#সর্দি কন্যা
#রোকসানা রাহমান
#পর্ব (৮)
উষ্মাকে দেখেই মা আত্মহারা হয়ে পড়লেন। বুকে টেনে আদুরে বুলি আওড়াচ্ছেন। আমি দুজনকে রেখে নিজের রুমের দিকে এগুলাম। গোসল করেই বেরিয়েছিলাম বলে হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। বিছানায় সবে বসেছি তখনই মা আর উষ্মার আগমন ঘটল। আমি জিজ্ঞেসা চাহনি রাখলে তিনি বললেন,
” উষ্মা গোসল করবে। ”
আমার ভ্রূজোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে এলো। বিরক্ত ভরা গলায় বললাম,
” তো আমি কী করব? আমাকে জানাচ্ছ কেন? ”
মা এগিয়ে এসে বললেন,
” তোর গোসলখানায় করবে তাই জানালাম। ”
আমি ফুঁসে উঠে বললাম,
” আমার গোসলখানা কেন? তোমারটা কী হয়েছে? ”
” ওটা তে তোর বাবা করছে। ”
” তাহলে অপেক্ষা করুক। ”
মা রেগে গেলেন। ধমকে বললেন,
” কেন অপেক্ষা করবে? কয়দিন পর তো এখানেই গোসল করবে। তাহলে আজ করলে সমস্যা কী? ”
আমাকে উত্তর দেওয়ার সময় দিল না মা। উষ্মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে টেনে নিয়ে আসলেন ভেতরে। গোসলখানায় ঠেলে দিয়ে আমাকে শুনিয়ে বললেন,
” তুই এখানেই গোসল করবি। যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ করবি। কেউ কিছু বললে আমায় ডাকবি। ”
মা আমার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন। তার শাসানির চাহনি ফেলে আমি বের হয়ে যাচ্ছিলাম। মা জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় যাচ্ছিস? ”
” মসজিদে। ”
” এখন? আযানই তো দেয়নি। ”
আমি পেছন না ঘুরেই চলতে চলতে বললাম,
” শুধু আযান দিলেই যে মসজিদে যেতে হবে এমন কোনো বাঁধা নিয়ম নেই, আম্মু। ”
____________
আমি জুমু’আর নামাজ শেষ করে আস্তে-ধীরে বাসার দিকে এগুলাম। গেইট পেরিয়ে সিঁড়ি বাইছিলাম। মাঝপথে দেখা হলো নিচতলার কাকিমার সাথে। পথরোধ করে জিজ্ঞেস করলেন,
” অরুণ, তোমাদের বাসায় কি মেহমান এসেছে? ”
আমি ভদ্রতাসূচক মাথা নেড়ে বললাম,
” জি। ”
” বাচ্চাগুলো খুব দুষ্টু নাকি? ”
বাচ্চার কথা শুনে একটু অবাক হলাম। পর মুহূর্তে বললাম,
” আমাদের বাসায় তো কোনো বাচ্চা আসেনি, কাকিমা। ”
কাকিমা আমার থেকেও বেশি অবাক হলেন। বললেন,
” তাহলে এমন ধুপধাপ শব্দ করছে কে? মনে হচ্ছে, এখনই মাথায় ছাদ ভেঙে পড়বে! ”
আমি কাকিমাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত সিঁড়ি কাটলাম। মা দরজা খুলে দিতেই বললাম,
” উষ্মা কোথায়? ”
মা কিছু একটা বললেন বোধ হয় কিন্তু আমার কর্ণগহ্বরে পৌঁছাল না। তার আগেই আমি আমার রুমে ছুটে এলাম। সোজা গোসলখানার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছিটকানি ভেতর থেকে টানা। আমি দরজায় মৃদু আঘাত করে ডাকলাম,
” উষ্মা? ”
উষ্মা উত্তর দিল না। আমি পানি ঝরার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। দরজায় আড়ি পাততে গানের গলা ও ধুপধাপ লাফানোর শব্দও পেলাম। নিমিষেই আমার মেজাজ পাল্টে গেল। খানিকটা শক্ত গলায় বললাম,
” উষ্মা বের হও। জলদি। ”
উষ্মা বের হলো না। আমাকে শুনলই না। নিজের মতো ধুপধাপ শব্দ তুলে খালি গলায় গান গেয়ে চলছে। আমি দরজায় জোরে জোরে থাপ্পড় মেরে চেঁচিয়ে বললাম,
” বের হবে নাকি দরজা ভেঙে ফেলব? ”
ভেতরের পানি পড়ার শব্দ হলো। দরজা একটুখানি ফাঁক করে বলল,
” আমার তো গোসল শেষ হয়নি! ”
” শেষ হয়নি মানে কী? দুই ঘণ্টা ধরে গোসল করছ তাও শেষ হয়নি? শরীরে কি গোবর মাখা? ”
উষ্মা দরজা আটকে দিল। আমি আবারও থাপ্পড়ের ঝড় তুললে সে খুলে দিল। বেরিয়ে এসে বলল,
” অনেকদিন ধরে বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি, তাই আজ ভিজছিলাম। ”
আমি দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম,
” এখন কি বৃষ্টি হচ্ছে যে ভিজছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কোথায়? ”
উষ্মা আবার গোসলখানায় ঢুকল। ঝরণার বাঁট ঘুরিয়ে বলল,
” এই তো বৃষ্টি। ”
আমি বাইরে থেকে বললাম,
” ওটা বৃষ্টি না ঝরণা। ”
উষ্মা বাঁট ঘুরিয়ে ঝরণা বন্ধ করে বলল,
” হ্যাঁ, জানি। ওটা ঝরণা। ”
” তাহলে বৃষ্টি বলছ কেন? তুমি কি সত্যিই পাগল? ”
উষ্মা গরম চোখে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
” বৃষ্টির মতো ছড়িয়ে টুপটাপ ছন্দ করে পানি পড়ে। তাই বৃষ্টি বলেছি। ”
কথাটা বলেই উষ্মা রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এদিকে আমার নিজের চুল ছেঁড়া দশা হলো!
_________
দুইদিন হতে চলল উষ্মার ফিরে যাওয়ার কোনো ভাবভঙ্গি নেই। আমার চোখের সামনে পড়লেই বলতে ইচ্ছে হয়, ‘ এই মেয়ে এখনও যাচ্ছ না কেন? ‘ ভদ্র হওয়ার কারণে বলা হয়ে উঠে না। এমনই এক বিরাগী সন্ধ্যায় মা নাস্তা দিতে এলেন রুমে। টেবিলে নাস্তা রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
” কিছু বলবে, আম্মু? ”
মা আমার পাশে বসে পড়লেন। স্নেহভরা চোখে চাইলেন। আদুরে হাত রাখলেন চুলে। আমি সন্দেহভরা গলায় সুধালাম,
” কী হয়েছে, আম্মু? ”
মা আনন্দিত গলায় বললেন,
” উষ্মা রাজি হয়ে গেছে। ”
” কোন ব্যাপারে? ”
” তোদের বিয়ের ব্যাপারে। আমাকে বলল, বিয়েতে তার আর আপত্তি নেই। আমরা চাইলে যেকোনো দিন বিয়ের তারিখ ঠিক করতে পারি। ”
আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন অসম্ভব কিছু ঘটে গেছে, কল্পনাতীত, ভাবনাতীত! বাকশূন্য হয়ে বসে থাকলাম অনেক্ষণ। মা আমার কাঁধ ঝাকিয়ে বললেন,
” নাজুদের এখানে ডেকে আনি, কী বলিস? ”
আমি আচমকা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালাম। সটাং দাঁড়িয়ে কাঠ স্বরে বললাম,
” না। কাউকে ডাকতে হবে না। ”
” কেন? ”
মায়ের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললাম,
” উষ্মা কোথায়? ”
” বসার রুমে। তোর বাবার সাথে নাস্তা খাচ্ছে আর গল্প করছে। ”
” ও কে পাঠিয়ে দেও। ”
মা আর কিছু বললেন না। উষ্মাকে পাঠিয়ে দিলেন। সে দরজার কাছ থেকে সুধাল,
” আসব? ”
আমি অনুমতি না দিয়ে ওর কাছে ছুটে গেলাম। একহাত ধরে টেনে ভেতরে এনে বললাম,
” তুমি মাকে কী বলেছ? ”
সে সরল গলায় জানতে চাইল,
” কী বলেছি? ”
আমি ধৈর্য ধরে বললাম,
” বিয়ের তারিখ ঠিক করতে বলেছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কেন? ”
” ব্যালেন্সিংয়ের জন্য। ”
” কিসের ব্যালেন্সিং? ”
উষ্মা আমার বিছানায় বসল। রয়ে-সয়ে বলল,
” আন্টি তো বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে আছেন। আপনার আর আমার জন্য হচ্ছে না। তিনি যেমন আপনাকে চাপ দিচ্ছেন তেমন আমাকেও। এখন দুই দিক থেকেই যদি বার বার ব্যর্থ হয়ে পড়েন তখন ধৈর্য্য হারাবেন, রেগে যাবেন। তখন যদি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে? বেঁধেধরে বিয়ের পিড়িতে বসিয়ে দেয়? তাই তাকে খুশি করার জন্য বলেছি, আমি রাজি। এখন আপনি না করে দিবেন, তাহলে আবার অখুশি হবেন। খুশি-অখুশিতে কাটাকাটি। হলো তো ব্যালেন্সিং? ”
আমি বুঝলাম কী বুঝলাম না তার ধার ধারল না সে। চট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
___________
ভয়ংকর ঘটনাটা ঘটল উষ্মার বিদায় নেওয়ার দিন সকালে। পুরো এক সপ্তাহ বেড়ানোর পর তার হঠাৎ করে মা-বাবার কথা মনে পড়েছে। মাও তাদের জন্য শুকনো খাবার, রান্না খাবারসহ নানা ধরনের কেনাকাটা করে প্যাকেটের পর প্যাকেট সাজাচ্ছেন। আমি অফিসের জন্য বের হব তখনই মা পিছু ডাকলেন। আমি থামলে বললেন,
” তোকে না বললাম আজ ছুটি নিতে? ”
” কেন? ”
” ভুলে গেলি? উষ্মাকে দিয়ে আসার কথা ছিল না? ”
আমি জুতোয় ফিতে বাঁধতে বাঁধতে বললাম,
” আমি কেন দিয়ে আসব? ও একাই যেতে পারবে। ”
” না, পারবে না। তুই দিয়ে আসবি। ”
” আশ্চর্য তো! আসার সময় তো একাই আসছে। তাহলে এখন একা যেতে কী সমস্যা? ”
” অনেক সমস্যা। মানুষ কী বলবে? যে মেয়ে দুইদিন পর এ বাড়ির বউ হবে, সে কেন একা একা চলাফেরা করবে? ”
” দুই দিন পর ও বউ হয়ে যাবে? ”
” হ্যাঁ, হবে। তুই শুধু হ্যাঁ বলে দেখ। ”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
” তুমি আবার বিয়ে নিয়ে পড়লে? ”
” তো পড়ব না? যেটা হবেই সেটা এত পেছনে টানার কী আছে? আর এখন তো উষ্মা রাজিই। তাহলে তুই কেন হচ্ছিস না? সমস্যা কী তোর? ”
আমি নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালাম। ভূত-ভবিষ্যৎ ভুলে বলে ফেললাম,
” কোনোদিনই হবে না। ”
মা বিস্ফারিত চোখে বললেন,
” কী বলছিস এসব! ”
” হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। ঐ মেয়েকে আমার বউ হিসেবে কল্পনা করলেই আমার শরীর রি রি করে ওঠে। আমার পছন্দের একদম শেষ তালিকাতেও নেই। তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি বলে সরাসরি না করতে পারিনি। ”
মা চিৎকার করে বললেন,
” অরুণ! রাগাবি না বলছি। ”
আমি ঠাণ্ডা গলায় বললাম,
” আমার কিছু করার নেই, আম্মু। আমি আর মিথ্যা বয়ে বেড়াতে পারছি না। উষ্মা আমার পছন্দ নয়। আমি তো অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে, তোমার ও কে পছন্দ হলো কী করে? আর কেউ না জানুক, তুমি তো আমার পছন্দ জানো? তোমার সিদ্ধান্তে আমি হতাশ! ”
চলবে