সম্পর্ক পর্ব-০১

0
3950

#সম্পর্ক
পর্ব-০১
সাদমান হাসিব সাদ

আমি জাকিয়া জেরিন অবনী, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, কিন্তু আব্বা ইদানীং আমার বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে।
আমি এতো করে বলছি আব্বা আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা, আগে অনার্সটা কমপ্লিট করি।
কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমাকে বিয়ে দিবে এটাই মনে হয় আব্বার পণ।

গত দুইমাসে ছয়বার সেজেগুজে আমাকে ছেলে পক্ষের সামনে যেতে হয়েছে, সবাই আমাকে পছন্দ করলেও আব্বা ছেলে পক্ষকে পছন্দ করেনি মূল কারণ হচ্ছে যৌতুক দাবি, আব্বার কথা হলো মেয়েকে এতো বড় করছি লেখাপড়া শিখাইছি, তারপর আবার যৌতুক দেবো সেটা কখনো না।

আজ আমাকে সপ্তম ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে, শুনেছি ছেলে অনেক ধনী, সেজেগুজে ছেলে পক্ষের সামনে বসে আছি, ছেলের মা আমাকে দেখে পছন্দ করছে ছেলের ভাই ভাবীও পছন্দ করছে, ছেলে দেখি আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।
আমি রুমে চলে এলাম বড় আপুকে বললাম আমি ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
আপু ঠিক আছে বলে চলে গেলো কিছুক্ষণ পর এসে বলল, ছেলের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলি ছাঁদে যা।
আমি ছাঁদে যেয়ে দেখি ছেলে ও তার ভাবী দাঁড়িয়ে আছে, বললাম ভাবী আপনি নিচে যান আমি আপনার দেবরের সাথে একা কথা বলতে চাই।
ভাবী চলে যেতে পা বাড়াতেই ছেলে মনে হয় ভয়ে কেমন হয়ে যাচ্ছে।
আমি বললাম ভয় পাচ্ছেন কেন, আমি কি আপনাকে মেরে ফেলবো, আপনি কি মেয়ে মানুষের সাথে কখনো কথা বলেননি।

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
অবাক হয়ে গেলাম বলে কি, সে না কি কোন মেয়ের সাথে কথা বলেনি।

,, আপনার নাম কি, আর করেন কি।

,, আমার নাম হিসাম আহম্মেদ, আমি কিছু করিনা।

,, কিছু করেন না মানে, এতো বড় ছেলে মায়ের আঁচলের নিচে বসে থাকেন।

,, না মানে আমিতো অসুস্থ, তাই আম্মু আমাকে অফিসে যেতে দেয়না, কোনকিছুর সাইন করতে হলে বাসাতে ফাইল নিয়ে আসে আমি সাইন করে দেই।

,,আপনি অসুস্থ, কিন্তু আপনাকে দেখে তো ভালো মনে হচ্ছে।

,, আমি মানুষকে খুব ভয় পাই, কারো সাথে ঠিকঠাক কথা বলতে পারিনা, আম্মু বলে আমি মানসিক ভাবে অসুস্থ, ডাক্তারও তাই বলে আমার মানসিক সমস্যা আছে, তাই সবসময় আমাকে মেডিসিন খেতে হয়।

হিসামের সাথে কথা বলে আমার মনে হয়নি হিসাম মানসিক রুগী, কি নিস্পাপ শিশু সুলভ চেহারা, চোখের চাহনি মন পাগল করার মত, আমি বিয়েতে রাজী ছিলাম না কিন্ত হিসামকে দেখে তার প্রেমে পড়ে গেছি, আব্বুও বিয়েতে মত দিয়ে দিছে। তাদের কোন কিছু দাবী দাওয়া ছিলো না, হিসামের আম্মুর কথা, আমরা মনের মত বউ পেয়েছি আর কিছু চাইনা, অবনী আমার নিজের মেয়ের মত থাকবে, আমি চাই অবনী আমাকে তার মা মনে করে আমার সব কথা শুনবে।
আব্বা হিসামের মায়ের কথায় খুব খুশী হয়েছে আব্বা যেমন ঘরে আমাকে বিয়ে দিবে ভাবছিল তেমন ঘর পেয়ে বেজায় খুশী।

বিয়েটা হয়েই গেল, আমি কখন থেকে ফুলশয্যায় বসে আছি হিসাম আসছে না, ভাবী হিসামকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে বলে গেল, এই নাও তোমার লজ্জাবতী স্বামীকে সে না কি রুমে আসতে ভয় পাচ্ছে।
ভাবী চলে যাবার পর আমি হিসামের কাছে গিয়ে বললাম,

,, আমি আপনার বউ, আমাকে ভয় পাচ্ছেন কেন, আজ থেকে আমি আপনি এক সাথে ঘুমাবো সারাজীবন এক সাথে থাকবো।

,, একসাথে না ঘুমালে হয়না, আমি না হয় সোফায় ঘুমাবো।

আমি তাকে হাত ধরে টান মেরে খাটে এনে বসালাম সে যেন কেমন ভয় পেয়ে গেল, আর কিছু বলল না অবুঝ ছেলের মত শুয়ে পড়ল আর কিছুক্ষনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল।

এই রাতটির জন্য হাজারো মেয়ে বুকে স্বপ্ন বেধে অপেক্ষা করে, আমিও করেছি, ভাবিনি আমার স্বপ্নে আমার বর এভাবে পানি ঢেলে দিবে, মনের দুঃখ মনে চাপা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি হিসাম আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে, তার মুখের ভাবখানা বাচ্চাদের মত করে রাখছে, রাতে অবশ্য একটু রাগ হয়েছিল, এখন সমস্ত রাগ উধাও হয়ে গেছে হিসামের মুখের দিকে চেয়ে।

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে হিসামকে ডাক দিলাম, সে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেলো, কাজের মেয়ে এসে বলল, ভাবি খালাম্মা আপনাকে নাস্তা করতে নিচে যেতে বলছে, আর এই যে ভাইয়ার নাস্তা তাকে বইলেন খাইতে।
কাজের মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি ডাইনিং এ নাস্তা করতে যাবো আর হিসাম রুমে একা নাস্তা করবে এটা কেমন কথা।

,, আমি কি করে বলব কেমন কথা, এই বাসায় কাজে আসছি অনেকদিন, সবসময় দেখি ভাইয়ার খাবার রুমে পাঠিয়ে দেন খালাম্মা, আমি খালাম্মাকে বলেছিলাম, ভাইয়া কেন ডাইনিং টেবিলে এসে খায় না, খালাম্মা বলছে ভাইয়া অসুস্থ।

,, আচ্ছা তোমার কি মনে হয় হিসাম মানসিক রুগী, তুমি তো অনেকদিন ধরে এই বাসায় আছো কখনো কি দেখেছ হিসাম পাগলামি করছে কাউকে মারধর করছে বা কোনকিছু ভাংচুর করছে।

,, না ভাবি কখনো এমন করছে দেখিনি, ভাইয়া খুব শান্ত কিন্তু মাঝেমাঝে অনেক ভয় পায়, কাউকে দেখলেও ভয়ে চুপসে যায়।

,, কেন ভয় পায় তুমি কি সেই ব্যাপারে কিছু জানো।

,, না ভাবি আমি কিছু জানিনা, খালাম্মা বলছে ডাক্তার না কি বলছে ভাইয়ার মাথায় সমস্যা আছে, তাই এমন করে।

কাজের মেয়ে চলে যেতে, আমি ভাবতে থাকি হিসাম কেন ভয় পায়, যদি সে মানসিক সমস্যায় ভুগতো তাহলে এত শান্ত স্বাভাবিক আচরণ করতে পারত না, কেমন যেন রহস্য মনে হচ্ছে সব।

হিসাম ওয়াশরুম থেকে বের হলে বললাম চল নিচে যাই নাস্তা করতে। আমার কথায় হিসাম ভয় পেয়ে গেল, সে বলল, আমি নিচে যাবো না তুমি যাও আমি এখানেই খাবো, অনেক জোর করার পরও হিসাম রুম থেকে বের হলো না আমি যত জোর করি সে তত ভয় পায়।

নাস্তার টেবিলে শাশুড়ী মাকে জিজ্ঞেস করলাম হিসাম কেন এমন আচরণ করে। শাশুড়ী মা বললেন সে জন্মের পর থেকেই এমন, তাকে মেডিসিন খাইয়ে রাখি সবসময়, না হলে বেশি পাগলামি করে।

সকাল দুপুর রাতে তিনবার করে হিসামকে মেডিসিন খাওয়াতে হয়, আমার শাশুড়ী নিজ হাতে মেডিসিন খাইয়ে দেয়।
বিয়ের পর আজ আমি বাবার বাসায় যাচ্ছি, হিসাম যেতে চাচ্ছেনা, অনেক বুঝিয়ে রাজি করেছি।
যাবার সময় শাশুড়ী বারবার সাবধান করে দিলো হিসামকে যেন একা না ছাড়ি, তাকে যেন চোখেচোখে রাখি আর মেডিসিন গুলো যেন ঠিকমতো খাওয়াই।
শাশুড়ীকে কথা দিলাম আপনি চিন্তা করবেন না আপনার ছেলের কিছু হবেনা, আপনি যা বলছেন তাই করব।

আমাদের বাসায় যাবার পর হিসামকে নিয়ে সবাই একসঙ্গে খাবার খেলাম, সে স্বাভাবিক ভাবেই খাবার খাইলো, আমার মনে অনেকগুলো প্রশ্ন এসে ভীড় করছে, এখানে যদি সে সবার সাথে বসে খাবার খেতে পারে, তাহলে তার বাসায় কেন পারেনা, সেখানে কেন পাগলামি করে।

আমি ভাবনায় মগ্ন হিসাম বিছানায় শুয়ে আমার মোবাইল নিয়ে টিপাটিপি করছে, আমি হিসামের দিকে তাকাতেই সে বলল, আমি তোমার মোবাইলে ছবি দেখতে চেয়েছিলাম কিন্তু ছবি বের করতে পারলাম না,তোমার ফোন ধরেছি বলে আমাকে মারবে তুমি, দেখো আমি ফোন নষ্ট করিনি, প্লিজ রাগ কর না।

আমি তো একদম অবাক, হিসামের চোখে মুখে এতো ভয় দেখে, আর সে কেন ভাবছে আমি তাকে মারব।
আমি তার কাছে গিয়ে হাতটা ধরে বললাম, কেন ভয় পাচ্ছো আমার ফোন মানেই তোমার ফোন আমার সব জিনিসে তোমার অধিকার আছে।
আচ্ছা তোমার কি মোবাইল ফোন নেই।

,, না, জানো আমার না খুব শখ ছিলো মোবাইল ফোনের আম্মুকে বলেছিলাম, তোমাদের সবার মোবাইল আছে আমাকে একটা মোবাইল কিনে দাও গেইম খেলবো, আম্মু কিনে দেয়নি, বলে তুই একটা পাগল তোকে মোবাইল কিনে দিয়ে কি করব, বিশ্বাস কর আমি পাগল না।

,, আমি জানি আমার বরটা পাগল না, শুনো আজ থেকে আমার মোবাইল তোমাকে দিয়ে দিলাম তুমি গেইম খেলবে, গান শুনবে, ভিডিও দেখবে।

,, সত্যি আমাকে দিয়ে দিলে মোবাইল, জানো একবার ভাইয়ার ফোন নিয়ে গেইম খেলতে চেয়েছি ভাইয়া আমাকে অনেক মারছে, বলছে আর কখনো যেন তোর এতো সাহস না দেখি।

আমি যত হিসামের কথা শুনছি ততই রহস্যের অতল গহীনে ডুবে যাচ্ছি।

চলবে,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে