#সর্দি কন্যা
#রোকসানা রাহমান
#পর্ব (৯)
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম,
” আমার কিছু করার নেই, আম্মু। আমি আর মিথ্যা বয়ে বেড়াতে পারছি না। উষ্মা আমার পছন্দ নয়। আমি তো অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, তোমার ও কে পছন্দ হলো কী করে? আর কেউ না জানুক, তুমি তো আমার পছন্দ জানো? তোমার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ! ”
মা রাগ সামলাতে পারছেন না। মুখমণ্ডল মৃদু কাঁপছে ক্রমাগত। উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়ছেন ঘন ঘন। আমি সবটা অগ্রাহ্য করে বললাম,
” আমার যেমন পশ্চিমাদের মতো অর্ধ উলঙ্গ মেয়ে পছন্দ নয় তেমন বাঙালিয়ানাও না। আমার গুছানো, পরিপাটি, উপস্থিত বুদ্ধিসম্পন্ন মেয়ে পছন্দ। উষ্মার মধ্যে এসব কিছু নেই। গলায় সুর নেই, চালচলনে তাল নেই। তার মধ্যে সারা বছর সর্দি লেগেই থাকে। ”
এইটুকু বলেই আমি থামলাম। গা গুলিয়ে আসছে যেন! লম্বা দম টেনে আবার বললাম,
” সব থেকে বড় কথা উষ্মার মধ্যে আত্মসম্মান বোধ নেই। যখন-তখন পা চেপে ধরে। মাথা নিচু করে নিজের সম্মান বিলিয়ে দেয়। আম্মু, আমার বউ হবে আত্মসম্পন্না। সমাজে মাথা উঁচু করে চলবে। ”
আমার বুকের ভেতর বয়ে বেড়ানো কথাগুলো একদমে শেষ করেই আমি মায়ের দিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম তার রাগে থমথমে মুখটা মিইয়ে এসেছে। লজ্জিত চাহনি আমার পেছনে। আমি চট করে পেছনে তাকিয়েই চমকালাম। উষ্মা ছলছল চোখ জোড়া নামিয়ে ফেলল। মৃদু গলায় বলল,
” আমি আসছি, আন্টি। ”
মায়ের নীরবতা ভাঙল না। কেমন যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি নিজেই আগ বাড়িয়ে বললাম,
” চলো, আমি এগিয়ে দিচ্ছি। ”
উষ্মা সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“, আমি একা যেতে পারব। ”
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম উষ্মা আমার সঙ্গ চাচ্ছে না। এড়িয়ে যাওয়ার তুমুল ইচ্ছা। তবুও তার পিছু পিছু নিচে নামলাম। গেইট পার হয়ে পাকা রাস্তায় আসলাম। একটা দোকানের সামনে এসে বললাম,
” একটু দাঁড়াও। ”
উষ্মা থামল না। নিজের মতো হেঁটে চলল। আমি এক প্যাকেট টিস্যু কিনে দৌড়ে তার পাশাপাশি আসলাম। শীতল গলায় বললাম,
” আমি জানি, তুমি কষ্ট পাচ্ছ। কষ্ট পাওয়ারই কথা। কোনো মানুষই নিজের সম্পর্কে দোষ-ত্রুটি শুনতে পারে না, মানতে পারে না। কিন্তু উষ্মা, তোমার খারাপ লাগলেও আমার বলতো হচ্ছে, ওগুলো একটাও মিথ্যা ছিল না। সব সত্য। এই সত্যগুলো ঢাকতেই এতদিন আমাকে মিথ্যা বলতে হয়েছে। আশা করছি আর বলতে হবে না। ”
উষ্মা আমার কথা শুনল নাকি বুঝতে পারলাম না। ভালো-মন্দ কোনো অভিব্যক্তিই প্রকাশ পেল না। চুপচাপ সামনে হেঁটে চলেছে। আমার আর এগোতে ইচ্ছে হলো না। ওর ডানহাতে টিস্যু প্যাকেট দিয়ে বললাম,
” তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা। আল্লাহ তোমাকে কারও যোগ্য করে তুলুক। কারও চোখে সুন্দর করে তুলুক। কারও ভালোবাসার…..”
আমাকে কথা শেষ করতে দিল না উষ্মা। টিস্যু প্যাকেট চেপে ধরে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল। একবারটি পেছন ফিরল না। অথচ আমি চাচ্ছিলাম মেয়েটা একবার পেছন ঘুরুক। আমার যে ‘ সরি ‘ বলা হয়নি!
________
বর্ষার এক বৃষ্টিমুখর বিকালে চায়ের তেষ্টা পেল খুব। তনয়াকে ডেকে তেষ্টার কথা জানিয়ে কাজে মনোঃসংযোগ করছিলাম। ঠিক তখনই মৃদু হাঁচির শব্দ এলো কানে। আমি কেঁপে উঠলাম। টের পেলাম শরীরের শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল বেড়ে গেছে।
” স্যার, আপনার চা। ”
তনয়ার কণ্ঠস্বরে আমি তটস্থ হলাম। চায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে তার দিকে তাকালাম। মৃদু হেসে ধন্যবাদটুকু দিতে পারলাম না। বিরক্ত স্বরে ঝাড়ি দিয়ে বসলাম,
” অসুস্থ হলে অফিসে আসছ কেন? ”
তনয়া টিস্যু দিয়ে নাক মুছে বিনয়ীর সাথে জানাল,
” তেমন অসুস্থ না, স্যার। কাল যাওয়ার সময় হঠাৎ বৃষ্টির কবলে পড়েছিলাম। হালকা ভিজে যাওয়ায় একটু ঠাণ্ডার সমস্যা হয়েছে। ”
আমি চিৎকার করে বললাম,
” গেট আউট। আমি না চাইলে আমার চোখের সামনে আসবে না। আসলেই চাকটি নট করে দেব। ”
তনয়া ভয়ে কেঁপে উঠেছিল। কাঁপা চাহনি দিয়ে দ্রুত আমার কেবিন ত্যাগ করে। তারপরের সারাবিকেল কাটে আমার বিরক্ত ও খিটখিটে মেজাজে। কাজে মন বসেনি একটুও। বসের সঙ্গে মিটিংয়ের সময়টা পিছিয়ে নিয়েছিলাম অনুরোধ করে।
____________
রাতে বাসায় ফিরে হাত-মুখ ধুয়ে একটু অন্যমনস্ক সময় কাটালাম। বৃষ্টির ছাঁটে মুখ ভিজিয়ে শীত শীত ভাব টেনে আনলাম শরীরে। তন্মধ্যে মা খেতে ডাকলে জানালার কাচ টেনে দিলাম। খাবার টেবিলে পৌঁছে জিজ্ঞেস করলাম,
” আজ কী রেঁধেছ, আম্মু? ”
ফোনালাপে ব্যস্ত থাকায় মা উত্তর দিতে পারলেন না। আমার সামনে প্লেট উল্টে ভাত বেড়ে দিলেন। বাবার পাতে তরকারি দিচ্ছিলেন তখন বাবা জিজ্ঞেস করলেন,
” কার সাথে কথা বলছ? নাজু নাকি? ”
মা হাসি মুখে মাথা নাড়লে আমার সর্ব মনোযোগ গিয়ে পড়ল মায়ের দিকে। কী কথা বলছে তাই শোনার চেষ্টায় খাওয়া বন্ধ হলো। মা কথার ফাঁকে আমাকে বললেন,
” খাচ্ছিস না কেন? ”
আমি খানিক ছিটকে উঠলাম। অ-মাখা ভাব মুখে তুলে বললাম,
” খাচ্ছি তো। ”
এই সুযোগে আবার বললাম,
” নাজু আন্টিকে আমার সালাম দিও। ”
মা শুধু শুনলেন, সালামের কথা জানালেন না। অনেক্ষণ পর মোবাইল রেখে বাবার পাশে বসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” অনেক দিন পর কথা বললে নাকি? কেমন আছেন উনি? ”
” ভালো। ”
” আংকেল? উনি এখন কী করছেন? ”
” তেমন কিছু নয়। ”
” ওহ, আর উষ…”
উষ্মার নামটা উচ্চারণ হতে গিয়েও ঠোঁটে আটকে গেল। জড়তায় চেপে ধরল কণ্ঠস্বর। মা বোধ হয় খেয়াল করলেন না। বাবার দিকে মনোযোগী হয়ে পড়লেন। আমি চুপচাপ ভাত খেতে চাইলেও মস্তিষ্ক সচল হয়ে রইল। বার বার উষ্মার কথা মনে হতে লাগল। বাঁধা মনের খুব জানতে ইচ্ছে হলো মেয়েটা এখন কী করছে, কেমন আছে? বিয়ে করেছে কি? বাচ্চা-কাচ্চাও হয়েছে নিশ্চয়? মেয়ে হয়েছে নাকি ছেলে? নাম রেখেছে কী? আমার অজস্র গোপন প্রশ্নের মধ্যে মায়ের গলা পেলাম,
” দুই বছর পর মেয়েটা এ বাসায় আসছে অথচ থাকবে না। এটা কোনো কথা? ”
মায়ের কণ্ঠে চাপা অভিমান। বাবা খুশি করতে বললেন,
” যেতে দিও না তাহলেই তো হবে। ”
মা ক্ষোভ ভরে বললেন,
” পরীক্ষা না থাকলে দিতামই না! ”
আমি কৌতূহলী হয়ে পড়লাম। তাদের কথপোকথনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম,
” কিসের পরীক্ষা, আম্মু? ”
মা আগ্রহ নিয়ে বললেন,
” বিসিএসের। ”
আমি আশ্চর্য হয়ে উচ্চারণ করলাম,
” বিসিএস! ”
মায়ের আগ্রহ বেড়ে গেল। মুখ এগিয়ে এনে আহ্লাদিত হয়ে বললেন,
” হ্যাঁ। প্রিলিতে টিকে গেছে তো। এখন লিখিত দিবে। সেজন্যই তো ঢাকা আসবে। এতক্ষণে মনে হয় রওনা হয়েছে। ভোরের দিকে তোর বাবা আনতে যাবে। দুই-তিন ঘণ্টা এখানে বিশ্রাম নিয়ে তারপর কেন্দ্রে যাবে। ”
আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম,
” কাল পরীক্ষা তাহলে আজ রাতে বের হয়েছে কেন? এতে তো প্রেশার পড়বে। কয়েক দিন আগে আসলেই তো হতো। ”
” আমিও তাই বলেছিলাম, শুনেনি। ”
” কেন? ”
” তোর জন্য। ”
” আমি আবার কী করলাম? ”
মা চোয়াল শক্ত করে বললেন,
” একবার অপমান করে মন শান্তি হয়নি আবার করতে চাচ্ছিস? ”
আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মায়ের দিকে তাকালে তিনি নীরস গলায় বললেন,
” আত্মসম্মান নেই বলেই বাসায় আসতে রাজি হয়েছে। হোক কয়েক ঘণ্টার জন্য, আসছে তো! ”
আমার চাহনি করুণ হয়ে গেল। অনুতাপে, অনুশোচনায় হৃদয় ঝলসে যেতে শুরু হলো। মনে পড়ল, মেয়েটাকে সরি বলা হয়নি।
__________
রাতে আমার ঘুম হলো না। অস্থির চিত্তে এপাশ-ওপাশ করে অর্ধেক রাত কাটিয়ে দিলাম। বাকি সময়টা আর বিছানায় শুয়ে থাকার ধৈর্য, ইচ্ছে, রুচি কোনোটাই হলো না। ফোন হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সারাদিন বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ এখন মেঘমুক্ত। চাঁদ উঠেছে, তারাও। তাদের আলোয় রাতের অন্ধকার গাঢ় থেকে ঝাপসায় পরিণত হয়েছে। সে ঝাপসা অন্ধকারে মন উদাস হতেই কলিংবেলের শব্দ শুনলাম। আমি চমকে উচ্চারণ করলাম, ‘ উষ্মা! ‘
চলবে