সাঝের বাতি পর্ব-০১

0
1756

সাঝের_বাতি
#Sajid_Hasan
#পর্ব_১

একের পর এক লাঠির আঘাতে রক্তিম লাল দাগ ফুটে উঠছে শরীরে।ব্যাথায় চিৎকার করছি আমি।ক্রমশ বেড়েই চলেছে সেই দাগ।দুচোখ দিয়ে অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।এ এমন বৃষ্টি থামার নাম নেই। আমার আর্তনাদে দোতলা বাড়ীটি দ্বিতীয়বার প্রতিশব্দ করে জানিয়ে সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইছে।ব্যাথা!ব্যাথা তো আমার বুকে হচ্ছে,রক্তক্ষরন হচ্ছে সেথায়।সে ব্যাথার কাছে শরীরের ব্যাথা তুচ্ছ।কখনই আশা করিনি নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার! তার জ্বলন্ত রাগ আমায় ভস্ম করে দিচ্ছে।ক্রমশ অবস হয়ে আসছে হাত পা।নড়ানোর শক্তিটুকুও হাড়িয়ে ফেলেছি।অনেক আকুতি মিনুতি করেও কোনো লাভ হয়নি।এত দিনের সমস্ত রাগ আজ মেটাবে সে।আমার ভালোবাসা তার কছে যে কোনো দাম নেই তা সে আজ হারে হারে টের পাইয়ে দিচ্ছে।এত ব্যাথার মাঝেও তার বিরবির করে বলা কথাটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম ,

-আরও করবি!খুব সখ না তোর ভালোবাসার।নে প্রান ভরে ভালোবাসা নে।

তার এসব কথায় বুকটা ছিরে যাচ্ছে।আর তার এই কথাগুলো আরও কয়েকগুণ ব্যাথাকে বাড়িয়ে তুলছে।এত আর্তনাত, এত চিৎকার কোনো কিছুই গলাতে পারছে না তার মন, থামছে না সে,ক্রমশ মোটা বেতের লাঠির আঘাত বেড়েই চলেছে।বন্ধ ঘরটায় আজই বোধহয় শেষ দিন আমার।এতটুকুও আলোর ছোয়া নেই দোতলার পশ্চিমের ঘরটায়।
মনে মনে এসব ভাবছি আর ব্যাথায় কোকাচ্ছি। আমার ভাবনায় বাধ ভেঙে দরজাটা বারবার কেউ সজরে ঠেলছে।দরজার ওপার থেকে একজন মধ্যবয়ষ্ক লোকের আওয়াজ ভেসে আসছে।তার আওয়াজে একটু স্তব্ধ হয় সিয়াম ভাইয়া।ঘেমে নেয়ে গেছে,সিলকি চুলগলো অগছালো হয়ে চারিদিকে ছরিয়ে পড়েছে।জোরা কান দুটো খারা করে শোনার চেষ্টা করে ভেসে আসা কথা গুলো।

-সিয়াম শুনতে পাচ্ছিস!দরজা খোল,কিরে?সিয়াম!

কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই আমার দিকে একপা এগিয়ে আসেন সিয়াম ভাইয়া। মোটা বেতের ডগা থুতনিতে লাগিয়ে আলতো উচুঁ করে মাথাটি।একটা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে ওঠে,

-আজকের পর আমার ধারের কাছেও আসার চেষ্টা করবি না।আর যদি আসিস এর থেকেও কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে তোর জন্য।তোকে হাজার বার বলেছি তোকে ভালোবাসি না আমি!আমারি ভুল! তোকে আগেই শাস্তি দেয়া উচিৎ ছিলো।যাই হোক..মাইন্ড ইট!

কথাটা বলেই মেঝেতে ছুরে মারে লাঠিটা। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছি আমি।একটু পর হালকা আলোর রশ্মি মুখে এসে পরতেই চোখ খুলি,সিয়াম ভাইয়া দরজা খুলেছে!দরজায় এতক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করা লোকটা আর কেউ নয় চাচ্চু অর্থাৎ সিয়াম ভাইয়ার বাবা।চাচ্চুর মখটা বিষন্ন। একপলক সিয়ামের দিকে তাকিয়ে একদৌরে দৌড়ে ঘরে ডোকে চাচ্চু।আমায় অবস্থা দেখে একপ্রকার অবাকের শীর্ষে পৌঁছে যান উনি।পুরো গায়ে রক্তিম লাল দাগ,ফুলে উঠেছে পুরো শরীর, কপালের কোনে রক্ত জমাট বেধে আছে,ঠোঁটের কোনে দিয়ে অঝোরে রক্ত পড়ছে।ঝাপসা আলোয় পুরো স্পষ্ট। আমার এমন অবস্থা দেখে আস্তে বিছানায় শুইয়ে দেয় চাচ্চু।তরিঘিরি ফোন দেয় ডাক্তারকে।খুব এমারজেন্সি বলে তারাতাড়ি আসতে বলে ফোন কেটে দেয়।
.
ঝড়ের গতিতে হেঁটে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দেয় সিয়াম।রাগে চোখমুখ লাল টকটকে হয়ে রয়েছে।বেলকনির রেলিং শক্ত হাতে খিচে ধরে সিয়াম।চুল বেঁয়ে নেমে আসছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা।রেলিংটাকে আরও খিচে ধরলো সিয়াম।যেনো রেলিং এর উপরই রাগ তার।এবার বেলকনিতে থাকা ছোট্ট টি টেবিলের চেয়ারে বসে পরে সিয়াম।

-কত সাহস!ওর সাহস কি করে হয় আমাকে ধাক্কা দেয়ার আর ওই কোল্ড কফি…ওহ্! ও কি জানে না আমার ঠান্ডায় ফোবিয়া আছে?জানে!..কিন্তু ইচ্ছে করেই আজ এটা করলো আমার সাথে।দুটো বছর ধরে সিয়ার ওই এক ঘ্যানঘ্যানানি,আমি আপনাকে ভালোবাসি সিয়াম ভাইয়া ‘ ভালোবাসি আপনাকে ‘ একটু বুঝুন,হাপিয়ে উঠেছি আমি!এত অপমান,কতোকগুলো থাপ্পড়! কোনো কিছুই কাজে লাগেনি।বেহায়া মেয়ে একটা।

রাগী কন্ঠে একপ্রকার চিৎকার করেই কথাটা বললো সিয়াম।হেলিয়ে দিলো নিজের পীট চেয়ারে।চোখ বুজতেই ঘুমে চোখ লেগে এলো তার।অতিদ্রুত গভীর ঘুমে অচ্ছন্ন হয়ে যায় সিয়াম।
.
-তোর খুব ব্যাথা করছে না সিয়া।আমি জানি রে মা,তুই অনেক ভালোবাসিস সিয়ামকে।কিন্তু কষ্ট একটাই তোর ভালোবাসার মর্যাদা সে কখনোই দিতে পারবেনা।সে হয়তো কখনোই তোর ভালোবাসার যোগ্য মানুষই নয়।দেখিস তোর জন্য এক রাজপুত্র আসবে।অনেক ভালোবাসবে তোকে।তুই চিন্তা করিস না,শাস্তি ও পাবে,সিয়ামকে তার যোগ্য শাস্তি আমি দিবো।নিজের সন্তান বলতেও লজ্জা করছে আমার।কতটা নিষ্টুর মনের মানুষ হলে এরকম টা করতে পারে।কুলাঙ্গার ছেলে একটা..ছি..!

– ন..না চাচ্চু,তুমি ভুল বুঝ..ছো সিয়াম ভাইয়াকে।আমারি তো ভু.ভুল….

-থাক! তোকে আর ওর হয়ে সাফাই গাইতে হবে না।কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার এসে যাবে।এরকম শরীর নিয়ে তোকে আর কথা বলতে হবে না

-সা.সাফাই নয় গো চা..চাচ্চু! এতে ভাইয়ার কোনো দোষ নেই।তুমি গিয়ে একবা..র তাকে দেখে এসো ওনার ওই ঠান্ডা..

-চুপ কর! তুই এখনো ওকে নিয়ে ভাবছিস?ও তোকে এতটা কষ্ট দিলো আর তুই?

আর কথা এগোলো না কিছুক্ষণ নিরবতা কটার পর দরজায় কেউ নক্ করলো। আলতো ঘার ঘুরে তাকাতেই একজন সুর্দশন যুবক চোখে পরলো।ব্লাক কালারের প্যান্ট,সাদা টি-শার্ট, ফুল সেভ করা সুর্দশন লোকটা কিছু বলার আগেই চাচ্চু তার দিকে এগিয়ে গেলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করেই বলে উঠলো-

-এসো আকাশ! আসলে অসময়ে ডাকার জন্য দুঃখিত।

এরপর চাচ্চু তাকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটানা বিস্তারিত বললো।তিনি আমায় অনেকক্ষন যাবত পরীক্ষা – নিকিক্ষা করে বললেন-

-আঙ্কেল সিয়াম কি পাগল হয়ে গিয়েছে?কি করে পারলো এরকম নিকৃষ্ট হতে?কিভাবে মেরেছে মেয়েটাকে।আমি কিছু ওষুধ ও কিছু জেল লিখে দিচ্ছি,ইমিডিয়েট সেগুলো আনিয়ে নেবেন।আর ওর দু তিন দিন টোটালি রেস্ট প্রয়োজন। একদম বিছানা থেকে ওঠা যাবে না।

কিহ্!দু..তিন দিন আমি তো এখানে এক মূহুর্ত থাকতে চাই না।আর সেখানে দু তিন দিন বিছানা থেকেই ওঠা যাবে না।আজ আমার কাছে তো সবটাই স্পষ্ট। এতদিন ভেবেছিলাম উনি হয়তো কোনো একদিন আমাকে বুঝবে। আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে নেবে।কিন্তু আজ সে আমার সমস্ত সপ্ন ভেঙে বুঝিয়ে দিয়েছে কতটা ঘৃণা আমার জন্য পুশে রেখেছেন তিনি,সামন্য ভালোবাসা জন্ম নেয়নি এতোদিনে।বৃথা চেষ্টা করে গেছি এতদিন।কিন্তু আর না,আর নয় বৃথা চেষ্টা।আমি আর এক মূহুর্ত আপনার জিবনে থাকতে চাই না।অনেক দুরে যেতে চাই আমি,যেখানে আর কোনোদিন আপনার সাথে দেখা হবে না।আপনি তো আমার জন্য অতিষ্ট! তবে আজ থেকে আর আপনাকে এই সিয়া অতিষ্ঠ করবে না। আপনার পেছন পেছন ঘুরবে না,বারবার বলবো না আপনাকে ভালোবাসি।যথাসম্ভব চেষ্টা করব এ বাড়িতে না আসার।
ভাবনার মাঝেই বুকের ভেতরে কেউ করাঘাত করছিলো।বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস।চারিদিকে একবার তাকালাম কেউ নেই।চাচ্চু আর ডাক্তারবাবুর বাইরে থেকে কথা বলার আওয়াজ আসছে।বুঝলাম তারা কি ব্যাপারে কথা বলছে।একটু পর চাচ্চু খাবার ও ঔষধ নিয়ে এলো।না চাইতেও খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিলাম কারন যত তারাতাড়ি সুস্থ হবো তত তারাতাড়ি চলে যেতে পারবো এখান থেকে।
.
ঘুমের ঘোরে কারো সজরে থাপ্পরে হকচকিয়ে উটলো সিয়াম।গালে হাত দিয়ে মাথা বেকিয়ে নিচু করে আছে সে।সামনে তাকানো আগেই আরো একটা থাপ্পড় দিলো ইবনান শেখ।

-আব্বু!আব্বু তুমি?..

-চুপ একদম চুপ!তুই আমায় একদম আব্বু বলবি না।যে ছেলের মধ্যে সামান্ন মনুষ্যত্ব নেই তাকে আমি আমার ছেলে বলেই মানি না।

-…………………. ”

-তোর লজ্জা করছে না ওইটুকু মেয়ের সাথে এতটা খারাপ আচরন করতে।কি দোষ করেছিলো ও?সামান্য কারনে মেয়েটাকে এভাবে মারলি?এতদিনে তো কম কষ্ট দিসনি মেয়েটাকে।কাউকে ভালোবাসা তো অন্যায় কিছু নয়।অথচ প্রতিবারই যখন মেয়েটা তোর কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে গেছে তুই তাকে তার বদৌলতে বুকভরা কষ্ট আর বেদনা দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিস।এমন একটাও তুই উদাহারন দিতে পারবি না যে তাকে কতকগুলো থাপ্পড় আর অপমান ছারা কিছু দিয়ে ফেরাসনি।তবুও মেয়েটা এক সপ্তাহ তোকে না দেখে থাকতে পারতো না,এত অপমান এত কষ্ট তার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ।…

-তুমি এতে আমার দোষ দেখছো?ও অপরাধ করেছে তাই আমি ওকে শাস্তি দিয়েছি।আচ্ছা ও কি জানতো না যে ঠান্ডায় আমার ফোবিয়া হয় আর আমায় ও ইচ্ছে করেই ধাক্কা দিয়েছে।সব ও আমার ওপর প্রতিশোধ নিয়েছে। সবটা ইচ্ছাকৃত করা ওর।এখানে আমার দোষ কোথায়?”

-ও কিছুই ইচ্ছে করে করেনি। আর তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস ঘটনাস্থলে আমিও ছিলাম।সবটা আমি নিজে দেখেছি।তুই ওকে মারার আগে একবার আমাদের মানসম্মান এর কথা ভেবে দেখলি না।কাল যখন সিয়ার মা আসবে তখন কি করে মুখ দেখাবো আমি?সিয়ার কষ্ট,সিয়ার ভালোবাসা তো তুই কোনোদিনই দেখিসনি আর আজও দেখবি না সেটাই স্বাভাবিক কিন্তু তুই আজ তোর পরিবারের কথাও ভাবিসনি।আমাদের মাথা হেট করে দিয়েছিস।ছিহ্!তোকে আমার ছেলে বলতে লজ্জা হচ্ছে।

কথাটা বলে হনহনিয়ে রুম ত্যাগ করলেন ইবনান শেখ।রাগ ও কষ্ট ঘিরে ধরলো সিয়ামকে।যে বাবা তার সাথে কোনোদিন রাগী কন্ঠে কথা বলেনি আজ সে বাবা তাকে মারলো এমনকি ছেলে বলতে লজ্জা করছে তার।সব দোষ ওই সিয়ার! আজ ওর জন্যই আব্বু আমার সাথে এরকম আচরন করলো। সিয়াকে এর জন্য শাস্তি পেতে হবে,আমার আব্বুকে ক্ষেপিয়ে ওই নিষ্চই তুলেছে।খুব,খুব শিগ্রয়ই শাস্তি পাবি তুই সিয়া!খুব শিগ্রয়ই।
.
রাত এগারোটা ছুই ছুই। ঘুম নেই চোখে একধ্যানে ভেবে চলেছি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো।মন ভেঙে গেছে আজ তবে আর আশা নেই সিয়াম ভাইয়ার প্রতি। জানি অনেক কষ্ট হবে আপনাকে ভুলতে হয়তো ভুলতেই পারবো না কোনোদিন তবে আর আপনার মুখোমুখি কোনো দিন হবো না।আমি যে এখনো ছোট সেটা আমিও জানি তবে ওতটাও তো ছোট নই সিয়াম ভাইয়া।আবারো এক দীর্ঘ নিশ্বাস বেড়িয়ে এলো। অনেক চেষ্টায় রাত দুটোর পর ঘুম এলো।জেগে থাকার ইচ্ছে নেই তাই স্বোদরে গ্রহন করে নিলাম ঘুমকে।বুজিয়ে দিলাম চোখদুটো। কিছুক্ষণ এর মধ্যেই গভীর ঘুমে অচ্ছন্ন হয়ে গেলাম।

_________________________________

গভীর ঘুমেই কারো অস্তিত্ব টের পাচ্ছি রুমে।অনেক কাছ থেকে কেউ দেখছে আমায়। তার শিতল শ্বাস আছরে পরছে মুখে।ঘনঘন শ্বাস নিয়ে কেউ এক ধ্যানে দেখছে আমায়।গভীর ঘুমে আচ্ছান্ন হওয়া চোখ খুলতে পাচ্ছি না।ধিরে ধিরে এগিয়ে আসছে আমার দিকে লোকটি।তার শ্বাস আরও ঘন হচ্ছে।তার নাক আমার নাকের সাথে স্পর্শ করার সাথেসাথে ঘুম ভেঙে যায় আমার।পিটপিট চোখে তাকাতেই অবাকের শীর্ষে পৌছে যাই।চিৎকার করার আগেই মুখ চেপে ধরে লোকটা। তার শিতল শ্বাস বুকের ভিতরে গিয়ে হৃদয়ে হানা দিচ্চে।তার চোখ দুটো লাল টকটকে।চেয়াল খিচে আছে তিনি।আমি কিছু বলার আগেই আস্তে আস্তে বললেন তিনি……….

#চলবে_??

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে