সম্পর্ক পর্ব-০২

0
1111

#সম্পর্ক
#Tasfiya Nur
#পর্বঃ২

ফজরের নামায পরে ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ভোরের আলো ফুটতে দেখছে মহুয়া হাতে ধোয়া উঠা কফি।আজ দিনটায় কোনোরকম কাজ আছে বলে মনে হয়না তার পুরো দিনটা আজ মেয়ের সাথে কাটাবে বলে ঠিক করে মহুয়া কতগুলো দিন হলো তার মেয়ের সাথে সময় কাটানো হয়না ঠিকঠাক।কফি খাচ্ছে আর আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছে মহুয়া ঢাকা শহরের ব্যস্ততায় আর বিল্ডিং এ ঠাসা পরিবেশটায় ভোরের স্নিগ্ধতা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার যেই দিকে তাকানো হোক শুধু ব্যস্ততা।গ্রামের পরিবেশটা বড্ড মিস করছে মহুয়া।গ্রামের কথা মাথাতে আসতেই বড় করে শ্বাস নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে যাওয়ার আগে বেডে শুয়ে থাকা ঘুমনৃত মেয়ের কপালে চুমু একে যায় সে।মেয়ের জন্য তার প্রিয় খাবার পায়েস বানাবে নিজ হাতে।রান্নাঘরে গিয়ে দেখে মিসেস শিরিন আগে থেকেই সকালের নাস্তা বানানো শুরু করেছেন হয়তো সে কফি বানিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরই।তাই মহুয়া ফুফুকে জিগাসা করে,
তুমি এত সকাল সকাল রান্নাঘরে কেন আসছো আজ তো আমার কাজ নেই তাহলে?
নামাজ পরে ঘুম আসছিলো না প্রতিদিনের অভ্যাস জানিসই তো।মুচকি হেসে মিসেস শিরিন উত্তর দেন।
আচ্ছা তুমি সাইড হও আজ আমি ব্রেকফাস্ট বানাই তুমি তিথিয়াকে তুলে দাও এখন থেকে ওকে অভ্যাস শুরু করাতে হবে নামাজ শিখাতে হবে জানোতো ছোটো থেকে ছেটো রা যা শিখে তাই তাদের আদর্শ হয় ছোটোরা যা দেখবে তাই শিখবে তাই আমি চাই তিথিয়া এখন থেকেই ভালো হয়ে বেড়ে উঠুক কোনো মন্দের প্রভাব ওর উপর না পড়ুক। মৃদু হেসে মিসেস শিরিনকে কথাগুলো বললো মহুয়া।মিসেস শিরিন একপলকে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর মনে মনে ভাবছে আল্লাহ সহায় হও এই মেয়ের এবার একটু সুখের পরশ দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
মিসেস শিরিনকে নিরুত্তর দেখে মহুয়া তাকে ধরে ঝাকিয়ে জিগাসা করে,
কি হলো ফুফু কি ভাবছো।মহুয়ার ডাকে ভাবনায় ছেদ ঘটে মিসেস শিরিনের, হতাশ চোখে তাকিয়ে বলেন,
আমায় মা তো বলে ডাকতে পারিস না কি মহু এই সন্তানহীন মায়ের কোলটা ভরে দে তোকে মেয়ে ভেবে নিয়ে সামলে আসলাম মা ডাকটা শুনার অধিকার কি হয়নি আমার।
মিসেস শিরিনের কথা শুনে চোখ ভরে পানি এসে যায় মহুয়ার এই মানুষটা এত কেন ভালোবাসে তাকে,নিজের মায়ের কথা মনে যাচ্ছে মহুয়ার।তার মাও তো তাকে ভালোবাসতো তাহলে আজ কেন পাশে পেলোনা। কান্না করে জড়িয়ে ধরে মিসেস শিরিনকে এতদিনের জমা আর্তনাদ যেন আজ বুক ফেটে বেড়িয়ে আসছে।
মা ও মা বলোনা কি ভুল করেছিলাম আমি যে আল্লাহ এত বড় শাস্তি দিলো ভুল করেছিলাম মানলাম তার এত বড় শাস্তি আমি সংসারহীন মেয়েটা বাবার আদর থেকে দূরে রইলো এত যন্ত্রণা কেন।
মিসেস শিরিন মহুয়াকে বুকে আগলে নিজেও কেদে দেন এই মেয়েটা এত কষ্ট চেপে রেখেছিলো নিজের মাঝে কাদুক কাদলে মনটা হালকা হবে মনে মনে ভেবে আরও শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেয় মা ডাকটা এতদিনে শুনতে পেলো সে মনটায় শান্তি বয়ে যাচ্ছে সত্যি মা ডাকটায় এত শান্তি।
এই তোমরা দুজন কাদছো কেন বলোতো।পিছন থেকে বলে ওঠে তিথিয়া,মেয়ের গলা শুনে ফুফুকে ছেড়ে দূরে দাড়ায় চোখ মুছে নেয় তাড়াহুরা করে মিসেস শিরিন ও পিছন ফিরে চোখ মুছে নেয়।তারপর হাসি হাসি মুখ করে এগিয়ে যান তিথিয়ার দিকে মহুয়া পাথর বনে দাড়িয়ে আছে রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে।মিসেস শিরিন তিথিয়ার সামনে হাটু মুড়ে বসে বলেন,এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলে যে নানুমনি ঘুম হয়েছে তো ঠিকঠাক।
হুম হয়েছে তো কিন্তু ওয়াশরুমে যেতে হলো তাই উঠে গেছি মাম্মাম কে ঘরে পেলাম আর চিকেন থুক্কু কিচেন থেকে কান্নার সাউন্ড পেয়ে এদিকে আসলাম তো বলোতো কান্না কেন করছিলে তোমরা। ভ্রু কুচকে কোমড়ে হাত দিয়ে প্রশ্নটা করে তিথিয়া।
মেয়ের কথার ধরণ দেখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মহুয়া মেয়েটা পুরো বাবার কার্বন কপি এই ছয় বছর বয়সে কত ম্যাচিউরিটি মেয়েটা বোধহয় মায়ের সমস্যা বুঝতে শিখে গেছে। কথাটা ভেবে আনমনে হেসে উঠে মহুয়া তারপর এগিয়ে যায় মিসের শিরিন আর তিথিয়ার দিকে দুজন কথা বলতে ব্যস্ত মিসেস শিরিন ব্যস্ত কান্না কেন করছিলো তার জবাবদিহি করতে।তবুও যেন তার মেয়ে মানতে নারাজ।
ফুফুর সামনে থেকে মেয়েকে টেনে কোলে নেয় সে।তারপর দুগালে দুটো চুমু খেয়ে বলে, মাম্মাম সোনা তোমার নানাভাইয়ের কথা মনে পরছিলো তোমার নানিমনির তাই কান্না করছিলাম মিস করি তো খুব তাই।
যেমন আমি বাবাকে মিস করি তাইনা মাম্মাম স্কুলের সবার বাবা আসে আমার বাবা আসেনা।মেয়ের কথায় অবাক হয়ে যায় মহুয়া আর মিসেস শিরিন কোনো রকম নিজেকে সামলে মহুয়া বলে
কে বলেছে আমার মাম্মাম সোনার বাবা নেই আছে তো নানাভাইয়ের মতো বিদেশে আছে,এখন ভালো মেয়ের মতো যাও ফ্রেশ হও মাম্মাম তোমার প্রিয় পায়েস রান্না করছি আজ।
ওহহ লাভ ইউ মাম্মাম আচ্ছা আমি ছুটে ফ্রেশ হয়ে আসছি। গ্রানী তুমিও চলো আমার সাথে আমি একা তো পারিনা ফ্রেশ হতে জানোতো।
আচ্ছা আসছি চল বুড়ি একটা পাকা পাকা কথা শুধু।মহুয়া হেসে দেয় মেয়ের এত খুশিতে।তাদের কথার মাঝেই কলিংবেলটা বেজে উঠলো। মিসেস শিরিন আর মহুয়া মুখ চাওয়াচাওয়ি করে এত সকালে কে আসতে পারে আটটাই বাজলো না।মহুয়া বললো,
তুমি ওকে ফ্রেশ করাও ফুফু আমি দেখছি।
আচ্ছা বলে তিথিয়াকে নিয়ে চলে যায় মিসেস শিরিন।মহুয়া এত সকালে কে আসতে পারে ভাবতে ভাবতে পায়েসের জন্য দুধ চুলায় দিয়ে পা বাড়া দরজার দিকে।দরজাটা খুলে অবাক হয়ে যায় মহুয়া।এত সকালে রাহাত দাড়িয়ে আছে তার সামনে চোখ দুটো ফোলাফোলা সারারাত মনে হয় ঘুমোয়নি মাথার চুল গুলো উষ্কখুষ্ক। কোনো রকম চোখে মুখে পানি দিয়ে ছুটে এসেছে বোঝায় যাচ্ছে।
একি রাহাত তুমি এতসকালে।অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মহুয়া।
হুম আমি কি ভিতরে আসতে বলবেনা।মৃদু স্বরে কথাটা বলে রাহাত।
ওহ হ্যা আসো ভিতরে আসো। কথাটা বলে দরজা থেকে সরে দাড়ায় মহুয়া।
রাহাত ভিতরে ঢুকে হাতে একটা বড় শপিং ব্যাগ আরেক হাতে এমনি একটা ব্যাগ ভিতরে কি আছে জানা নেই মহুয়ার।ভিতরে ঢুকে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে জিগাসা করে তিথিয়া কোথায় মহুয়া।

ছেলের ঘরের দরজা ঠেলে রুমে ঢুকেন মিসেস মিলি চৌধুরী। পুরো ঘরে সিগারেটের প্যাক আর মহুয়ার শাড়ি কাপড় ছড়ানো ছিটানো।এসব দেখে চোখে পানি এসে যায় মিসেস মিলির।
সাগর বিছানায় এলেমেলো হয়ে মহুয়ার শাড়ি জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে।এতই যখন ভালোবাসতি ভুল কেন বুঝেছিলি সাগর কেন অন্যের কথায় বিশ্বাস করেছিলি অবশ্য দোষ তোর একার না আমাদের ছিলো যে মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে পারিনি। বিরবির করে কথাগুলো বলে ছেলের দিকে এগিয়ে যান তিনি অফিসের মিটিং আছে ছেলেকে তুলে দিতে বলেছেন তার স্বামী মিঃ রিশাদ চৌধুরী।
মায়ের ডাকে চোখ খুলে তাকায় সাগর।মাথা ধরে উঠে বসে বিছানায়। সাগরের মা ছেলের কাছে গিয়ে বসে বলেন,
এভাবে আর কতদিন সাগর এবার তো নিজের কথা ভাব আমাদের কথা ভাব বয়স বারছে দিন দিন কমছে না।
মায়ের কথায় ছোটোবাচ্চাদের মতো জড়িয়ে ধরে কেদে দেয় সাগর।
কেন চলে গেলো মা আমি না হয় ভালোবাসিনি সে তো বেসেছিলো একবার কি পারত না নিজেকে ভালো প্রমাণ করে থেকে যেতে তার স্মৃতি আমার কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে মা।
ছেলের কথায় কোনো জবাব খুজে পান না মিসেস মিলি শুধু বলেন তোর বাবা মিটিং এর জন্য রেডি হতে বললো।কথাটা শেষ করে নিঃশব্দে বেড়িয়ে যান তিনি।সাতর মায়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পা বাড়ায় ওয়াশরুমের দিকে।কাজের ভিতর থাকলে হয়তো তার কিছুটা শান্তি মিলবে এই আশায় কাজে ডুবে থাকে সাগর।

পুরো ড্রয়িং রুম জুড়ে রাহাতের সাথে দৌড়ে খেলছে তিথিয়া।রান্নাঘরের এককোণায় দাড়িয়ে এই মধুর দৃশ্য দেখছে মহুয়া।আফসোস রাহাতের জায়গায় সাগর থাকলে হয়তো এতটাই খুশি থাকতো তিথিয়া।কেন তিনজনের ছোট্ট পরিবারটা কি সুখে থাকা যেতনা।আজ দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত কিছুই আসেনা যেন।তিথিয়ার জন্য কাপড় আর চকলেটের বক্স এনেছে রাহাত। মিসেস শিরিন পাশের ফ্লোরের এক আন্টি এসেছে তার সাথে কথা বলছে তার জন্য কফি নাস্তা নিয়ে পা বাড়ায় মহুয়া মিসেস শিরিনের রুমে।
আর কতদিন এভাবে ভাতিজীকে বসিয়ে রাখবেন এবার তো তাকে বিয়ে দিন শুনুন আমার হাতে একটা পাত্র আছে বয়সটা হয়তো একটু বেশি কিন্তু মহুয়া ডিভোর্সি হিসেবে আর এক বাচ্চা সহ হয়তো ঠিকঠাক আছে।আর শুনুন যুবতী মেয়ে কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই। আবার আজ জানলাম একজন ছেলের সাথে নাকি মেলামেশা তার বাসাতেও এসেছে দেখলাম,নিজের সব কি তাকে দিয়েই মিটায় যে বিয়ে করছেনা। মিসেস শিরিন প্রতিবেশীর কথা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে শুধু মাত্র ডিভোর্সি আর এক বাচ্চার মা বলে আমার মেয়েটার এমন কথাও শুনতে হবে হায়রে আমাদের সমাজ কবে পাল্টাবে হয়তো বেচে থাকতে তা আর হবেনা।মনে মনে ভাবছেন মিসেস শিরিন। দরজার সামনে থমকে দাড়িয়ে আছে মহুয়া ধীর পায়ে আন্টির সামনে গিয়ে নাস্তা সোফার সামনের ছোটো টেবিলটায় রেখে বলে,আন্টি অন্যের চরিত্রের দিকে আঙুল তুললে বাকি তিনটা আঙুল নিজের দিকেই থাকে শুনেছি যে মানুষ যেমন সে অন্যকেও তেমন ভাবে মানুষ যদি ভালো হয় তাহলে সে তার মতোয় দুনিয়ার বাকি সবাইকে সহজ সরল ভাবে কারো দিকে আঙুল তোলার কথা ভাবনাতেও আনেনা আর খারাপ হলে সে পারে তার সাথে থাকা আশপাশের মানুষের দিকে আঙুল তুলতে তার মতো করে ভাবে সবাইকে তাহলে কি আমি এটা ভাববো আন্টি আমার চরিত্রে আঙুল তুলে আপনার চরিত্র কি আমাদের সামনে প্রকাশ করলেন?রাস্তায় বেরুলে চোখে পরে আপনার মেয়ে কলেজ যাওয়ার পথে একটা ছেলের বাইকে ঘুরে তারমানে সেও কি আপনার ভাষ্যমতে আমার মতোয় পরপুরুষ নিয়ে নিজের চাহিদা মিটায় আমি সরি আন্টি কিন্তু কথাটা বলতে হলো আপনি আমার গুরুজন আমাকে নিম্ন মানপর স্নেহ যদি করতেন আমি আমার সবটা দিয়ে আপনাকে সম্মান দিতাম। কথাগুলো শেষ করে মুচকি হাসে মহুয়া।
কথাটা বলতেই প্রতিবেশী আন্টি মুখটা চুপসে গেলো তিনি কোনোরকম তাড়াহুরা করে কফিটা শেষ করে চলে যেতে নিলেন মহুয়ার দিকে তাকিয়ে বলে গেলেন আমায় মাফ করে দিও মা আমি তোমায় বুঝতে ভুল করেছি।
দরজায় দাড়িয়ে সব দেখছিলো রাহাত মহিলাটি চলে গেলে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবে তোমার এই শান্ত প্রতিবাদ টার জন্যই এতটা ভালোবাসি তোমায় কবে বুঝবে তুমি।এসবের মাঝেই তিথিয়া তার মায়ের ফোন নিয়ে ছুটে এসে বলে মাম্মাম তোমার কল এসেছে। এই অসময়ে কে কল করবে তার ফোনে তো রাহাত কল দেয় বেশি কিন্তু সে তো এখানেই ভাবতেই ফোনটা হাতে নিয়ে নাম্বার দেখে অবাক মহুয়া হঠাৎ এই মানুষটা ফোন দিলো কিন্তু কেন?

চলবে?

(আসসালামু আলাইকুম, রিচেক করিনি ভুলগুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে