তার বাবা মা, রিয়া,কাকলি সরকার ও তার ছোট ছেলে ও ছোট মেয়ে আর হাফসা বেগম রয়েছেন।আরশি ও তার বাবা মা আর রিয়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছে। এখানে কি হচ্ছে কিছুই তাদের বোধগম্য নয়। সবাই শুধু এইটুকুই বুঝতে পেরেছে যে অনু আর রাফাতের বিয়ে হয়েছে তাও অনেক আগে।
রিয়া অবাকের চুড়ান্ত সীমায় ঝুলছে। রিয়ার বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে। রাফাত আর অনুর বিয়েটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তিনবছর ধরে রাফাতের ছবি নিজের বুকে চাপিয়ে ঘুমিয়েছে সে। রাফাত আর অনুর বিয়ে হলেও সে রাফাতকে ছেড়ে দেবে না এমনটা তার প্রতিজ্ঞা।রাফাতকে এ জনমে নিজের করেই ছাড়বে সে।
হাফসা বেগম কাকলি বেগমের কাছে গিয়ে অপরাধসূচক কন্ঠ নিয়ে বললেন,
‘কাকলি তুমি অনুর কথা কিছু মনে করো না। আসলে ওর সাথে যা হয়েছে তারপরে ও……..
হাফসা বেগমকে আর কিছু বলতে দিলেন না কাকলি সরকার।কাকলি সরকার অভিমানী কন্ঠে বললেন,
‘থাক হাফসা, বুঝতে পেরেছি আমি। আসলে এই সতেরো বছর ধরে তো আর কম কথা শুনিনি। রাস্তায় বের হলেই মানুষজন বলাবলি করে,ওই দেখো, ওনার হাজবেন্ট একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে।
এইসব কথা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি।’
কাকলি সরকার চুপ হয়ে গেলেন। হাফসা বেগম বুঝতে পারলেন তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কাকলি বেগমের সব কষ্ট যেন গলায় এসে আটকে গেছে। এক অদ্ভুত নিরবতা বিরাজ করল বাড়িটায়। কাকলি সরকার আবার বলতে শুরু করলেন,
‘হাফসা আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি এভাবে তোমার সাথে কথা বলতে চাইনি। আসলে হাফসা রাফাতকে অনেক পার্টিতে যেতে হয় যেখানে যেতে হলে অনেক স্মার্ট হতে হয়। কথায় কথায় ইংলিশ বলতে হয়। কিন্তু অনু তো এতটা স্মার্ট নয়। ওকে অনেক অপমানিত হতে হবে সেখানে। তাই আমি চাইছিলাম রাফাতের মতোই বিদেশে পড়াশোনা করা একটা মেয়ের সাথে রাফাতের বিয়ে দেবো। অনু কখনো আমাদের সাথে সুখী হতে পারবে না। যা হওয়ার হয়ে গেছে হাফসা, বিষয়টাকে আর বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই।’
হাফসা বেগম নিস্তব্দ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন আজকেই কাকলি সরকারকে বকে দেবেন যে অনু ডক্টর। কিন্তু রাফাতের পরিবারের চাহিদা অনেক। অনু ডক্টর হলেও বিদেশে পড়াশোনা করেনি যার কারনে কাকলি সরকার মেনে নিতে পারবেন না অনুকে। এখন হাফসা বেগমেরও মনে হয়ে লাগল যে অনু আর রাফাতের ডিভোর্স হয়ে গেলেই ভালো।
কাকলি সরকার তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন। অনুর চাচা চাচী এই বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে হাফসা বেগম সবটা খুলে বকেন তাদের। সবকিছু শুনে হতভম্বিত হয়ে যান তারা। আরশি আর রিয়াও উপস্থিত ছিল সেখানে। আরশি আর রিয়া যেন আকাশ থেকে পড়ল। হা করে তাকিয়ে আছে হাফসা বেগমের দিকে।
,,
,,
,,
,,
অনু কোনো দিকে না তাকিয়ে নির্বিকার ভাবে হেঁটে যাচ্ছে। পেছন থেকে অনুর বান্ধবীরা আর ভাই বোন অনবরত ডেকে যাচ্ছে কিন্তু সেসব কিছুই কানে ঢুকছে না অনুর। অনু রাগে থরথর করে কাঁপছে। অনুর জুতাটা একটু উচু হওয়ায় পা টা হঠাৎ মুড়িয়ে যায়। অনুর পায়ের কিছু অংশ ছিলে গেছে কিন্তু অনু সেইদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে এগিয়ে চলে তার বাড়ির দিকে।
অনুর শাড়ির কুচি হালকা নেমে গেছে। মাথায় বাধা গোলাপ আর গাদা ফুলের মিশ্রিত মালাটি নিচে পড়ে পড়াগড়ি খেতে লাগল। সবকিছু উপেক্ষা করে অনু হনহন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কিছুক্ষন পর অনুর ফ্রেন্ডরা আর ভাই বোন বাড়িতে ঢুকে গেল। বাড়িতে ঢুকেই অনুকে খুজতে লাগল তারা। নিচে কোথাও অনুকে খুজে না পেয়ে অনুর রুমের দিকে পা বাড়ালো সবাই।
রুমের ভেতর হুমড়ি খেয়ে ঢুকে পড়ল সবাই। রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে সবাই তাকিয়ে রইল অনুর দিকে। সবাই যেন আকাশ থেকে পড়ল অনুর কান্ড দেখে। রাসেল অবাক চক্ষুতে অনুকে জিজ্ঞাসা করল,
চলবে,